ধারাবাহিক – প্রতি শনিবার ।
২২তম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
বাঁশপাতি
(Green
bee eater)
২৩তম পর্ব শুরু ……
শীতকালে
খুব তাড়াতাড়ি বেলা পড়ে আসে। অবেলায়
খেয়ে উঠে ঘুমানো আমার একটুও পছন্দ নয়। তাই,দুপুরে ভাত খাওয়ার পর আমরা কত্তা-গিন্নি একটু এদিক ওদিক
পায়চারি করে বেড়াই।
আর সঙ্গে থাকে ক্যামেরাটা। যদি কোনও
পাখি-টাখি দেখতে পাই তাহলে সুযোগ বুঝে তাদের ফ্রেমবন্দি
করতে পারবো।
সেদিন দুপুর শেষে আমরা কত্তা-গিন্নি দুজনে গল্প করতে করতে হাঁটছি,আমাদের চলার পথের
বাঁদিকে কচুরিপানা সমৃদ্ধ একটা বিল আছে,তার চারপাশে আরও অন্যান্য
জলজ উদ্ভিদের সঙ্গে ছাড়া ছাড়া কিছু ঢোল-কলমি গাছের সরু সরু ডালগুলো
মাথা চাড়া দিয়ে উঠে আছে।
ওই ডালেতেই বাঁশপাতিরা বসে-ওড়ে,সঙ্গী-সঙ্গিনীর সাথে মনের সুখে
ঘর বাঁধার স্বপ্নও দেখে হয়তো।
তা সে যাইহোক,আমরা হেঁটে যেতে গিয়ে দেখি একটা বাঁশপাতি পাখি মুখে একটা ফড়িং ধরে নিয়ে সঙ্গী বা সঙ্গিনীর সঙ্গে ভাগ করে খাবার মতলবে গাছের ডালে সবে বসতে যাবে,আমিও গদগদ দু-একটা শর্ট নিতে গেলাম। কিন্তু ছবি তুলছি বুঝতে পেরে পাখিটা চট করে পিছন ঘুরে গেল। তারপর অনেকবার চেষ্টা করেছি ফড়িং মুখে নিয়ে পাখিটার অন্ততঃ একটা ভালো ছবি তুলতে। অপেক্ষাও করলাম অনেকদিন। কিন্তু একবারও ভালো হলো না ছবিগুলো। শেষে কিনা বাধ্য হয়েই আমাদেরই এক পাখি বন্ধুর কাছথেকে ফড়িং মুখে বাঁশপাতি,আর তাদের ধুলো স্নানের ছবিটা ধার করতে হলো! বাঁশপাতিগুলো আমার সঙ্গে শয়তানি করেছে। আমি যতবার ওদের এমন ছবি তুলতে চেষ্টা করেছি ততবারই মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে,নয়তো ধুলো উড়িয়ে দিয়ে চলে গিয়েছে যাতে ছবি না তুলতে পারি!
যাঁরা পাখির ছবি তোলেন বা পাখি চেনেন তাঁদের কাছে "বাঁশপাতি" খুব
পছন্দের পাখি। ওর উজ্জ্বল ঝলমলে রঙ বেশ
নজরকাড়া। লম্বায় অনেকটা চড়ুই পাখির সমান। আর গায়ের রঙ… আহাঃ,দেখে মনে হয় যেন মিষ্টি সবুজ রঙের ভেলভেটে মোড়া। মাথা ও গলা বাদামী রঙের।
অবিশ্রাম বসে ওড়ে। অর্থাৎ অস্থিরতা এদের আরেকটা বৈশিষ্ট্য!
এমনই একদিন ছবি তুলতে বেরিয়ে
রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে জলার ধারে এদের ডাক শুনে ঘুরে অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখেছিলাম
অপূর্ব সুন্দর আর অত্যন্ত চঞ্চল পাখিটাকে। সেই প্রথম
অনেক চেষ্টায় তার দু-একটা ছবি তুলতে পেরেছিলাম। তখন ক্যামেরায়
সবে সবে হাতেখড়ি হয়েছে।
কাক,বক,শালিক,চিল ছাড়া তেমন কোনও পাখি চোখে পড়ে না। ছবি তোলার পর পাখির বই খুঁজে খুঁজে
ছবির সঙ্গে মিলিয়ে বারবার তার নাম জানার চেষ্টা করেছি। তারপর হঠাৎ
করেই একদিন জানলাম পাখিটার নাম “বাঁশপাতি”।
কত ঘটনা কতরকম ভাবে নিত্যই ঘটে চলে। অনেক বছর আগের কথা। আমার কত্তামশাইয়ের
কলেজের এক বন্ধু তার বাড়ি যাওয়ার জন্যে অনেকবার নিমন্ত্রণ করেছেন। সেইসময় আমার “কোডাক ক্রোমা” রিল ক্যামেরা ছিল। ছবি তুলতে
ভালোবাসি শুনে সেই বন্ধু আমাকে বলেছিল বৌঠান,একবার আমাদের
গ্রামে এসো,মনের খুশিতে সারাদিন ছবি তুলতে পারবে। সারা গ্রাম
ঘুরিয়ে দেখাবো তোমাদের”। শুধু মানুষের
ছবি তুলে কি হবে! প্রাকৃতিক দৃশ্য,ফুল-পাখি,গাছ-পালার ছবি তোলা শুরু করো,
তুলতে তুলতে নেশা হয়ে গেলে তখন দেখবে অন্য ভালোলাগা তৈরি হয়ে যাবে। আর গ্রামের
ছবির দৃশ্য খুব ভালো হয়।
তারপর কেটেও গিয়েছে বহু বছর! সময়ের নিরিখে বিচ্ছিন্ন হয়েছে তার
সঙ্গে যোগাযোগ।
কিন্তু ডিজিটাল ক্যামেরা হাতে পাওয়ার
পর পাখির ছবি তোলার শখটা পূরণ করার জন্যে তার বাড়ি যাবো ভেবেছিলাম। তার কোনও ফোন নম্বরও ছিল না আমাদের
কাছে। ল্যান্ডফোন
তো কবেই উঠে গিয়েছে! প্রযুক্তির
উন্নতিতে দুনিয়া হাতের মুঠোয় এসে
গেলেও তার ফোন নম্বর হারিয়ে গিয়েছিল।
শুধু তার বাড়ির ঠিকানাটা মনেছিল। বর্ধমানের
বাগিলা ষ্টেশনে নেমে ক্যানেল পেরিয়ে শশীনাড়া গ্রামে তার বাড়ি। সেখানে
তাদের পুকুর মড়াই সবজি-বাগান সবই আছে। আছে ঘরে ঘরে তাঁতী আর তাঁতবোনার
যন্ত্র। আছে
তাঁত সমবায়। কিন্তু
দুঃখের বিষয় আজ যাবো কাল যাবো মনে করেও তার বাড়ি কখনও যাওয়া হয়ে ওঠেনি! এখানে তার কথা বলার উদ্দেশ্য
হলো,এই পাখি আর প্রকৃতির ছবি তোলার উৎসাহটা তার কাছ থেকেই পেয়ে
ছিলাম।
একবার বর্ধমান লোকালে উঠেছিলাম কোথাও
থেকে ফেরার সময়।
হঠাৎই তার সঙ্গে দেখা হলো। কত্তামশাই
তার পাশে বসা সহযাত্রী মানুষটিকে চিনতে পেরে নাম ধরে ডেকে উঠলেন। সেও চিনতে
পেরে অবাক হলো।
কথা আর থামেই না। গল্পে গল্পে
সে জানলো আমি পাখির ছবি তুলি। আর
সে এটাও জানালো যে অনেক রকমের পাখি আসে ওদের ওখানে। আমার কত্তামশাই
সঙ্গে সঙ্গে বললো গ্যালারি থেকে তোমার তোলা পাখির ছবিগুলো দেখাও ওকে। ছবি দেখতে
দেখতে একটা পাখি দেখে সে বলে উঠলো এটা তো বাঁশপাতি!
আমি
বললাম আপনি ঠিক জানেন এটা বাঁশপাতি পাখি! সে বললো
একশোভাগ সঠিক জানি তোমার তোলা ছবিটা বাঁশপাতি পাখির। আমাদের গ্রামে ঝুলন্ত তারে,বাঁশগাছের সরু ডালে দল বেঁধে ওরা গায়ে গায়ে ঘেঁষাঘেঁষি করে বসে থাকে। অবশেষে
যার ছবি তুলেছিলাম,তার নামের সঙ্গে আমি পরিচিত হলাম। এখন অহরহ
বাঁশপাতিকে
দেখতে পাই। এখনও পর্যন্ত বাঁশপাতির
অনেক ছবি তুলেছি কিন্তু সাধ মেটেনি। পাখিটাকে
দেখলে আর হাতে ক্যামেরা থাকলে দু-একটা ছবি না তুলে
থাকতে পারিনা।
পাখি পরিচিতি:
বাংলা নাম- সবুজ বাঁশপাতি।
ইংরেজি নামঃ Green Bee-eater.
বৈজ্ঞানিক নামঃ Merops Orientalis (মেরোপস ওরিয়েন্টালিস)
অঞ্চলভেদে গ্রামে-গঞ্জের
লোকেরা কোথাও সুঁইচোরা আবার কোথাওবা নরুণ চোরা পাখিও বলে এদের। পাখি গবেষকদের মতে, এরা মেরোপিদি
গোত্রের অন্তর্ভুক্ত।
কচি
বাঁশপাতার
মতো গায়ের রঙ তাই এদের বাঁশপাতি পাখি বলা হয়। বাঁশপাতির
গড়ন বেশ ছিপছিপে। গায়ের
রঙ উজ্জ্বল সবুজ। বাঁকানো
কালো ঠোঁট। চোখের
দু-পাশে কাজল রেখা গিয়ে ঘাড়ের সঙ্গে মিশেছে। গলার নীচে
নেকলেসের মতো কালো একটা কালো দাগ আছে। মাথা এবং পিঠের
ওপরের অংশ সোনালী। ডানার
নীচে উজ্জ্বল তামাটে রঙ ওড়ার সময় চোখে পড়ে। পায়ের রঙ কালচে। স্ত্রী এবং
পুরুষ পাখি একইরকম দেখতে। সবুজ বাঁশপাতির লেজের মাঝ বরাবর দুটি পালক দুই ইঞ্চি পরিমাণ বর্ধিত হয়ে শেষ
পর্যন্ত পিনের আকার নিয়েছে। লেজের শেষাংশ সূঁচের আগার মতো তাই গ্রামের দিকে এদের সুঁইচোরা বলে ডাকে। উজ্জ্বল সবুজ রং আর বর্ধিত লেজের কারণে খুব সহজেই এদের চিনতে পারা যায়। আমাদের
দেশেই বেশ কয়েক রকমের বাঁশপাতি দেখা যায়…যাদের শরীরের বা পালকের সবুজ রঙের সঙ্গে অন্য রঙের
মিশ্রনে,গলা বুক অথবা
লেজের রঙের সঙ্গে মানানসই নাম দেওয়া হয়েছে। সবুজ বাঁশপাতি, পিঙ্গলমাথা বাঁশপাতি,নীললেজ বাঁশপাতি ইত্যাদি। আবার দেশ কাল জলবায়ু ভেদে একই প্রজাতির পাখিদের
শরীরের রঙের তারতম্য ঘটেছে।
বাঁশপাতি পতঙ্গভূক। মাছিও এদের খুব পছন্দের খাদ্য। এদের পতঙ্গ শিকার করার কৌশলটাও
বেশ চমকপ্রদ। একজায়গায় স্থির হয়ে এক সেকেন্ডের একভাগ সময়ও
বসে না। তার মধ্যে থেকেই ফড়িং,মাছি বা পোকা দেখতে পেলেই উড়ে
উড়েই খপাৎ করে ধরে নিয়ে ঝাঁকুনি দিয়ে সেটাকে গিলে ফেলে। পুকুর বিল ঝিলের ধারে উঁচু
হয়ে থাকে শুকনো সরু ডালে,কঞ্চিতে বা ঢোলকলমির ডালে ঘুরপাক খেতে খেতে
এসে বসেই আবার উড়তে থাকে। ওদের ওড়াটাও দেখার মতো!এরা দলবদ্ধভাবে বাস করে। মাঠবাদা বা জলার ধারে ইলেকট্রিক
ওভারহেডের তারের উপর একসঙ্গে সারি দিয়ে গায়ে গা লাগিয়ে দলবেঁধে বসে থাকে ওরা। সে দৃশ্য ভারী সুন্দর। দুদিকের পালক ছড়িয়ে আর সরু
লেজ নিয়ে যখন ওড়ে আর বসে সে দৃশ্যও খুব সুন্দর।
শীতের শেষে অর্থাৎ মার্চ থেকে জুন এদের প্রজনন
মরশুম। এমনিতেই এদের রঙ উজ্জ্বল,প্রজনন মরশুমে পুরুষ পাখির
উজ্জ্বলতা আরও বেড়ে যায়। বাঁশপাতি গাছে বাসা বাঁধতে পারে না। সাধারনতঃ নদীর পাড়ে বা জলের
ধারের খাড়া জায়গায় (যেখানে জল ঢুকবে না) এরা বাসা বানায়। মাটিতে সুড়ঙ্গের মতো গর্ত
করে পাঁচ-সাতটা ডিম পাড়ে। ডিমের রঙ ধবধবে সাদা। স্ত্রী-পুরুষ দুজনে মিলে ডিমে তা দেয়
এবং ডিম ফুটতে সময় লাগে তিন থেকে সাড়ে তিন সপ্তাহ।
উড়ে গিয়ে ফড়িং ধরে নিয়ে এসে খেলেও এদের সব থেকে
প্রিয় খাবার হলো মৌমাছি। তাই এরা বী-ইটার (bee eater) নামে পরিচিত। তবে পোকা-মাকড় ধরে খেলেও এরা খুব ছোট্ট
ছোট্ট মাছ ধরে নিয়েও খায়। বিশেষ করে বর্ষাকালে পুকুর
ভেসে গিয়ে চাষের জমিতে যখন অল্প অল্প জলের সঙ্গে মাছের চারা এসে ঢুকে পড়ে তখন এরা দলবেঁধে
মাছ শিকার করে খায়।
কখনও কখনও বিকেলের দিকে বাঁশপাতি পাখিদের ধুলোর মধ্যে গড়াগড়ি দিয়ে ধুলো মাখতে
দেখা যায়। একা নয় দলবেঁধে ওরা ধুলোস্নান করে। বাঁশপাতি পাখির ধুলো স্নান
দেখতে ভীষণ ভালো লাগে এবং তা দারুণ উপভোগ্য। ওরা কেন ধুলো উড়িয়ে তাতে গড়াগড়ি
খায়,সবাই সবাইকে ধুলো মাখায় তা আমার জানা নেই। তবে অনেক বার দেখেছি প্রথমে
দু-একজন এসে মনের আনন্দে পাখনা মেলিয়ে দিয়ে ধুলো মাখে,সেই
দেখে আবার দুচার জন এসে ধুলোয় নামে আর গড়াগড়ি খায়। তখন সবাই মিলে অন্যজনকে ধুলো
মাখতে থাকে। দেখতে খুব মজা লাগে। আগে যারা এসে ধুলো ওড়াচ্ছিল
তাদের কেউ কেউ উড়ে চলে যায়,তো আরও কয়েকজন এসে নেমে পড়ে। সেখানে হঠাৎ কেউ এসে পড়লে
দল বেঁধে তারা উড়ে যায় আর উড়ে যাবার সময় ধুলো উড়িয়ে দিয়ে যায়। পক্ষীবিশেষজ্ঞরা হয়তো বলতে
পারেন বাঁশপাতির ধুলোস্নানের কারণ। তবে কারণ যাইহোক,ধুলোমাখা বাঁশপাতি দেখতে দারুণ।
সমাপ্ত
ক্রমশ ……
২৪তম পর্ব পড়ুন আগামী শনিবার ।
লেখিকার অন্যান্য লেখা পড়তে এখানে ক্লিক করুন ।
বিঃদ্রঃ – ছবি এবং ভি ডি ও লেখিকার নিজের তোলা ।
লেখিকার জীবনের সঙ্গে গল্প অঙ্গাঙ্গিকভাবে জড়িয়ে আছে। যা দেখেন, যা শোনেন, যা শোনেন, যা কিছু স্মৃতির পাতায় জড়িয়ে আছে মনের সাথে,তাই নিয়ে লিখতেই বেশি পছন্দ করেন।
লেখা শুরু স্কুল-ম্যাগাজিন, কলেজ -ম্যাগাজিন দিয়ে। বর্তমানে কিছু লেখা প্রকাশিত হচ্ছে কয়েকটি মাসিক-ত্রৈমাসিক পত্রিকায়। বর্তমানে বার্ড’স ফটোগ্রাফী এবং “পাখি-প্রকৃতি” নিয়ে লেখা শুরু করেছেন।