লেখকের অন্যান্য লেখা পড়তে এখানে ক্লিক করুন ।
জীবনের সমালোচনাকে সাহিত্য বলা হয় । সমসাময়িক
জীবনের অর্থনীতি , রাজনীতি , ধর্মনীতি , সমাজনীতি ইত্যাদি সাহিত্য -
ভাবনায় ছায়াপাত করে , তার প্রভাবে অনুরঞ্জিত হয় সাহিত্যের আকৃতি ও প্রকৃতি ।
সাহিত্যের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে শিশুসাহিত্য ।
শিশুসাহিত্য বলতে বোঝায় ছোটদের উপযোগী লেখা , সাধারণত যার সঙ্গে বিভিন্ন রকম
ছবি আঁকা থাকে । শিশুসাহিত্যকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা যায় , যেমন ছবির বই , প্রচলিত কাহিনী , কল্পকাহিনী, রূপকথা , নীতিমূলক গল্প ইত্যাদি । অবশ্য
শিশুদের উপযোগী কবিতা , ছড়া , গীতিকাব্য ইত্যাদিও শিশুসাহিত্যের পর্যায়ে পড়ে ।
শিশুসাহিত্যের ইতিহাস অনেক পুরনো, 'ঈশপের গল্প ' এবং ' পঞ্চতন্ত্র ' সেই ইতিহাসেরই অঙ্গ । মহামতি গৌতম বুদ্ধের জীবন ও উপদেশের
অপূর্ব সব কাহিনী নিয়ে রচিত ‘ জাতক কাহিনী ' - ও এই পর্যায়ে পড়ে । প্রাচীনকালে মুখে মুখে ছোটদের
গল্প বলার প্রচলন ছিল । পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই , যেমন - ভারত , পারস্য ( ইরান ) , গ্রিস , চীন , আয়ারল্যান্ড ইত্যাদি।
বাংলা শিশুসাহিত্যের উন্মেষলগ্নে রয়েছে ।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরে ( ১৮২০-১৮৯১ ) বোধোদয়’, ‘ বর্ণপরিচয় ' এবং ' কথামালা ' , অক্ষয়কুমার দত্তের ( ১৮২০-১৮৮৬
) “ চারুপাঠ', মদনমোহন তর্কালঙ্কারের (
১৮১৭-১৮৫৮ ) “ শিশুশিক্ষা
ইত্যাদি । কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ( ১৮৬১-১৯৪১ ) হাত দিয়েই বাংলা
শিশুসাহিত্য একটা শক্ত ভিতের উপর দাঁড়াতে সক্ষম হয় । কেননা , তার আগে ছোটদের জন্য যা লেখা হত
, তার উদ্দেশ্য ছিল শিক্ষাদান ।
নীতিশিক্ষা যার একটা অঙ্গ । বাংলা শিশুসাহিত্যে রবীন্দ্রনাথই প্রথম লিখতে শুরু
করলেন শিশু তথা ছোটদের ভাল লাগার দিকে লক্ষ রেখে । অন্য যারা এই রকম ভাল লাগার
লেখা লিখতে শুরু করলেন তাদের মধ্যে রয়েছেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী ( ১৮৬৩-১৯১৫
) , সুকুমার রায় (
১৮৮৭-১১২৩ ) , দক্ষিণারঞ্জন মিত্রমজুমদার ( ১৮৭৭-১৯৫৭ ) , অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ( ১৮৭১-১৯৫১
) প্রমুখ । পরবর্তীকালে এই ধারায় আরও যারা সংযোজিত হলেন , তাদের মধ্যে রয়েছেন লীলা
মজুমদার , সত্যজিৎ রায়
, মুহম্মদ মনসুরউদ্দিন , প্রেমেন্দ্র মিত্র , আশাপূর্ণাদেবী , নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় , শিবরাম চক্রবর্তী , খান মোঃ মঈনুদ্দীন , সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় , শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় , সমরেশ মজুমদার , বুদ্ধদেব গুহ , আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ , প্রমুখ । ধীরে ধীরে গড়ে উঠল
বাংলা শিশুসাহিত্যের বিশাল ভাণ্ডার । বর্তমানেও উক্ত ধারা বহমান রয়েছে ।
আমাদের আলোচ্য বিষয় বালো শিশুসাহিত্যে দক্ষিণারঞ্জন মিত্ৰমজুমদার । সেজন্য আমাদের আলোচনা আলোচ্য বিষয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখার চেষ্টা করব । বাংলা প্রচলিত কাহিনী তথা লোকাহিনী , বিশেষ করে রূপকথার সংগ্রহে ও গবেষণায় বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে যিনি বিশেষভাবে আলোচিত , তিনি হলেন দক্ষিণারঞ্জন মিত্রমজুমদার । তার সহজ সরল ভাষা তথা ব্যতিক্রমী উপস্থাপনার কারণে আপামর বাঙালির কাছে বাংলা রূপকথা তথা শিশুসাহিত্য এবং দক্ষিণারঞ্জন মিত্রমজুমদার সমার্থক হয়ে উঠেছে ।
বাংলাদেশের রাজধানী শহর ঢাকার সন্নিকটবর্তী সাভার থানার তথা উপজেলার কর্ণপাড়া তথা উলাইল গ্রামের বিখ্যাত 'মিত্রমজুমদার বংশে ১৮৭৭ সালের ১৫ এপ্রিল ( ২ বৈশাখ , ১২৮৪ বঙ্গাব্দ ) দক্ষিণারঞ্জন জন্মগ্রহণ করেন । তার পিতার নাম রমদারঞ্জন মিত্ৰমজুমদার এবং মাতার নাম কুসুমময়ী । ২০০৬ সালে সাভার কলেজে অনুষ্ঠিত 'দক্ষিণারঞ্জন মিত্ৰমজুমদার লোক উৎসব' উপলক্ষে প্রকাশিত, গবেষক কালীপ্রসন্ন দাস সম্পাদিত ' দক্ষিণারঞ্জনের শিকড়ের সন্ধানে ' গ্রন্থে উল্লেখিত হয়েছে ' দক্ষিণারঞ্জনের পিতা রমদারঞ্জনই কর্ণপাড়ার বাড়িতে মিত্ৰমজুমদার বংশের প্রথম অধিবাসী । রমদারঞ্জন ছিলেন ঐতিহ্যবাহী বংশের সম্ভ্রান্ত পারিবারিক ঐতিহ্যের ধারক । মিত্ৰমজুমদার বংশের নামডাক ছিল । সাভারে বসতি স্থাপনের পূর্বে এঁরা সম্ভবত মানিকগঞ্জের সিংগাইর উপজেলার ধন্ন ইউনিয়নের উলাইন মৌজার অধিবাসী ছিলেন । রমদারঞ্জন সপরিবারে সাভারের কর্ণপাড়া মৌজায় অভিবাসিত হলে তার সঙ্গে তার বংশমর্যাদা , আভিজাত্য ও ঐতিহ্যও কর্ণপাড়ায় বিস্তৃত হয় । এই অঞ্চলের মানুষ তাকে ‘ উলাইনের মজুমদার হিসেবে গ্রহণ করে । কর্ণপাড়ায় তার বসতবাড়ি ‘ উলাইনের মজুমদার বাড়ি ' হিসেবে খ্যাতি লাভ করে । এই নাম ক্রমে লোকমুখে ব্যাপকভাবে প্রচলিত হয় এবং কালক্রমে কর্ণপাড়া মৌজার পূর্বাংশ উলাইল নামে পরিচিত হয় । এটা স্পষ্ট যে , দক্ষিণারঞ্জনের পিতা প্রভাব খাটিয়ে এই রূপান্তর ঘটাননি । তবে সাধারণ মানুষের উপর মিত্ৰমজুমদার বংশের ঐতিহ্যের প্রভাব ছিল অপরিসীম । একটি পরিবারের অভিবাসনকে কেন্দ্র করে সাধারণ মানুষের মুখে মুখে একটি স্থানের নামের পরিবর্তন সহজ কথা নয় । ”
বাল্যকাল থেকেই দক্ষিণারঞ্জন মিত্রমজুমদার ছিলেন অনেকটা ডানপিটে ধরনের । লেখাপড়ার চেয়ে পাড়ার বন্ধু - বান্ধবের সঙ্গে খেলাধুলা , দস্যিপনা কিংবা আড্ডা দিতে অধিকতর স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন তিনি । গতবাঁধা জীবনের প্রতি ছিল তার অনীহা । পিতা - মাতার একমাত্র সন্তান হওয়ার কারণে দক্ষিণারঞ্জন সীমাহীন আদর এবং পর্যাপ্ত স্বাধীনতার মধ্যে বড় হতে থাকেন । এর মধ্যে দক্ষিণারঞ্জনের জীবনে এক দুর্যোগ নেমে আসে । মাত্র নয় বছর বয়সে তিনি মাতৃহারা হন । মাতৃবিয়োগের পরে তিনি লেখাপড়ার প্রতি খানিকটা আগ্রহী হয়ে ওঠেন । পড়াশুনার প্রতি ছেলের আগ্রহ দেখে পিতা রমদারঞ্জন তাঁকে ১৮৮৭ সালে অর্থাৎ দশ বছর বয়সে ঢাকার কিশোরীমোহন হাইস্কুলে প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি করে দেন । কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যে দক্ষিণারঞ্জন পুনরায় লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন । চিন্তিত পিতা তাকে ১৮৯৩ সালে ঢাকার ঐতিহ্যবাহী কলেজিয়েট স্কুলে সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি করে দেন এই আশায় যে হয়তো নতুন স্কুলে দক্ষিণারঞ্জনের লেখাপড়ার প্রতি ঝোঁক বাড়বে । কিন্তু স্কুল পরিবর্তনেও তার অবস্থার তেমন উন্নতি হল না। মূলত পারিবারিক পরিবেশ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার কারণে দক্ষিণারঞ্জনের মনের মধ্যে সব সময় একটা হতাশা কাজ করত । তদুপরি এ সময় তাঁর বাবা দ্বিতীয় বিবাহ করায় তিনি হীনমন্যতায় ভুগতে থাকেন । রমদারঞ্জন মিত্ৰমজুমদার ছেলের মানসিক অবস্থার সার্বিক পরিস্থিতি উপলব্ধি করে তাকে তার বোন রাজলক্ষ্মী চৌধুরানীর কাছে পাঠিয়ে দেন । ( টাঙ্গাইলের দীঘাপাতিয়াতে ) । নিঃসন্তান রাজলক্ষ্মীদেবী ভাইপো দক্ষিণারঞ্জনকে পুত্রস্নেহে লালন - পালন করতে থাকেন । পিসিমা তাকে সেখানকার ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সন্তোষ জাহ্নবী হাইস্কুলে ভর্তি করে দেন । ভাইপোর পড়াশুনার উন্নতির স্বার্থে তিনি তাকে বোর্ডিং - এ রাখার ব্যবস্থা করে দেন । পিসিমার আন্তরিক ব্যবহার , অপত্য স্নেহে অনুপ্রাণিত দক্ষিণারঞ্জন নতুন করে পড়াশুনার প্রতি বিশেষভাবে উৎসাহী হয়ে ওঠেন । যার ফলস্বরূপ তিনি নবম ও দশম - এই উভয় শ্রেণীতে পরীক্ষায় প্রথম স্থান লাভ করেন । কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে দক্ষিণারঞ্জনের এই স্কুল থেকে এনট্রান্স পরীক্ষা দেওয়া সম্ভব হয়নি । কারণ সে সময় তার পিতা রমদারঞ্জন ছেলেকে তার কর্মস্থল মুর্শিদাবাদের বহরমপুরে নিয়ে যান এবং সেখানকার নামী স্কুল - বহরমপুর হাইস্কুলে ১৮৯৭ সালে নতুন করে আবার দশম শ্রেণীতে ভর্তি করে দেন । দক্ষিণারঞ্জন ১৮৯৮ সালে অনুষ্ঠিত এন্ট্রান্স পরীক্ষায় বহরমপুর হাইস্কুল থেকে অংশগ্রহণ করে কৃতিত্বের সঙ্গে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন । এরপর তিনি বহরমপুরের কৃষ্ণনাথ কলেজে এফ.এ. ক্লাসে ভর্তি হলেও সাহিত্যের প্রতি তীব্র নেশার কারণে তার লেখাপড়ায় যবনিকাপাত ঘটে ।
দক্ষিণারঞ্জন মিত্রমজুমদার ১৮৯৯ সাল থেকে নিয়মিত ভাবে বিভিন্ন ( যেমন - সাহিত্য পরিষদ পত্রিকা , প্রদীপ ইত্যাদি ) পত্র - পত্রিকায় লিখতে শুরু করেন । তদুপরি ১৯০১ সালে কবির পিতা রমদারঞ্জনের উৎসাহে তিনি প্রকাশ করেন ‘ সুধা ' নামের একটি মাসিক সাহিত্য পত্রিকা। দক্ষিণারঞ্জনের সম্পাদিত এই বিখ্যাত সাহিত্যপত্রটি প্রায় চার বছর স্থায়ী হয়েছিল। গোটা বিশেক সংখ্যায় প্রকাশিত এ পত্রিকাটির লেখার মান ছিল যেমন প্রশংসনীয় ,তেমনি এর মুদ্রণশৈলী ছিল উন্নত মানের। পত্রিকা ছাপানোর কাজে দক্ষিণারঞ্জনকে প্রতি মাসে কলকাতায় যেতে হত । অসম্ভব কষ্টসহিষ্ণু ও কর্মব্রতী ছিলেন বলে তার পক্ষে বহরমপুর থেকে এ ধরনের একটা সাহিত্যপত্রিকা প্রকাশ করা সম্ভব হয়েছিল। একাগ্র চিত্তে এ কাজ করার ফলস্বরূপ তিনি সে সময়ে সমকালীন বিখ্যাত সব লেখকদের সঙ্গে পরিচিত হয়ে ওঠেন । কালীপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায় , নিখিলনাথ রায় , রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সহ সে-সময়কার অনেক বিখ্যাত লেখকের লেখা ছাপা হয়েছিল 'সুধা '-তে ।
১৯০২ সালে রমদারঞ্জন মিত্ৰমজুমদার মৃত্যুমুখে পতিত হন । পিতার মৃত্যুর পর দক্ষিণারঞ্জন বহরমপুর থেকে টাঙ্গাইলে পিসিমার কাছে চলে আসেন । এ সময় তিনি তার পিসিমা রাজলক্ষ্মী চৌধুরানীর বিরাট ভূ - সম্পত্তি দেখাশোনা করার দায়িত্ব পান । এ গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনের ফাঁকে ফাঁকে দক্ষিণারঞ্জন বিভিন্ন গ্রাম ভ্রমণ করে গভীর নিষ্ঠার সঙ্গে সংগ্রহ করেন বাংলার লোকায়ত সংস্কৃতির অনেক অমূল্য স্মারক । সংগৃহীত এ স্মারকগুলো পরবর্তীকালে তিনি তার বিভিন্ন লেখার রসদ হিসেবে ব্যবহার করেন। রাজলক্ষ্মী চৌধুরানী ছিলেন লোককথার অফুরন্ত ভাণ্ডারী । পিসিমার উৎসাহ ও সহায়তায় দক্ষিণারঞ্জন এসময় গ্রামীণ মহিলাদের কাছ থেকে সংগ্রহ করেন পুরাতন কাহিনী , গীতি কাহিনী , রসকাহিনী , ব্রতকাহিনী সহ অসংখ্য বাংলা লোককাহিনী । সমকালীন লেখক - গবেষকরা লোক কাহিনীকে গুরুত্ব না দিলেও দক্ষিণারঞ্জন এগুলোর গুরুত্ব ঠিকই বুঝেছিলেন । লোক - কাহিনী সংগ্রহে তিনি যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন । সংগ্রহকালীন গুরুত্বপূর্ণ সময়গুলোতে তাঁকে অমানুষিক কষ্ট - পরিশ্রম করতে হয় । দক্ষিণারঞ্জন মিত্রমজুমদারের এ নিষ্ঠা ও পরিশ্রমই তাকে গোটা বিশ্বের লোককাহিনী গবেষকদের কাছে পরিচিত করে তোলে ।
১৯০৮ সালে দক্ষিণারঞ্জন বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন বিক্রমপুরের মালখান নগরের বিখ্যাত বসু পরিবারের কন্যা গিরিবালাদেবীর সঙ্গে । তার শ্বশুরের নাম শশিভূষণ বসু এবং শাশুড়ি সুহাসিনী বসু । দক্ষিণারঞ্জন - গিরিবালার দাম্পত্য জীবন পঁচিশ বছরের । এরপর গিরিবালাদেবীর মৃত্যু ঘটে। তাদের সন্তান - সন্ততির সংখ্যা এগারো জন । পারিবারিক জীবনের নানা ঘাত - প্রতিঘাত, মৃত্যুকে উপেক্ষা করে দক্ষিণারঞ্জন সবসময় তার সাহিত্য কর্মে অবিচল ছিলেন । তার সাহিত্যজীবন ও ব্যক্তিজীবনকে পৃথক করে দেখা সম্ভব নয় । সারা জীবন তিনি নিজেকে সাহিত্য সাধনায় জড়িয়ে রেখেছিলেন । তার জীবনের সিংহভাগ বিভিন্ন বিষয়ের ওপর লেখালেখির মধ্যে অতিবাহিত হয়। বলাই বাহুল্য , তার রচনার অধিকাংশই শিশুসাহিত্য । তার গ্রন্থগুলোর মধ্যে ঠাকুরমার ঝুলি’ ( ১৯০৭ ) , ঠাকুরদাদার ঝুলি ( ১৯০৯ ) , ‘ খো কাখুকুর খেলা ' ( ১৯০৯ ) , “ ঠানদিদির থলে ( ১৯০৯ ) , “ দাদামশায়ের থলে ' ( ১৯১৩ ) , ‘ চিরদিনের রূপকথা ' ( ১৯৪৭ ) , গ্রাম্য - গীতি ' ( ১৯৪৮ ) , রূপকথার অনুবাদ গ্রন্থ পৃথিবীর রূপকথা ” ( ১৯৪৮ ) ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য । এছাড়া তিনি সাহিত্যের অন্যান্য বিষয়ে যেসব গ্রন্থ রচনা করেন , সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল , কবিতার বই । - ‘ উত্থান ' ( ১৯০২ ) , ‘ বঙ্গীয় সাহিত্য মন্দির ’ ( ১৯৩৯ ) , কিশোর উপন্যাস – “ চারু ও হারু ' ( ১৯১২ ) , স্বদেশ - প্রেমমূলক গানের সংকলন । “ আহুতি ' ( ১৯০৮ ) , ' ভাদ্র ’ ( ১৯২৭ ) , গল্পের বই - ‘ ক্যাঙ্গুরু ’ ( ১৯৪৮ ) ইত্যাদির পাশাপাশি শিশুসাহিত্য সচিত্র ‘ সরল চণ্ডী ' ( ১৯১০ ) , ‘ আমার বই ' ( ১৯১২ ) , ‘ পূজার কথা ’ ( ১৯১৮ ) , ‘ ফাস্ট বয় ’ ( ১৯২৭ ) , ' উৎপল ও রবি ’ ( ১৯২৮ ) , বাংলার সোনার ছেলে ' ( ১৯৩৫ ) , ‘ সবুজ লেখা ( ১৯৩৮ ) , ' আমার দেশ ' ( ১৯৪৮ ) , ' লাস্ট বয়’ ( ১৯৪৮ ) , ' প্রথম কথা ' ( ১৯৪৮ ) ইত্যাদি ।
স্বনামধন্য গবেষক দীনেশচন্দ্র সেন ( ১৮৬৬-১৯৩৯ ) দক্ষিণারঞ্জনের গ্রন্থগুলোকে চারটি ভাগে বিভক্ত করেছেন । যেমন - ( ১ ) রূপকথা বিষয়ক - " ঠাকুরমার ঝুলি ইত্যাদি , ( ২ ) গীতিকথামূলক “ ঠাকুরদাদার ঝুলি ' ইত্যাদি , ( ৩ ) ব্রতকথামূলক –‘ঠানদিদির থলে ' ইত্যাদি এবং ( ৪ ) রসকথা মূলক - “ দাদামশায়ের থলে ” ইত্যাদি । স্মর্তব্য , দক্ষিণারঞ্জন মিত্ৰমজুমদারকে বাংলা সাহিত্যজগতের পাদপ্রদীপের আলোতে নিয়ে আসার পেছনে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পাশাপাশি ড . দীনেশচন্দ্র সেনও যথেষ্ট ভূমিকা রাখেন ।
আমাদের দেশে প্রচলিত লোককাহিনী , বিশেষ করে রূপকথা তথা রূপকাহিনীর ভাণ্ডার যে যথেষ্ট ঐশ্বর্যময় , দক্ষিণারঞ্জন মিত্ৰমজুমদার তা প্রথম প্রমাণ করলেন । তাঁর “ ঠাকুরমার ঝুলি ' সহ অনেকগুলো গ্রন্থ মৌলিক রচনা নয় । পূর্ববঙ্গ ( বর্তমান বাংলাদেশ ) -এর বিশেষ করে বৃহত্তর ময়মনসিংহের বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে এ কাহিনীগুলো সংগ্রহ করে তা সংকলন আকারে প্রকাশ করেছেন । তবে এসব গ্রন্থ তাঁর মৌলিক রচনা না হলেও ভাষা - ব্যবহার ও সংলাপ - সৃজনে তিনি যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন । বলার অপেক্ষা রাখে না – “ ঠাকুমার ঝুলি ’ দক্ষিণারঞ্জনের সর্বাপেক্ষা আলোচিত এবং বহুল পঠিত গ্রন্থ । বাংলার সবচেয়ে জনপ্রিয় শিশুসাহিত্য এটি । বলা হয়ে থাকে তিনি যদি আর কোন গ্রন্থ সংকলন কিংবা রচনা নাও করতেন , তবু বাংলা সাহিত্য বিশেষ করে শিশুসাহিত্যের ইতিহাসে অমর হয়ে থাকতেন । ১৯০৭ সালে ' ঠাকুরমার ঝুলি ' প্রকাশ হওয়ার পর থেকে এখনও বাঙালি পাঠকের কাছে এটি সমান ভাবে জনপ্রিয় । কিংবদন্তীতুল্য এ গ্রন্থটির ভূমিকা লিখেছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর । তার লেখা ঐতিহাসিক ভূমিকাটির অংশবিশেষ এরূপ - “ ... তিনি ( দক্ষিণাবাবু ) ঠাকুরমা'র মুখের কথাকে ছাপার অক্ষরে তুলিয়া পুঁতিয়াছেন তবু তাহার পাতাগুলি প্রায় তেমনি সবুজ , তেমনি তাজাই রহিয়াছে , রূপকথার সেই বিশেষ ভাষা , বিশেষ রীতি , তাহার সেই প্রাচীন সরলতাটুকু তিনি যে এতটা দূর রক্ষা করিতে পারিয়াছেন , ইহাতে তাহার সূক্ষ্ম রসবোধ ও স্বাভাবিক কলানৈপুণ্য প্রকাশ পাইয়াছে ।.. ”
১৯৯৩ সালের এপ্রিল মাসে ত্রৈমাসিক 'সম্ভার ’ পত্রিকায় ( সাভার থেকে প্রকাশিত ) প্রকাশের জন্য আমরা বাংলাদেশে অর্থাৎ সাভারের কর্ণপাড়া তথা উলাইন গ্রামে বসবাসরত দক্ষিণারঞ্জনের জ্ঞাতি ভাইপো ৮৩ বছর বয়সী ( তার কয়েক বছর পরে প্রয়াত ) দেবীপ্রসাদ মিত্রমজুমদার - এর সঙ্গে এক অন্তরঙ্গ সাক্ষাৎকারে মিলিত হই মূলত তার জ্যেঠামহাশয় সম্পর্কে জানার আগ্রহে । এখানে তার বক্তব্যের অংশবিশেষ উল্লেখ করা হল : “ ... জ্যেঠামহাশয় দক্ষিণারঞ্জন মিত্ৰমজুমদার ড.দীনেশচন্দ্র সেনের প্রায় সমসাময়িক এবং স্নেহধন্য ছিলেন । ... ব্যক্তিগত ভাবে তিনি অত্যন্ত সদালপী , মিশুকে এবং হৃদয়বান ছিলেন । সাধারণ জীবন যাপনে অভ্যস্ত দক্ষিণারঞ্জন খদ্দরের ধুতি এবং বিদ্যাসাগর চটি পরতেন । ... বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁকে ‘ শিশুসাহিত্য সম্রাট ' উপাধিতে ভূষিত করেন ।...
দক্ষিণারঞ্জন মিত্রমজুমদার ১৯০৬ সাল থেকে কলকাতায় স্থায়ী ভাবে বসবাস শুরু করেন । কলকাতার নাগরিক জীবনে অভ্যস্ত হলেও তার মন - প্রাণটি পড়ে থাকত শৈশব - কৈশোরের স্মৃতি বিজড়িত পূর্ববঙ্গ তথা বর্তমান বাংলাদেশে । বাংলার লোকায়ত সংস্কৃতির উজ্জ্বল পথিকৃৎ , অসম্ভব প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর দক্ষিণারঞ্জন সারাজীবন নিজেকে বিশেষ ভাবে জড়িত রেখেছিলেন বাংলা শিশুসাহিত্য সংকলন , সম্পাদনা এবং রচনার কাজে । বাংলা সাহিত্য বিশেষ করে শিশুসাহিত্যের ইতিহাসে তার নামটি অক্ষয় হয়ে থাকবে । ১৯৫৭ সালের ৩০ মার্চ কলকাতার নিজ বাসগৃহ ‘ সাহিত্যাশ্রম ’-এ এই মহান সাহিত্যসাধকের জীবনাবসান ঘটে ।
লেখক পরিচিতি –
ড.বাসুদেব রায়ের
জন্ম ১৯৬২ সালে। কবিতার মাধ্যমে সাহিত্যের জগতে আত্মপ্রকাশ। প্রথম প্রকাশিত বই
মানব' (কাব্যগ্রন্থ), দ্বিতীয় বই রক্তের বাঁধন (উপন্যাস)। সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায়
পদচারণা করলেও প্রবন্ধ সাহিত্যের দিকে তার ঝোঁক বেশি। তদুপরি গবেষণামূলক প্রবন্ধ
তথা বই লিখতে তিনি অধিকতর উৎসাহী। গবেষণামূলক বইয়ের পাশাপাশি সাধু-মহাপুরুষদের
জীবনী-গ্রন্থ, একাঙ্কিকা ইত্যাদি সম্পাদনাও করেছেন তিনি।
ড.বাসুদেব রায়ের
বেশ কয়েকটি বই প্রকাশিত হয়েছে। হার উল্লেখযোগ্য গবেষণা গুলোর মধ্যে রয়েছে
মনসামঙ্গল কাব্যে দেবদেবীর স্বরূপ', চণ্ডীমঙ্গল ও অন্নদামঙ্গল
কাব্যে দেবদেবীর স্বরূপ, মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে
সমাজ-চিত্র ইত্যাদি। তাঁর যৌথ রচনা ও উপেক্ষণীয় নয়।
বিভিন্ন
পত্র-পত্রিকায় বাসুদেব রায় নিরলস ভাবে লিখে চলেছেন। এছাড়াও নতুন করে তিনি একক ও যৌথভাবে বেশ কয়েকটি
গবেষণামূলক কাজে হাত দিয়েছেন।