তিরিশোত্তর বাংলা কাব্যে , বাংলার লোকজ প্রকৃতির অন্তরঙ্গ কবি জীবনান্দ দাশ এক ব্যাতিক্রমী কণ্ঠস্বর । তিনি প্রকৃতির কবি , নিঃসঙ্গতার কবি , জীবনের অন্তর্লীন বিশাদের কবি । বাংলার নিসর্গ ও লোক ঐতিহ্য তার কবিতায় এসেছে অভিনবভাৰে ।
জীবনানন্দ দাশকে ‘নির্জনতম কবি'বলে অভিহিত করেছিলেন বুদ্ধদেব বসু । তাঁর কাব্যে
প্রথম থেকেই প্রকৃতি- এক উল্লেখযোগ্য অস্তিত্ব । কখনো প্রকৃতি কবিতার বিষয় ,তখনো তা কবিতাৱ পটভূমি ,আবার কখনো তা ক্লান্ত কবির শেষ আশ্রয়ভূমি । এছাড়া
বেশ কিছু প্রকৃতি - মগ্ন কবিতা প্রতীকী সংকেতে মুগ্ধ হয়ে জীবনানন্দের কবিতা
দিয়েছে অনন্যতা । শুধু তাই নয় , তার প্রকৃতি - নিবিষ্ট কবিতা পাঠকের সামনে তুলে ধরেছে
প্রকৃতির এক অসাধারণ ইন্দ্রিয়ভেদ্য রূপ যা নির্মাণ কুশলতায় অনন্য হয়ে আছে বাংলা
সাহিত্যে ।
জীবনানন্দের প্রথম কাব্য গ্রন্থ
' ঝরা পালক ’-এ ( ১৯২৭ ) প্রকৃতি নিছক নিসর্গ
দৃশ্যমাত্র । তা কেবল বর্ণনার বিষয় ,তাতে হৃদয়ের গভীর অনুভবের ছোয়া নেই , নেই সংবেদনশীলতার প্রগাঢ়
উত্তাপ । তবে রোমান্টিক দূর - মনস্কতা ও স্বপ্নোচ্ছাসের
কিছুটা আভাস ‘ঝরা পালকের’ প্রকৃতি - চিত্রে
লক্ষ করা যায়–
জীবনানন্দ দাশের ‘ধূসর পান্ডুলিপি’( ১৯৩৬ ) কাব্যগ্রন্থের কেন্দ্রবিন্দুতেও রয়েছে প্রকৃতি । এ গ্রন্থের প্রেমের কবিতাও যেন প্রকৃতির মধ্যে মুক্তি খুঁজে পেতে চেয়েছে । কবিতার পর কবিতায় এসেছে প্রকৃতির ছবি - একেই রবীন্দ্রনাথ বলেছেন , “চিত্ররূপময় ' কবিতা । জীবনানন্দের চিত্রিত গ্রাম - বাংলা যেন আমাদের নির্জন আশ্রয়ের মত। তার কবিতায় যে প্রকৃতির ছবি আমরা পাই তা শুধু চিত্ররূপময় নয় ,তা ধ্বনিগন্ধময় এক ইন্দ্রিয়নির্ভর জগৎকে আমাদের সামনে উদ্ভাসিত করে । এসব কবিতায় কখনো ধরা পড়ে হৈমন্তিক বিষাদ , কখনো তাতে ধরা পড়ে শীতের আবহ, কখনো তাতে হেমন্তের রেশ ,কখনো তা কুয়াশা আর হিমে ঝরে পড়া পাতার ভিড়ে সমর্পিত । এখানে তিনি আকাশের নক্ষত্রের কথা বলেন, সন্ধ্যায় মেঘের রঙকে ফুটিয়ে তুলেন , বিকেল বেলার ধূসরতার ছবি আঁকেন । তার এইসব নিসর্গ অনুভূতিতে রয়েছে ইন্দ্রিয়মগ্নতা । অনুভূতির সকল তীব্রতা , তীক্ষ্মতা আর সূক্ষ্মতা নিয়ে এসব কবিতায় প্রখর হয়ে ওঠে কবির ইন্দ্রিয় । কবির অনুভূতির অনুষঙ্গে আমরা বাতাসে ঝিঝির গন্ধ পাই। নরম জলের গন্ধ দিয়ে নদীকে বারবার তীরকে মাখতে দেখি ।
জীবনানন্দের কবি - চেতনার পরতে
পরতে ক্রিয়াশীল ছিল গ্রাম বাংলার নৈসর্গিক পটচিত্র । ওঁর শেষের দিকের
কাব্যগ্রন্থ 'রূপসী বাংলায় ' (১৯৪৭ ) তাই কবিতার পর কবিতায় ফুটে উঠেছে রূপসী বাংলার বহু
বর্ণিল ছবি। সেখানে আমরা পাই গ্রাম বাংলার ভিজে মাটির গন্ধ , তমালের নীল ছায়া । আমাদের চোখে
ভাসে কচি লেবু পাতার মতো নরম সবুজ আলো ,শালিখের খয়েরি ডানা,ভোরের দোয়েল পাখি ,ছাতার মতো বড় পাতা ,কাঁচা বাতাবির মতো সবুজ ঘাস এমনি আরো কত ছবি । বাংলার
প্রকৃতি জীবনানন্দের প্রাণসত্তা এমনভাবে মিশে যায় যে তিনি গভীর মমতায় বলেন –
খুঁজিতে যাই না আর ।
জীবনানন্দ দাশের এই কাব্যগ্রন্থের সনেটগুচ্ছে রয়েছে একান্ত প্রকৃতি লগ্ন দেশজ আবেগ ও আবেশ । এতে রয়েছে প্রকৃতির অকৃত্রিম ছবি ,তার সঙ্গে যোগ ঘটেছে অতীত গরিমার লোকায়ত ঐতিহ্যের । এভাবে নিসর্গ - চেতনার সঙ্গে ইতিহাস সচেতনতার মেলবন্ধন ঘটেছে ।
গ্রাম বাংলার প্রকৃতি , পরিবেশ , স্বপ্নসাধ ও নিসর্গানুভূতি
ইন্দ্রিয়মগ্নতায় অপরূপ রূপ লাভ করেছে জীবনানন্দের কবিতায় । কখনো তিনি গ্রাম
বাংলার প্রকৃতির প্রাণসত্তা হিসেবে দেখেছেন রূপকথার কোনো এক রাজকন্যাকে –
কোন এক রাজকন্যা
-পরনে ঘাসের শাড়ি- কালো চুলধান
বাংলার শালিধান- আঙ্গিনায় ইহাদের করেছে বরণ,
হৃদয়ে জলের গন্ধ কন্যার- ঘুম নাই ,নাইকো মরণ -
তার আর কোনোদিন - পালঙ্কে সে শোয়
নাকো ,হয় নাকো ম্লান,
লক্ষ্মীপ্যাঁচা শ্যামা
আর শালিখের গানে তার জাগিতেছে প্রাণ –
সারাদিন - সারারাত বুকে করে আছে তারে শুপুরির
বন ;
বাংলার প্রকৃতির এই রূপ শুধু
কবিকে অভিভূত করেনি ,প্রকৃতির সৌন্দর্যের মধ্যেও তিনি উপলব্ধি করেছেন ইতিহাসের
ঐতিহ্যকে ,
মধুকর ডিঙ্গা থেকে না জানি সে করে চাঁদ চম্পার কাছে
এমনই হিজল - বট তমালের নীল ছায়া বাংলার 'অপরূপ রূপ’-
দেখেছিল ……..
রূপসী বাংলা কাব্যে কবির জীবন - অনুরাগের
কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে প্রকৃতি । সেই জন্যেই তিনি ধানসিঁড়ি নদীর তীরে
হয়তো শঙ্খচিল শালিখের বেশে ,হয়তো নবান্নের সময়ে ভোরের কাক হয়ে আবার বাংলার
বুকে জন্ম নিতে চেয়েছিলেন ।
জীবনানন্দ দাশ জীবন ও প্রকৃতিকে
যেমন এক করে দেখেছেন এবং প্রকৃতির মধ্যে আবিষ্কার করেছেন নতুন উপমা ও উৎপ্রেক্ষা ।
তিনি প্রকৃতির বাহ্যিক সৌন্দর্য দেখেই শুধু ক্ষান্ত হননি,দেখেছেন এর অন্তর্লীন রূপ , প্রকৃতির স্পর্শ গন্ধও তার
কবিতায় শব্দমালায় তিনি গ্রথিত করেছেন ।
‘বনলতা সেন '(১৯৪২) কাব্যগ্রন্থেও প্রকৃতি এসেছে নতুন তাৎপর্য নিয়ে ।
এখানেও কবির প্রকৃতি চেতনায় মননঋদ্ধ ও আবেগময় প্রকাশ ঘটেছে । প্রকৃতি
এখানে প্রশান্তি ও স্থিরতার এক জগৎ । বাস্তবতার ক্লান্তি ও জ্বালা ,হতাশা ও অস্থিরতার বিপরীতে প্রকৃতি এখানে মুক্তি ও শান্তির
দিশা ,স্বস্তির
আশ্রয়ভূমি । ‘সুচেতনা ' কবিতায় কবি এক শুভ চেতনার কথা
ব্যক্ত করেছেন । কল্পনায় দ্বীপের মতো বিচ্ছিন্ন এই চেতনার সবুজে বিরাজ করছে
নির্জনতা । অর্থাৎ এই শুভ চেতনা সর্বত্র বিস্তারিত বলে কৰি অনুভব করেন –
সুচেতনা , তুমি এক দূরতর
দ্বীপ
বিকেলের নক্ষত্রের কাছে ;
সেইখানে দারুচিনি - বনানীর ফাঁকে
নির্জনতা আছে ।
কবি জীবনানন্দ দাশ কবিতায়
সুক্ষ্ম ও গভীর অনুভবের এক জগৎ তৈরি করেন । বিশেষ করে গ্রামবাংলার নিসর্গের যে ছবি
তিনি এঁকেছেন , বাংলা
সাহিত্যে তার তুলনা চলে না । সেই নিসর্গের সঙ্গে অনুভব ও বোধের বহুতর মাত্র
যুক্ত হয়ে তার হাতে অনন্যসাধারণ কবিতাশিল্প রচিত হয়েছে । ‘এই
পৃথিবীতে এক স্থান আছে’ কবিতায় কবি বাংলার প্রভাতের
সৌন্দর্য ও তার রহস্যময়তার কথা তুলে ধরেছেন । ভোরের সূর্যের আলোর বিচ্ছুরণকে কবি
পাকা করমচার সাথে তুলনা করেছেন –
সেখানে গাছের নাম : কাঁঠাল , অশ্বথ , বট , জারুল , হিজল;
সেখানে ভোরের মেঘে
নাটার রঙের সঙ্গে জাগিছে অরুণ ;
জীবনানন্দ দাশ তার অন্তিম
পর্যায়ের অনেক কবিতাতে প্রকৃতির প্রশান্তির কাছে আশ্রয়
নিতে চেয়েছেন । পৃথিবীর ঘাস ও নীলাকাশের ব্যাপ্তির মধ্যে পেয়েছেন হৃদয়মূল্যকে ।
প্রকৃতি ও হৃদয়ের মর্মরিত হরিতের পথে গ্লানিমুক্ত আলোর এক পৃথিবীর স্বপ্ন দেখেছেন
তিনি । কারণ তিনি শেষ পর্যন্ত বিশ্বাস করেন; রক্ত, রিরংসা ও
সংঘাতময় পৃথিবীর পতনশীলতা থেকে শেষ মুক্তি ও আশ্রয় মেলে কেবল প্রকৃতির
সান্নিধ্যে । তিনি জানেন –
মানুষের রক্তাক্ত হৃদয়
হরিতের কাছে এসে শিখবে অক্ষর গুঞ্জরণ।
জীবনানন্দ প্রকৃতির মধ্যেই
জীবনের গভীরতম প্রশান্তি অনুভব করতে চেয়েছিলেন । বনলতা সেন কবিতায় উপস্থাপিত
নিসর্গ পটভূমি আশ্রয় করে কবি শান্তি অনুভব করতে চেয়েছেন । কবি এখানে তাঁর মানস
প্রতিমাকে সবুজ ঘাসের মতো শান্তিদায়ক ও পেলৰস্পর্শ করে
অঙ্কিত করেছেন । এভাবেই কবির কবিতায় মূর্ত হয়ে ওঠেছে প্রকৃতি ।
সমাপ্ত
লেখক পরিচিতি –
রঘুনাথ ভট্টাচার্য-র জন্ম বাংলাদেশের ঢাকায় । ধামরাই কলেজ , জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেছেন । বাংলায় স্নাতকোত্তর ও পিএইচ ,ডি । বিভাগীয় প্রধান , বাংলা বিভাগ , নবযুগ কলেজ , ধামরাই , ঢাকা ।
প্রকাশিত গ্রন্থ - ( ১ ) বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্য ( ১৯২০-১৯৩০ ) । ( ২ ) সবুজপত্র গোষ্ঠীর সাহিত্য ভাবনা। ( ৩ ) প্রবন্ধ সংগ্রহ । ( ৪ ) ঈশ্বর ভাবনার বিবর্তন ও অন্যান্য প্রবন্ধ । ( ৫ ) বাংলার বৈষ্ণব দর্শন : সাহিত্যে রাধা ও কৃষ্ণের ক্রমবিবর্তন । এছাড়াও যৌথভাবে একাধিক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে ।