Advt

Advt

সাতে সাত সমুদ্র -- ডঃ তুষার রায়, Sate Sat Samudra by Dr. Tushar Roy, Tatkhanik Bengali / Bengali Free Web / Online Magazine

জানা অজানা

সাতে সাত সমুদ্র-

ডঃ তুষার রায়, নতুন দিল্লি

 (পূর্বকথনঃ মনে আছে ১০ই জানুয়ারির জানা-অজানায় (মঙ্গল গ্রহের সফর) লিখেছিলাম যে ১৮ই ফেব্রুয়ারি সকালে মঙ্গল-যান Ingenuity মঙ্গল গ্রহে নামবে। গতকাল সন্ধ্যায় (১৮-০২-২০২১) টি ভি তে খবর দেখলাম-মঙ্গল যান রোভার-সহ মঙ্গলে নেমে গেছে। শনিবার (২০-২-২১) সকালে টি ভি-তে দেখলাম Ingenuity মঙ্গল থেকে রঙিন ছবি পাঠাতে আরম্ভ করেছে।  জয় বিজ্ঞান।  জয় মানব-প্রতিভা। )

ছোটবেলায় নামতায় তো পড়েছি সাতে সাত সমুদ্র -- ”, কিন্তু আসলে সাতটা সমুদ্র আছে কি? সমুদ্র বলতে গেলে একটাই সমুদ্রের বৈজ্ঞানিক সংজ্ঞা হল,পরস্পর সংযুক্ত বৃহৎ লবণাক্ত জলরাশি। আমাদের ভৌগোলিক সুবিধের জন্যই আমরা ভিন্ন ভিন্ন নাম দিয়ে এতগুলো সমুদ্র তৈরি করেছি। তারও মধ্যে আসলে সমুদ্র পাঁচটিই-প্রশান্ত মহাসাগর,আটলান্টিক মহাসাগর,ভারত মহাসাগর,দক্ষিণ (অ্যান্টার্কটিক) মহাসাগর ও উত্তর (আর্কটিক) মহাসাগর। এই মহাসাগর গুলি সব চেয়ে বড় থেকে সব চেয়ে ছোট এইভাবে সাজিয়ে দিলাম। এই পাঁচটি মহাসাগরকে আবার উত্তর আর দক্ষিণ গোলার্ধে আলাদা করলে,অর্থাৎ উত্তর ও দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগর এবং উত্তর ও দক্ষিণ আটলান্টিক মহাসাগর ধরলে হয় সাত মহাসাগর। এবার যদি ছোট থেকে বড় সাজানো হয় তাহলে দাঁড়ায়, আর্কটিক সাগর,উত্তর আটলান্টিক মহাসাগর,দক্ষিণ আটলান্টিক, ভারত মহাসাগর,উত্তর প্রশান্ত মহাসাগর,দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগর, দক্ষিণ সাগর বা অ্যান্টার্কটিক মহাসাগর।

সৌর মণ্ডলে একমাত্র পৃথিবী নামক এই গ্রহেই জল তরল অবস্থাতে পাওয়া যায়। আমরা সবাই জানি এই পৃথিবীর ভূখণ্ডের শতকরা ৭১ভাগ হচ্ছে জল আর বাকি অংশই স্থল-অর্থাৎ সমতল,পাহাড়-পর্বত,মরুভূমি,জঙ্গল ইত্যাদি। কিন্তু অবাক কাণ্ড কি জানেন এই ৭১ ভাগ জল কিন্তু পৃথিবীর মোট ওজনের মোটে ৯ ভাগ !! মনে আছে ওই নীলাভ গোলকেদেখেছিলাম পৃথিবীর ওজন(আসলে mass)৬.০*১০**২৪ কেজি। আর সব কটা সমুদ্র মিলিয়ে ওজন হল ১.৩৭*১০**২১ কেজি যা নাকি গোটা পৃথিবীর ওজনের শতকরা ০.০২৩ ভাগ। এর পরে আছে ০.৫*১০**২১ কেজি জল রয়েছে বরফ,নদী-নালা,হ্রদ,মাটির নিচের জল এবং পৃথিবীর উপরিভাগের আবহাওয়া মণ্ডলে জলিয় বাষ্প হিসাবে। এ ছাড়াও একটি বড় অংশ জল রয়েছে পৃথিবীর ক্রাস্ট (Crust),ম্যান্টেল (Mantle) এবং কোরে (Core)-হাইড্রেটেড খনিজ হিসাবে।বিশ্বাস হচ্ছেনা?না হওয়ারই কথা-কেন না কোরে তাপমান কত মনে আছে? ৫৪০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস!

এখন প্রশ্ন হল সৃষ্টির কালে পৃথিবী তো ছিল এক বিশাল আগুনের পিণ্ড-সমান গোলক। তাহলে এত জল এলো কোথা থেকে? বৈজ্ঞানিকেরা আজও এর সঠিক উত্তর খুঁজে পাননিভিন্ন ভিন্ন মত বা থিওরি আছে,কিন্তু কোনটাই পুরোপুরি প্রমাণিত হয়নি এখনও পর্যন্ত। বেশির ভাগ বৈজ্ঞানিকের বিশ্বাস পৃথিবীর জল এসেছিল মহাকাশ থেকে-অ্যস্টেরয়েডস(Asteroids)আর ধূমকেতু(Comets)-র মাধ্যমে।

সাত সমুদ্রের কথায় আবার ফিরে আসা যাক। সব থেকে বড় আর গভীর সমুদ্র ত হল প্রশান্ত মহাসাগর। কত বড়? ৬৩০ লক্ষ বর্গ কিলোমিটার,আর জল ধরে সমগ্র গ্রহের মোট জলের অর্ধেকেরও বেশি। শুধু আয়তনে নয়,গভীরতার দিক থেকেও প্রশান্ত মহাসাগর গভীরতম। এই গভীরতম এলাকা হল ফিলিপাইন দ্বীপপুঞ্জ আর গুয়ামের মাঝামাঝি;এই অর্ধচন্দ্রাকার ২৫৫০কিলোমিটার ম্বা আর ৭০ কিলোমিটার চওড়া খাড়ির নাম হল-ম্যারিয়ানা খাড়িবা ম্যারিয়ানা ট্রেঞ্চ। কত গভীর ? একটা হিমালয় পাহাড় ঢুকে গিয়েও খালি জায়গা থাকবে-৩৫,৮১৪ ফিট গভীর। মাউন্ট এভারেস্ট কত উঁচু?২৯,০২৫ ফিট।
অর্থাৎ হিমালয়কে ম্যারিয়ানা ট্রেঞ্চে ঢুকিয়ে দিলেও ৬৭৮৯ফিট খালি থেকে যাবে। এই স্থানের একটা নাম দেওয়া হয়েছে - চ্যালেঞ্জার ডিপ (Challenger Deep)-পৃথিবীর সবচেয়ে নিচের স্থান।

 আমরা সবাই জানি এডমন্ড হিলারি আর তেনজিং নোরগে প্রথম এভারেস্ট বিজয়ী বীর। এরপরে বিগত ৬৭ বছরে অসংখ্য পর্বতারোহী এভারেস্ট জয় করেছেন। কিছু সংখ্যক অভিযাত্রী চাঁদেও পা রেখেছেন। কিন্তু এই প্রশান্ত মহাসাগরের গভীরে অর্থাৎ ম্যারিয়ানা ট্রেঞ্চে বা চ্যালেঞ্জার ডিপে আজ পর্যন্ত কেবল তিনজন মানব সন্তান যেতে পেরেছেন। এই তিন মানব-সন্তানের সঙ্গে একটু পরেই আমাদের পরিচয় হবে,তার আগে ম্যারিয়ানা ট্রেঞ্চ সম্বন্ধে একটু তথ্য জেনে নিই:
আমরা জানি স্বপ্নের জাহাজ টাইটানিক ডুবেছিল ১৪ই এপ্রিল,১৯১২ সালে। জেমস্‌ ক্যামারুনের অসাধারণ সুন্দর চলচ্চিত্র টাইটানিকনিশ্চয়ই দেখেছেন। টাইটানিক ডুবে উত্তর আটলান্টিকের ১২,৬০০ ফুট (প্রায় আড়াই মাইল) নিচে দু-টুকরো হয়ে পড়েছিল-৮৫ বছর ধরে। চ্যালেঞ্জার ডিপএর থেকেও ৩ গুন গভীর। এত নিচে কি প্রচণ্ড সমুদ্র-জলের চাপ হবে কল্পনা করতে পারেন? প্রতি বর্গ-ইঞ্চিতে ৮ টন ওজনের সমান চাপ অর্থাৎ আমাদের হাতের একটি আঙুলের উপর ১০৭৩ কিলোগ্রাম ওজনের চাপ। অতএব ওখানে তো আর খালি সুইমিং সুট পরে যাওয়া যাবেনা। তাই ওখানে যাবার জন্য ৫ইঞ্চি পুরু স্টিলের পাত দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল সেই ডুবো-জাহাজের মত ক্যাপসুল-নাম দেওয়া হয়েছিল-ট্রিষ্টি (Trieste)
সেই বিশেষ ক্যাপসুলে চড়ে দুই অসীম সাহসিক মানব-সন্তান ১৯৬০ সালের ২৩শে জানুয়ারি পৌঁছেছিল চ্যালেঞ্জার ডিপে। সময় লেগেছিল ৫ ঘন্টা। কি দেখেছিলেন ওখানে? ভাবছেন অত ভয়ঙ্কর চাপে কোন জীবন্ত প্রাণী কি করে বাঁচবে? কিন্তু,না, জীবন ওখানেও বেঁচে আছেএক ধরণের চ্যাপ্টা একফুট লম্বা মাছ দেখতে পেয়েছিলেন ওঁরা আর ওই যাঁতাকলে আধ-ঘণ্টা কাটিয়ে ফিরে এসেছিলেন সমুদ্রের উপর। এই দুই বীর মানব সন্তানের নাম-লেফটেন্যান্ট ডন ওয়ালস্‌ এবং জেকস্‌ পিকার্ড। এর পরে যে তৃতীয় ব্যক্তি চ্যালেঞ্জার ডিপে যান তাঁকে কিন্তু আমরা প্রায় সবাই চিনি,মানে নাম শুনেছি,উনিই বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা-জেমস ক্যামারুণ। নামটা মনে পড়ছে? উনিই তো আটটি অস্কার বিজয়ী বিখ্যাত চলচ্চিত্র টাইটানিক”-এর নির্মাতা-জেমস ক্যামারুন। জেমস ক্যামারুন চ্যালেঞ্জার ডিপে গিয়েছিলেন আজ থেকে আট বছর আগে,২৬শে মার্চ,২০১২ সালে। ক্যাপসুলটি এখন ওয়াশিংটন ডি সিতে জাতীয় নৌবাহিনীর সংগ্রহালয়ে রক্ষিত আছে।
কতকগুলি সাগর বা সমুদ্র আছে যারা আসলে সমুদ্র নয়-বড় লেক বা হ্রদ। এদের মধ্যে সর্ববৃহৎ হল কাস্পিয়ান সাগর। নামে সাগর হলেও আসলে এটি একটি হ্রদ,যার আয়তন মাত্র ৩,৭১,০০০ বর্গ-কিলোমিটার। আমেরিকা-ক্যানাডা
 অঞ্চলের পাঁচটি লেকের(গ্রেট লেকস) আয়তনই ২,৪৪,১০৬ বর্গ-কিলোমিটার। তুলনায়,পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট সমুদ্র,অর্থাৎ আর্কটিক  সাগরের আয়তন ১৪০ লক্ষ বর্গ কিলোমিটার। এক একটি লেকই সমুদ্র-সমান।লেক সুপিরিয়রের আয়তনই ৮২,১০৩ বর্গ-কিলোমিটার। মেজ লেকটি অর্থাৎ লেক মিশিগানের আয়তন ৫৮,০০০বর্গ-কিলোমিটার। ভাগ্যক্রমে ওর পাড়ে বসে গল্প করার এমনকি একটি গল্প লেখারও সৌভাগ্য হয়েছিল। সেটির বিশালতা দেখে সমুদ্র থেকে কোন অংশে ছোট মনে হয়নিসমুদ্রের বিশালতা,এমনকি সমুদ্রের মত ঢেউও ওঠে।





সাত সমুদ্র তো নাহয় হাতে গুনতে পারা যায়,কিন্তু আমাদের হারিয়ে যাওয়া রাজকুমারীকে খুঁজতে গেলে যে ১৩টি নদীও পেরুতে হবে। এই তেরটি নদী কোন কোনটি ? পৃথিবীতে বড় বড় নদীই আছে ১৬৫ টি। আর মোট নদী? অসংখ্য। আমাদের
দেশেই আছে চারশো-র (৪০০) অধিক নদী। তাহলে সেই বিশেষ ১৩টি নদী কোন-কোনটি যাদের আমরা পার করব? আমরা জানি আমাদের পূজা-পার্বণে ৭টি পবিত্র নদীকে স্মরণ করে পবিত্র স্থাটিকে পবিত্র করা হয় - (গজ্ঞেচ যমুনে চৈব গোদাবরী সরস্বতী,নর্মদে সিন্ধু কাবেরী জলহস্মিন সন্নিধং কুরু”)। এই তেরো নদীরমধ্যে গঙ্গা,যমুনা,গোদাবরী,সরস্বতী,নর্মদা,সিন্ধু ও কাবেরী-এই সাতটি পবিত্র নদী তো থাকবেই। বাকী ৬টি কারা ? ব্রহ্মপুত্র,বিপাশা বা বিয়াস, মহানদী,কৃষ্ণা,তাপ্তি ও চম্বল? কেননা এরাই আমাদের দেশের বড় বড় নদীর তালিকায় রয়েছে।


                                                                                            (চলবে)

 

লেখকের অন্যান্য লেখা পড়তে এখানে ক্লিক করুন ।

 

লেখক পরিচিতি


স্কুলে থাকতেই শুরু হয়েছিল গল্প আর মহাকাশের উপর প্রবন্ধ।শুকতারাতে অসীমের অন্বেষণেপ্রকাশিত হয়েছিল। সীমাহীন বলেই বুঝি মহাকাশের আকর্ষণ ছিল অসীম। জ্যোতিঃশাস্ত্রের ছোটখাটো বই পড়ে কম দামী বাইনোকুলার চোখে লাগিয়ে চলতে লাগল নক্ষত্রদের সংগে নীরব বার্তালাপ। ইচ্ছা ছিল জ্যোতিঃশাস্ত্র নিয়ে পড়াশুনা করা। কিন্তু
“Need to have and Nice to have” এর কলহে সেটা হতে পারেনি। কিন্তু নেশা আর পেশায় কলহ কখনও হয়নি। তাই এখন এই পরিণত বয়সেও মহাকাশের অনন্ত রহস্য সহজ সরল ভাষায় পরিবেষণ করে আনন্দ পা


কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় আর আই. আই. টি, দিল্লি থেকে পড়াশুনা ও গবেষণাকিছুদিন অধ্যাপনা,তারপর সরকারী বৈজ্ঞানিক দপ্তরে কার্যকালে পৃথিবীর কয়েকটি দেশেও কাজ করার সৌভাগ্য হয়েছে। পঞ্চাশটির বেশি প্রবন্ধ বৈজ্ঞানিক পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসে (ইন্দোর) আমন্ত্রিত প্রবন্ধ পাঠ করার গৌরবও ভাগ্যে ঘটেছে।