ধারাবাহিক
– প্রতি শনিবার
হলুদ পাখি (Black-hooded oriole)
১৭তম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিককরুন ।
লেখিকার অন্যান্য লেখা পড়তেএখানে ক্লিক করুন ।
১৮তম পর্ব শুরু ………………
“সেই যে হলুদ পাখি বসে জামরুল গাছের ডালে করতো ডাকাডাকি আমার শৈশবের সকালে একদিন গেল উড়ে, জানিনা কোন সুদুরে ফিরবে
না, সে কি ফিরবে না, ফিরবে না আর
কোনদিন”……
এই গানটা ভীষণ নস্টালজিক। আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে যায় ফেলে আসা শৈশবে। যদিও শৈশব ফিরে আসে না ঠিকই, কিন্তু হলুদ পাখি বার বার ফিরে ফিরে আসে। কখনও সে মনে ফাগুনের(বসন্তের) আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে যায়। আবার কখনও দূর থেকে ডাক দিয়ে যায়। পাখির ডাকটা-কে ছন্দ করে বললে, মনে হয় যেন সে বলছে “হোক খোকা, “হোক খোকা” অথবা “আয় কুটুম,আয় কুটুম”। আসলে যে যেভাবেই বলি না কেন, পাখির ডাকের সঙ্গে তার সেই সুরটাই কানে লেগে থাকে। সেই কোন ছোটবেলা থেকে হলুদ পাখির ডাক শুনেছি! আজও পাখিটার ডাক শুনলেই খুঁজে দেখতে থাকি সে কোথায় বসে ডাকছে!
কিছু কিছু পাখি নিয়ে বেশ কিছু লৌকিক এবং পৌরাণিক গল্প আছে, যা যুগে যুগে প্রচলিত। সেই প্রচলিত গল্পগুলো শুনতে শুনতে মানুষের মনেও সেই বিষয়ে সাময়িক
বিশ্বাস গড়ে উঠেছিল যা আজও বহমান। কোনও কোনও ক্ষেত্রে পাখির ডাক ছিল ভালো-মন্দ, শুভ-অশুভ’র প্রতীক। সকাল থেকে বাড়ির চারপাশে ঘন ঘন কাকের ডাক শুনলেই সকলে চিন্তায়
পড়ে যেতো এবং সেদিন কোনও দুঃসংবাদ এলেই ধরে নেওয়া হতো কাকের ডাকটাই ছিল সঙ্কেত।
একটা ঘটনা আমার খুব মনে পড়ে। সক্কাল সক্কাল বাড়িতে কাক ডাকলেই আমার মা-দিদিমা রেগে গিয়ে কাককে উদ্দেশ্যে করে বলতেই থাকতো “যা!...যা!... গঙ্গা জলে ডুবে মর”! কি
জানি বাবা কি দুঃসংবাদ নিয়ে আসছে কে জানে! আমি তখন সবে মাধ্যমিক। আর পাঁচটা দিনের
মতোই আমার মা সকাল থেকে বাসি কাজ সারতে ব্যস্ত। সেদিনও সকাল থেকে
ভীষনরকম কাক ডাকছিল। কাকের ডাকটাও খুব বিশ্রী রকম শোনাচ্ছিল। সকাল আটটা বাজতে
না বাজতেই মামার বাড়ির পাড়া থেকে একজন এসে খবর দিলো, ভোরেরবেলা আমার দাদু মারা গিয়েছেন। মা তখনই হাঁউঁ-মাউঁ করে কেঁদে উঠে বললো….আজ সকাল থেকে যা কাক ডাকতে শুরু করেছিল,
আমি তখনই জানতাম দুঃসংবাদ কিছু আসছে! বাপি গো….. বাপি, তুমি চলে গেলে…..এমন করে….!
তবে হলুদপাখির ডাক কিন্তু সবসময়ই মঙ্গলময়। বাড়িতে সদ্য বিবাহিত
নববধূর আগমনের পর হলুদ পাখি ডাক দিয়ে গেলেই সবাই ধরে নিতো পাখিটা নিশ্চয়ই বলে গেল “খোকা হোক”। আর নববঁধু লজ্জ্বায় রাঙা হয়ে উঠতো। ছোটবেলায় এমন গল্প অনেকেই ঠাকুমা-দিদিমার মুখে শুনেছেন হয়তো।
অনেকেই হলুদপাখি’কে বউ-কথা-কও পাখি বলে ভুল করেন। বউ কথা কও পাখি হলো পাপিয়া পাখির একটি শ্রেণী বিশেষ। গ্রাম-গঞ্জের আবাসিক পাখি কাক-বক-শালিকের মতো হলুদপাখিও খুবই পরিচিত।
তবে, হলুদপাখির অনেক নাম। যে যখন যে নামে ডাকে
সেই নামটাই সার্থক হয়ে ওঠে। বেনে বউ, খোকা হোক, কুটুমপাখি, ইষ্টিকুটুম ছাড়াও হলুদপাখি ইত্যাদি বিভিন্ন
নামে একে ডাকা হয়।
বাংলার লোককাহিনীতে হলুদপাখিকে নিয়ে অনেক গল্প প্ৰচলিত আছে। আবছা মনে আছে গল্পটা….
অনেক অনেক বছর আগের কথা। সেই সময় যাঁরা পারিবারিকভাবে
ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত থাকতেন তাঁরা বণিক সম্প্রদায়ভুক্ত ছিলেন। কিন্তু পরবর্তীকালে
শোনা যায়, যাঁরা সোনার ব্যবসা করতেন একমাত্র তাঁরাই
‘বেনে’ নামে পরিচিত ছিলেন। স্বভাবতঃই বেনে’রা ছিলেন অর্থবান এবং সমৃদ্ধশালী। এমনই ধনী কোনও এক বণিক বা বেনে বাড়ির সপ্তম
পুত্রের সুন্দরী স্ত্রী কন্যা-সন্তানের জন্ম দেওয়ায়,
তার স্বামী এবং শ্বশুরবাড়ির লোকেরা রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে ওঠে। তারা ঠিক করে যেভাবে
হোক ছোটবউ আর তার কন্যাকে গোপনে হত্যা করবে!
ছোটবউ দাসী মারফত সে কথা জানতে পেরে যায়। একদিন দুপুরবেলা
ছোটবউ হলুদ রঙের কাপড় পরে, তার একঢাল কালো চুলে মুখ
ঢেকে, শাড়ির আঁচলে মেয়েকে লুকিয়ে নিয়ে ছদ্মবেশে পালিয়ে যেতে গিয়ে
তার স্বামীর হাতে ধরা পড়ে যায়। স্বামী তাকে বাধা দিতে উদ্যত হলে, ছোটবউ হঠাৎই সকলের সামনে দিয়ে একটা হলুদপাখির রূপ ধরে উড়ে যায়! বেনে বাড়ির ছোটবউয়ের পাখি হয়ে উড়ে যাবার খবর তৎক্ষণাৎ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তে
থাকে। কালক্রমে,হলুদ পাখি দেখলেই সকলে ধারণা করে নিতো যে,
এটাই বেনেবাড়ির ছোটবউ। সেই থেকে হলুদ পাখির
নাম হলো “বেনে বউ”। পাখিটার মাথাটা চকচকে
কালো তাই কেউ কেউ ছোটবউয়ের কালো চুলের সাথে মিল করে বলে “কালোমাথা বেনেবউ”।
দিন আসে দিন যায়, বেনে বউয়ের গল্প ছড়িয়ে পড়তে
থাকে। হলুদ পাখির ডাক শুনলেই গ্রামের মানুষজন ধারণা করে নিতো “বেনেবউ” যেন নিজের দুঃখী জীবনের কথাই প্রচার করে চলেছে
“খোকা হোক” বা “হো…ক খোকা”,“হো…ক খোকা” ডাকের সঙ্গে।
আমাদের ছোটবেলায় অতিথি আসা- যাওয়ার খবরাখবর বিনিময়ের কোনও মাধ্যম ছিল না। চিঠি লিখলেও তাতে দীর্ঘ দিনের প্রতীক্ষা থাকতো। কাজেই পাখির ডাক
শুনেই শুভ-অশুভ খবরের মতো অতিথি আসার খবরও আন্দাজ করা হতো। মনে পড়ে, একবার আমরা সব ভাইবোন মায়ের সঙ্গে মামার বাড়ি গিয়েছিলাম। আমরা যেতেই দিদিমা
বলে উঠলো আমি জানতাম তোরা আসবি! আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম কি করে জানলে! দিদিমা বললো
কুটুমপাখি সকালেই খবর দিলো যে “কুটুম এ..লো কুটুম এ..লো” বলে। আমাদের মামারবাড়ির উল্টোদিকেই বিশাল বাঁশঝাড়
ছিল। দোতলার ঘরে চৌকিতে বসে পুবের জানলা দিয়ে তাকালে বাঁশঝাড়সহ মামার বাড়ির সমস্ত রাস্তাটা
দেখা যেতো। হটাৎ চোখে পড়লো কালোমাথার হলুদ রঙের একটা পাখি খুব লম্বা একটা
বাঁশের গায়ে বসে বসে ডেকে চলেছে। দিদিমা বললো অই দেখ্,অই দেখ্ আমাদের ইষ্টিকুটুম
এখনও বসে আছে। ছোটবেলার এমন ছোট ছোট বহু ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে হলুদপাখির সঙ্গে আমার পরিচয়। তখন বিশ্বাস হতো
হলুদপাখি ডাকলেই বাড়িতে সত্যিই বুঝি কুটুম আসে। ‘খোকা হোক’ বললে সত্যিই হয়তো ‘খোকা হয়’!
আমি কিন্তু যতবারই হলুদ পাখির ডাক শুনি মনে হয় পাখিটা বলছে “হো..ক খুকু”,“হো..ক খুকু”!আসলে পাখি বলে নিজের মতো করে আর আমরা বুঝি আমাদের মতো করে।
গতবছর,বেশ ক’দিন ধরে দেখেছি হলুদ পাখিটা করঞ্জা গাছ থেকেই বেশিরভাগ সময় ডাকছে আর আমি তাকিয়ে
দেখলেও সে আর উড়ে পালাচ্ছে না! খুব ভালো করে লক্ষ্য করলাম বার
বার শুকনো ঘাস, লতা-পাতা বয়ে নিয়ে গিয়ে
ওই করঞ্জা গাছেই বসছে। কিন্তু এখন আর একা নয়। দুজনে একসঙ্গে আসছে, বসছে। আমিও খুব কৌতূহলী হয়ে ওদের নজরে রাখছি। গাছটার ঠিক নীচেই আমার ঘর। তাই গাছের তলা থেকে ওপরের ডালটা সম্পূর্ণ দেখা
যায় না। দু’তিন দিন আর সেভাবে নজর করিনি। দিনকয়েক পরে হঠাৎ গাছের দিকে তাকিয়ে দেখি ওরা কি সুন্দর
বাসা বানিয়েছে! দুটো ডালের মধ্যে খুব শক্তপোক্ত করে একটা
ঝুলন্ত বাসা বানিয়েছে যাতে দমকা হাওয়ায় বা ঝড়-ঝঞ্ঝায় সেটা উপড়ে
পড়ে না যায়।
পাখিদের মধ্যে টুনটুনি এবং বাবুই পাখি বাসা তৈরি করে খুব
নিখুঁত এবং নিপুণ কায়দায়। বাসা তৈরিতে এদের খ্যাতিও আছে। কিন্তু বেনে বউ বা হলদে পাখির বাসা সচরাচর চোখে পড়ে না বলে ধারনাই ছিল না, যে এরাও
বাসা তৈরিতে যথেষ্ট কুশলী শিল্পী। প্রথমে,বাসাটাকে দুটো ডালের সঙ্গে সুন্দর করে
বেঁধেছে। খুব লম্বা ফিতের মতো গাছের ছাল বা গুল্ম গাছের শিকড়
দিয়ে এ-ডাল থেকে ও-ডালে বহু পাক দিয়ে জড়িয়ে
সুন্দর একটা দোলনা তৈরি করেছে। তারমধ্যে আস্তরণ দিয়ে বেশ একটা ঝুলন্ত গোলাকার বাটি মতো তৈরি করেছে যার দু-ধারে কাপের
মতো হাতল আছে। আর বাটি বা কাপের হাতলটা গাছের ডালের সঙ্গে শিকড় অথবা গাছের ছাল দিয়ে খুব শক্ত
করে বেঁধে রেখেছে।
প্রথম ক’দিন দেখেছিলাম
ঘাস লতা, শুকনো পাতা বয়ে নিয়ে যেতে। দেখার আগ্রহ বাড়তে লক্ষ্য করলাম ছোট ছোট পোকা, শুঁয়োপোকা
এই সবও মুখে করে নিয়ে যেতে। কারণ, মা ও ছানা দুজনেরই এই সময় প্রোটিন খুব
প্রয়োজন। বাসা তৈরির পর থেকে ডিম ফুটে বাচ্চা বেরুনো পর্যন্ত প্রায় রোজই আমি সময় পেলে একবার
না একবার লক্ষ্য করেছি। আর মাঝে মাঝে দু একটা ছবিও তুলেছি। ছবি তোলার পর এদের বাসা তৈরির ঘটনা লিখতে বসেছি।
ওরে বাবা! কারা যেন আসছে। একটু ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে থাকি। অপ্রাপ্তবয়স্ক হলুদ পাখি।
পাখি পরিচিতি : হলুদ পাখি/বেনে বউ/ ইষ্টিকুটুম/কুটুমপাখি ইত্যাদি আরও অনেক নাম আছে।
ইংরেজি নাম : Black hooded Oriole.
বৈজ্ঞানিক নাম :Oriolus Xanthornus.
হলুদ পাখির মাথা গলা ও বুকের উপরের
দিক, ডানা ও পুচ্ছ কালো রং-সহ দেহের অবশিষ্ট অংশ উজ্জ্বল সোনালী হলুদ রঙের। গোলাপী রঙের ঠোঁট,আর গাঢ় লাল রঙের চোখ। স্ত্রী ও পুরুষ একইরকম
দেখতে, তবে স্ত্রী পাখির মাথার রঙ কিছুটা
ফ্যাকাশে। এরা আকারে ময়না পাখির মতো। অপরিনত পাখিদের কপালের রঙ হলুদ। কালো মাথায় হলুদ দাগ
দেখা যায়।
বেনেবউ অন্য পাখির বাচ্চাকে নিজের বাচ্চার মতোই লালন-পালন করে। কোকিল (Asian Koel) এবং ‘চোখ গেলো’ পাখি (Common Hawk-Cuckoo) চুপি চুপি এসে বেনেবউয়ের বাসায় ডিম পেড়ে গেলে বেনেবউ দম্পতি দিব্যি সেই ডিম ও ছানার পালক পিতা-মাতা হয়ে যায়। অন্যের বাচ্চা বুঝতে পেরেও তারা নিজের বাচ্চার সঙ্গেই তাদের বড়ো করে তোলে।
‘চোখগেল’বা
কোকিল’রা ভাবে খুব ধোঁকা দিয়েছি ওকে। হলুদপাখি ভাবে….ওদের বাচ্চা আমার বাচ্চাদের থেকে আকারে অনেক বড়ো আর তাড়াতাড়ি বাড়ে! খাবার বেশি খায়! কিন্তু কি করা যাবে। ওরা তো বাচ্চা, ওদের
তো কোনও দোষ নেই। তাই অন্য কেউ আমাদের
বোকা ভাবে ভাবুক।
এরা বিভিন্ন কীটপতঙ্গ খায়। ফুল ও ফলের রস খেতে পছন্দ করে। ফাগুন মাসে বনে বনে যেন আগুন লাগে শিমুল পলাশ ফুলের ছোঁয়ায়। সেই সময় হলুদ পাখি লাল শিমুল পলাশ ফুলের ওপর সারাক্ষণ বসে থাকে। আর ফুলের ভেতরে মুখ
ঢুকিয়ে দিয়ে ফুলের মধু এবং ফুলের গর্ভদণ্ডের ভেতর থেকে রস বার করে মনের সুখে পান করে। এই সময় ফাল্গুন মঞ্জরী গাছটা গোলাপী রঙের ফুলে ভরে ওঠে। এই গাছের ফুলেতে যেমন মিষ্টি গন্ধ তেমনই রসে টইটুম্বুর থাকে
ফুলগুলো। গাছের তলা দিয়ে যাবার সময় ফোঁটা ফোঁটা
রস গাছটা থেকে গায়ের উপর পড়ে। হলুদ পাখি গোলাপী
ফাল্গুন মঞ্জরী/বসন্ত মঞ্জরী গাছে যখন
বসে থাকে তার অপরূপ শোভা পরিলক্ষিত হয়। লাল, হলুদ, সবুজ,
গোলাপী সব রঙ মিশে একাকার হয়ে যায়।
এপ্রিল থেকে জুলাই-আগষ্ট এদের প্রজননকাল। এই সময় বেনেবউ দম্পতি মেতে ওঠে প্রেমের নেশায়, ঘর বাঁধার স্বপ্নে। সেই সঙ্গে মাতাল করা শিমুল পলাশ মহুয়া
মান্দার ছাড়াও বিভিন্ন ফুলের মধু খাওয়ার নেশায় ওরা ছুটে বেড়ায়।
ক্রমশ ………
১৯তম পর্ব পড়ুন আগামী শনিবার ।
বিঃদ্রঃ – সব ছবি এবং ভি ডি ও লেখিকার নিজের তোলা ।
লেখিকার জীবনের সঙ্গে গল্প অঙ্গাঙ্গিকভাবে জড়িয়ে আছে। যা দেখেন, যা শোনেন, যা শোনেন, যা কিছু স্মৃতির পাতায় জড়িয়ে আছে মনের সাথে,তাই নিয়ে লিখতেই বেশি পছন্দ করেন।
লেখা শুরু স্কুল-ম্যাগাজিন, কলেজ -ম্যাগাজিন দিয়ে। বর্তমানে কিছু লেখা প্রকাশিত হচ্ছে কয়েকটি মাসিক-ত্রৈমাসিক পত্রিকায়। বর্তমানে বার্ড’স ফটোগ্রাফী এবং “পাখি-প্রকৃতি” নিয়ে লেখা শুরু করেছেন।