১৫তম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন ।
লেখিকার অন্যান্য লেখা পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
১৬তম পর্ব শুরু ……
পাপিয়া
(Common
Hawk Cuckoo)
‘পাখি’ মানেই দু’খানা ডানা নিয়ে অনন্ত আকাশে উড়ে চলা। অসীম শূন্যে মুক্তির
বিচরণ! কিন্তু নাঃ,কক্ষনোও তা সত্যি নয়। দূর থেকে অনেক কিছু
মনে হলেও পাখিদের কথা জানতে গিয়ে দেখেছি ওরাও মনুষ্য প্রজাতির মতোই সমাজবদ্ধ,সংসারী প্রাণী। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তারা সন্তানের প্রতি যত্নবান দম্পতি।
এদের জীবন খুবই বৈচিত্র্যপূর্ণ এবং বর্ণময়। বস্ত্রের চাহিদা না থাকলেও,খাদ্য-বাসস্থান,শারীরিক এবং প্রাকৃতিক চাহিদা মোটেও
গৌণ নয়।
“বউ
কথা কও”,”পিয়া বোলে পিউ বোলে”,”বোল রে পাপীহারা”,”চোখ গেল চোখ গেল কেন ডাকিস রে”,অথবা নজরুলের ”পিউ পিউ বিরহী পাপিয়া”…..প্রতিটা বিখ্যাত গানের কলি শুধুমাত্র পাপিয়াদের নিয়েই লেখা
হয়েছে। পাপিয়াকে আমি আগে কখনও চোখে দেখিনি। তবে তার ডাক শুনেছি বহুবার। কতসময় আমার
বাড়ির আশেপাশেই ডাক দিয়ে চলে যায়। বাগানে বসে ডাকতেই থাকে। খুব মন ছুঁয়ে যায় সেই ডাক।
এতদিনের আশা পূর্ণ হয়েছিল যখন ওকে দেখতে পেয়েছিলাম। তাও হাত বিশেকের দূরত্বে।
“ধন্যি
মেয়ে” সিনেমার গান….”যা
যা বেহায়া পাখি যা না” গানটা বাজলেই পাখির ডাকটা মনে পড়ে যায়। আর সিনেমার
সিকোয়েন্সটা তো ভোলা যায় না! গল্পে,গানে,সিনেমায়, সাহিত্যিকদের রচনায় সবসময় ফিরে ফিরে এসেছে,‘বউ কথা ক…..ও’,‘চোখ গেল’,পিউ কাঁ..হা…. পিউ কাঁ..হা আর পাপিয়া পাখির নাম! ওই ডাকটার সঙ্গেও ছোটবেলা
থেকে বিভিন্ন সময়ে আমরা কমবেশি অনেকেই পরিচিত। শহর ছেড়ে একটু গ্রামের দিকে এখনও মাঝে
মাঝে ভীষণ গ্রীষ্মের নিঃঝুম দুপুরে,উদাসী বিরহী
পাপিয়ার ডাক শুনতে পাওয়া যায়। এখনও নিঃস্তব্ধ দুপুর হঠাৎই মুখর হয়ে ওঠে করুণ
পাপিয়ার ডাকে।
ঠিক কবে থেকে পাখিদের প্রতি আমার কৌতূহল গড়ে উঠেছে মনে নেই,তবে প্রতিদিন একটু একটু করে নজর করতে করতে পাখি চিনেছি। নাম ধাম একটু একটু করে জেনেছি। আর তাতেই জানার আগ্রহ বেড়ে গিয়েছে। এখন পাখির ডাক কানে এলেই খুঁজতে থাকি কোথা থেকে সে ডাকছে! কি তার নাম! কোথায় তারা বাসা বাঁধে আর কেমনই বা দেখতে তাদের সাধের বাসাখানা! পাখিটার বাড়ি এদেশে না বিদেশে! এরা লোকালয়ের কাছে আসলেও বড়ো বড়ো গাছের উপরের দিকে পাতার আড়ালে লুকিয়ে লুকিয়ে ডাকে। ইদানিং প্রায়ই ওর ডাক শুনতে পাচ্ছিলাম।
মাস কয়েক আগে খুব ঘন ঘন ডাক শুনতে পেয়ে সন্ধানী চোখে খুঁজছিলাম। তারপর দেখি নতুন অতিথি সজনা গাছের ডালে খুব শান্ত আর মন মরা হয়ে বসে আছে। দরজা খুলে বাগানে বেরিয়ে অতিথি আপ্যায়ন করতে গেলে যদি ভুল বুঝে ফিরে যায়! তাই বাড়ির উঠোন থেকেই কয়েকটা ছবি তুলেছিলাম। কিন্তু সেদিন আকাশ বেশ মেঘলা ছিল তাই ছবিগুলো ভালো হয়নি। তবে হ্যাঁ,ওটা যে পাপিয়া সেটা প্রথমে দর্শনে বুঝতে পারিনি। ওর চোখ এবং গাছের ডালে বসার ধরণ দেখলেই প্রথমেই মনে হবে এটা হয়তো কোনও শিকারি বাজ পাখি বসে আছে। দেখতেও খানিকটা শিকারী বাজের মতোই। পরক্ষণেই চমকে উঠেছিলাম ডাক শুনে। এর সুরেলা কণ্ঠস্বর শুনলে মন ভরে ওঠে। দেখতে কুৎসিত হলেও সুমিষ্ট গান সকলের মন ভরিয়ে দেয় কিন্তু এত কাছে পেয়েও সুন্দর করে ছবি তুলতে না পারায় খুব আফশোষ ছিল।
আশায় ছিলাম যদি আবার দেখতে পাই। দিন কয়েক আগে সেই আশা পূর্ণ হলো। দুপুরবেলা হঠাৎই কত্তামশাইয়ের চোখ পড়লো আমগাছের মোটা শাখার মাঝামাঝি একটা ডালে। (আমি পাখির ছবি তুলি বলে উনিও আমায় খুশি করতে চোখ রাখেন পাখির দিকে)। সেদিন আমি ব্যস্তছিলাম দুপুরের আহারের পরবর্তী অধ্যায়ে। খেয়ে উঠে হাত ধুতে নেমেই কিছু একটা দেখে,ইশারা করলো আমায় আমগাছের দিকে তাকাতে। এক নিমেষে দেখেই আমি তাড়াতাড়ি ক্যামেরা বার করে নিয়ে এলাম। দুপুরের একফালি রোদ পড়েছে গাছের উপর। আর সেখানে পাশাপাশি ঘেঁষাঘেঁষি করে বসে আছে দুটো পাপিয়া। অসম্ভব ক্ষিপ্র ওদের দৃষ্টি শক্তি। আমার দিকে নজর পড়তেই তৎক্ষণাৎ দুজনে আলাদা হয়ে গেল। সম্ভবতঃ স্ত্রী পাপিয়াটা করুণ মুখে আমার দিকে তাকাতেই আমি ওর ছবি তুললাম। খুব আফশোষ করছিলাম ওদের জোড়া ছবিটা না পাওয়ায়। আবার খারাপ লাগছিল ওদের মেটিংটা ভেঙে যাওয়ায়।
রসালো নরম ছোট ফল এদের খুবই প্রিয়। তাই,আম জাম লিচু জাতীয় রসালো ফল গাছের উপরেই এদের দেখা যেতে পারে। এরা প্রজনন মৌসুম ছাড়া একা একাই ঘুরে বেড়ায়। নির্ঝঞ্ঝাট একাকী ঘুরে বেড়াতেই এরা সচ্ছন্দ। সাধারণতঃ মে থেকে আগস্ট এদের প্রজনন ঋতু। এইসময় এরা জোড়ায় জোড়ায় থাকার চেষ্টা করে। কোকিলের প্রজাতি অর্থাৎ কুকুলিডা পর্বভুক্ত । তাই এই সময় পুরুষ কোকিলের মতোই পুরুষ পাপিয়ার সুর উথলে ওঠে এই সময়। দিন-রাত ডাকতে থাকে ‘চোখগেলো চোখগেলো’ অথবা ‘পিউ-কাঁহা পিউ-কাঁহা’ সুরে। সে ডাকটা যখন বেশি প্রকট হয়ে ওঠে,তখন বুঝতে বাকি থাকে না যে এটা পুরুষ পাখির কন্ঠস্বর। মাঝে মাঝে সারারাত ধরেও ডাকতে শোনা যায়। তবে,ওদের সুরে রয়েছে চমৎকার তাল-লয়। ডাকতে শুরু করলে নিচু স্বর থেকে ধীরে ধীরে উচ্চৈঃস্বরে ডাকতে থাকে তারপর হঠাৎই ডাকটা থেমে যায়। সেই সুরেও থাকে অদ্ভুত এক ধরনের মাদকতা। ডাকটা একবার শুনলেই কান খাড়া হয়ে ওঠে আবার শোনার জন্যে।
কোকিলের
মতো ওদেরও মাত্র কয়েকটা দিনের দাম্পত্য,তাও আবার সেই
শর্তসাপেক্ষে। এই ক’দিন ধরে মিলনের আশায় পুরুষ পাপিয়ার গগনভেদী আর্তচিৎকার শুনে
শুনে মনটা আবেগে ভরে উঠছে। স্ত্রী পাপিয়া লুকিয়ে বসে চুপ করে সে ডাক শোনে কিন্তু
সাড়া দেয় না। আবার কখনও খুব ছোট্ট করে ডেকে স্ত্রী পাপিয়া অন্য কোনও গাছে ছুটে চলে
যায় নিজের অবস্থান বোঝাতে।
পাখি পরিচিতি : পাপিয়া/চোখ গেল/ পিউ কাঁহা। ইংরেজি নাম : Common Hawk Cuckoo. বৈজ্ঞানিক নাম হলো Hierococcyx varius.
পাখির
নাম নির্ধারিত হয় তাদের আচার আচরণ, খাদ্যাভ্যাস,বাসা তৈরির পদ্ধতি এবং তাদের প্রকৃতি অনুযায়ী। ইংরেজি “Hawk” মানে বাজ পাখি। শিকরা বাজের সঙ্গে সাদৃশ্য রয়েছে বলে পাপিয়ার ইংরেজি
নামের সঙ্গে Hawk যুক্ত হয়েছে। আর সাধারণ কোকিলের প্রজাতি বলেই এদের নাম Common
Hawk Cuckoo. এদের Common hawk- cuckoo ছাড়াও Brain fever bird এবং বাজপাখি কোকিলও বলা হয়। বিভিন্ন ধরনের পাপিয়া আছে তার মধ্যে আমাদের
লোকালয়ের কাছাকাছি যারা আসে তারা হলো বউ কথা কও, চোখ গেল,খয়েরি পাপিয়া,করুণ পাপিয়া,উদয়ী
পাপিয়া। প্রকৃতিগত ভাবে তারা একইরকম। গ্রামেগঞ্জে বিভিন্ন নামে তাদের ডাকা হয়।
এরা
লম্বায় ৩৩-৩৪ সেন্টিমিটার। ঠোঁট তীক্ষ্ণ। মাথা
থেকে লেজের প্রান্ত পর্যন্ত ধূসর। তবে লেজের ওপর কিছু কালো বলয় রয়েছে। গলার নিচ
থেকে বুক পর্যন্ত লালচে বাদামি। বুকের দু’পাশে সরু বাদামি দাগ। চোখের তারা,চক্ষু বলয় হলুদ রঙের।পা আর আঙুল হলুদ। স্ত্রী-পুরুষ পাখিতে তেমন কোনও
পার্থক্য নজরে পড়ে না। মানুষের বসতির আশেপাশে হালকা গাছপালাযুক্ত অঞ্চলে,পার্কে বা বাগানে বাস করে। এরা কোকুলিফর্মস বর্গের অন্তর্ভুক্ত। অর্থাৎ
প্রাকৃতিক নিয়মে ডিম পাড়তে সমর্থ হলেও,কোকিলের মতো এরাও বাসা
তৈরী করতে অপারগ। সুযোগ বুঝে ছাতারে,বুলবুলি এমনকি দুর্গা
টুনটুনি পাখির বাসায়ও ডিম পেড়ে চলে আসে। তবে প্রতিবারই একটা করে ডিম দেয়। অন্য
পাখিরা নিজেদের ডিম ভেবে তা দেয় আর দূর থেকে পাপিয়া নজর রাখে। ডিম ফুটলেই সেটা
নিয়ে চলে যায়। সাধারণ সমতলভূমি ছাড়াও পাহাড়ী এলাকায় যেখানে শাল পিয়াল মহুল বা
মহুয়া গাছ আছে সেই সব জায়গা পাপিয়ার বেশি পছন্দের। ডিসেম্বরের হাড় কাঁপানো ঠান্ডায়
পুরুলিয়ার বানসা পাহাড়ে গিয়েও অনেকবার ডাক শুনে ঘুরে তাকিয়ে পাপিয়াকে দেখেছি পাতার
আড়ালে লুকিয়ে বসে থাকতে। প্রকৃতির অলঙ্কার পাখি। অথচ প্রকৃতি থেকে পাখিরাই একটু
একটু করে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে প্রায় প্রতিদিন। প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা করতে হলে
পাখিদের হারিয়ে যেতে দেওয়া যাবে না।
ক্রমশ
………
১৭তম পর্ব পড়ুন আগামী শনিবার ।
বিঃদ্রঃ – সব ছবি এবং ভি ডি ও লেখিকার নিজের তোলা ।
লেখিকার জীবনের সঙ্গে গল্প অঙ্গাঙ্গিকভাবে জড়িয়ে আছে। যা দেখেন, যা শোনেন, যা শোনেন, যা কিছু স্মৃতির পাতায় জড়িয়ে আছে মনের সাথে,তাই নিয়ে লিখতেই বেশি পছন্দ করেন।
লেখা শুরু স্কুল-ম্যাগাজিন, কলেজ -ম্যাগাজিন দিয়ে। বর্তমানে কিছু লেখা প্রকাশিত হচ্ছে কয়েকটি মাসিক-ত্রৈমাসিক পত্রিকায়। বর্তমানে বার্ড’স ফটোগ্রাফী এবং “পাখি-প্রকৃতি” নিয়ে লেখা শুরু করেছেন।