ধারাবাহিক – প্রতি শনিবার ।
১৪তম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন ।
লেখিকার অন্যান্য লেখা পড়তে এখানে ক্লিক
করুন ।
১৫তম পর্ব শুরু …………
মোহনীয় মোহনচূড়া (Hoopoe)
"কিমোনো" জাপানীদের একটি ঐতিহ্যবাহী পোশাক। বিশেষ করে কোনও সামাজিক অনুষ্ঠানে জাপানি মহিলারা সকলেই কিমোনো পরেন। কিমোনো হল গলা থেকে কাঁধ পর্যন্ত ঢাকা এবং পা পর্যন্ত লম্বা বিশেষ পোশাক।
জাপানী মহিলারা এক
ধরনের হাত পাখা ব্যবহার করেন। ওদের ভাষায় ওই হাত পাখাকে হ্যারিসেন (Harisen) বলে। আমরা বলি জাপানী পাখা।
মনে পড়ে ছোটবেলায়
খাতার পাতা ছিঁড়ে ছিঁড়ে কত কিছু তৈরি করতাম। কাগজের ফুল,কাগজের নৌকা,কখনও কাগজের রকেট তৈরি করে খেলা করতাম। আবার কখনও খাতা থেকে
পাতা ছিঁড়ে নিয়ে,পাতাটাকে
অনেকগুলো সরু সরু এবং লম্বা ভাগে ভাঁজ করে সেটাকে আবার মাঝখান থেকে ভাঁজ করে নিয়ে
মাঝখানটা হাত দিয়ে চেপে ধরে আঠা দিয়ে জুড়ে দিতাম। তারপর দুপাশ থেকে ভাঁজ খুললেই
জাপানী পাখার মতো আকৃতি হতো। যদিও খাতা থেকে পাতা ছিঁড়লে খুব বকুনি খেতাম। প্রহারও
যে জুটতো না তা নয়।
“কিমোনো পরিহিতা জাপানী মহিলা আর তার হাতে দৃশ্যমান খুব
সুন্দর নকশা করা একটা জাপানী পাখা” এমন ছবি আমরা অনেকেই দেখেছি বিভিন্ন পত্রিকায়,কাগজে,বইয়ের পাতায়। সেই ছবি খুবই ঐতিহ্যবাহী এবং সকলের খুবই
পছন্দের।
যাইহোক,এতক্ষণ যা বললাম সেগুলো নিছকই কিছু কথার কথা।
তবে আমার ছবির পাখি
মোহনচূড়া যখন তার মোহনীয় ঝুঁটিটা মেলে ধরে,তখনই তা দেখে জাপানী হাতপাখার সঙ্গে খুব সাদৃশ্য আছে বলে
মনে হয়। মোহন অর্থাৎ চিত্তাকর্ষক বা মনোহর আর চূড়া অর্থাৎ ঝুঁটি। মোহনচূড়া ঠিক
তেমনি চিত্তাকর্ষক ঝুঁটিওয়ালা একটা পাখি।
ছোটবেলায় ইংরেজি ‘word book’এর পাতায় এই হুপো পাখিটার ছবি দেখতাম। লেখা থাকতো ‘H’ for Hoopoe.ব্যস,জানার গণ্ডি ওইটুকুই ছিল। আর কিছু জানতাম না পাখিটার বিষয়ে।
বাড়ির আশে পাশে ঘরোয়া পাখিগুলোর মতো রোজ যে তাকে দেখা যায়,তাও নয়। তাই প্রায় ভুলতে বসেছিলাম ‘হুপো’ নামে পাখির কথা।
বড় হয়ে জেনেছি পাখিটার নাম মোহনচূড়া। ভারী মিষ্টি নামটা। পাখির রূপের যাদুতে মোহিত
হয়ে নাকি সাহিত্যিক বনফুল পাখিটার নামকরণ করেছিলেন “মোহনচূড়া”। গ্রামে গঞ্জে
"হূদ হূদ" নামেই সে বেশি পরিচিত। কেউ কেউ একসঙ্গে বলে মোহনচূড়া হুদহুদ।
আমার বাগানে বহু
রকমের পাখি আসে। রোজই মনে মনে ভাবি আজ যদি হঠাৎ একটা মোহনচূড়া আমার বাগানে আসে!
যদি দেখি বাগানের ঘাসের ভেতর থেকে ওরা পোকা বা কেঁচো খুঁটে খুঁটে খাচ্ছে! উফ! ভাবা
যায় না! কিন্তু না:,এত আশা
থাকতেও আমার বাগানে আসেনি মোহনচূড়া। ওরা আমাকেই টেনে নিয়ে গিয়েছিল ওদের কাছে।
এর আগে মোহনচূড়া
পাখি দেখেছি দু’একবার। তবে সেটা অনেক দূর থেকে। তখন অবশ্য ছবি তুলতে পারিনি। এবারে
দেখলাম একেবারে সামনে থেকে আর অনেকক্ষণ ধরে। সে এক অবাক বিস্ময়ের দেখা। অপূর্ব
সুন্দর তার রূপ!
একবার ময়ূরের ছবি
তুলতে জ্যাংলা মোড় পেরিয়ে একটা গ্রামের ভেতরে গিয়েছিলাম। জায়গাটা হুগলী জেলাতেই।
অনেকক্ষণ খোঁজাখুঁজির পর একটা পূর্ণ বয়স্ক ময়ূর দেখতে পেয়েছি কিন্তু খুব অল্প
সময়ের ব্যবধানে সে উড়ে গিয়ে বড়ো গাছের মাথার উপর এমন ভাবে বসে পড়লো যে কিছুতেই ছবি
তোলা সম্ভব হল না। তার উপর বর্ষার জল কাদায় পা পিছলে যাচ্ছিলো। নিরাশ হয়ে ফিরে
আসছিলাম,তখনই
একেবারে সামনে এসে নামলো মোহনচূড়া পাখি। একটা দুটো নয়,তিনটে চারটে একসঙ্গে। অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছি,মাথায় যেন একটা রাজমুকুট পরে এসেছে তারা। মাথা জুড়ে খুব
আকর্ষণীয় আর বেশ বড় একটা ঝুঁটি আছে। আর ঝুঁটিটা মেলে ধরতেই মনে হল সুদৃশ্য একটা
জাপানী পাখা যেন কেউ খুলে ধরল। হালকা কমলা রঙের ঝুঁটির পালকের শেষ মাথাটা কালো
রঙের। তবে মেঘলা আকাশ এবং ঝির ঝিরে বৃষ্টি নেমে যাওয়ায় আবারও বাধা পড়লো। ছবি
তুললাম কিন্তু একটুও ভালো হল না!
বি.টি.পি.এস. (Bandel Thermal Power
Station) ক্যাম্পাসের
ভেতর দিয়ে গিয়ে গোপালপুর গ্রাম ফেলে দু-পা এগোলেই ডিভিসির একটা লকগেট আছে। সেই
লকগেটের ধারে ক্যানেল পাড়ে একবার পাখির ছবি তুলতে গিয়েছিলাম। ওটা সম্ভবত: হুগলী
জেলার বলাগড়ের অধীনে। ওখানে বিভিন্ন প্রজাতির প্রচুর পাখি আসে। জায়গাটা একেবারে
সবুজে মোড়া। বড়ো বড়ো গাছ দিয়ে ঘেরা জায়গাটার পরিবেশও খুব সুন্দর। হালকা হাওয়া আর
গাছের ছাওয়ায় বেশ কিছুক্ষণ নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়ানো যায় সেখানে। পাখির ছবি তোলার
জন্যে খুবই আদর্শ জায়গা এটা।
দু-একটা মুনিয়া,ফটিক জল আর একটা সোনা-বউ পাখির ছবি তুলতে পেরে মন দারুণ
খুশি হয়ে উঠলো। পায়ে পায়ে হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে গিয়ে সবে মোটরসাইকেলে উঠতে যাবো এমন
সময় দেখি লকগেট সংলগ্ন জমিতে বেশ কয়েকটা মোহনচূড়া পাখি ঘুরে ঘুরে,খুঁটে খুঁটে খাবার খাচ্ছে। ওটা একটা আমবাগান। সেখানে গাছের
ছায়াও আছে। কিন্তু জায়গাটার অবস্থা দেখে খুব খারাপ লাগলো। পিকনিক পার্টিরা গিয়ে
চারিদিক এত অপরিচ্ছন্ন করে রেখে দিয়ে গিয়েছে যে,পাখির ছবি তুলতে গেলে ওই নোংরাগুলোই ছবিতে দৃশ্যমান হয়ে উঠে
আসছে। তা দেখে ভীষণ খারাপ লাগলো। ছবি না তুলে ক্যামেরা বন্ধ করে দিলাম।
তবে মনে আশা ছিল
যদি আর একবার ধারে কাছে মোহনচূড়াকে দেখতে পাই তাহলে ওর একটা ভালো ছবি তুলবো।
ভাবনা বাস্তব হতে
বেশিদিন সময় লাগেনি। এর কিছুদিন পর আমরা লেহ্-লাদাখ-কাশ্মীর ভ্রমণে গিয়েছিলাম।
লেহ্ থেকে হুন্ডার হয়ে সেদিন আমরা নুব্রা ভ্যালিতে রাত্রিবাস করলাম। পরের দিন
ভোরবেলা বেরিয়ে পড়েছি পাখির ছবি তুলতে। ঠিক করেছি যে পাখি পাবো তারই ছবি তুলবো। এই
মন নিয়ে চলতে চলতে প্রথমেই যার দর্শন পেলাম সে হল মোহনচূড়া (হুপো)। আপেল গাছের
ডালে বসে আছে দেখে আনন্দে লাফিয়ে উঠেছি। আর তখনই সে উড়ে পালালো। তাতে আমার তো
নিজের উপরেই অসম্ভব রাগ হয়ে গিয়েছিল। বুঝতে পারছিলাম না কিভাবে নিজেকে ক্ষমা করবো।
চোখের সামনে হাতের নাগালে পেয়েও কেউ এমন নির্বুদ্ধিতার কাজ করে! নিমেষ ফেলতেই এবার
জোড়ায় জোড়ায় এসে হাজির হল।
আমরা জুন মাস শেষের
দুদিন আগে সেখানে গিয়েছি। তাই সব গাছেই সবুজ আপেল ঝুলে আছে। একটা বোঁটায় পাঁচ থেকে
ছ’টা। দুদিকের দুটো আপেল গাছের মধ্যে দিয়ে ইলেকট্রিকের ওভারহেড তার টানা আছে। আপেল
গাছে মোহনচূড়াকে বসে থাকতে দেখে ক্যামেরা রেডি করতে গিয়ে দেখি ওরা দল বেঁধে তারে
বসে আছে। ওরা তখন সকলেই খুব কাজে ব্যস্ত। কাজ বলতে বাঁকানো ঠোঁট দিয়ে খুব পরিপাটি
করে নিজেদের গা-পালক পরিষ্কার করা। তাছাড়া এ গাছ থেকে ও গাছ ওড়াউড়ি করে নিজেদের
মধ্যে খেলা করছিল।
অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু
হঠাৎ করে পেয়ে গেলে সেই মুহূর্তে মানুষ কেমন যেন ক্যাবলা হয়ে যায়। বুদ্ধি লোপ পায়
বলে মনে হয়! চোখের সামনে এতগুলো মোহনচূড়া দেখে প্রথমটায় বাকরুদ্ধ হয়ে ছবি তুলতে
ভুলে গিয়ে শুধু তাকিয়ে ছিলাম। মন ভরে ছবি তুললাম। সেদিন মোহনচূড়া পাখি ছাড়াও আরও
অনেকগুলো পাখি পেয়েছিলাম।
আবার মোহনচূড়ার দেখা পেলাম কাশ্মীরের কোকারনাগ গার্ডেনে।
অসাধারণ সুন্দর সেই বাগানখানা। টিকিট সংগ্রহ করে গার্ডেনে ঢুকতে প্রথমেই দর্শন
পেলাম মোহনচূড়ার! সবুজ ঘাসের লনে দুলে দুলে ঘুরে বেড়াচ্ছে ঝুঁটি নাড়িয়ে নাড়িয়ে।
প্রথম যখন দেখলাম……
মোহনচূড়া গাছ থেকে
সোজা নেমে এলো মাটিতে। সরু লম্বা এবং বাঁকানো ঠোঁট দিয়ে মাটির ভেতর থেকে কেঁচো বার
করে করে খাচ্ছিলো। দু’পায়ে হেলেদুলে মাটির উপর দিয়ে চলতে চলতে পোকা-মাকড়,পিঁপড়ে যা পাচ্ছে তাই খাচ্ছে। মোহনচূড়া যখন হেঁটে বেড়ায় তখন
তার মোহনীয় ঝুঁটিটাও হাঁটার তালে তালে নড়তে থাকে। খাবারের খোঁজে হেঁটে চলে
বেড়াচ্ছিল আর থেকে থেকেই ঝুঁটিটা সম্পূর্ণ প্রসারিত করছিল।
খেয়াল করলাম এরা
উত্তেজিত হলেই মাথার ঝুঁটিটা মেলে ধরে। আবার স্ত্রী-পুরুষ পাখি একসঙ্গে থাকলেও
তাদের ঝুঁটি প্রসারিত হয়। যতক্ষণ দাঁড়িয়ে পাখিটাকে দেখেছি,তার মধ্যে অন্তত: বার পাঁচ-ছয় ওদের ঝুঁটি মেলতে আর বন্ধ
করতে দেখেছি। তাদের অনন্য রূপের বাহার প্রত্যক্ষ করেছি। আর কখনও সেই সুযোগ পাবো
কিনা জানিনা,তবে মন
ভরে দেখে নিয়েছি মোহনচূড়া’কে।
গভীর জঙ্গল এদের
একদম পছন্দ নয়। মোহনচূড়া মেঠো পাখি। গ্রামের ঘরবাড়ির ধারে কাছে,লম্বা বড়ো গাছের তলায়,ছায়া ছায়া ঘাস জমিতে এদের দেখতে পাওয়া যায়।
পাখি পরিচিতি: মোহনচূড়া/ হূদ হূদ (Common Hoopoe/ Eurasian Hoopoe). বৈজ্ঞানিক
নাম Upupa epops .
মোহনচূড়া পাখির শরীরটা লালচে বাদামি রঙের। ডানা ও লেজে সাদা
ও কালো দাগ আছে,যা জেব্রা
স্ট্রাইপ বলে পরিচিত। শুধু মোহনীয় ঝুঁটি নয়,এরা পালক মেললেও খুব সুন্দর দেখতে লাগে।
মার্চ থেকে জুন মাস পর্যন্ত মোহনচূড়ার প্রজনন মৌসুম। গাছের
কোটরে অথবা পুরনো বাড়ির ফাটলে/ ফাঁক ফোকরে এরা বাসা বাঁধে। একসঙ্গে ৫-৬ ডিম পাড়ে।
স্ত্রী পাখি ডিমে টা দিয়ে ১৮-২০ দিনের মধ্যে বাচ্চা ফোটায়।
এরা সাধারণত: হেঁটে
হেঁটে খাবার সংগ্রহ করে মাঠ ঘাট,নদীর চর,খেতি জমি থেকে। এরা অসম্ভব জোরে হাঁটতে পারে তেমনি জোরে
দৌড়তে পারে। এদের মূল খাদ্য পোকামাকড়,শুঁয়োপোকা,কুমরে পোকা,গুবরে পোকা,ঝিঁঝিঁ,ঘাস ফড়িং ছাড়াও কেঁচো এবং পুঁইযে সাপ।
বর্তমানে গ্রামগুলো
রূপান্তরিত হয়ে প্রতিনিয়ত গড়ে উঠছে ইট,কাঠ পাথরে বাঁধানো শহর। চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছে শহুরে জৌলুস। কমে যাচ্ছে
পাখিদের বিচরণ ক্ষেত্র। গ্রাম্য সৌন্দর্য হারিয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে নিশ্চিহ্ন হয়ে
গিয়েছে অনেক বর্ণময় পাখি। মোহনচূড়ারাও হারিয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। প্রকৃতির অনন্য
সৌন্দর্যের অনেকটা অংশ জুড়ে আছে বর্ণময় বিভিন্ন পাখি। আর পাখিরা হারিয়ে গেলে
প্রকৃতির ভারসাম্য হারিয়ে যাবে! পাখিদের বিচরণ ভূমি যাতে নষ্ট না হয় সেদিকে
আমাদেরই লক্ষ্য রাখা দরকার।
ক্রমশ ………
১৬তম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন ।
বিঃদ্রঃ – সব ছবি এবং ভি ডি ও লেখিকার নিজের তোলা ।
লেখিকার জীবনের সঙ্গে গল্প অঙ্গাঙ্গিকভাবে জড়িয়ে আছে। যা দেখেন, যা শোনেন, যা শোনেন, যা কিছু স্মৃতির পাতায় জড়িয়ে আছে মনের সাথে,তাই নিয়ে লিখতেই বেশি পছন্দ করেন।
লেখা শুরু স্কুল-ম্যাগাজিন, কলেজ -ম্যাগাজিন দিয়ে। বর্তমানে কিছু লেখা প্রকাশিত হচ্ছে কয়েকটি মাসিক-ত্রৈমাসিক পত্রিকায়। বর্তমানে বার্ড’স ফটোগ্রাফী এবং “পাখি-প্রকৃতি” নিয়ে লেখা শুরু করেছেন।