ধারাবাহিক
– প্রতি শনিবার
১২তমপর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন ।
১৩তম
পর্ব শুরু ……
কাক নিয়ে কত কথা
……………………………
“নাই
বা আমি সুন্দর হলাম কি’ই বা আসে-যায়
অসুন্দর
কত যে দেখি,সবই তো গড়েছেন বিধাতায়”
ফেলে আসা শৈশবটাকে মাঝে মধ্যেই
যেন সামনে দেখতে পাই।
কত রকমভাবে সে ফিরিয়ে
নিয়ে যেতে চায় আমাকে।
ফিরে যাবার জন্যে
আমার চোখদুটো চকচকে হয়ে ওঠে। কত ঘটনা মনে পড়ে যায়। কিন্তু
চাইলেও তো যেতে পারি না! এই তো,কাকের কথা লিখতে গিয়েই মনে পড়ে গেল কত কথা…..
সেই
কোন ছোট্টবেলায় হয়তো
বা সবে হামাগুড়ি দিতে শিখেছি,যা পাই তাই খুঁটে মুখে দিয়ে দিই! তখন থেকেই পাখ-পাখালীর সঙ্গে আমার পরিচয়। সেইসময় কাক বলতে বুঝতাম কালো রঙের একটা পাখি,কা,কা করে ডাকে।
খুব আবছা মনে পড়ে, আমি তখন একটু বড়,সবে
নিজে হাতে খেতে শিখছি,মা
ভাত মেখে গোল গোল নাড়ুর মতো করে থালায় সাজিয়ে দিয়ে নিজের চোখদুটো বন্ধ করে বলতো “কে খায় কে খায়,কাক খায়
না বক খায়,দেখি দেখি!সেই কথা শুনেই একটা
ভাতের নাড়ু টপ করে মুখে ভরে দিয়ে তাড়াতাড়ি চিবিয়ে খেয়ে নিতাম। আর তক্ষুনি মা চোখ খুলে বলতো…..কে খেলো! আমি বলতাম কাক এসে খেয়ে নিয়েছে। আবার মা চোখ বুঁজতো,’কে খায় কে খায়’…. ভাই হাঁ করতো আর মা তার মুখে ভাতের ড্যালা গুঁজে দিয়ে বলতো….. ওমা! কাক এসে ভাতটা খেয়ে গেল বুঝি!
তখনকার আমরা খুব সহজ সরল শিশু ছিলাম।
মায়েদের কাছ থেকেই তখনকার আমরা ঘরোয়া পাখিগুলোকে চিনেছি। কাক,বক,শালিক,চড়ুই,টিয়া, টুনটুনি,বুলবুলি পাখিদের
নিয়ে কত গল্প,কত গান,কত ছড়া প্রতিদিন শুনতাম। সেই থেকেই পাখির প্রতি আমার খুব কৌতূহল ছিল। সে যাইহোক, পাঠশালার পাঠ শেষ করে প্রথম শ্রেণী পেরিয়ে
দ্বিতীয় শ্রেণীর প্রকৃতি-বিজ্ঞান বই পড়ে জেনেছিলাম কাককে
‘ঝাড়ুদার’ পাখি বলা হয়। কাক সব আবর্জনা খেয়ে নিয়ে আমাদের পরিবেশকে পরিচ্ছন্ন রাখে। তাই কাককে ‘পরিবেশ বন্ধু’ বলা হয়।
আমাদের
জীবনে ভিন্ন ভিন্ন বিষয়বস্তু নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন অভিজ্ঞতা থাকে। একবার কাক নিয়ে আমার বীভৎস অভিজ্ঞতা হয়েছিল। সময় লেগেছিল সেই ভীতি কাটাতে।
বেশ কয়েক বছর আগের ঘটনা……
আমাদের
বাড়ির সামনে বহু পুরোনো একটা গুলঞ্চ/গোলকচাঁপা ফুলের গাছ
আছে।
সেই গাছে এক কাক-দম্পতির বাসা ছিল। মার্চ মাস থেকে জুলাই মাস (প্রজনন ঋতু),প্রতিবারই
ডিম পাড়ার সময় কাক দম্পতি ওই গাছেই এসে বসে থাকতো। গুলঞ্চ গাছটার সামনে একটা ইলেক্ট্রিকের ট্রান্সফরমার আছে। একদিন সকালে কাকেদের বিরক্তিকর কোলাহলে তাড়াতাড়ি
বাইরে বেরিয়ে এসেছি।
এমনিতেই অকারণে কাকের
চিৎকার অশুভ ইঙ্গিত বহন করে বলে ছোট থেকে শুনেছি। বাইরে
এসে দেখি একটা কাক ট্রান্সফরমারের উপরে মরে পড়ে আছে। আর
বাকি কাকগুলো ওর চারপাশে উড়ে উড়ে কা… কা… করে ডেকেই চলেছে। পরেরদিন দেখি জোড়া কাকের একটা ওই গাছেই চুপ করে বসে আছে। ওই সময় কাকটার গলার স্বরটা কেমন যেন ধরা ধরা
শুনতে লাগছিল। তার কা…কা… ডাকটা
স্বাভাবিক ডাকের থেকে খানিকটা আলাদা হয়ে উঠেছিল। অনেকেই ঠাট্টা করে বলেছে কাকটার গলা ধরে গেছে
না কি!
সপ্তাহখানেক
পর থেকে সঙ্গী/সঙ্গিনীহারা কাকটা সকলের কাছে খুবই আতঙ্কের হয়ে
উঠেছিল। ঠোঁট দিয়ে সে সক্কলকে
ঠোক্কর মারতে শুরু করলো। গাছের
সামনে দিয়ে যে কেউ গেলেই আচমকা পিছনদিক থেকে এসে ভীষণ জোরে ঠোক্কর মেরে পালিয়ে যেতে। বিশেষ করে বাচ্চা ছেলে-মেয়েদের অবস্থা বেশ সঙ্গীন হয়ে উঠেছিল। আমাদের এখানে হিন্দি,বাংলা আর ইংলিশ মিডিয়াম মিলে তিনটে স্কুল
আছে। স্কুলগুলোতে যাবার রাস্তায় এই গুলঞ্চ গাছটা
আছে আর গাছের ডালে আছে কাক। কাকের
ভয়ে তটস্থ সকলে কোনওমতে জায়গাটা পেরিয়ে যেতো।
আমার
ছেলে তখন ক্লাস থ্রি’তে পড়ে। একা একা বাইরে বেরিয়ে বার কতক ওই কাকের ঠোক্কর খেয়ে ছুটে
ঘরে পালিয়ে আসতো। কাকের ঠোঁট ভীষন শক্ত
আর মুখের দিকটা খুব সার্প-পয়েন্টেড।
একদিন স্কুল ছুটির
পর আমি ছেলেকে নিয়ে এসে বাড়ির গেটের তালা খুলছি,এমন সময় কাকটা পিছন থেকে এসে অসম্ভব জোরে
ঠোক্কর দিতেই আমি চেঁচিয়ে উঠলাম, তারপর দেখি ছেলেটার মাথার চামড়া
ফুটো হয়ে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে!সকলে
আরও সতর্ক হয়ে উঠলো কাকটাকে নিয়ে।
কি ব্যবস্থা করা যায়
কেউ ভেবে পাচ্ছে না।
খুব কাছাকাছি থাকেন
এমন একজন বনদপ্তরের কর্মী খবর পেয়ে এলেন এখানে কাকটাকে দেখতে। অফিসের বাইরে তাঁর পরিচয় একজন বার্ডার হিসাবে। সব শুনে তিনি জানালেন যে কাকটা পাগল হয়ে গিয়েছে। ট্রান্সফরমারের উপর বিদ্যুৎপৃষ্ঠ হয়ে মারা
যাওয়া কাকটা নিশ্চয়ই ওরই সঙ্গী/সঙ্গিনী ছিল।
এই মৃত্যুটা সে মেনে
নিতে পারছে না বলেই এমন আচরণ করছে। মানুষের মতো পাখিদেরও এমন মানসিক আঘাত হয় যা থেকে তার মধ্যে অস্বাভাবিক আচরণ
আসতে পারে। শুনে অবাক হয়েছিলাম। তারপর পাখিদের জীবন নিয়ে দু একটা বই নাড়াচাড়া করতে গিয়ে অবাক করা আরও অনেক কিছুই জেনেছি ওদের সম্মন্ধে।
ওনার
কাছেই শুনেছিলাম কাক’রা একবার জোড় বাঁধলে নাকি জীবনভর সেই জোড় ভাঙে না। আমি সেই কথাটার সত্য- মিথ্যা যাচাই করতে যায়নি। তবে শুনেছি যে একজোড়া স্ত্রী অথবা পুরুষের একজন যদি মারা যায় তবে অন্যজন নাকি বাকি জীবনটা একাই কাটিয়ে দেয়। তবে আবার জোড়ের
একজন কোনও কারণে মারা গেলে অন্যজন কিছুদিন পর অন্য কোন একা থাকে
এমন কোনও কাকের সঙ্গে আবার জোড় বাধে। এ ক্ষেত্রেও মানুষের সঙ্গে পাখিদের সমাজের খুব বেশি পার্থক্য নেই। তবে, ওই ঘটনার কয়েকমাস বাদে ওই কাকটাকে আর ধারে কাছে খুঁজে
পাওয়া যায়নি। কাকটা চলে যাওয়ায়
সবাই স্বস্তি পেয়েছিল।
কাক
সবথেকে পরিচিত পাখি।
তার স্বভাব বৈশিষ্ট্য
বা আচরণ সকলেরই জানা আছে।
অন্য পাখি না চিনলেও
কাক দেখেনি বা চেনে না এমন কেউ নেই। পাখিদের নিয়ে যখন থেকে লেখা শুরু করেছিলাম তখনই ভেবেছিলাম শুধু আমার নয় সকলের
অপছন্দের এই কালো পাখিটাকে নিয়ে কোনওদিন কিছু লিখবো না। কিন্তু সেদিন যা ঘটলো তারপরেও ওকে নিয়ে একটু কিছু না লিখলে
হয়তো আমার মাথাটাই কোনদিন ফুটো করে দেবে ঠোক্কর মেরে মেরে।
সেদিন দুপুরে পাখিদের ভাত দিয়েছি। সব পাখিরা খেয়ে চলে যাবার পর দুটো কাক এলো। ওই কাক দুটোই আমাদের বাড়ির আবাসিক। ওরা এসে খাচ্ছে দেখে আমি গোটা দুই-তিনেক ছবি তুলে নিয়ে ঘরে চলে এসেছি। চেয়ারে বসে ফোনটা হাতে নিয়ে এটা ওটা সেটা দেখছি। বেশ ঝিমুনি আসছে। সারাদিনের পর সংসারের কাজ সেরে এসে বসলে,রোজই আমার মাথাটা এই সময় চিংড়িমাছের মতো বারবার ঝুলে পড়ে!
তা,হটাৎ মাথায় খুব জোরে একটা ঠোক্কর খেয়ে চিনচিন করে উঠলো মাথাটা। যেন,ব্রম্ভান্ড ঘুরতে লাগলো। তবুও
নিজেকে সামলে নিলাম। মাথাটা
হাত দিয়ে চেপে ধরেছি।
দেখি দুপুরে ভাত খেতে
আসে যে কাকটা সে এসে সামনে বসে চোখ নাচিয়ে বলছে কি গো! তুমি তো আমার অনেকগুলো ছবি তুললে,আমাদের নিয়ে লিখবে নাকি এবার!
সে কথা শুনে,মনে হলো রাগে যেন আমার পিত্তি জ্বলে
গেলো! আমি বললাম,তোদের নিয়ে লেখার কোনও
প্রশ্নই আসে না।
আমি চিন্তাও করিনি। তাছাড়া আমি কেন,কেউই তোদের পছন্দ করে না। অমন নোংরা ঘাঁটা স্বভাব দেখলে কেই বা ভালোবাসবে শুনি?
কাক
বললো,বাঃ রে বাঃ! তোমার বাগানে ছুঁড়ে ছুঁড়ে
এদিক ওদিক সেদিক থেকে ময়লা আবর্জনা ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফেলে রাখো তোমরা। সে সব নোংরা গুলো আমরা চোখে দেখে সহ্য করতে পারি না। কিন্তু আমাদের ক্ষমতাতে কুলোয় না সেগুলোকে তুলে নিয়ে ফেলে
দিয়ে আসতে। তাই আমরা নিজেরাই সেই নোংরাগুলো খেয়ে নিয়ে
তোমাদের জায়গা পরিষ্কার রাখি।
তাতে তোমাদের উপকার
হয় কিনা বলো! পরিস্থিতি
বিবেচনা করে,আমি একটু নরম হয়েই বললাম,তা
তো হয়। তবে কিনা….
মুখের কথা কেড়ে নিয়ে কাক বললো,তাহলে! শুধু গায়ের রঙটা
কালো বলেই তোমরা এমন করে আমাদের অছেদ্দ্যা,অসম্মান করো। তোমরা আমরা একজায়গায় পাশাপাশি বাস করি। সে অর্থে,আমরা তোমাদের প্রতিবেশী। তোমরা তোমাদের ছোট বাচ্চাদের কাছে আমাদের পরিচয় দাও ‘ঝাড়ুদার’ পাখি বলে। ছিঃ ছিঃ! আর আমরা,আমাদের বাচ্চা উড়তে শিখলেই তাকে
শেখাই সমস্ত ময়লা- আবর্জনা
খেয়ে নিয়ে মনুষ্যসমাজকে পরিচ্ছন্ন রাখতে,পরিবেশকে দূষণমুক্ত
করতে। আর তোমরা নিজেরাই
পরিবেশকে দূষিত করে তোলো! ছিঃ ছিঃ!
কাকের কথাগুলো শুনে আমি চুপ করে গেলাম। কোনও সাড়া দিইনি।
কাক বললো দেখো,আমাদের চোখটা থাকে নোংরা-ময়লার দিকে আর কানটা থাকে তোমরা
কে কি বলছো সেই দিকে। এই তো দিনকয়েক আগে তোমাদের প্রতিবেশী ওই নন্দী মাস্টার তার বাড়িতে পড়তে আসে
যে ছেলেমেয়েগুলো,তাদেরকে বাগধারা
শেখাচ্ছিল আমাদের নাম দিয়ে। আমরা কি করি না করি সেই খুটিনাটি দিয়ে তাদের পড়াচ্ছে। আমি তখন মাস্টারের পাঁচিলে বসে আছি। আমাদের নামটা কানে আসতেই কান খাড়া করে রইলাম কি বলছে সেটা
শোনার জন্যে। যেটুকু বুঝলাম ‘বাগধারা’ না কি যেন পড়াচ্ছিল। তা বাপু আমাদের নাম দিয়েই ছেলে-মেয়েদেরদের পড়াতে হবে!
আমাদের স্ত্রী কাক প্লাস্টিক, ফিতে,দড়ি, কাপড়ের
টুকরা, উল, তুলো, লোহার
তার, পলিথিন মানে রাস্তায়
পড়ে থাকা প্রায় সব কিছু দিয়ে অগোছালোভাবে বাসা
তৈরি করে। নন্দী মাস্টার বাংলা পড়াতে গিয়ে কিছু আর খুঁজে না পেয়ে বলে দিলো যেমন ধরো ‘কাকের
বাসা’ একটা বাগধারা। কাক দিয়ে এমন অনেক বাগধারা আছে …..“কাকের বুদ্ধি” “তীর্থের কাক” 'কাক নিদ্রা’ “কাক ভূষণ্ডী” “কাকের বুদ্ধি” “ঝড়ো কাক” “কাকচক্ষু” “কাকচেষ্টা” “কাকভোর” আরও
কত কি! কাক
বললো,নন্দী মাস্টারের
ফন্দি আমি সব বুঝেছি।
এই বাগধারার মধ্যেই লুকিয়ে আছে আমাদের
(কাকেদের)স্বভাব ও বৈশিষ্ট্য।
সেটাই মাষ্টার ওদের
শেখালো! কেন আমাদের নিয়ে ভালো কিছু বলতে পারলো না!
ইচ্ছে করছিল মাষ্টারের মাথায় খুব জোরে একটা ঠোক্কর মারতে।
তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললো কাকিমা, আমি কোনও কথা শুনবো না। তুমি আমাদের ছবি তুলেছো,তাই এবারে আমাদের নিয়ে তোমাকে লিখতেই হবে। আর আমাদের নামে ভালো ভালো কথা লিখবে নইলে এমন ঠোক্কর…….
কাকের
ঠোক্করের কথাটা শুনে তাড়াতাড়ি সোজা হয়ে উঠে বসলাম চেয়ারে। দেখি আমার ফোনটা হাতে আছে! কিন্তু আমার মাথায় কত্তামশাইয়ের হাত! কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই উনি বললেন, তখন থেকে বসে বসে কি সব বিড় বিড় করছো আর খাটের ওই ডিজাইনে বারবার মাথাটা ঠুকে যাচ্ছে
দেখে মাথাটায় হাত দিলাম।
আমি স্বস্তির শ্বাস
নিয়ে বললাম,নাঃ
কিছু নয়। আজ কাক নিয়ে কিছু কথা লিখতে হবে।
কাক
বলতে সাধারণতঃ পাতিকাককেই বোঝায়। পাখিদের মধ্যে সবথেকে সাহসী,চালাক এবং বুদ্ধিমান পাখি হলো কাক। এরা জীবনধারণের জন্যে মানুষের উপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল। কাক স্নান করতে ভালোবাসে কিন্তু এমনভাবে জল ছিটিয়ে স্নান
করে তাতে তার শরীরের অর্ধেক পালকও ভেজে না। তাই
বৃষ্টি পড়লে এরা এক জায়গায় বসে বসে ভিজতে থাকে।
বৃষ্টিতে ভেজা কাককে আরও খারাপ দেখতে
লাগে।
কাক অত্যন্ত জনপ্রিয় একটা পাখি। এরা সর্বভুক (Omnivorous)। মানুষের
উচ্ছিষ্ট খেয়েই এরা জীবনধারণ করতে পারে। মানুষের সান্নিধ্যে বসবাসকারী যে ক'টি
পাখি প্রজাতি আছে তাদের মধ্যে কাক অন্যতম। পাখিদের মধ্যে কাক এমন একটা প্রজাতি যাকে সব্বাই
চেনে। তবুও সামান্য পরিচিতি দিলাম। পাতিকাক ছাড়াও মাঝে মাঝে আমরা দাঁড় কাক দেখতে পাই। সমতলের কাক ছাড়াও পাহাড়ি কাক দেখতে পাওয়া যায় লেঃ-লাদাখের পার্বত্য অঞ্চলে।
পৃথিবীতে প্রায় ৪০টিরও বেশি প্রজাতির কাক আছে তবে আমাদের
দেশে সাধারণত বেশি সংখ্যক পাতিকাক ও অল্প
সংখ্যক দাঁড়কাক দেখা যায়। পাতিকাকের মাথার পেছন থেকে গলা ও বুক এবং পেটের সামনের
দিকটা ধূসর বা ফ্যাকাসে ধূসর; বাকি শরীর,ঠোঁট,চোখ এবং পা কালো। মাথার
তালু,কপাল ও গলার নিচের দিকটাও কালো। ঠোঁট দাঁড়কাকের মত,তবে একটু কম বাঁকা। ঠোঁটের
উপরে গোঁফ দেখা যায়।
কাকেরা দলবদ্ধ হয়ে থাকতে পছন্দ করে। দুপুরের দিকে মাঝে মাঝে এরা বৈঠকে বসে। তখন একসঙ্গে সবাই ডাকাডাকি করে,কখনও একসাথে উড়েও বেড়ায়। কাকেরা
দিনেরবেলা খাবারের সন্ধানে দলবেঁধে এক
এলাকা থেকে আরেক এলাকায় যায়। ভোরবেলা ও সন্ধের ঠিক আগে এরকম
দলে দলে কাক উড়ে যাবার দৃশ্য দেখা যায়। রাত নামার আগেই তারা দল বেঁধে নিজেদের
আশ্রয়ে চলে যায়।
কাক দেখতে
যতই কালো হোক তবুও ওদের মনটা
খুবই ভালো। এরা খানিকটা পরার্থপর।
খুবই উপকারী পাখি। সবাই জানে
কাকের বাসায় কোকিল ডিম পাড়ে।
মা কাক কোকিলের বাচ্চাকে
চিনতে পারলেও নিজের বাচ্চার থেকে তাকে আলাদা করে না। একই
সঙ্গে সকলকেই খাওয়ায়।
সদ্যোজাত কাকের ছানা পালকহীন,শরীর এবং
ঠোঁট গোলাপী রঙের। মুখের ভেতরের অংশ লালরঙের। কাক সাধারণত
১০ থেকে ১৫ বা ১৭ বছর পর্যন্ত বাঁচে।
তবে কাক
হল একমাত্র
পাখি,যে ঈগলের মাথা বা ঘাড়ের উপর বসে ঠোক্কর মেরে মেরে তাকে বিরক্ত করতে পারে,যে
সাহস অন্য কোন পাখির নেই!
পাখি দম্পতিদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্কটা বেশ
মধুর। একে অন্যের খুবই খেয়াল রাখে। নিজেদের মধ্যে মান-অভিমান হলে সেটাও চলে অনেকক্ষণ ধরে।
পাখি পরিচিতি:পাতিকাক/কাক/বায়স (House Crow/Common Crow)
বৈজ্ঞানিক নাম: করভাস স্প্লেনডেন্স (Corvus splendens)
পাতি কাক ছাড়া আছে দাঁড় কাক। এরা পাতিকাকের থেকে আকারে বড়ো এবং চেহারায় একটু ভারী। দাঁড়
কাকের ঠোঁট মোটা। সমস্ত দেহ
কুচকুচে কালো। দাঁড়কাকের বৈজ্ঞানিক নামের অর্থ হলো বড়ো ঠোঁট বিশিষ্ট কাক। এদের গলার স্বর পাতি কাকের
থেকেও কর্কশ। ঠোঁট দুটো নীলচে-সাদা রঙের।
দাঁড় কাক
পাখি পরিচিতি : দাঁড় কাক ( jungle Crow)
বৈজ্ঞানিক নাম : Corvas Macrorhynchos..
এই দু’ধরণের
দেশীয় কাক ছাড়া লাল ঠোঁট কাক এবং হলুদ ঠোঁট পাহাড়ি কাক নিয়ে এ পর্যন্ত আমি মোট চার
প্রকার কাক দেখেছি।
লাল ঠোঁট পাহাড়ী কাক ‘চফ’ নামেও পরিচিত। এরা আমাদের দেশীয় কাকের থেকে আকারে বেশ বড়।
আমাদের দেশীয় পাতি কাকের মতো ঘাড়-গলার রঙও ধূসর নয়।
'লাল
ঠোঁট কাক বা পাহাড়ি কাক'এর সারা শরীর উজ্জ্বল নীলচে-কালো পালকগুচ্ছ দিয়ে ঢাকা।
পালকের সংখ্যাও অনেক বেশি। পায়ের পাতা ও আঙুলের অংশও উজ্জ্বল লাল। লাল রঙের ঠোঁটটা
বেশ খানিকটা লম্বা আর খানিকটা বাঁকানো গঠন। আর চোখদুটো খুব গভীর এবং জ্বলজ্বলে।
এরা পাহাড়ের
ফাটলের মধ্যেই বসবাস করে। খাদ্য
সংগ্রহ করে নিয়েই আবার বাসস্থানে ফিরে চলে এসে বসে খায়। দল বেঁধে
থাকতে পছন্দ করলেও জোড়ায় জোড়ায় বেশি থাকতে দেখা যায়। এদের গলার স্বর পাতিকাকের থেকেও কর্কশ
এবং বেশ উচ্চগ্রামে বাঁধা।
এ তো গেলো লাল ঠোঁট কাক দেখতে কেমন সেই কথা!
কিন্তু তাদের পেলাম কোথায় না বললে মনটা খুঁত খুঁত করছে। বলেই ফেলি তাহলে!
চারিদিকে
রুক্ষ পাহাড়ে ঘেরা সোমোরিরি লেকের আশেপাশে গড়ে উঠা অস্থায়ী আস্তানায় রাতের আশ্রয় মিলেছে। ঝুপ করে অন্ধকার
নামতেই হালকা তুষারপাত আর সঙ্গে সামান্য পুষ্প বৃষ্টি সেখানকার তাপমাত্রাকে হিমাঙ্কের আরও কয়েক ডিগ্রি নীচে নামিয়ে দিয়েছে। দীর্ঘ রাত
নামলো,তারপর সব চুপ! দেখলাম ভোরের
সূর্য সমস্ত
পাহাড়টাকে সোনালী করে তুলেছে। হঠাৎই দুটো লাল ঠোঁট কাক উড়ে এসে পাহাড়ের ফাটলের
পাশে বসলো আর অন্যজন ফাটলের গর্তে ঢুকে গেলো। খানিক অপেক্ষা করলাম, তারপর দুজনেই ফাটলের মুখের সামনে এসে একসঙ্গে
অনেক্ষণ বসে রইলো। খুব ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম। একটা কথা না বললেই নয়,কুৎসিত রূপেরও প্রবল একটা সৌন্দর্য
থাকে। ভালোবাসা দিয়ে
নিরীক্ষণ করলে সুন্দররূপটাই চোখে ধরা দেয়। অনেক ছবি তুললাম আর ভাবলাম যা পেলাম, তাই'ই সঞ্চয় হয়ে
থাকুক।
পাখি
পরিচিতি: লাল ঠোঁট কাক (Red-billed
chough)
বৈজ্ঞানিক নাম: Pyrrhocorax
Pyrrhocorax.
তখন জানতাম না হলুদ ঠোঁট কাকও কাকের একটা প্রজাতি। লাদাখের
বৌদ্ধ মনাস্ট্রি "লামুয়রু" যা "Moon
Land" নামেও পরিচিত,সেখানে হলুদ ঠোঁট
কাক বা Alpine chough এর
দেখা পেলাম। পার্বত্য বা পাহাড়ি কাকের দুটো প্রজাতিই এখানে লেহ্- লাদাখে দেখতে
পেলাম। এদের সকলেরই পা'দুটো লাল,আর নখগুলো কালো। তবে হলুদ ঠোঁট কাকগুলোকে দেখে মনে
হলো এরা লাল ঠোঁট কাকের থেকে সামান্য একটু ছোট। বাকি শারীরিক গঠন প্রায় একই। গলার
স্বরও বেশ কর্কশ। একমাত্র পার্বত্য এলাকাতেই এদের দেখতে পাওয়া যায়। স্পেনের পূর্বাঞ্চল থেকে
ইউরোপের দক্ষিণাঞ্চল,মধ্য এশিয়ার আল্পস পর্বত মালা,হিমালয় থেকে চীনের
পশ্চিমাঞ্চলে এরা বাস করে। এরা এদের নির্দিষ্ট অঞ্চলেই সবসময় বাস করে,কখনো অভিবাসী
(mygratory
bird) হয় না।
পাখি
পরিচিতি : হলুদ ঠোঁট পাহাড়ি কাক (Alpine chough or yellow-billed chough).
বৈজ্ঞানিক নাম : Pyrrhocorax
groculus.
কাক নিয়ে কত কথা বললাম। সবটাই সত্যি। প্রকৃতির মাঝে এক অনুপম সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে,যার অনেকটাই জুড়ে
আছে পাখি। তার খুব সামান্যটুকুই
আমি দেখতে পেয়েছি।
লেহ্-লাদাখ ভ্রমন
পাখি-প্রকৃতি,প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, যাই বলি না কেন সব দিক থেকে আমাকে ভরিয়ে দিয়েছে।
এই পার্বত্য এলাকায় পাহাড় ও জলের পাখিদের দেখা পাবো ভাবিনি। যা ছিল অধরা, তাই
একেবারে সামনে এসে হাজির হলো। দু-চোখ ভরে দেখলাম, দু হাত ভরে পেলাম। আর মন ভরে উঠলো অশেষ কৃতজ্ঞতায়।
ক্রমশ ……
১৪তম পর্ব পড়ুন আগামী শনিবার ।
লেখিকার অন্যান্য লেখা পড়তে এখানে ক্লিক করুন ।
বিঃদ্রঃ – সব ছবি এবং ভি ডি ও লেখিকার নিজের তোলা ।
লেখিকার জীবনের সঙ্গে গল্প অঙ্গাঙ্গিকভাবে জড়িয়ে আছে। যা দেখেন, যা শোনেন, যা শোনেন, যা কিছু স্মৃতির পাতায় জড়িয়ে আছে মনের সাথে,তাই নিয়ে লিখতেই বেশি পছন্দ করেন।
লেখা শুরু স্কুল-ম্যাগাজিন, কলেজ -ম্যাগাজিন দিয়ে। বর্তমানে কিছু লেখা প্রকাশিত হচ্ছে কয়েকটি মাসিক-ত্রৈমাসিক পত্রিকায়। বর্তমানে বার্ড’স ফটোগ্রাফী এবং “পাখি-প্রকৃতি” নিয়ে লেখা শুরু করেছেন।