৭ম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন ।
লেখিকার অন্যান্য লেখা পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
৮ম পর্ব শুরু ………
কমলাদামা (Orange-headed
thrush)
“ভালো করিয়া বাজান রে দোতারা, সুন্দরী কমলা নাচে”…….এই গানটা আমার খুব পছন্দের। সেই কোন ছোটবেলায় নির্মলেন্দু চৌধুরীর কন্ঠে গানটা শুনতাম। তারপর তো কত শিল্পীই এই গানটা গেয়েছেন তাঁদের নিজেদের মতো করে। কখনও গানের কথা বদলে গিয়েছে তো কখনও বদলেছে সুর। কিন্তু আমাদের মতো সত্তরের দশকের অনেকের কাছে গানটির গীতিকার-সুরকার লোকসঙ্গীত শিল্পী নির্মলেন্দু চৌধুরীর গাওয়া গানটা আজও মনের মধ্যে রয়ে গিয়েছে।
তবে,এখানে কমলা
সুন্দরী মানে আমি কমলা দামা পাখির কথা
বলছি। ওর নাচটা হয়তো দেখাতে পারতাম ভিডিও করে। কিন্তু আগেই বলে রাখি ওর নাচের ভিডিওটা আমি তুলিনি।
আসলে,ও তো তেমন ভালো নাচতে পারে না!আর ওর নাচটা তোমাদের দেখালে তোমরা যদি বলে ওঠো
হুঁ.... উ, ওই তো ভারী নাচ,তা নিয়ে আবার কত কথা! দূর,দূর!!
কিন্তু যেটুকু বলতে পারি তাতে কোনও মিথ্যে নেই। কমলাদামা খুব মিষ্টি সুরে গান করতে পারে। আর গানের গলা?.. বলবো কি ভাই! ভারী মিষ্টি।
এবার নিশ্চয়ই প্রশ্ন
উঠবে যে আমি
গানের কি-ই বা বুঝি? নাঃ,আমি গানের একটুও কিচ্ছু
বুঝি
না। গানের এই
না বোঝা বিষয়টা নিয়ে একটা কথা মনে পড়লো।
আমি যখন ছোট ছিলাম,তখন আমাদের পাশের
বাড়ির শঙ্করীদি গান গাইতো শুনতাম। পাড়ার
সবাই বলতো শঙ্করীদি নাকি রবীন্দ্রসঙ্গীত শুরু করলে,সুর বদলে স্থায়ী- অন্তরা-সঞ্চারিতে
গিয়ে সেটা নজরুলগীতি বা অতুলপ্রসাদী গানের মতো শুনতে লাগতো। সেই শঙ্করীদির
গান শুনে শুনেই একটু শিখেছিলাম। বাবা একটা
পুরোনো হারমোনিয়াম কিনেও
দিয়েছিলেন। তারপর
আমি যখন বড়ো হলাম তখন পাত্রপক্ষ দেখতে আসলে বাবা-মা জোর করে পাত্রপক্ষকে গান শোনাতে বলতেন।
অনেক সময় প্রায় পছন্দ হয়ে যাওয়া সম্বন্ধ আমার গান গাওয়ার
জন্যে ভেঙে যেতো।
শেষবার পাত্রপক্ষ যখন দেখতে এসেছিল তখন আমি গান গাইনি! তাই সেইবারই আমার বিয়ের সম্মন্ধটা পাকা হয়েছিল। এই তো গত সপ্তাহেও, একদিন সন্ধেবেলা হারমোনিয়ামটা নিয়ে একটু গলা সাধছিলাম। ওমা! পরেরদিনই সকালবেলা একজন প্রতিবেশী ভাসুরঝি জিজ্ঞাসা করলো কাকিমা,কাল সন্ধ্যেবেলা আপনি কাঁদছিলেন কেন? তাহলেই বোঝো!
তবে,আমি নিজেও জানি যে আমি 'সা' বললে, সবাই শুনে ভাবে আমি 'পা' বলছি! তবুও বলি,এতদিন ধরে যেটুকু গান শুনেছি
তাতে কমলাদামাকে ভালো গায়ক-গায়িকা (পাখিদের) বলা
যেতেই পারে।
কমলা রঙের জন্য ওকে কেউ কেউ ভালোবেসে 'কমলাবউ'
বলে ডাকে। দেখতে বেশ চমত্কার। টলটলে নীল মায়াবি চোখ। দেখতেও খানিকটা দোয়েল পাখির
মতোই। ঠোঁট দুখানা কালচে রঙের,আর পা এবং আঙুলগুলো হালকা গোলাপি।
আমি
রোজ পাখিদের ছবি তুলি আর তাদের নিয়ে লিখে সবাইকে দেখাই। পাখিদের ছবি তোলা আর তাদের
প্রসঙ্গে আমার লেখা দেখে অনেকেই বলেন যে আমার
ভাগ্য খুব ভালো। সেটা
আমিও স্বীকার করি। তবে,আগেই বলে রাখছি অনেকেই ভাবতে পারেন যে পাখির ছবির সঙ্গে আবার ভাগ্য
ভালো মন্দের কি সম্পর্ক! ছবি তুলতে তুলতে,আর ওদের নিয়ে বকর
বকর
করতে করতে নির্ঘাত মাথাটাই খারাপ
হয়ে গিয়েছে! কিন্তু না,আমার মাথা যে খারাপ
হয়নি তা আমার কথাগুলো শুনলেই কিছুটা বোঝা
যাবে।
কারণ,অনেকেই যারা পাখির ছবি
তোলেন তাদের বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে ক্যামেরা নিয়ে ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করতে হয়। তাদের
সব ইয়া বড়ো বড়ো ফটোকল (ক্যামেরা, টেলি,জুম কতরকমের লেন্স,দুপায়া-তিনপায়া
স্ট্যান্ড
ইত্যাদি আরও কত কিছু আছে। আর আমি কিনা বাড়ির উঠোন থেকে, উঠোনের
খোলা দরজার সামনে বাগান থেকে, বাড়ির গেটের সামনে থেকেই সব পাখিদের ছবি তুলি। তাদের সঙ্গে কথা বলি। তারা আমার কথা বুঝতে
পারে,আমিও তাদের কথা (ডাক) বুঝতে চেষ্টা করি।
সে যে যাই বলুক পাখিরা আমার বাড়িতে আসে, এতেই আমার অনেক পাওয়া
হয়ে যায়।
আমার বলতে লজ্জ্বা নেই যে,আমার ক্যামেরাটা খুবই
ছোট্ট। তাতে আলাদা কোনোও
লেন্স-টেন্স নেই। পাখি এসে বসলে,তাকে দেখতে পেয়ে ছুটে ঘরে
এসে আলমারি খুলে ক্যামেরা বার করি। তার আবার দুটো ব্যাগ, একটা প্লাস্টিক ফয়েল। সব
মোড়ক খুলে ক্যামেরা নিয়ে গিয়ে যখন পাখির সামনে হাজির হই, দেখি তখনও তারা আমার জন্য অপেক্ষা
করে বসে আছে। আমার ভাগ্য ভালো বলেই সেটা হয়তো সম্ভবপর হয়।
কমলাদামা যেদিন প্রথম আমার
বাড়ির বাগানে এলো সেদিন ওর ওই রূপ দেখে আমি অবাক
বিস্ময়ে তাকিয়েছিলাম পলক না পড়া চোখে। কমলাদামা
পাখিটাকে রীতিমতো সুন্দর দেখতে।
দেখে চোখ ফেরানো যায় না। কিন্তু যেখানে এসে সে বসেছিল সেই
জায়গাটায় বড়োই বেমানান লাগছিল তাকে।
সকালবেলা পৌরসভার সাফাইকর্মী এসে প্রতিটি বাড়ি সংলগ্ন ছোট
নর্দমাগুলো পরিষ্কার করে,তার দুপাশে গাছ থেকে ঝরে পড়া শুকনো পাতা
ও কাদামাটিসহ আবর্জনা তুলে ডাম্প করে দিয়েছে। যাতে নর্দমার জল সহজে বয়ে গিয়ে বড়ো নিকাশি নালায় পৌঁছতে
পারে। একটু পরে
বেলা বাড়তেই দেখি,চড়া রোদে আবর্জনা কাদামাটি উপর থেকে একটু
শুকিয়ে গিয়েছে।
আর তাতে কমলা রঙের কি যেন একটা নড়াচড়া করছে। ভালো করে
তাকিয়ে দেখে ভাবছি কি-ই বা হতে পারে!হঠাৎই জোড়া পায়ে পাশ ফিরে লাফাতে দেখে চোখে পড়লো একটা কমলা রঙের পাখি,
তার নীলচে-ছাই রঙের ডানাটা মেলে খুব মিষ্টি সুরে
ডেকে উঠেই থেমে গেলো।
তারপর ওই আবর্জনার স্তুপের উপর থেকে পোকা খুঁটে খুঁটে খেতে
লাগলো। ঠোঁট
দিয়ে শুকনো পাতা সরিয়ে সরিয়ে টেনে বার করছে আর কুট কুট করে খাচ্ছে।
প্রথমটা আমি হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম,ছবি তোলার কথা মাথায় আসতেই ভাবলাম ওকি এতক্ষণ এক জায়গায় বসে থাকবে!
তবুও মনের জোরে ছুটে ঘরে এসে ক্যামেরা নিয়ে গিয়ে যতগুলো ইচ্ছে ছবি তুলেছি। তারপরেও
অনেক্ষণ বসেছিল।
এতক্ষণ পাখিটাকে
যতটা যেমনভাবে
দেখেছি তেমনই বলেছি। ওরা স্যাঁতস্যাঁতে জায়গায়,অর্থাৎ ডাম্পিং বা ড্রেনের ধারে
থাকতে পছন্দ করে। আর সেখান থেকে পোকা-মাকড় খুঁজে খুঁজে খায়। আর এক জায়গায় বসেও থাকে অনেক্ষণ।
পরের দিন
দুপুরের দিকে দেখি কমলা পাখিটা আবার এসেছে পোকা খেতে। তবে এক নয় দুজনে মিলে। ওহ,সেদিন আমার এত আনন্দ হয়েছে যে,বলে বোঝাতে পারবো না। মনে
হলো সে যেন ছবি তোলাবার জন্যেই আমার কাছে এসেছিল। কিন্তু
কিছুতেই ওদের দুজনকে একসঙ্গে ফ্রেমবন্দি করতে পারিনি। কমলাদামাকে কোথাও কোথাও কমলা বউও বলে। আবার কোথাওবা
কমলা দোয়েল,কমলা ফুলি এসব বিভিন্ন নামে ডাকা হয়। আমি বলি
“কমলা সুন্দরী। কমলাদামা
পাখি দম্পতি নিজেদের মধ্যে খুব ভাব-ভালো বাসার সম্পর্ক বজায় রাখে। স্ত্রী ও পুরুষ পাখি
দুজনে মিলে তিন থেকে পাঁচ দিনের মধ্যে বাসা তৈরি করে। বাসা বাঁধার সময় পুরুষ পাখি
পাতার ঝোঁপঝাড়ে লুকিয়ে লুকিয়ে আনন্দে গান করে গিন্নির মন ভোলায়।
জানি, সব কথা শুনে নিয়ে হয়তো সবাই বলবে যে, এ তো সাধারণ ব্যাপার। সব সামাজিক প্রাণীরাই বাসা বাঁধে,বাচ্চা প্রতিপালন করে,আর স্বামী-স্ত্রী মিলে মিশে সংসার করে,সে
মানুষ বা পাখি যেইহোক না কেন।
নতুন কথা তো কিছু নয়!সেটা ঠিক কথা। তবে কি জানো,কাউকে জানলে তার পুরোটা জানতে খুব ইচ্ছে
করে। আর,তার থেকে বেশি ইচ্ছে করে সবাইকে জানাতে। তাই......
কমলাদামা আদতে খুব লাজুক
প্রকৃতির। তবে এদের
গানের
গলাটা খুব মিষ্টি। প্রথম প্রথম শুনলে তো খুবই ভাল লাগে। এপ্রিল
থেকে জুন মাস এদের প্রজনন কাল। সেই সময় যখন
পুরুষ কমলাদামা সাথীকে কাছে পেতে তাকে খুঁজে বেড়ায়, তখন এদের বিরহের সুর
শুনলে মন উদাস হয়ে যায়।
কিন্তু
প্রায়ই দেখা যায় এরা বিরহের গান গেয়েই চলে, কিন্তু তার সঙ্গিনী আসে না।
হয়তো, সঙ্গিনী
খুব সহজে কাছে আসতে চায় না।
নয়তো,তার কানে যায় না এই বিরহের সুর, অথবা শুনলেও নিজের
দর বাড়াতে সে পাত্তা দেয় না।
ভোরের আলো ফোটার আগে থেকেই
একসাথে বাসা বাঁধার জন্যে সে সঙ্গিনীকে ডাকতে শুরু করত। কখনও কখনও সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার পরও
সে ডেকেই চলে।
অনেক সময় একটানা তিনচার দিন ধরে এই বিরহী পাখির গান চলতেই
থাকে। দীর্ঘক্ষণ
বিরহের গান শুনলে কানমাথা কিন্তু ঝনঝন করে উঠতে পারে।
ডেকে ডেকে সাথীকে না পেলে কি হয় তা
একবার শুনেছিলাম আমার এক পাখি বান্ধবের কাছ থেকে। সে একবার তার গ্রামের বাড়িতে গিয়ে কদিন একটানা কমলাদামার বিরহের গান শুনেছিল। ওইরকম কাতর
ডাক শুনে তার মনে হয়েছিল যদি সম্ভব হতো তাহলে সে নাকি ওর একটা সঙ্গিনী খুঁজে এনে দিতো। কিন্তু
কয়েকদিন পরে কমলাদামার বিরহের সুর বদলে গিয়েছিল আর আমার বন্ধুও তার বাড়ি ফিরে গিয়েছিল। কিন্তু
জানতে পারিনি কমলাদামা তার সঙ্গিনীকে খুঁজে পেয়েছিল নাকি তার ভালোবাসার বাসা বাঁধার
স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে গিয়েছিল।
পাখির
নাম :
কমলাদামা (Orange-headed
thrush)
বৈজ্ঞানিক নাম : জুথেরা সিট্রিনা
(Scientific
name: Zoothera citrina).
কমলাদামা
আকার আকৃতিতে দোয়েল পাখির মতোই। হাঁটেও
দোয়েলের মতোই লাফিয়ে
লাফিয়ে। ২০ থেকে ২২ সেন্টিমিটার লম্বা এরা। স্ত্রী-পুরুষ
পাখি দেখতে একরকম মনে হলেও সৌন্দর্যের দিক থেকে পুরুষ পাখি সবসময় রূপবান। কমলাদামা পাখির মাথা,ঘাড়,গলা ও বুক
কমলা-বাদামি। তলপেট ও লেজের নিচের দিক সাদাটে। চোখের মণি গাঢ় পিঙ্গল। চোখের নিচ
বরাবর পরপর তিনটি সাদা ছোপ আছে। পিঠের পালক নীলাভ ছাই বর্ণের। পায়ের রঙ
ফিকে গোলাপি। স্ত্রী পাখির বুকের রঙ সামান্য ফিকে। পিঠের ওপরের পালক ধূসর ছাই রঙের। কমলাদামা স্ত্রী-পুরুষ সারাবছর একসঙ্গে থাকে না। প্রজনন কালে স্ত্রী-পুরুষ পাখি একসঙ্গে ঘোরাফেরা করে ঘর বাঁধবে বলে।
বাসা
বাঁধার ব্যাপারে এরা যথেষ্ট খুঁতখুঁতে। জায়গা পছন্দ হলে তবেই বাসা তৈরি করে। বাসার আদল চায়ের কাপের মতো। এমনকি তাতে চায়ের কাপের মতো হাতলও থাকে। হাতলসহ বাসাটা গাছের ডালপালার সঙ্গে মজবুত করে বেঁধে রাখে। বাসা
তৈরির উপকরণ শুকনো ঘাস,লতাপাতা,আর সরু সরু শিকড়বাকড়।
বাসা তৈরি করে ডিম পাড়ার পর থেকে বাচ্চা বড়ো হয়ে উড়তে শেখা এবং শিকার করতে শেখা
অবধি কমলাদামা অন্য পাখিদের মতো একই কৌশল অবলম্বন করে।
খাদ্য: পোকা মাকড়,কীটপতঙ্গ
ইত্যাদি এদের প্রধান খাদ্য। সুযোগ
পেলে কেঁচো, সাপের ছোট বাচ্চাও শিকার করে।
ক্রমশ .........
৯ম পর্ব পড়ুন আগামী শনিবার ।
বিঃদ্রঃ – সব ছবি এবং ভি ডি ও লেখিকার নিজের তোলা ।
লেখিকার জীবনের সঙ্গে গল্প অঙ্গাঙ্গিকভাবে জড়িয়ে আছে। যা দেখেন, যা শোনেন, যা শোনেন, যা কিছু স্মৃতির পাতায় জড়িয়ে আছে মনের সাথে,তাই নিয়ে লিখতেই বেশি পছন্দ করেন।
লেখা শুরু স্কুল-ম্যাগাজিন, কলেজ -ম্যাগাজিন দিয়ে। বর্তমানে কিছু লেখা প্রকাশিত হচ্ছে কয়েকটি মাসিক-ত্রৈমাসিক পত্রিকায়। বর্তমানে বার্ড’স ফটোগ্রাফী এবং “পাখি-প্রকৃতি” নিয়ে লেখা শুরু করেছেন।