ধারাবাহিক – প্রতি শনিবার
শালিক কথা ও কাহিনী
১০ম পর্ব পড়তে এখানে
ক্লিক করুন ।
লেখিকার অন্যান্য লেখা
পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
১১তম পর্ব শুরু ……
"যাহা কিছু সহজলভ্য তাহাই অনাদরের সামিল"…….
চিরসবুজ আমাদের এই বাংলার অনন্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্য প্রতিনিয়তই
আমাদের মুগ্ধ করে। যদিও সেই সৌন্দর্যের অনেকখানি জুড়ে রয়েছে গ্রাম বাংলার চিরপরিচিত শত শত পাখি। আমাদের চারপাশের ঘরোয়া পাখিগুলোর মধ্যে শালিক পাখির নাম সবার উপরে। এরা সারাদিন
বাড়ির আশে পাশে সপরিবারে ঘুরে বেড়ায়। আমাদের গৃহস্থ দম্পতির মতো সর্বক্ষণ ছোট খাট ব্যাপারে এদেরও ঝগড়া-ঝাঁটি লেগেই থাকে। আবার সংসারী মানুষের মতো দুজনেই মানিয়ে নেয় বাচ্চাদের কথা ভেবে। এরা ভাত শালিক নামে পরিচিত। অনেক প্রকার শালিক পাখি আছে তবে বিশেষ করে ৬ প্রকার শালিক পাখি
আমাদের আশে পাশেই ঘুরে বেড়ায়।
দিন কয়েক আগে, একদিন দুপুরবেলা এসে আমার বাড়ির পাঁচিলে মুখ গম্ভীর করে একাই বসেছিল একটা ভাত
শালিক! আমি বললাম কি ব্যাপার রে তোদের। কি হয়েছে? মুখখানা অমন ভার ভার লাগছে কেন? সে উঁচু গলায় ক্র্যাক-ক্র্যাক, টুঁই টুঁই টুঁই শব্দে যা বললো তাতে বুঝলাম সে বলছে…..কি আর বলবো কাকিমা। মনে হচ্ছে আর বুঝি একসঙ্গে থাকা যাবে
না!
কথাটা শুনেই মনে পড়ে গেল দিন কয়েক
আগেই ‘রয়্যাল
সোসাইটির জার্নাল ‘দ্য প্রসিডিংস’ দাবি করেছে, ইদানিং নাকি মানুষদের মতো
পাখিদের সংসারও ভেঙে যাচ্ছে। বিশ্বাসের অভাব ঘটছে
নিজেদের মধ্যে। কথায় কথায় ঝগড়াঝাঁটি
হয়ে সাংসারিক ছাড়াছাড়ি অর্থাৎ ডিভোর্স পর্যন্ত গড়িয়ে যাচ্ছে। ধৈর্য্যের অভাব ঘটছে নিজেদের বোঝাপড়ায়। এমনকি পাখিদের মধ্যে
প্রেম-ভালবাসার সম্পর্কও নাকি গড়ে উঠতে পারছে না।
বিজ্ঞানীদের দাবি, পরিযায়ী পাখিদের
মধ্যেই ডিভোর্স সব থেকে বেশি হচ্ছে। সঙ্গী বা সঙ্গিনীরা দূরে গিয়ে আর ফিরছে না। সেখানেই অন্য সঙ্গীকে নিয়ে সংসার করছে। মানুষের মতো তারাও পরকীয়ায় জড়াচ্ছে। তার ফলে
পাখিদেরও সংসার ভাঙছে। এমনকি অত্যন্ত দুঃখজনক বিষয় হলো যে,বহু পাখি মানসিক অবসাদেও ভুগছে।
পাখিদের ডিভোর্সের জন্য মানুষকেই দায়ী
করছেন পরিবেশবিদরা। বন-জঙ্গল সাফ করার ফলে পাখিরা বাস্তুহারা হচ্ছে। মোবাইলের মাইক্রোওয়েভ রশ্মি,গাড়ির শব্দ এবং অতিরিক্ত পরিবেশদূষণে পাখিরা
তাদের ভাব ভালোবাসা বিনিময়ের পদ্ধতি ভুলতে বসেছে। তাতেই পক্ষী বিজ্ঞানীদের
কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়েছে। এখনও অবধি অসংখ্য পাখি-দম্পতির ডিভোর্স দেখেছেন তাঁরা। প্রতিনিয়ত তাঁরা
গবেষণা করে চলেছেন,কিভাবে এই সমস্যার সমাধান করা যায়!তা না হলে
নীল আকাশে ডানা মেলে উড়ে বেড়ানো,বিশ্ব প্রকৃতির এই সুন্দরতম সৃষ্টি
‘পাখি’একদিন পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে
যাবে!
মুছে যাবে পাখির গান। হারিয়ে যাবে জগতের সুর-তাল-লয়!
ভোরের বেলায় যে সব পাখির গানে আমাদের ঘুম ভাঙে, শালিক পাখি তাদের মধ্যে
অন্যতম। বাপ রে বাপ!কি অসম্ভব গলার জোর এদের। একেক সময় ওই বিকট
চেঁচানিতে আমার মাথার গোলমাল হয়ে যায়। একটা কাজ করতে গিয়ে
অন্য কাজ করে ফেলি। কান-মাথা ঝালাপালা
হয়ে ওঠে!আমিও তখন চিৎকার জুড়ে দিয়ে হেঁকে বলি,এখন যা তো…..বিরক্তি ধরিয়ে দিলো!কি বুঝতে পারে কে জানে। উড়ে চলে যায় কিছুক্ষণের জন্যে। তবে,এদের ডাকটাও বেশ বৈচিত্র্যপূর্ণ এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন রকমের। বিশেষ করে ভালোবাসার জন্যে এক গান তো ঝগড়া বাঁধলে তা আরেক রকম। কখনও আবার ডাক শুনে মনে হয় “কি করছো”?
“কেমন আছো”বলে আমার খোঁজ নিতে এসেছে। তবে,শালিক পাখি খুব সুন্দর শিস দেয়। আর অন্য পাখিদের ডাক নকল করতে পারে। পোষ মানালে কথা বলতেও পারে।
এরা স্বভাবে খুব রাগী। বেশ কয়েকজন মিলে একসঙ্গে
থাকলেও,দুজন দুজন থাকতে বেশি পছন্দ করে। যখন একসঙ্গে থাকে,খন দেখলে মনে হয় অন্তহীন ভালোবাসা দুজনের মধ্যে। আবার
রেগে গেলেই বিশাল ঝগড়া ঝাঁটি,চেঁচামেচি শুরু করে দেয়। স্বভাবসিদ্ধ পুরুষের মতোই শালিক পুরুষ রেগে গেলে তার চেহারাই বদলে যায়।
তবে,এরা সমাজ বদ্ধ জীব। স্ত্রী-পুরুষ মিলে মিশেই ঘর বাঁধে, ডিমে
তা দেয়, ছানাদের প্রতিপালন করে আবার কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে খাবার সংগ্রহ করে। পালা করে
দুজনেই বাচ্চাদের খাওয়ায়।
খাওয়ার ব্যাপারেও কোনও
বাছবিচার নেই। এরা সর্বভূক (Omnivorse)। যেমন জোটে তেমন খায়। এরা যেখানেই থাকে সেখানকার মানুষদের খুব ভালোভাবে চিনে রাখে। এমনকি প্রতিদিন আসা-যাওয়ার জন্য এরা কাছে আসতেও ভয় পায় না। পাখিদের সমাজে অন্য সকল পাখির তুলনায় এরা খুব সাধারণ জীবন যাপন করে। দু-তিনটে বাচ্চা নিয়ে শালিক দম্পতি সুন্দর সুখী পরিবার গড়ে তোলে।
বাচ্চাদের নিয়ে বাবা-মা শালিকের আসা-যাওয়ার এমন দৃশ্য প্রায়ই নজরে পড়ে। ডিম ফোটার কয়েকদিন পর,প্রথম অবস্থায় ঠোঁটে করে খাবার নিয়ে গিয়ে তাদের
খাওয়ায়। তারপর উড়তে শিখে নীচে নামলে বাচ্চাগুলো চিক চিক করে ডাকে
আর ডানা নেড়ে নেড়ে মায়ের মুখ থেকে তারা খাবার খায়। সারাক্ষণ বসে থাকে মায়ের অপেক্ষায়।
মানুষের মধ্যে কানা,খোঁড়া, গন্নাকাটা
থেকে শুরু করে অনেক রকম শারীরিক প্রতিবন্ধকতা দেখা।যায়। কিন্তু প্রতিবন্ধী বা “বিশেষভাবে সক্ষম” পাখি আগে কখনও দেখেছি বলে মনে পড়ে না!
একদিন দেখি এক শালিক দম্পতি তিনটে বাচ্চা নিয়ে আমার বাড়ির সামনে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ওদের দেখতে পেয়ে একটু মুড়ি ছড়িয়ে দিলাম। হঠাৎই নজরে পড়লো একটা বাচ্চার একটা পা
নেই!আর নিচের ঠোঁটের অর্ধেকটা নেই। উপরের ঠোঁটটাও সঠিক আকৃতির নয়। খুব চেষ্টা করেও একটা দানা মুড়ি ঠোঁটে করে তুলতে পারলো না সে! ওকে দেখে মনে খুব কষ্ট হলো। সেই থেকে ওই খোঁড়া শালিক ছানাটার উপর নজর রাখতে শুরু করলাম।
শালিক বাবা-মা তার ছানাদের উড়তে শেখাচ্ছে একেবারে গাছের নিচের
দিকের ডাল থেকে খুব সাবধানে সাবধানে। নিজেরা একটু করে উড়ে পাঁচ-সাত হাত দূরে গিয়ে বসছে, তারপর
পাখির ভাষায় ছানাকে নির্দেশ দিচ্ছে আর তারাও ঠিক তেমন করে উড়ে যাচ্ছে। যাইহোক, বাচ্চাগুলোকে উড়তে শেখানোর সময় লক্ষ্য করলাম খোঁড়া বাচ্চাটা খুব কষ্ট করে ওড়ার চেষ্টা করছে। বারবার
পা ফসকে যাচ্ছে কিন্তু ওই একটা পা দিয়েই গাছের সরু ডালটা আঁকড়ে ধরছে। পাখিটাকে এমন করে চলতে দেখে খুব কষ্ট লাগছিল।
ঘটনাটা মে’২০২০ সালের।‘করোনা’ মহামারিতে বিপর্যস্ত মানুষ ঘরে বন্দি। তার মধ্যে ক’দিন ধরেই ঝড়ের আগাম সতর্কতা জারি হয়েছে। আবহাওয়া দপ্তর ঘোষণা করেছে “আমফান"(UMPUN)নামে সুপার সাইক্লোন তার গতি বাড়িয়ে আরও শক্তিশালী হয়ে আছড়ে পড়তে চলেছে। সেদিন সকাল থেকেই হালকা
হাওয়া চলছিল। দুপুরশেষে আচমকা দমকা হাওয়া উঠলো। ঝড়ের দাপটে নিমেষে চারিদিক শুনশান। প্রাণীকুল পক্ষীকুল সকলেই দিশেহারা!
ঝড় উঠলেই গাছের ভাঙা ডালপালা,
ফল-ফুল-পাতা উড়ে এসে পড়ে, তাই সব থেকে আগে উঠোনের দরজাটা বন্ধ করতে হয়। আমি দরজা বন্ধ করতে গিয়ে দেখি আগের দিনের সেই খোঁড়া শালিকটা ভয় পেয়ে গুটিশুটি হয়ে বাগানে বসে রয়েছে!কোনদিকে যাবে ভেবে পাচ্ছে না! অসম্ভব ঝড়ের ধাক্কায় উড়িয়ে নিয়ে যাবার উপক্রম। সেইসঙ্গে বৃষ্টিও শুরু হয়েছিল। ততক্ষণে মা শালিক বাকি দুটো ছানাকে নিয়ে উড়ে গিয়েছে। খোঁড়া শালিক বাচ্চাটাকে দেখে আমি এগিয়ে যেতেই সে এসে আমার হাতে ধরা দিলো!অন্য সময় হলে হয়তো উড়ে পালাতো।
হাতে তুলে নিয়ে দেখি ঠক ঠক করে কাঁপছে পাখিটা। ওকে একটা ঝুড়ির নীচে রেখেদিলাম। বৃষ্টিতে চুপসে গিয়েছে ছোট্ট শরীরটা। সন্ধে পেরিয়ে রাত্রি নামার পর ঝড় শান্ত হলো,খানিক পরে বৃষ্টিও থামলো কিছু সময়ের জন্য। পাখিটা অনেক্ষণ ধরে ডাকার পর ধীরে ধীরে শান্ত হয়েছিল। ভোরবেলা ওকে আমি আমার রান্নাঘরের চালে তুলে দিয়েছিলাম, যাতে ওর মা এসে ওকে নিয়ে যেতে পারে। কিন্তু শালিক দম্পতি তাদের বিকলাঙ্গ বাচ্চাটাকে ফিরিয়ে নেয়নি। কোনও রকমে সে আবার ফিরে এসেছিল আমার উঠোনের এক কোণে। বাচ্চাটাকে ফিরে আসতে দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলাম তার দিকে। মনে হয়েছিল তার চোখেও বুঝি জল চিকচিক করছে।
খুব কষ্ট করে একপায়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে সে চলতো। সারাদিন রান্নাঘরের চালে বসে থাকত আর সন্ধে হলেই নেমে এসে উঠোনের কোণে বসে থাকত। এত কিছুর পরেও একটা অদ্ভুত জিনিষ দেখেছি! খাবার.দিলে যখন সে খেতো, অন্য পাখিরা সেই খাবার খেতে এলেই মা পাখি কিন্তু তাদের তাড়াতে ছুটে যেতো। আর মাকে না দেখতে না পেলে সে হাঁ হাঁ করে খুব চেঁচাতো।
“হোক না শিশু বিকলাঙ্গ”!... তবুও সে যে হৃদয়ের ধন!
খুব গৌণ হলেও বিষয়টা বেশ স্পর্শকাতর। প্ৰথম প্ৰথম বাচ্চাটাকে
দেখে খুব কষ্ট লাগতো। খেতে পারতো না,এক পায়ে চলতে গিয়ে বার বার উল্টে উল্টে পড়ে যেতো। কিন্তু সময়ের
সঙ্গে সঙ্গে ছোট্ট সেই ছানাটাই প্রকৃতিতে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্যে অসম্ভব
লড়াই করে জিতে গিয়েছিল। পাখিটা এখন পূর্ণ বয়স্ক। মাঝে মাঝেই
এসে পাঁচিলে বসে থাকে। আবার খানিকবাদে উড়ে যায়। মনে হয় যেন সে আমার সঙ্গেই দেখা করতে
আসে! অসম,ক্ষুদ্র একটা পাখির বাচ্চার লড়াইকে আমি কুর্নিশ না করে পারিনি!
বৈজ্ঞানিক নাম : (Acridotheres
tristis)
মার্চ-এপ্রিল থেকে আগস্ট ভাত শালিকের প্রজনন মৌসুম। শুকনো পাতা,গুল্ম লতার শুকনো শিকড়,ঘাস,খড়,কাগজ,প্লাস্টিক,পুরোনো,কাপড়,সাপের খোলস,আবর্জনা দিয়ে অগোছালো
একটা বাসা বানায়। তাতে একবারে ৪-৬ ডিম পাড়লেও বড়জোর তিন চারটে বাঁচে। যেখানে বাসা করে সেই জায়গাটা খুব নোংরা করে তোলে। এরা বৃষ্টির জমা জলে স্নান করতে ভালোবাসে।
ভাত শালিক ছাড়াও আরও অনেক রকমের শালিক পাখি দেখতে পাওয়া যায়। পাখিদের মধ্যে বক এবং শালিক গবাদি পশুর গায়ে গায়ে ঘুরে বেড়ায়। গরু-মোষের গায়ের
উপর বসে থাকে। তাদের গায়ের এবং লেজের ডাঁশ জাতীয় পোকা খুঁটে খায়। ভাত শালিক ছাড়াও আরও কয়েকপ্রকার শালিক দেখা যায়। যেমন গোশালিক, ঝুঁটি শালিক, কাঠ
শালিক,গাঙ শালিক, জাভান শালিক বা ময়না,ব্রাহ্মণী শালিক। এরা বনে জঙ্গলে
ঘুরে বেড়াতেই পছন্দ করে। পাতি বা ভাত
শালিকের মতো এরা ঘরে দোরে না থাকলেও বাড়ির আশেপাশেই এদের দেখতে পাওয়া যায়।
গো শালিক……
আজ হেব্বি
রাগ হয়ে গিয়েছিল। আরে বাবাঃ, রাগের কারণটা একবার শুনেই দেখো! জানি তোমরা বলবে
রাগের কারণ জেনে আমরা কি করবো। তবুও কিছু কথা বলতে ভালো লাগে! এই যেমন আজ সকালে একদল
গো-শালিক আমার
বাগানে ঘুরছিল। হঠাৎই দলের মধ্যে থেকে একজন এসে আমার
সামনে এসে বসলো। ওমা! তাকিয়ে দেখি গোশালিকটা কত কিছু বলে চলেছে!যেটুকু বুঝলাম বলছি। তবে তোমরা কিন্তু বাপু দোষ ধরো না……মনে হলো সে বলছে,”এই তো বেশ গুছিয়ে বসেছি। বলো তো কেমন লাগছে আমায়”?
কালো-সাদা শালিক
পাখিকে গো-শালিক বা গোবরে শালিক নামে ডাকা হয়। এদের ঠোঁটের রঙ গাঢ় কমলা-হলুদ আর চোখের মণি হালকা হলুদ রঙের।
পাখি পরিচিতি: গো-শালিক/গোবরে শালিক/গুয়ে শালিক Pied Myna / Asian Pied Starling বৈজ্ঞানিক নাম: Sturnus contra .
ঝুঁটি শালিক : আমার বাগানে প্রায়ই ঘুরে বেড়ায় এরা। গ্রামে গঞ্জের
সর্বত্রই দেখা যায় এদের। ঠোঁটের গোড়ায়
ঝুঁটি আছে বলে একে ঝুঁটি শালিক বলে।
“রথ দেখা আর কলা বেচা”-র উদ্দেশ্য নিয়ে রোজই দুপুর শেষে বেরিয়ে
পড়ি বাড়ির আশেপাশে একটু পায়চারি করতে। হাতে থাকে
সঙ্গী ছোট্ট ক্যামেরাটা। আমার বাড়ির
আশেপাশেই লালে লাল হয়ে ফুটে থাকে শিমুল পলাশ মান্দার ফুল। তার আগুনরঙা পাপড়ির উপর অসংখ্য পাখিদের আসা-যাওয়া বেড়ে যায় তখন। তারা ফুলের ওপর নেচে বেড়ায় আর প্রাণ ভরে মধু পান করে। অসংখ্য পাখির মতো ঝুঁটি শালিকও এসে ফুলের দখল নেয় মধুর
লোভে।
পাখি পরিচিতি : ঝুঁটি শালিক/জংলী ময়না (Jungle myna)
বৈজ্ঞানিক নাম: Acridotheres Fuscus.
কাঠশালিক :
কাঠ শালিক খুব দুর্লভ দর্শন পাখি। সচরাচর এখানে ওখানে না পাওয়া গেলেও যেখানে শিমুল পলাশ মান্দার ফুল ফোটে,কাঠশালিক সেখানেই ভিড় জমায়। ফুলের ভেতর মুখ ডুবিয়ে দিয়ে মধু পান করে মনের সুখে। আমার বাড়ির কাছেই শিমুল,পলাশ,মান্দার,করবী,কাঠচাঁপা ফুলের ওপর কাঠশালিককে নেচে বেড়াতে দেখেছি। কাঠশালিক দেখতেও ভারী সুন্দর। বিশেষ করে
ওদের চোখদুটো খুবই উজ্জ্বল। সব শালিক পাখিই গান গায়,অপূর্বসুন্দর শীষ দেয় তারা। কিন্তু কাঠশালিক সব থেকে বেশি ভালো গান গায়।
পাখি পরিচিতি : কাঠ শালিক : Grey- headed Myna(Chestnut-
tailed starling)
বৈজ্ঞানিক নাম : স্টারনাস মালাবেরি
কাস (Sturnus
malabaricus).
গাঙ শালিক:
দেখতে অনেকটা ভাত শালিখের মত। চোখের পাশের রঙ লাল বা ইটরঙা। স্ত্রী ও পুরুষ পাখি একই রকমের দেখতে। গাঙ বা নদীর ধারে বসবাস করে এবং ডিম পাড়ে বলে হয়তো এদের নাম গাঙ শালিক। এরা আমার
বাড়ির ধারে কাছে আসেনি। আমি গিয়েছিলাম ওদের সাথে দেখা করতে। পুরুলিয়ার
বানসা গ্রামে একে খুঁজে পেয়েছিলাম।
পাখি পরিচিতি : গাঙ শালিক (Bank Myna)
বিজ্ঞানসম্মত নাম - Acridotheres ginginianus.
জাভান ময়না :
দিন কয়েক আগে একদিন দুপুরে একজোড়া জাভান
ময়না এসেছিল আমার বাগানে। দুটোকে একসঙ্গে দেখতে পেয়েই তাড়াতাড়ি ক্যামেরা বার করে
নিয়ে যেতে যেতেই একটা উড়ে গিয়ে খানিক দূরে বসলো,আমার নাগালের বাইরে। তাই ওদের
দুটোকে একফ্রেমে বন্দি করতে পারিনি।ওর ছবিটা তোলার পর মনে হলো,যেন
আমার হাতে ক্যামেরাটা দেখে হাঁ হয়ে গিয়ে ভাবছে ….এটা কে রে বাবা! ওটা আবার কি জিনিষ!
প্রথমদিকে প্রায় অচেনাই ছিল পাখিটা। তারপর বার কয়েক এদের দেখে দেখে নাম জেনে গিয়েছি। যদিও
এরা জাভা ও বালির স্থানীয় পাখি তবুও আমাদের গ্রামেগঞ্জে ও চাষযোগ্য
এলাকায় বসবাস করে। জাভান ময়না সর্বভুক। পোকামাকড়,ফলমূল,বীজ এবং বর্জ্য পদার্থ
এদের পছন্দের খাবার। সাধারণ শালিকের মতোই এদের গলার স্বর। প্রকৃতিগত
ভাবে এরা খুবই সাহসী, মানুষকেও ভয় পায় না।
পাখি পরিচিতি: জাভান ময়না/ শালিক (Javan Myna).
বৈজ্ঞানিক নাম: Acridotheres
Juvanicus.
এরা সাদা ময়না বা white vented Myna নামেও পরিচিত।
ব্রাহ্মণী শালিক…
ডিসেম্বর মাসে পুরুলিয়ায়
গিয়েছিলাম। সেখানে বানসা গ্রামে ঘুরতে ঘুরতে দেখা পেলাম
যুগল ব্রাহ্মণী শালীকের। ইলেকট্রিক তারে দুজনে বেশ গুছিয়ে বসেছিল। এদের
শরীরের
গড়নটাই বেশ রাগী রাগী। তবে এত্তো রাগী হওয়া ভালো নয়! অন্য পাখিরা এদের ধারে কাছে ঘেঁষতে পারে না! চাল-চলনেও বেশ গুন্ডা গুন্ডা ভাব।
সে যাইহোক,দুজনে বসে আছে দেখে আমি সবে ছবি তুলতে
যাবো,এমন সময় সঙ্গিনীর দিকে এমন করে তাকালো যে সে বাধ্য হয়ে
উড়ে চলে গেল ঝোপ-জঙ্গলের মধ্যে। তাই তাকে নাগালে পেয়েও ছবিতে ধরতে পারিনি। শুধু
পুরুষ পাখিটার ছবি তুলে চলে এসেছিলাম।
যখন ফিরে আসছিলাম তখন প্রায়
মাঝদুপুর। হটাৎ দেখি জংলা ঝোপের মাথার উপর বসে সেইরকম রাগী চোখ নিয়ে সে যেন আমাকেই
মেপে নিচ্ছে!আর তার মাথার চুল পিছন দিকে খাড়া
খাড়া হয়ে উঠেছে।
ব্রাহ্মণী শালিক আকারে অন্য শালিকের মতোই। প্রাপ্তবয়স্ক পাখির চাঁদি,ঝুঁটি
ও ঘাড়ের পেছনের অংশ কালো। পুরুষের মাথার ঝুঁটি ঘাড়ের পেছনে ঝুলে পড়ে। কালচে লেজের
আগা সাদা এবং চোখের পেছনের চামড়া নীলচে। পা,পায়ের পাতা ও
নখের রঙ হালকা কমলা-হলুদ। ঠোঁট দু'খানা হলুদ রঙের। স্ত্রী পাখির চেহারা একটু
আলাদা। তার লম্বাটে গড়ন। আর মাথার ঝুঁটি পুরুষ পাখির মতো ঘাড়ের নীচে অবধি ঝুলে
থাকে না বা খাড়া হয়ে ওঠে না। ওরা যখন দল বেঁধে থাকে খুব মিষ্টি সুরেলা গানে ভরিয়ে তোলে
জায়গাটা।
পাখি পরিচিতি :
ব্রাহ্মণী শালিক বা ব্রাহ্মণী ময়না পুরুষ (Brahminy Starling Male)বৈজ্ঞানিক নাম: স্টারনিয়া প্যাগোডারাম (Sturnia pagodarum).
পাখি আর প্রকৃতি একে অন্যের পরিপূরক। ওরা প্রকৃতির সৌন্দর্যের অঙ্গ এবং পরিবেশের বন্ধু। নীল দিগন্তে স্বপ্নের উড়ানে ভেসে চলা সুন্দর পক্ষীকুল যাতে চিরতরে হারিয়ে না যায়
তার জন্যে মানব সমাজকেই সচেষ্ট হতে হবে। ফিরিয়ে দিতে
হবে ওদের ওড়ার আকাশ, নির্মল প্রকৃতি ও দূষণমুক্ত পরিবেশ।
ক্রমশ ………
১২তম পর্ব পড়ুন আগামী শনিবার ।
বিঃদ্রঃ – সব ছবি এবং ভি ডি ও লেখিকার নিজের তোলা ।
লেখিকার জীবনের সঙ্গে গল্প অঙ্গাঙ্গিকভাবে জড়িয়ে আছে। যা দেখেন, যা শোনেন, যা শোনেন, যা কিছু স্মৃতির পাতায় জড়িয়ে আছে মনের সাথে,তাই নিয়ে লিখতেই বেশি পছন্দ করেন।
লেখা শুরু স্কুল-ম্যাগাজিন, কলেজ -ম্যাগাজিন দিয়ে। বর্তমানে কিছু লেখা প্রকাশিত হচ্ছে কয়েকটি মাসিক-ত্রৈমাসিক পত্রিকায়। বর্তমানে বার্ড’স ফটোগ্রাফী এবং “পাখি-প্রকৃতি” নিয়ে লেখা শুরু করেছেন।