Advt

Advt

pakhi-prakriti-part-6-bulbuli-red-vented-bulbul-pycnonotus-cafer-red-whiskered-bulbul-pycnonotus-jocosus--jana-ajana-feature-by-shrabani-chatterjee-tatkhanik-digital-bengali-web-bangla-e-magazine-পাখি-প্রকৃতি-শ্রাবণী-চ্যাটার্জী


 

৫ম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন

লেখিকার অন্যান্য লেখা পড়তে এখানে ক্লিক করুন

৬ষ্ঠ পর্ব শুরু ……

বুলবুল কাহিনী

 বুলবুলি পাখিগুলোকে দেখলেই মনে পড়ে যায় ঘুমপাড়ানি সেই গানটার কথা, -

সোনা ঘুমল পাড়া জুড়ল বর্গী এলো দেশে,বুলবুলিতে ধান খেয়েছে খাজনা দেবো কিসে”!

শুনেছি,আমার ‘মা’-ও নাকি আমাদের ঘুম পাড়াতে এই গানটাই গাইত। কালে কালে সব মায়েরাই সন্তানকে ঘুম পাড়ানোর সময় তার মায়ের কাছ থেকে শোনা গানটি গেয়ে থাকেন। আমিও গাইতাম আমার ছেলেমেয়েকে ঘুম পাড়াবার সময়। এখন অবশ্য এই গান গেয়ে অনেক ‘মা’-ই হয়তো তার বাচ্চাকে ঘুম পাড়ায় না। 

বুলবুলি পাখির ধান খাওয়ার সঙ্গে বর্গীর সম্পর্কটা কি এবং কেন, সেটা বড়ো হয়ে ইতিহাস বই পড়ে জেনেছিলাম। বাংলার মসনদে যখন আলীবর্দি খাঁ রাজত্ব করছিলেন, সেই সময়ে এদেশে বর্গী আক্রমণ হয়েছিল। বর্গীরা দলবেঁধে গ্রামে গ্রামে  লুটপাট করতে শুরু করেছিল। সে কথা কানে যেতেই  নবাব তাঁর সৈন্য-সামন্ত নিয়ে শক্ত হাতে বর্গী দমন করতে এগিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু বর্গীদের একটা দল তখন মুর্শিদাবাদ ছেড়ে  হুগলী জেলায় পালিয়ে এসে নতুন করে  স্থায়ী আস্তানা  তৈরি করেছিল। তারা গ্রামবাসীদের উপর অকথ্য অত্যাচার করে খাজনা আদায় করতো। খাজনার হার এতই বেশি ছিল যে গরিব মানুষের পক্ষে তা দেওয়া সম্ভব হতো না। দুরন্ত-দামাল ছোট ছেলে ঘুমিয়ে পড়লে পাড়া শান্ত হতো কিন্তু খাজনা একটুও কম হোতো না বা বর্গীদের শান্তও  করা যেতো না। খাজনা না দিয়ে বর্গীদের ফিরিয়ে দেবার জন্যে বিভিন্ন বাহানায় বুলবুল পাখির ধান খেয়ে যাওয়ার  গল্প বলতো তারা। তখন এই ছড়াটা তৈরি হয়েছিল।

বুলবুলিকে নিয়ে কবি সাহিত্যিকরা যে যাই বলুক না কেন, ওদের আমি কখনও গান গাইতে দেখিনি!তবে,সারাদিন মিষ্টি সুরে ডাকাডাকি করে গাছের ডালে ডালে ঘুরে বেড়াতে দেখেছি।।

আমাদের ছোটবেলার সেই গানটা “পাখিদের ওই পাঠশালাতে কোকিল গুরু…….., আর গানের এই লাইনটা “বুলবুলির ওই মিষ্টি গলা,তাইতো সবাই ছুটে আসে,চন্দনা বউ মনে মনে বুলবুলিকেই ভালোবাসে”…… সকলের খুব প্রিয় ছিল। তবে ওটা কেমন যেন গল্প কথা। 

 অনেক রকমের বুলবুল পাখি আছে। কেউবা খয়েরি বুলবুল,কেউ বা সিপাহী বুলবুল আবার কেউ বা লাল-পুচ্ছ বুলবুল,কেউবা শাহ বুলবুল। এরা সবাই সমতলের পাখি। এরা পাহাড়ে যে থাকে না তা নয়! তবে অনেকরকম পাহাড়ি বুলবুল আছে,তাদের মধ্যে হিম-বুলবুলিকেই আমি দেখেছি। তার যেমন রঙ তেমনই রূপ! একটা অদ্ভুত ব্যাপার হল, সমতলের বুলবুল পাহাড়ে গেলেও পাহাড়ি বুলবুল কিন্তু সমতলে আসে না।

 পাখি কমবেশি সবাই চেনে। তবে,খুব কম মানুষই পাখিদের সঙ্গে কথা বলেন। আজ বুলবুলিই থাকুক আমাদের সাথে। তাকে আমি রোজ দেখি আর রোজ লিখে রাখি তার কথা।

 ভালোবেসে পাখিটাকে কেউ বলে বুলবুল,কেউ বলে বুলবুলি। কত গানে কত ভাবে সবাই তাকে চিনেছে। একদিন সকালবেলা বুলবুল এসে আমার কাঞ্চন গাছের সরু ডালে বসে ডেকেই চলেছে। খুব রাগ হল অমন চিৎকার শুনে। আমি বললাম আরে:! তুই না চেঁচিয়ে বলতো কি বলছিস? ওমা! সে মাথা সোজা করে তুলে বলে কিনা,’দেখো আমি বাড়ছি মাম্মি’……. তাকিয়ে দেখি সত্যিই তো! কাঞ্চন গাছের সরু আগায় উঠে সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছে সে,বেশ লম্বা দেখতে লাগছে ওকে। তবুও কপট রাগ দেখিয়ে আমি বললাম,তোরা তো পাখি,কোথা থেকে এসব কথা শিখছিস বলতো! সে বলল তোমাদের টিভির বিজ্ঞাপন থেকে। আমি হেসে বললাম,দাঁড়া তোকে দেখাচ্ছি মজা। কথাটা শুনে ব্যাটা পালাল তক্ষুনি।

 পরেরদিন দেখি আর এক কত্তা-গিন্নি বুলবুল একসঙ্গে দুজনে এসেছে। তা দুজনকেই দেখতে একইরকম,ঠিক চিনতে পারছিলাম না। কিন্তু স্বভাব বৈচিত্র্যে এরা মানুষের মতোই,তাই পরক্ষণেই স্ত্রী-পুরুষ চিনতে অসুবিধে হল না।

 "আজ খুব জমিয়ে খাবো"……. কথাটা কানে আসতেই ঘুরে তাকিয়ে দেখি একজোড়া বুলবুল এসেছে। আমাদের বাগানের কাঁঠাল গাছে গোড়া থেকে আগা অবধি এত বড়ো বড়ো কাঁঠাল হয় যে ফলের ভারে অনেক সময় গাছের ডাল ভেঙে পড়ে। যাইহোক,একজোড়া পেল্লায় সাইজের কাঁঠাল দেখতে পেয়ে তো আনন্দে আটখানা তারা,একেবারে কাঁঠালের গা ঘেঁষে এসে বসলো। তা অমন নধর কাঁঠাল দেখে গিন্নি-বুলবুলি আর লোভ সামলাতে না পেরে আগেই ঠোঁট বসিয়ে দিয়েছে তাতে। তাই দেখে কত্তা বুলবুল একেবারে রেগে টং হয়ে গিয়ে কি যাচ্ছেতাই কাণ্ড করলো সেদিন। প্রথমে তো দুজনের তুমুল ঝগড়াঝাঁটি হল,তা থেকে ঝাপটা-ঝাপটি, কামড়া কামড়ি সবই হল। আমি দেখছি আর ভাবছি এরা করছেটা কি! অবশ্য কাকেই বা বলবো? পাখি আর মানুষ,সব ঘরেরই এক অবস্থা।





 পাখি বলেই ওদের মারপিট-ঝগড়াঝাঁটি বেশ কৌতূহল নিয়েই দেখলাম! কত্তা বুলবুল তেড়ে এসে বলল,কেন তুমি আগে কাঁঠালটা খেতে গেলে? আমি কত্তা,আমাকে না দিয়ে.. ছিঃ ছিঃ!!মাথা নিচু করে গিন্নি-বুলবুলি বলল খুব ভুল হয়েছে,রাগ করোনা প্লিজ। কিন্তু কে শোনে কার কথা!

 কাঁঠাল খাওয়া নিয়ে যা হল তা আমার চোখের সামনেই। ঘটনার পর কত্তা-বাবু রাগ করে চলে গেল, আর গিন্নি জলে ভেজা চোখ নিয়ে তার যাবার পথের দিকে তাকিয়ে রইলো! সম্ভবত: ওটাই স্ত্রী বুলবুলি-ই হবে! ওদের দেখে বুঝলাম, কত্তা-গিন্নির ঝগড়া পাখিদের মধ্যেও নিত্য দিনের ব্যাপার!

 গাড় বাদামী আর কালো রঙের মিশ্রণে আমাদের বুলবুলিকে ভারী মিষ্টি দেখতে। একদম স্লিম ফিগার।

 বুলবুলি সামাজিক পাখি। তাই জোট বেঁধে ওরা থাকতে পছন্দ করে। ওদের ভালোবাসা কিন্তু বেশ গভীর। ঝগড়া করলেও ওরা জোড়ায় জোড়ায় থাকে। জোড় ছাড়া ওদের প্রায় দেখাই যায় না। বাগানে ঝোপের মধ্যে,আগাছার জঙ্গলে এক সঙ্গে দল বেঁধে কিচিরমিচির শব্দে ওরা মাতিয়ে রাখে। আর হৈ চৈ করে বি কুইক,বি কুইক করে মুখরিত করে রাখে চারিদিক।

 মনে পড়ে গেলো বছর খানেক আগের একটা কথা। সেদিন দুপুরের পর বাড়ির সামনেটাতে একটু পায়চারী করছিলাম। অভ্যাস বশত: ক্যামেরাটা হাতেই থাকে এই সময়। দেখলাম, একটা বুলবুলি এসে আমার সামনেই একটা গাছের মাথার উপর গজিয়ে ওঠা বুনো ঝোপের লতানো ডালে এসে বসলো। সবে একটা ছবি তুলেছি,কিন্তু মনে হল যেন বুলবুলিটা কিছু বলতে চাইছে আমাকে! ভালো করে বোঝার চেষ্টা করলাম কি বলছে! বুলবুলি বলল জানো কাকিমা, তোমরা তো সোজা হয়ে বসে খাবার খাও। আমরা কিন্তু উল্টে গিয়ে ঝুলে ঝুলে খাবার খেতে দারুণ মজা পাই! কথাটা বলেই লতানো ঝোপের ডালে ঝুলে ঝুলে ফল খেতে লাগলো। লতানো গাছে তেলাকুচো ফল ঝুলছে। বুলবুলি খেতে খেতে একবার মুখ বাড়িয়ে বলল,জানো তো তেলাকুচো ফল আমাদের ভীষণ প্রিয়। আমি বললাম তবে তো ভালোই হল, এইবেলা বেশি করে খেয়ে নে।

 বুলবুলিরা খুবই চঞ্চল স্বভাবের পাখি। স্থির হয়ে যেন তারা বসতেই পারে না। তার ওপর আবার বেশ ঝগড়াটে এবং খুবই লড়াইবাজ।

 আমার বাড়িতে দলে দলে পাখি আসে ভাত খেতে। দিন কয়েক আগে দুপুরবেলা রান্নাঘরের চালে ভাত দিয়েছি।  একদল পাখি ছুটে এলো ভাত খেতে। বুলবুলি আর শালিকের দল এসেই তাদের তাড়িয়ে দিলো। তারা চলে যেতেই ওই ভাত নিয়ে লড়াই বাঁধল পাঁচ-ছটা বুলবুলি আর গোটা চার-পাঁচ শালিকের মধ্যে।

 বাপ রে বাপ! দু’দলই খামচা-খামচি, পালক ঝাপটানি, ঠোঁট হাঁ করে চিৎকার শুরু করলো। আমি ক্যামেরা হাতে নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে গেলাম। দেখি,মারামারি কাকে বলে! বুলবুলির দল এঁটে উঠতে না পেরে চলে গেল, শালিকদের মধ্যে তিনটে শালিক আবার পিছু পিছু উড়ে গেল ওদের তাড়াতে।

 ওমা!পরক্ষণেই দেখি বুলবুলিগুলো আরও বড়ো দল নিয়ে এসেছে। শালিকরাও ছাড়বার পাত্র নয়। বুলবুলিকে মাটিতে ফেলে তার ঘাড়ের উপর চেপে বসলো। শালিকের ওই ষণ্ডা-গুণ্ডা চেহারা দেখে ভয় পেয়ে বুলবুলিরা কোনও রকমে ওদের সঙ্গী পাখিটাকে ছাড়িয়ে নিয়ে পালাল। তারপরেও কিছু হয়েছিল কিনা আমি জানি না। এই ঘটনার ছবি আমি তুলে রেখেছি।


শালিকের সঙ্গে বুলবুল পাখির মারামারি চলছে ভাত খাওয়া নিয়ে। 

 কিন্তু সেদিন বুলবুলির বাচ্চাগুলোর জন্যে আমার খুব খারাপ লাগছিল। বুলবুলি-কত্তা-গিন্নি তিনটে বাচ্চা নিয়ে এসেছিল। সদ্য তারা উড়তে শিখেছে। বাবা-মা তাদের ধরে ধরে শেখাচ্ছিল কিভাবে ভাত খুঁটে খুঁটে খেতে হয়। অন্য পাখিদের সঙ্গে মিলে মিশে দু-চার দানা সবে ঠোঁটে তুলেছে,আর তখনি শালিকের সঙ্গে বুলবুলির মারপিটের শুরু হল ভাতের দখল নিয়ে। অন্য নিরীহ পাখিরা খাওয়া বন্ধ করে পাশে সরে গিয়ে হাঁ করে দেখছে! সবাই চুপ। মনুষ্য সমাজে যেমন হয় আর কি! প্রথমে ভেবেছিলাম বুলবুল-কত্তা-গিন্নি বুঝি ভয় পেয়ে পালাল,কিন্তু না:,তারা বাচ্চা তিনটেকে নিয়ে গিয়ে রেখে এসেছিল আর সঙ্গে বাকি বুলবুলিদের ডেকে এনেছিল। 



 পাখি পরিচিতি: বাংলা বুলবুল/খয়েরি বুলবুলি/লাল-পুচ্ছ বুলবুলি (Red-vented bulbul) বৈজ্ঞানিক নাম: ‘পিকনোনোটাস কাফের’ (Pycnonotus cafer).

  বুলবুলি পাখির বৈশিষ্ট্য হল ঝুঁটি। বাংলা বুলবুলির মাথার ঝুঁটিটা খুবই ছোট। স্ত্রী-পুরুষ একই রকম দেখতে। মাথা ও গলা চকচকে কালো। সারা শরীর এবং ডানা গাড় খয়েরি বা বাদামী রঙের। ডানা,পিঠের ওপরের অংশ ও বুকের প্রতিটি পালকের আগায় খুব সরু সাদা পট্টি নজরে পড়ে। চোখের ভেতরের অংশ গাড় পিঙ্গল। ঠোঁট ও পায়ের রঙ কুচকুচে কালো। লেজের নিচের অংশ অর্থাৎ অবসারণী ঢাকা থাকে উজ্জ্বল লাল রঙের আবরণে। অবসারনীর উপরের ঢাকনাটা লাল রঙের তাই এর ইংরেজি নাম লাল-পুচ্ছ বুলবুল/বুলবুলি (Red-vented Bulbul) এদের ঠোঁট ও নখ খুব শক্ত।

 ফেব্রুয়ারি-মার্চ থেকে আগস্ট-সেপ্টেম্বর বুলবুলের প্রজনন কাল। আমার বাড়ির সামনে পুটুশ,বাবলা,সকুল গাছের ঝোপে,কখনও কাঠ-চাঁপা ফুল গাছের নিচের দিকের ডালে বুলবুলি পাখিদের বাসা বাঁধতে দেখেছি।

 ছোট্ট প্রাণ বুদ্ধি অনেক”! যতবারই বুলবুলির বাসা চোখে পড়েছে,দেখেছি একটা ‘Y’ আকৃতির ডাল বেছে নিয়ে তাতে বাসা তৈরি করেছে। সেটা দেখতে কতকটা কাপের মতো। সরু সরু কাঠির মতো শিকড়,শুকনো পাতা,শুকনো ঘাস এসব দিয়ে বাসা তৈরি করে তার ভেতর দু-চারটে ডিম পাড়ে। ডিম ফুটলে কত্তা-গিন্নি দুজনেই বাচ্চাদের দেখাশুনা করে। 



সিপাহী বুলবুল

আমার দেখা বুলবুলি পাখিদের মধ্যে যেন সবথেকে সুন্দর হল সিপাহী বুলবুলি।

 সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে ঘরের বাইরে আসার পর থেকে দিনটা আমার ভালোই কাটে। বিশেষ করে শীতের শেষের সময়টায় সকালবেলা একজোড়া সিপাহী বুলবুলি রোজ এসে ‘সুপ্রভাত’ জানিয়ে মনটা বেশ ভালো করে দিয়ে যায়। তার পর দোয়েল, টুনটুনি তো আছেই। তারাও এসে খানিকটা নাচানাচি করে।

 সিপাহী বুলবুল অনেক বেশি সাহসী এবং লড়াইবাজ পাখি।

 ইতিহাস কত যুদ্ধের, কত লড়াইয়ের, কত সংগ্রামের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে অনন্তকাল ধরে। লড়াই করতে করতে একসময় লড়াইটাই শহর ছাড়িয়ে গ্রাম-গঞ্জের একশ্রেণীর মানুষের মনে বিনোদনের অঙ্গ হয়ে উঠেছিল। ষাঁড়ের লড়াই, মোরগের লড়াই আর বুলবুলি পাখির লড়াই উৎসব-অনুষ্ঠানে ঠাঁই পেতো। শুনেছি সেই সময় কলকাতার বাবু-সমাজও নাকি বুলবুলির লড়াই নিয়ে মেতে উঠত। সাহসী সিপাহী বুলবুলিকে নেওয়া হতো সেই লড়াইয়ে।

 বছর আষ্টেক আগে একবার ঝাড়গ্রামে বেড়াতে গিয়েছিলাম। সেখানে গ্রামের আদিবাসী মানুষগুলোর সঙ্গে ক’দিনেই আমাদের খুব সখ্যতা গড়ে উঠেছিল। ওরা ঝাড়গ্রামের বিভিন্ন জায়গা ঘুরে দেখিয়েছিল আমাদের। সেখানকার গোপীবল্লভ পুরের রাধাগোবিন্দ জীউর মন্দিরে বেড়াতে গিয়ে জানলাম যে মকরসংক্রান্তিতে বুলবুল পাখির লড়াই হয় সেখানে। দূর দূরান্ত থেকে বহু মানুষ আসে। তারা কেউ পাখির লড়াই দেখতে আসে আবার কেউ পাখি নিয়ে আসে লড়াইয়ে অংশগ্রহণ করতে। শুনলাম,প্রশিক্ষিত ক্ষুধার্ত বুলবুলির চোখে আগুন উপচে পড়ার গল্প। প্রতিযোগী বুলবুলিকে পরাস্ত করে ছিটকে কোর্টের বাইরে ফেলে দেবার গল্প। যদিও তা শুনে আমার  ভালো লাগেনি। শুধু নৃশংসতার কত রূপ হতে পারে তা চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল।

 পাখির নাম: সিপাহী বুলবুল/বুলবুলি (Red-whiskered bulbul) বৈজ্ঞানিক নাম: পিকনোনোটাস জোকোসাস (Pycnonotus jocosus) .

এদের চোখের রঙ লাল, গাল ও গলার রঙ সাদা। মাথায় লম্বা কালো তেকোনাকার ঝুঁটি আছে। পিঠ বাদামি রঙের। গলা-বুকের সাদা অংশের পর থেকে পেটের রঙ খুব হালকা বাদামি ঘেঁষা। কানের নিচে উজ্জ্বল লাল পট্টি এবং লালের পাশে সাদা বর্ডার পাখিটার সৌন্দর্য অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। পিঠ থেকে লেজের উপরাংশ পর্যন্ত কালচে-বাদামি। লেজের প্রান্ত কালচে। অবসারণী উজ্জ্বল লাল রঙের। ঠোঁট ও পা কালচে। স্ত্রী-পুরুষ দেখতে একই রকম।

 ঝুঁটি ফুলিয়ে শরীরী বিভঙ্গে এমন রাজকীয় ভঙ্গিমায় গাছের ডালে বসে তা দেখে ঠিক সৈনিক সৈনিক বলেই মনে হয়। আবার মাথার চাঁদিতে লাল টুপি আছে তাই হয়তো একে সিপাহী বুলবুল বলা হয়। স্বভাব এদের বাংলা বুলবুলির মতোই। তবে আকারে অন্য বুলবুলির তুলনায় একটু সরু দেখতে লাগে। এরাও পতঙ্গভুক,অর্থাৎ গাছ থেকে পোকামাকড় ধরে খায়। আর খুব মিষ্টি সুরে ডাকে।

  প্রজনন কালে পুরুষ সিপাহী বুলবুলের কানের লাল অংশের কিছুটা উজ্জ্বল নীল রঙ হয়ে ওঠে। তখন দেখতে আরও সুন্দর হয়ে ওঠে।



 হিম বুলবুলি.

 এতো রকমের বুলবুলি পাখি আছে,তার মধ্যে খয়েরি বুলবুলি,সিপাহী বুলবুলি আর হিম বুলবুলিকেই আমি সামনে থেকে দেখেছি। পাহাড়ি বুলবুলি বা হিম বুলবুলিকে দার্জিলিংয়ে, সিটঙয়ে ছাড়াও লেহ্-লাদাখ-কাশ্মীর-মুঘল গার্ডেন বেড়াতে গিয়ে দেখেছিলাম।

 তা সেই লেহ্-লাদাখ ঘুরে আসার পর থেকে আমার ঘুম প্রায় ছুটেই গিয়েছিল। না না, ভয় পাবার মতো তেমন কিছুই হয় নি! তবুও ঘুমোতে পারছিলাম না! আসলে দিনে-রাতে যখনই ঘুমোতে যাচ্ছি, চোখ বন্ধ করলে কেবলই দেখছি পাহাড়,আর পাহাড়! ঘন নীল আকাশ তাতে সাদা সাদা খণ্ড খণ্ড মেঘ ভেসে ভেসে চলেছে! একে তো ঝর্ণা নদী,আকাশ আর পাহাড় দেখে দেখে শেষ হচ্ছে না,তার উপর কত রকমের সব পাখি উড়ে উড়ে আসছে আর সামনে এসে বসছে। এসব দেখতে দেখতে ঘুমের ঘোরে চোখ রগড়াতে রগড়াতে ঘুমটা ভেঙে যাচ্ছিলো। 

 তারমধ্যে একদিন রাতে বেশ ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ দেখি একটা হিমালয়ান বুলবুল, একগাল হাসি নিয়ে, কোথা থেকে যেন এসে বসলো গাছ ভর্তি ফুলের উপর। তারপর এদিক ফিরে ওদিক ফিরে কত ভঙ্গিমায় বসছে আর আমাকে ঘুরে ফিরে দেখছে। ওর হাসি দেখে আমার কেন জানি না খুব গা জ্বলে গেল।

 তবুও কৌতূহল নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। হা: হা: করে হেসে বুলবুল বলল,সবে সেলুন থেকে এলুম গো! ভালো করে দেখো তো চুলটা স্পাইক করে আমাকে কেমন লাগছে?

 আমি বলে উঠলাম,তোরা তো মানুষদের দেখে দেখে সব শিখছিস। সেই কথা শুনে বুলবুলিটা আরও জোরে হেসে উঠে বলল দূর! তোমাদের ছেলে ছোকরাগুলোই তো আমাদের দেখে দেখে নিজেদের চুলে স্পাইক করতে শিখেছে। এখন তো তোমাদের দেশে কিংবা শহরে কিংবা গ্রামে, বেশির ভাগ ছেলেদের স্টাইল হয়েছে সোনালী চুল আর তাতে স্পাইক করা। আমি বললাম মোটেই না, তুই বাজে বকছিস। তোরাই আমাদের সবকিছু নকল করিস। বুলবুলিটা বলল, আর তোমরা যে যেখানে যা দেখো তাই নকল করো, তার বেলায়?

 পাখি বলছে, আমি বলছি! এই নিয়ে তর্কাতর্কি হতে হতে ঘুমের মধ্যেই আমার মাথাটা গেলো গরম হয়ে। আর তখনই আমি বুলবুলিটাকে তাড়াবার জন্যে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম।

 হঠাৎ দেখি আর একটা বুলবুলি তার বয়সটা একটু বেশিই হবে, সে অন্য একটা গাছের ডালে বসে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমার চোখে চোখ পড়তেই সে বলে উঠলো, ওর বয়স কম বুঝলে কি না! তোমাদের ওই চ্যাংরা ছেলেদের মতোই খানিকটা আর কি। কি বলতে কি বলে ফেলেছে, আসলে ওই স্পাইকটাই আমাদের বৈশিষ্ট্য। এই দেখো না আমারও আছে, এখন তবে একটু ঘেঁটে গিয়েছে! ওকে ক্ষমা করে দাও দিদি। শুনেছি,শত দোষ করলেও নাকি তোমরা সবাই কে ক্ষমা করে দাও ..

আমি বললাম ক্ষমা করবো! দাঁড়া,আজ তোর একদিন কি আমার একদিন। এই কথা বলে লম্বা লাঠিটা হাত বাড়িয়ে নিতে গিয়েই হঠাৎ আমার ঘুমটাই ভেঙে গেলো! ওমা! তার মানে এতক্ষণ আমি স্বপ্ন দেখছিলাম!

 একটু ধাতস্থ হয়ে ঘড়িতে কটা বাজে দেখতে গিয়ে দেখি, আমার হাতে ফোনটা ধরা রয়েছে,আর গ্যালারিতে ওই হিমালয়ান বুলবুলির ছবিগুলো জ্বল জ্বল করছে।

 কানে তখনও ওর কথাটা বাজছে “কি গো, স্পাইক করে কেমন লাগছে আমায় একবার বলো তো দেখি!



 পাখি পরিচিতি : হিম বুলবুলি/ হিমালয়ী বুলবুলি। সাদা-গাল বুলবুলি। বৈজ্ঞানিক নাম: পিকনোনটাস লিউকোজেনিস (Pycnonotus leucogenys)

এদের মাথা,গলা এবং ঝুঁটি কালো। গাল দুটো সাদা। ডানার পিছনে ও পাশে ছাড়াও লম্বা লেজটি ধূসর বাদামী রঙের। অবসারণীর উপরের অংশ উজ্জ্বল হলুদ। মাথায় অসাধারণ সুন্দর একটা ঝুঁটি আছে যেটা দেখলেই মনে হবে যেন স্পাইক করা চুল। কালো মুখ,চোখদুটো চকচকে কালো কাঁচের গুলির মতো।

 এরাও গায়ক পাখি। মিষ্টি দূরে সারাক্ষণ মাতিয়ে রাখে পাহাড়ি এলাকা। অঞ্চলভেদে সামান্য পরিবর্তন থাকলেও, একইগণ এবং একই প্রজাতির পাখি তাই বাংলা বুলবুলির সঙ্গে এদের জীবনযাত্রার কোনও প্রভেদ নেই।

 

ক্রমশ ……

৭ম পর্ব পড়ুন আগামী শনিবার

বিঃদ্রঃ – সব ছবি এবং ভি ডি ও লেখিকার নিজের তোলা । 

লেখিকার পরিচিতি –

লেখিকার জীবনের সঙ্গে গল্প অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে। যা দেখেন, যা শোনেন, যা শোনেন, যা কিছু স্মৃতির পাতায় জড়িয়ে আছে মনের সাথে,তাই নিয়ে লিখতেই বেশি পছন্দ করেন

লেখা শুরু স্কুল-ম্যাগাজি, কলেজ -ম্যাগাজিন দিয়ে বর্তমানে কিছু লেখা প্রকাশিত হচ্ছে কয়েকটি মাসিক-ত্রৈমাসিক পত্রিকায় বর্তমানে বার্ড’স ফটোগ্রাফী এবং পাখি-প্রকৃতি” নিয়ে লেখা শুরু করেছেন