মৌটুসী আর দুর্গা টুনটুনি (শেষ অংশ)
৪র্থ পর্ব পড়তে এখানে
ক্লিক করুন ।
লেখিকার অন্যান্য লেখা
পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
পর্ব – ৫
দুষ্টু-মিষ্টি এই পাখি দম্পতিকে আমরা আদরের নামে ডাকি
মোটুসী আর দুর্গাটুনটুনি। ইংরেজি এবং
বৈজ্ঞানিক নামগুলো পাখিদের গায়ের রঙ,তাদের স্বভাব,তাদের প্রজাতি,পাখির
গণ এবং তাদের বর্গ অনুযায়ী হয়ে থাকে।
সেই অনুসারে পাখির ইংরেজি নাম মৌটুসী - Olive-backed Sunbird
female. আর দুর্গাটুনটুনি - Purple
Sunbird male.
বৈজ্ঞানিক নাম: Cinnyris
jugularis. এরা
'জলপাইপিঠ মৌটুসি' নামেও পরিচিত।
পাখিগুলো ছোট্ট হলেও বুদ্ধি ভীষন প্রখর আর গতি ততটাই
ক্ষিপ্র। সদা সতর্ক
দৃষ্টি। একটা সোয়া
সেকেন্ডও এক জায়গায় বসে না ওরা,এতটাই চঞ্চল।
যখনকার কথা বলছি,সম্ভবতঃ সেটা ছিল এপ্রিল মাস। সারাদিন রোদ ঝলমলে আকাশ ছিল। রোদের আলোয়
চারিদিকে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। নির্মেঘ আকাশে
দুপুর বেলার দিকে আচমকা ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি এলো। এমন বৃষ্টি সচরাচর হয় না। সেই সময় জলপাইপিঠ মৌটুসী পাখিটা এসেছিল। বৃষ্টি এসে যাওয়ায় আমরা ঘরের ভেতর ঢুকে পড়েছি। ঘরের জানলা দিয়ে দেখি মৌটুসী পালিয়ে যেতে না পেরে,জবা গাছের পাতার নীচে লুকিয়ে বসে পড়েছে। ঝলমলে রোদ
তাতে ঝকঝকে নীল আকাশ। প্রজনন কালে
রঙ না বদলালেও মৌটুসীর রূপের লাবণ্য ছড়িয়ে পড়েছে গাছের পাতার আড়ালে। আর রোদের আলো জবা ফুলের উপর বর্ষিত হয়েছে। ফুলের লাল রঙ পাখির গায়ে বিচ্ছুরিত হয়েছে। অপরূপ সুন্দর সেই রূপ আমি ঘরের জানলা দিয়ে প্রত্যক্ষ করছিলাম। তখনই ছবি তোলার জন্যে মনটা ব্যাকুল হয়ে উঠলো। মুহূর্তে এক মিনিটের ব্যবধানে ক্যামেরা হাতে নিয়ে ঘরের বাইরে
বেরোবার চেষ্টা করতেই আমার কত্তামশাই বললেন, এখনই ঘরের বাইরে যেওনা। তাহলে পাখিটা নিশ্চিন্ত আশ্রয় ছেড়ে বেরিয়ে পড়লে বৃষ্টিতে দিশেহারা
হয়ে যাবে। তাই জানলা
দিয়েই একটা ছবি তুলেছি। সে ছবিটাও
ভারী সুন্দর হয়েছে। পরে ছবিটা দেখে মনে হয়েছে আমাকে ডেকে যেন পাখিটা বলছে “"দেখো,কেমন ছাতার তলায় বসে আছি।বৃষ্টি
পড়ছে তো কি হয়েছে"!
আমি যা লিখছি তা শুধুই পাখির কথা,
ওদের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা বিভিন্ন ঘটনা আর ওদের নিয়ে কল্পনার স্বপ্নকথন। তাতে কাব্য বা সাহিত্যের একটা কণাও নেই।
মৌটুসী বা দুর্গাটুনটুনিরা সকলেই “সানবার্ড” প্রজাতির অন্তর্গত
ছোট্ট একটা পাখি। সানবার্ডের
অনেকরকমের প্রজাতি আছে। তার মধ্যে আমার বাড়ির বাগানে purple sunbird দুর্গাটুনটুনি স্ত্রী- পুরুষ রোজ আসে। এছাড়া খুব মাঝে মধ্যে আসে বেগুনী কোমর মৌটুসী (Purple ramped Sunbird)
‘বেগুনিকোমর মৌটুসি’ (Purple-rumped sunbird) বৈজ্ঞানিক
নাম: Leptocoma zeylonica |
বেগুনী কোমর মৌটুসী পাখিকে দেখতে আরও
অসাধারণ সুন্দর। যেদিন প্রথম
দেখেছিলাম কয়েক সেকেন্ডের জন্যে আমার জবাগাছে এসে বসেছিল। হলুদ-বেগুনী রঙের পাখি লালফুলের উপর ঝলকিয়ে
উঠেছিল। অপূর্ব সে
রূপে মুগ্ধ হয়েছিলাম। এক ঝলক আমার দিকে নজর পড়তেই,সে তার চোখটা পাতার আড়ালে লুকিয়ে নিয়েছিল। এরা এতটাই তীক্ষ্ণবুদ্ধি সম্পন্ন।
পশু পাখিদের মধ্যে পুরুষ সততই সুন্দর। প্রজনন ঋতুতে পুরুষ পাখি স্ত্রী পাখির মনোরঞ্জন করতে অপরূপে
নিজেকে সাজিয়ে তোলে। দুজনেই নেচে নেচে ঘুরে বেড়ায়। পুরুষ পাখি গান গেয়ে স্ত্রী পাখিকে আকর্ষণ করে। প্রতিদিনের চেনা সুরও বদলে যায় এই সময়। বলা যায়,পুরুষ পাখির গানের সুরে আকৃষ্ট হযে প্রেমে পড়ে
যায় স্ত্রী পাখিটি। প্রেমপর্ব
শেষে শুরু হয় ঘরবাঁধার ব্যবস্থা শুরু হয়। ব্যস শুরু হয়ে যায় কত্তা-গিন্নির সংসার। এদিকে সংসার তো হলো কিন্তু বাসা বানাতে হবে স্ত্রীটুনিকে। কত্তা মাঝে মাঝে এসে দেখে বাসা ঠিকমতো তৈরি হচ্ছে কিনা। এরা দল বেঁধে ঘুরে বেড়ালেও এই কদিন দুজনে দুজনে ঘুরে ফিরে এক
ফুল থেকে অন্য ফুলে মধু ছেয়ে বেড়ায়।
স্ত্রী
পাখি যখন বাসা তৈরি করা,ডিম পাড়ার
মতো সাংসারিক কাজে ব্যস্ত থাকে পুরুষ পাখি তখন এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ালেও ডিম ফুটে পক্ষীশাবক
জন্ম নেবার মুহূর্ত থেকে পুরুষ পাখির দায়িত্ব বেড়ে যায়। এমনকি স্ত্রী পাখির প্রোটিনের ঘাটতি মেটাতে ওইসময় পোকা ধরে এনে
তাকে খাওয়ায় এবং স্ত্রী পাখির প্রতি বেশি খেয়াল রাখে।
এরা
আবাসিক পাখি। মানুষের কাছাকাছি
এলাকায় বাসা বাঁধে,গাছের নিচের দিকের ডালে। ফুলের পাপড়ি,গাছের বাকল,শুকনো পাতা,মাকড়সার জাল দিয়ে বাসাটা তৈরি হয়। বাসার উপরের দিকে গোলাকার ছিদ্র থাকে,যেখান ফিয়ে সহজেই তারা ঢুকতে বেরোতে পারে।
তবে কোনও প্রজাতির সানবার্ডই আমাদের
ছোট টুনটুনির (tailor bird) মতো অতো সুন্দর বাসা বানাতে পারে না।
এবার একটা গল্প বলি……
সবুজ লেজ মোটুসীর গল্প। এরা Mrs.Gould’s
Sunbird নামেও পরিচিত।
আমি বললাম হ্যাঁ, আমরা দার্জিলিং যাচ্ছি। গাছ রইলো, ফুলও ফুটবে। তোরা এসে ঘুরে যাস কিন্তু।
মৌটুসী বললো জানো, ওইখানকার একটা জায়গায় আমার কাকা থাকে। পারলে একবার দেখা
কোরো তো। আমাদের নাম বললেই তারা বুঝতে পারবে। শুনেছি পাহাড়ের জল হাওয়া খুব ভালো। তাই আমার কাকারা খুব সুন্দর দেখতে আর খুব ঝকঝকে উজ্জ্বল
গায়ের রঙ তাদের। দেখে তুমি চোখ ফেরাতেই পারবে না।
আমি বললাম : তবে তোরাও চল আমার সাথে।
মৌটুসী বললো না না, আসলে আমরা সমতলের পাখি তো, তাই পাহাড়-দেশে থাকতে পারি না। হয়তো কখনও গিয়ে ঘুরে চলে আসি।
আমি
বললাম তোর কাকাদের নাম কি? দেখা করতে গেলে
তো তাদের নাম জানতে হবে।
মৌটুসী বললো,আমার কাকাদের নাম: সবুজ লেজ মৌটুসী ( Green-tailed Sunbird). ওরা আমাদেরই বর্গের পাখি।
আমরা দার্জিলিংয়ে যাওয়ার পথে লেপচা
জগতে একদিন ছিলাম। লেপচাজগৎ দার্জিলিং জেলায় অবস্থিত একটা সুন্দর পাহাড়ি গ্রাম। পাহাড়ে তখন বসন্তঋতু
ধীরে ধীরে তার সৌন্দর্য মেলে ধরছে। ভোর হতে না হতেই কিচির
মিচির পাখির ডাকে মুখরিত হয়ে ওঠে চারিদিক। কাঞ্চননজঙ্ঘার উপরে
সূর্যোদযের প্ৰথম আলো প্রতিভাত হওয়ার পরেই পাহাড়ে ঘেরা লেপচাজগতের উপর সেই আলো এসে
খেলা করে। পাহাড়ের
ধাপে ধাপে থরে থরে সাজানো অপূর্ব সুন্দর সব ফুল ফুটেছে। ফুলশাখাতে পরিস্ফুটিত ফুলের উপর রঙবেরঙের পাখিরা খেলে বেড়াচ্ছে। গুচ্ছ গুচ্ছ বাসরলতা,রডোডেনড্রন ফুলের ভারে গাছের শাখা প্রশাখা নিচের দিকে ঝুলে পড়েছে। গাছের নিচে লাল কার্পেটের মতো বিছিয়ে পড়ে আছে ঝরে যাওয়া বাসি
ফুলগুলো। আমার কল্পনায় মনে হলো,গাছগুলো বুঝি মাথা নত করে অতিথি পাখিদের আহ্বান করছে। কেননা তাদেরও তো পরাগমিলন
সংযোগ ঘটবে পাখিদের আগমনে।
সেখানেই বাসরলতা গাছে দেখা হলো মৌটুসীর কাকা- কাকিমা সুবুজলেজ মৌটুসীদের সাথে। অসাধারণ সুন্দর দেখতে তাদের। সত্যিই একবার দেখলে মনে হয় শুধু দেখতেই থাকি। এত রূপের বাহার তাদের।
মৌটুসীর কাকা বলছি কারণ এরা সবাই একই
প্রজাতির। সবাই সানবার্ড গোত্রের অন্তর্ভুক্ত। শুধু রঙ আর রূপ আলাদা আলাদা। ওদের নাম সবুজ লেজ মৌটুসী ( Green-tailed Sunbird) .
অনেক প্রজাতির সানবার্ড আছে আমাদের দেশে। সবুজ লেজ সানবার্ড তাদের মধ্যে অন্যতম।এরা পাহাড়ি অঞ্চলের
পাখি। একটু
খেয়াল করলে বোঝা যায় পাহাড়ের পাখিরা সমতলের পাখিদের থেকে অনেক বেশি সুন্দর।
সুবুজ লেজি মৌটুসীর (Green-tailed Sunbird) আবাসস্থল
গ্রীষ্মমন্ডলীয় আদ্র পার্বত্য অরণ্যে। এদের বিশ্বজনীন বিস্তৃতি
বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত,নেপাল,ভুটান, মায়ানমার,থাইল্যান্ড,ভিয়েতনাম এবং তিব্বত পর্যন্ত।
পাখির বাংলা নাম : সবুজ
লেজ মৌটুসী। ইংরেজি নাম: Green-tailed
Sunbird). বৈজ্ঞানিক নাম: Aethopyga
nipalensis .
এদের স্ত্রী পাখির তুলনায় পুরুষ পাখি অনেকটা
বেশি লম্বা। স্ত্রী পাখির থেকে ওজনও
বেশি। দুজনের চেহারাও ভিন্ন। পুরুষ পাখির ঘাড় মাথা গাঢ় সবুজ। ঘাড়ের শেষ থেকে পিঠের মাঝখান পর্যন্ত খয়েরি মেশানো লাল রঙের। মাথার চাঁদি আসমানী নীল
রঙের। পিঠের নিচের দিক এবং ডানা গাঢ় জলপাই রঙের সঙ্গে খয়েরীর মিশ্রণ। লেজের রঙ গাঢ় নীল আভাযুক্ত। গলা-বুক হলদে
মিশ্রিত লাল। বুকের নিচ থেকে পায়ুদ্বার
পর্যন্ত সবজেটে হলুদ। শরীরের তুলনায় পুরুষ
পাখির লেজ খানিকটা লম্বা।
অন্যদিকে স্ত্রী পাখির গলা ও পেটের দুপাশসহ লেজের নিচে পর্যন্ত
ধুসর জলপাই রঙের। ডানা বাদামি রঙের। পেটের নিচের দিকটা জলপাই রঙের। স্ত্রী-পুরুষ
দুজনেরই ঠোঁট লম্বা,কাস্তের মতো বাঁকানো। চোখ ও পায়ের রঙ কালো।
অধুনা,গ্রাম বা শহর কংক্রিটের আবরণে ঢেকে গিয়েছে। প্রতিদিনই সবুজ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। তাই মধুপায়ী মৌটুসী পাখিরা হারিয়ে যেতে বসেছে। বিপন্ন তালিকাভুক্ত হওয়ার আগে এখনও যারা প্রতিবেশী পাখিটার সঙ্গে
পরিচিত হয়ে উঠতে পারেন নি,একটু
চোখ মেলে দেখলে হয়তো নিজের বাড়ির আশেপাশে ওদের পেয়ে যেতে পারেন। ওরাই বিশ্বপ্রকৃতির সবচেয়ে
সুন্দরতম সৃষ্টি।
ক্রমশ ……
৬ষ্ঠ পর্ব পড়ুন আগামী শনিবার ।
বিঃদ্রঃ – সব ছবি এবং ভি ডি ও লেখিকার নিজের তোলা ।
লেখিকার জীবনের সঙ্গে গল্প অঙ্গাঙ্গিকভাবে জড়িয়ে আছে। যা দেখেন, যা শোনেন, যা শোনেন, যা কিছু স্মৃতির পাতায় জড়িয়ে আছে মনের সাথে,তাই নিয়ে লিখতেই বেশি পছন্দ করেন।
লেখা শুরু স্কুল-ম্যাগাজিন, কলেজ -ম্যাগাজিন দিয়ে। বর্তমানে কিছু লেখা প্রকাশিত হচ্ছে কয়েকটি মাসিক-ত্রৈমাসিক পত্রিকায়। বর্তমানে বার্ড’স ফটোগ্রাফী এবং “পাখি-প্রকৃতি” নিয়ে লেখা শুরু করেছেন।