৩য় পর্ব পড়তে এখানে
ক্লিক করুন।
লেখিকার অন্যান্য
লেখা পড়তে এখানে ক্লিক করুন ।
পর্ব
– ৪, শুরু ......
নীল পাখিটা
মৌটুসী আর দুর্গা
টুনটুনি (১ম অংশ)
‘পাখি’ আমার কাছে এক অপার বিস্ময়ের বিষয়। দুটো ডানায় ভর করে সারা বিশ্ব চরাচর জুড়ে তার অবাধ গতি। অপার সুন্দর তার রূপ। ওরা অবলা হলেও নিজেদের মধ্যে সংযোগ রক্ষা করার জন্যে বিভিন্ন রকমভাবে ডাকে,গান গায়, শীষ দেয়, নানা ভঙ্গিমায় নিজেদের ভাবের আদানপ্রদান করে। মনুষ্য সমাজের মতো পাখিরাও সমাজ-সংসারে আবব্ধ জীব।
আমাদের
বাড়ির আশেপাশেই খুব সুন্দর সুন্দর পাখিরা বাস করে। দেশ কালের সীমানা ছাড়িয়ে আমাদের চারপাশে যে অসংখ্য পাখিরা ঘুরে
বেড়ায়,তাদের চমৎকার রূপের
বাহার একটু খেয়াল করলেই নিজের চোখে ধরা পড়বে। ওরা আমাদের প্রতিবেশী।।
আজ শোনাবো
প্রতিবেশী পাখি দুর্গা টুনটুনির কথা।
গ্রামে
গঞ্জে বাস করার সুবাদে সেই ছোট থেকেই পাখি তো দেখতাম, কিন্তু
হাতে গোনা দু’একটা ছাড়া একটাও পাখি চিনতাম না। কাক শালিক চড়াই গেরস্থের ঘরের পাখি। সুখ দুঃখের সাথী। টুনটুনি বুলবুলি পাখিরা খোকা-খুকুর চোখে ঘুম এনে দিতো তাই মায়ের মুখে ওদের
নামটাই শুনতাম। একটু বড় হতেই আমারও
সাধ জাগতো পাখি হতে। বাড়ির উঠোন,বাগানে
পায়রা শালিক কাক কোকিল,চড়াই কত পাখিই আসতো। এখন অনেকেই শহুরে চোখে পাখি দেখতেও পায় না।
ছোটবেলা থেকে টুনটুনি পাখির নামটার সঙ্গে আমরা সকলেই পরিচিত
হলেও দুর্গা টুনটুনির নাম অনেকেরই জানা নেই বা জানলেও তাদের দেখার মতো সময় হয়তো হয়ে
ওঠে না। তবে রঙে রূপে দুর্গা
একেবারেই অন্যরকম। ঘরোয়া আর পাঁচটা পাখির থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।
যখন থেকে
সত্যিকারের ভালোলাগা নিয়ে পাখি দেখতে শিখেছি,তখন থেকেই নীল টুনটুনি
আমাকে পাগল করে দিয়েছে। আমি পাখির প্রেমে
পড়ে গিয়েছি।
ওরা আমার
বাড়িতে রোজ আসে। শতবার ওদের দেখেও
আমার মন ভরে না। আমার পাখি দেখার আর
ছবি তোলার হাতে খড়ি হলো পুরুষ দুর্গাটুনটুনি আর তার স্ত্রী,মৌটুসীর ছবি ক্যামেরা বন্দি করে। আমার খোলা উঠোন,মাথার উপর খোলা আকাশ। চার পাশে অসংখ্য গাছ
আর তাতে হরেকরকম পাখির আনাগোনা লেগেই থাকে।
আমার বাড়িতে আসা-যাওয়া করে যে পাখিগুলো, তাদের সঙ্গেও মনে মনে আমার আত্মীয়তা
গড়ে উঠেছে। ওরা একদিন
না আসলেই আমি কেমন যেন চিন্তায় পড়ে যাই। আসলে আমার জবা গাছ আর রান্না ঘরের চালের (ছাদের) মাথায় বসে পাখিরা
খুব আনন্দ পায়।
ওরা
যখন আসে আমিও বেশ খুশি হয়ে উঠি। ওরাও খুশি
হয়। আমার মনে হয়
ওরা যেন আমার সঙ্গে কথা বলে। আমিও যেন ওদের
কথা সব বুঝতে পারি।
দুর্গা টুনটুনিকে প্রথম দেখেছিলাম
বেশ বছর কয়েক আগে জানুয়ারি মাসে। শীতের সকালে উজ্জ্বল রোদের আভা পালকে মাখিয়ে আমার লালজবা গাছের
একটা ফুল থেকে আরেকটা ফুলে উড়ে উড়ে বেড়াচ্ছিল। স্বভাব চঞ্চলতায় ফুলের মধ্যে বাঁকানো ঠোঁট ঢুকিয়ে দিয়ে খুশির
নাচ গান চলছিল। দুটো দুই রঙের
পাখি, একসঙ্গেই আসছে যাচ্ছে। মনে মনে ধরে নিলাম এদের দুজনের মধ্যে নিশ্চয়ই কোনও সম্পর্ক আছে। আর একজন উড়ে চলে গেলে অন্যজনও মুহুর্তে চলে যাচ্ছে। আবার ফিরে আসছে অদ্ভুত চি-হুইচ…চি- হুইচ শব্দে ডাকতে ডাকতে। সেই থেকেই
প্রতিনিয়ত পাখি দেখা,তাদের গতি-প্রকৃতি লক্ষ্য করা,তাদের ডাকার শব্দগুলো কানে নেওয়ার
অভ্যেস তৈরি হয়ে গেল। প্রথম ভালোলাগার শুরুটা একটু একটু করে ভালোবাসা এনে দিলো আমার
মনে।
আমার উঠোনের লাল জবা গাছটা তখন শরীরে
যুবতী হয়ে উঠেছে। গাছের কান্ড
বিস্তৃতি লাভ করে শাখা প্রশাখার প্রসার ঘটাতে ব্যস্ত। গাছের সবুজ পাতাগুলো আরও সবুজ হয়ে উঠছে। পাতার অগ্রমুকুলে বিকশিত নতুন পাতায় ভরে উঠেছে গাছটা। নিত্যই অসংখ্য ফুল ফুটছে আর ফুলের গতিও ঊর্ধ্বমুখী। এতদিন কাঠবিড়ালি,প্রজাপতি,পতঙ্গ এসে ফুলে ফুলে পরাগ মিলন ঘটাতো। সেই প্রথম দেখলাম ছোট্ট ছোট্ট পাখিরা আসতে শুরু করেছে। তাদেরই একজন এই দুর্গাটুনটুনি।
প্রথমবার এক ঝলক দেখলেও ঠিক বুঝে উঠতে
পারিনি। বার বার দেখার
জন্যে উৎসুক হয়ে উঠছিলাম। খুব ভালো করে
নজর করতেই দেখি খুব ছোট্ট একটা কালচে নীল রঙের পাখি ফুলের উপর লাফালাফি করছে। তারপর খেয়াল করলাম কালো নয়,তার মাথা থেকে গলা পর্যন্ত উজ্জ্বল আসমানী নীল
রং ঝলকে উঠলো। সকালের সোনাঝরা
রোদে পাখিটার রঙ আমাকে তার প্ৰতি আকৃষ্ট করলো। সেই শুরু। তারপর থেকে
আজও এত বছর ধরে রোজ ওরা আসে,আর আমি আমার স্বভাব নিয়মে ওদের ছবি তুলতেই থাকি
আমার এই পড়শী কিন্তু খুবই চঞ্চল। আর এই চঞ্চলতাই ওদেরকে আরও সুন্দর করে তুলেছে। এক্ষুনি এক ডালে তো পলক ফেলতে না ফেলতেই অন্য ডালে। আর ছবি তোলা! সে বড় দুষ্কর ব্যাপার। যদি কখনও কাস্তের
মতো বাঁকানো সরু ঠোঁট ফুলের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে বসে থাকে তাহলে সেকেন্ডের ভগ্নাংশে ওভাবেই
তাকে ক্যামেরা বন্দি করা যায়। অন্ততঃ ফুলের
মধুর লোভেই সে দুদন্ড বসতে পারে। তাই একে “মধু চুষকি” (Honey sucker) বলা হয়। মধু খাওয়ার জন্য এরা ফুলের ভেতর ঠোঁট ডুবিয়ে দিয়ে ডানা দুখানা
দুপাশে ছড়িয়ে দিয়ে শূন্যে ঝুলে থাকতে পারে।
এরা মধু চুষে খায়। মধু খাওয়ার দৃশ্যটাও ভারী চমৎকার। কাস্তের মতো বাঁকানো ঠোঁটের ভেতর থাকে ফাঁপানো নলাকৃতি জিভ। জিভের গঠন ইনজেকশনের সূঁচের মতো। সেই জিভ ফুলের ভেতর প্রবেশ করিয়ে দিয়ে মধু চুষে নেয়। অভিযোজনগত কারণেই ঠোঁটটা সরু,বাঁকানো এবং জিভটা নলাকৃতি।
নীল টুনটুনি (Purple sunbird male)
দুটো ছবি পাশাপাশি দিলাম। কেননা শুধু
একজনের ছবি দিলে তোমরা সবাই ভাবতে আমি বুঝি মিছে কথা বলছি। কেননা যে পাখির রঙ হলুদ
তার নাম কি করে আবার "নীল টুনটুনি" হয়! নয়তো বলতে পারো আমি রঙ চিনি না হলুদকে নীল বলি। এতক্ষণে
হয়তো ভেবেও নিয়েছো যে এর মাথা নেহাতই খারাপ হয়ে গিয়েছে,সবাইকে যা খুশি তাই বুঝিয়ে
ছবিদুটো চালাবার চেষ্টা করছে।
না গো না,আমি তেমন মানুষ নয়! ওর যা
নাম তাইই বললাম, বিশ্বাস করাটা তোমাদের ব্যাপার।
এবার সঠিক কথাটাই বলছি শোনো...
হলুদ ও নীল দুটো পাখিই এক। পাখিদের প্রজনন কালে
বেশীরভাগ পুরুষ পাখিগুলো বেশি রঙিন হয়ে ওঠে। আর স্ত্রী পাখিগুলোকে এ সময় কেমন যেন
ম্যাড়ম্যাড়ে দেখতে লাগে। বিশেষ করে পুরুষ পার্পল সানবার্ডদের প্রজনন কালে নিজের
রঙের সম্পূর্ণ পরিবর্তন ঘটে যায়। মার্চ-এপ্রিল থেকে জুন মাস পর্যন্ত এদের রঙ হয়
নীল বা বেগুনী আর পালকের শেষের দিকটা ব্রাউন হয়ে উঠে। এখন বাচ্চারা বড় হয়ে গিয়েছে।
পোকা ধরে নিজেরাই খেতে পারে। এবার কত্তা-গিন্নি দুজনেই বেরিয়ে পড়েছে ওদের সবথেকে
প্রিয় খাবার মধু খেতে। গিন্নির ফিকে রঙ উজ্জ্বল হয়েছে।কিন্তু ওদের রঙের পরিবর্তন
হয় না। পুরুষ পাখি নীল রঙ থেকে হলুদ হয়ে উঠেছে।গলা থেকে পেট পর্যন্ত টানা কালো
দাগটা একমাত্র পুরুষ পাখীরই থাকে।
কেউ হয়তো বিশ্বাস করবে কি না জানি
না। পাখিদের সঙ্গে
মনে মনে আমার একটা নিবিড় আত্মীয়তা গড়ে উঠেছে।
এই তো কিছুদিন আগের কথাই বলি…..
আমি তখন সংসারের কাজে ব্যস্ত। হটাৎ কাকিমা কাকিমা করে ডাকতে ডাকতে মৌটুসী এসে বসলো ঝুলন্ত
লাল জবা ফুলটার উপরে। আমি গাছ থেকে ফুল তুলি না। ওদের জন্যেই রেখে দিই। গাছে ফুল থাকলে
পাখিরা আসে গাছেরা আরও সুন্দর হয়ে ওঠে। এতেই আমার নিত্য পূজো করা হয়ে যায়।
সে যাইহোক,মৌটুসী
এসে বললো কাকিমা তোমার জামাইকে দেখেছো?
আমি বললাম কই না তো!
মৌটুসী বললে,ওহ,তুমি নিশ্চয়ই চিনতে
পারোনি নিশ্চয়ই।
আমি বললাম,ও মা চিনতে পারবো না কেন রে?
মৌটুসী বললে,আসলে এখন তোমার জামাইয়ের রঙও বদলে গিয়েছে গো!!তাই ভাবলাম!
আমি বললাম দূর,সেই কবে থেকে ওকে দেখছি। জানি তো,এখন ওর হলুদ রঙটা নীল হয়েছে! ঘাড়ের পালকগুলো আরও উজ্জ্বল হয়েছে। আর দু’দিকের ওড়ার পালকের ভেতর থেকে লাল-হলুদ পাখনা গজিয়েছে! তাই তো!
মৌটুসী বললে হ্যাঁ। তাই তো এই সময়টায় ওকে চোখে চোখে রাখি। বলা তো যায় না,যদি…….
মোটুসীর কথা শেষ না হতেই আমি গালে হাত
দিয়ে বললাম সে কি রে! তা তোকে
সে ভালোবাসে তো?
মৌটুসী লজ্জ্বা রাঙা হয়ে বললো হ্যাঁ, খুউব……। সেই জন্যেই তো এই সময় ওর পিছু ছাড়তে পারি না। ওই দেখো গো কাকিমা,চুপি চুপি ফুলের উপর বসে আমাদের কথা শুনছিল।
আমি বললাম,সত্যি
তো! মেয়ে আমার যেমন তেমন,কিন্তু জামাই আমার
রূপবান! সারা গাছটায় উড়ে উড়ে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে! মৌটুসীকে দেখতে
পেয়ে দুর্গা (পুরুষ দুর্গা টুনটুনি)
মিষ্টি সুরে গান ধরলো। গান শুনে মৌটুসী ফুলের উপর পাখনা মেলে দাঁড়িয়ে পড়লো। দুজনের খুশি আর ধরে না!
তারপর তো কর্তাগিন্নি ঘুরে ফিরে আসছে
আর পোকা ধরে ধরে খাচ্ছে। কখনও বাঁকানো লম্বা ঠোঁট আর নলাকৃতি জিভ (ইনজেকশনের নিডলের মতো)ফুলের
ভেতর ঢুকিয়ে দিয়ে ফুলের মধু খাচ্ছে। সে দৃশ্য দেখতে দারুণ লাগে।
হঠাৎই ঘুমটা ভেঙ্গে গেলো পাখির ডাকে। তাকিয়ে দেখি বেশ বেলা হয়ে গিয়েছে। তার মানে দুর্গাটুনটুনির স্বপ্ন দেখছিলাম এতক্ষণ!
এতক্ষণ যত কথা বললাম, পাখির পরিচয় দিতে ঠিক তত কথাই বাকি রইলো। আবার পাখির কথা বলবো পরের পর্বে……….
পাখিটির ইংরেজি নাম Purple Sunbird.
ক্রমশ ……
পরের পর্ব পড়ুন আগামী
শনিবার ।
বিঃদ্রঃ – সব ছবি এবং ভি ডি ও লেখিকার নিজের তোলা ।
লেখিকার জীবনের সঙ্গে গল্প অঙ্গাঙ্গিকভাবে জড়িয়ে আছে। যা দেখেন, যা শোনেন, যা শোনেন, যা কিছু স্মৃতির পাতায় জড়িয়ে আছে মনের সাথে,তাই নিয়ে লিখতেই বেশি পছন্দ করেন।
লেখা শুরু স্কুল-ম্যাগাজিন, কলেজ -ম্যাগাজিন দিয়ে। বর্তমানে কিছু লেখা প্রকাশিত হচ্ছে কয়েকটি মাসিক-ত্রৈমাসিক পত্রিকায়। বর্তমানে বার্ড’স ফটোগ্রাফী এবং “পাখি-প্রকৃতি” নিয়ে লেখা শুরু করেছেন।