আমার
সম্ভ্রম আর অবাকের ঘোর ভাঙার আগেই অবিনাশ বলে চলল,“বেশ
কিছুদিন ধরেই ঘুসঘুসে জ্বর আর মাথা-ব্যথা হ’চ্ছিল-শরীরও
দুর্বল হয়ে পড়ছিল,আগের মত দৌড়ে দৌড়ে কাজ করতে পারতাম না। খাবার
ইচ্ছাও কমে যাচ্ছিল-অফিসে কাজ করতে
করতে হাঁপিয়ে পড়তাম। বন্ধু-বান্ধব,সতীর্থরা বলতো
ডাক্তার দেখাও। গৃহিণীও যেদ করতেন-ডাক্তারের
কাছে নিয়ে যাবার কথা বলতেন।
আমি
হেসে উড়িয়ে দিতাম-“ও কিছু নয়-রাতে ঘুম বুঝি কম হয়েছে, ক’দিন পরেই সব ঠিক হয়ে যাবে,একটু হেসে ওকে আশ্বস্ত করার জন্যে
বললাম,আরে বয়স হচ্ছে ত”। এতটা
বলে অবিনাশ থেমে গেলেন।বোধহয় একটু হাঁপাচ্ছিল,আমি ওর গভীর নিঃশ্বাসের
মৃদু আওয়াজ পাচ্ছিলাম।
আমি
কোন কথা না বলে এক-দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম ওর দিকে।
অবিনাশ ব্যাগের থেকে ছোট বোতলটা বের
করে এক ঢোক জল খেয়ে নিয়ে শার্টের আস্তিনে ঠোট মুছে আবার বলতে লাগল,“ক’দিন পরে কিন্তু কিছুই ঠিক হ’ল না।একদিন অফিস ফেরত বাসে উঠতে গিয়ে রাস্তায় পড়ে গেলাম।যাত্রীরা ধরাধরি করে কাছাকাছি ডাক্তারের চেম্বারে নিয়ে গেলেন। ভাগ্যক্রমে
উনি ছিলেন নামী ডাক্তার- স্পেশালিষ্ট। ডাক্তারবাবু তক্ষুণী
পরীক্ষা করলেন কয়েক
মিনিটের মধ্যেই ওঁর মুখে যেন ঘন মেঘ জমল আর কপালের বলিরেখা গভীর হয়ে
উঠল। বললেন,“এতদিন
কি ঘুমিয়ে ছিলেন? কতকগুলো টেস্ট লিখে দিচ্ছি,আগামী কালই করিয়ে রিপোর্ট নিয়ে আসুন
যত শীঘ্র সম্ভব”।
রিপোর্টগুলো
নিয়ে গেলাম দুদিন পরে। ডাক্তার বাবু ম্লান হেসে বললেন,‘যা আঁচ
করেছিলাম তাই,তবু
একবার ডাক্তার বোসের সঙ্গে পরামর্শ করতে চাই। আপনি সন্ধ্যা বেলায় আসুন’। এবার অবিনাশ অনেকক্ষণ পর্যন্ত থেমে রইলো। বোধহয় একটু বেশি করে দম
নিতে লাগল।
আমিও
প্রায় শ্বাস-রুদ্ধ অবস্থায় বসে রইলাম।
একটু
পরে প্রায় ফিসফিসিয়ে বলে উঠল অবিনাশ,“সন্ধ্যা বেলায় ডাক্তার বাবুর ঘরে ঢুকতেই
গম্ভীর ভাবে বলে উঠলেন,বসুন, অনেক
দেরি করে ফেলেছেন মিঃ সান্যাল।বোম্বে চলে যান-টি আই
এফ আর এ ভর্তি হয়ে যান ইমিডিয়েটলি। সময় নষ্ট করবেন না। হাতে সময় খুব
কম”।
এতটা
বলে অবিনাশ আবার চুপ হয়ে গেল। শুধু নির্লিপ্ত চোখে আমার মুখের দিকে চেয়ে রইল।
সামান্য
পরে অবিনাশ বলতে লাগল,“ততক্ষণে আমি অনেকটা সাহস সঞ্চয় করে
ফেলেছিলাম,জিজ্ঞাসা
করলাম,‘কত
কম ডাক্তারবাবু?’ ডাক্তারবাবু অবাক হয়ে আমার
মুখের দিকে চেয়ে বললেন,‘আপনার তো ব্লাড ক্যান্সার অনেক দিন ধরে,লাস্ট-স্টেজ’।
আবার
একটু থেমে থেকে বলল অবিনাশ,“আমার সাহস দেখে ডাক্তারবাবুও বুঝি সাহস
পেলেন,সাধারণত
এসব ক্ষেত্রে রুগী ভেঙে পড়ে কান্নাকাটি শুরু করে দেয়”।
আমি
উপর-নিচে ঘাড় নেড়ে নীরবে ওর কথার সায় জানালাম।
অবিনাশ
আবার বলতে আরম্ভ করল,“ডাক্তার বাবু কি যেন ভাবলেন তারপর জানালার
দিকে তাকিয়ে বললেন,
“ইমিডিয়েটলি ভর্তি হয়ে যান।আমার এক চেনা-জানা ডাক্তারকে লিখে দেব,রিপোর্টগুলো সব সঙ্গে
নিয়ে যাবেন”—‘ওঁর শেষের কথাগুলো আর আমার কানে যায়নি। বেরিয়ে এসে অনেক রাত পর্যন্ত
রাস্তায় রাস্তায় ঘুরলাম উদ্ভ্রান্তের মতন। শেষে অনেক রাতে বাড়ি ফিরে না-খেয়ে
ঘুমিয়ে পড়লাম। সকালে উঠে রোজকার মতন পার্কে বেড়াতে গেলাম।ফিরে
এসে চা খেতে খেতে স্ত্রী-ছেলে-মেয়ের সামনে সবকথা বললাম। এক-সপ্তাহের মধ্যে সব ঠিক
করে ফেললাম।ওদের বললাম নিজের পায়ে দাঁড়াবার জন্য।ব্যাস!
আমার কাজ শেষ”। বলা শেষ করে অবিনাশ আকাশ-পানে দু’হাত তুলে যেন হাঁফ ছাড়ল।
আমি
ওর দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম।
একজন
চা-ওয়ালা সামনে দিয়ে যাচ্ছিল চা-কেক-বিস্কুট নিয়ে। অবিনাশ জিজ্ঞেস করল,”চা খাবেন
দাদা”?
আমি
ঘাড় নেড়ে বললাম,“আমি
নিচ্ছি,তুমি
বসো”।
আমার
‘তুমি’ সম্বোধনে বোধ হয় খুশি হয়ে
ম্লান হাসল অবিনাশ,“বেশ’।
চায়ে
বিস্কুট ভিজিয়ে বেশ তৃপ্তি-সহকারেই খাচ্ছিল
অবিনাশ।
হঠাৎ
বিষম-খেয়ে কাশতে লাগল। আমি হেসে বললাম “ওই তোমার
বাড়ি থেকে সবাই তোমার নাম করছে”।
কাশতে
কাশতেই অবিনাশ ম্লান হাসল। কিন্তু কাশিটা বেড়েই চলল;আমি জলের
বোতল এগিয়ে দিলাম,“একটু
জল খেয়ে নাও”।
জলের
বোতলটা হাতে নিতেই অজ্ঞান হয়ে বেঞ্চি থেকে গড়িয়ে পড়ে গেল অবিনাশ। আশে-পাশের বেঞ্চি
থেকেও লোক-জন দৌড়ে এলো। ধরা-ধরি করে ওকে তুললাম কিন্তু বসাতে পারলাম না।ঘাড়টা একদিকে বেঁকে ঝুঁকে রইল। স্টেশনের রেলওয়ের ডাক্তারের সাহায্যে কাছের ‘খান্না-নার্সিংহোমে’ নিয়ে গেলাম। ওর পকেট থেকে
ইন্সিওরেন্সের কার্ডটা বের করে ওদের হাতে দিলাম। সঙ্গে সঙ্গে দু’জন ডাক্তার এসে গেলেন-স্ট্রেচারে ক’রে ভিতরে
নিয়ে গেল অবিনাশকে।
আমি কিংকর্তব্যবিমূড়
অবস্থায় নার্সিং হোমের একটা বেঞ্চিতে বসে পড়ে প্রার্থনা করতে লাগলাম।
কয়েক
মিনিটের মধ্যেই একজন ডাক্তার বেরিয়ে এসে আমাকে কাছে ডেকে বললেন “সরি স্যার-হি ইজ নো মোর-ব্রট্ ডেড”।
একটা
ভয়ঙ্কর আওয়াজ করে কাছে কোথায়ও একটা বাজ পড়ল আর তার প্রতিধ্বনি আকাশে-বাতাসে ভাসতে
লাগল। আমি চমকে উঠে দুকানে হাত চাপা দিলাম-মনে হল আকাশ-বাতাস মুখর হয়ে বার বার
গুঞ্জিত হতে লাগল প্রতিবাদের ধ্বনি,“হে ঈশ্বর ! আমাকেই কেন? এ
অন্যায়,এ অন্যায়, এ অন্যায় ---”।
একটু পরে স্টেশনের
লাউড-স্পীকারে আমাদের ট্রেনের আসার আর প্রস্থানের সময়ের
ঘোষণা শুনতে পেলাম।
লেখক পরিচিতি –
শোভনলাল আধারকার-এর স্কুলে থাকতেই শুরু হয়েছিল গল্প আর মহাকাশের উপর প্রবন্ধ লেখা। ওই সময়েই “শুকতারা”তে “অসীমের অন্বেষণে” প্রকাশিত হয়েছিল। সীমাহীন বলেই বুঝি মহাকাশের আকর্ষণ ছিল অসীম। জ্যোতিঃশাস্ত্রের ছোটখাটো বই পড়ে কম দামী বাইনোকুলার চোখে লাগিয়ে চলতে লাগল নক্ষত্রদের সংগে নীরব বার্তালাপ। ইচ্ছা ছিল জ্যোতিঃশাস্ত্র নিয়ে পড়াশুনা করা। কিন্তু “Need to have and Nice to have” এর কলহে সেটা হতে পারেনি। কিন্তু নেশা আর পেশায় দ্বন্দ্ব কখনও হয়নি। তাই এখন এই পরিণত বয়সেও মহাকাশের আর বিজ্ঞানের অনন্ত রহস্য নতুন করে জেনে ও জানিয়ে সহজ সরল ভাষায় পরিবেষণ করে আনন্দ পান।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় আর আই. আই. টি, দিল্লি থেকে পড়াশুনা ও গবেষণা,কিছুদিন অধ্যাপনা,তারপর সরকারী বৈজ্ঞানিক দপ্তরে কার্যকালে পৃথিবীর কয়েকটি দেশেও কাজ করার সৌভাগ্য হয়েছে।
ঞ্চাশটিরও বেশি প্রবন্ধ নামী বৈজ্ঞানিক পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসে (ইন্দোর) আমন্ত্রিত প্রবন্ধ পাঠ করার গৌরবও ভাগ্যে ঘটেছে। বিগত দেড় বছর করোনার প্রকোপে ছাপাখানা বন্ধ থাকার কারণে অনেক ই-ম্যাগাজিনে বিজ্ঞান বিষয়ক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে ও হচ্ছে।
দিল্লি থেকে প্রকাশিত বহুল জনপ্রিয় ই-ম্যাগাজিন, “তাৎক্ষণিক”এর ‘জানা-অজানা’ কলমে এখন পর্যন্ত প্রায় ৩০ টি জনপ্রিয়-বিজ্ঞান বিষয়ক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। সম্প্রতি “দেশ” ওয়েব-সাইটে একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে এবং বিশেষ প্রশংসিত হয়েছে।