Advt

Advt

Mouna Mukhar (Story / Galpo) 1st Part, by Shovanlal Adharkar, Tatkhanik Bangla / Bengali e magazine Online Reading Free

 

Mouna Mukhar (Story / Galpo) 1st Part, by Shovanlal Adharkar, Tatkhanik Bangla / Bengali e magazine Online Reading Free

দিল্লি রেল স্টেশনে বসেছিলাম হরিদ্বার-কাঠগুদাম গামী ট্রেনের অপেক্ষায়। বাইরে তখনও গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছিল। মাঝে মাঝে দূরে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল। অতি-বৃষ্টির কারণে আজ নাকি সব ট্রেন দেরিতে আসছে-ছাড়ছেও দেরিতে। খবরটা কুলিদের কাছ থেকেই পেলাম। রেল স্টেশনে ওদের মত গুগুল সার্চআর হয়না। তানাহলে লম্বা সিঁড়ি বেয়ে যাও আবার এনকোয়ারিতেলাইন লাগাও।

আমার বেঞ্চিরই আর এক প্রান্তে প্রাক-মাঝ-বয়সী এক ভদ্রলোক বসে ছিলেন চুপ-চাপ। তাঁর নির্লিপ্ত চোখ দেখে আমার খুব অবাক লাগছিল। আরও অবাক লাগছিল এই কারণে যে দেখলাম একটু আগেই ওর পরিবারের লোকজন,মানে স্ত্রী আর দুটি বাচ্চা-ছেলে আর মেয়ে বিদায় নিয়ে চলে গেল।

আমি অবাক হয়ে দেখছিলাম। এমন নির্লিপ্ত একজোড়া গভীর কালো চোখ এই বয়সী মানুষের সচরাচর দেখা যায়না।

আমি আলাপ করার জন্য ওঁর কাছে একটু সরে গেলাম। রেল-স্টেশনে যেচে আলাপ করার সবচেয়ে সোজা উপায় হ, জিজ্ঞেস করা, ‘কত লেট বলছে স্যার? আমিও তাই করলাম। ভদ্রলোক এক অপার্থিব দৃষ্টিতে এক ঝলক আমার পানে চেয়ে ম্লান হেসে উত্তর দিলেন কেউ কি বলতে পারে আর কত দেরি ? বলেই আবার চোখ ফিরিয়ে নিলেন।

উত্তরটার সঠিক অর্থ বুঝতে না পেরে আমি তাকিয়ে রইলাম।

ভদ্রলোক এবার সোজাসুজি আমার মুখের দিকে তাকালেন। স্মিত হেসে বললেন,“ কিছু মনে করবেন না দাদাভাই, আপনি কি জানেন আপনি আর কত দিন থাকবেন এই পৃথিবীতে?”

আমি ঠাট্টা ভেবে স্মিত হেসে হালকা ভাবেই উত্তর দিলাম,“কেউ পারেনা,আমিও পারিনা

ভদ্রলোক একটুও হাসলেন না। চোখ সোজা রেখে সেই অস্বাভাবিক নির্লিপ্ত চোখে আমার দিকে চেয়ে বললেন,“ঠিক তাই দাদা

আমি আলাপের মোড় ফেরাবার জন্যে বললাম কিন্তু ট্রেনের আসার কোনও স্থিরতা নেই জেনেও আপনার পরিবার আপনাকে একা রেখে চলে গেলেন যে ! খুব জরুরী কাজ আছে বোধ হয়। তাই জিজ্ঞেস করেছিলাম আরকি”।

আমিই ওদের যেতে বলেছি-ওরা জানে ওদের ভবিষ্যৎ। আমাকে ছাড়া ওদের বাঁচতে হবে সে কথাটা ওদের ভাল করে বুঝিয়ে দিয়েছি, সাদা-মাটা আবেগহীন ভাষায় কথা কটি বললেন।

আমি চুপ করে তাকিয়ে রইলাম-খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে,ভাবলাম না জেনে বোকার মত একটা কথা বলে ফেলেছি,হয়ত বা পারিবারিক বিচ্ছেদ জাতিয় কিছু হবে। মুখে বললাম,“সরি,দাদা, কিছু মনে করবেন না

ভদ্রলোক বোধহয় আমার মনের কথা পড়তে পারলেন,বলে উঠলেন,“না না দাদা,ওসব কিছু নয়       

আমার মনে আবার প্রশ্ন জাগল,মুখে কিছু না বলে তাকিয়ে রইলাম, ‘তাহলে?’

 আমার নীরব প্রশ্নের কোন উত্তর না দিয়ে শুধু অদ্ভুত দৃষ্টিতে চেয়ে হাসলেন। কিন্তু ওর দিকে চেয়ে আমার মনে হল না উনি ঠাট্টা বা হেঁয়ালি করছেন। মনে হল এক নজরে ভদ্রলোক আমার মনে কি আছে সবকিছু পড়ে নিলেন।

ঈশ্বর কিছু লোককে কম পরমায়ু দিয়ে পাঠান-আমি তাদেরই একজন, খুব ধীরে কিন্তু দৃঢ়স্বরে বলে উঠলেন ভদ্রলোক।                          

আমি যেন বিরাট একটা ঝাঁকুনি খেয়ে স্তব্ধ হয়ে ওঁর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলামএকটা জলজ্যান্ত কম বয়সী মানুষ কি করে জীবনের এই কঠিন বাস্তবটা মেনে নিয়ে সাদা-সাপটা ভাবে আর একজনকে বলতে পারে? কয়েক মুহূর্তের জন্য আমার মুখে কোন কথা জোগাল না।

এত লোকের ভিড়েও স্টেশনটা যেন স্তব্ধ মূক-বধির-পাথরের মূর্তি হয়ে গেল।         

অনেক পরে রাতের হাওয়ার ফিসফিসে শব্দে বললেন,“দাদাভাই,আমি বয়সে হয়ত আপনার চেয়ে ছোট কিন্তু আমাদের অস্তিত্বের একটি পরম সত্য আমাকে চোখে আঙুল দিয়ে শিখিয়ে দিয়েছে এই জীবন। সেটি হল-ভাল মন্দ সব কিছু সমান ভাবে হেসে মেনে নিতে হয়। মেনে নেওয়াতেই শান্তি-না নিলেই দুঃখ আর অশান্তি। ওই যে ইংরাজিতে বলে,“টেক লাইফ অ্যাজ ইট কামস্‌

কথাটা বলে ভদ্রলোক ম্লান হাসলেন মনে হল।

হাসিটা মুখে রেখেই ডান হাতটা আমার পানে বাড়িয়ে বললেন,নমস্কার,আমার নাম অবিনাশ,অবিনাশ সান্যাল

আমি শ্রদ্ধা আর আদরের সঙ্গে দুহাত বাড়িয়ে ওর হাতটা চেপে ধরলাম,“আমি সুমন্ত সেন, নমস্কার,ভাই। আমার মনে হল ওর হাতটা আন্তরিক কিন্তু ভীষণ ঠাণ্ডা।

আবার সেই নির্লিপ্ত হাসি।        

একসময় নিস্তব্ধতা ভেঙে অবিনাশ বলে উঠলেন,“জানেন আমি আমার বাড়ি-ঘর,ব্যাঙ্ক একাউন্ট,স্থাবর-অস্থাবর সব সম্পত্তি আমার স্ত্রী আর ছেলে মেয়ের নামে যৌথ-ভাবে করে দিয়েছি,যাতে আমার পরে যদি আমার স্ত্রী আবার বিয়ে করেন তাহলে আমার সন্তানদের বড় হবার পথে কোন বাধা হবেনা আর আমার স্ত্রীও নিজের ইচ্ছেমত বাঁচতে পারবেন,আমি চাইনা সে কেবল আমার বিধবা হয়ে তার দীর্ঘ বাকী জীবনটা কাটাক

আমি অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলাম ওর দিকে। ভাবছিলাম,এই পাঁচ-ফুট লম্বা ছোট-খাটো অতি সাধারণ দেখতে মানুষটা এত শক্তিধর কি করে হতে পারে! ওই অবস্থায় যেকোনো মানুষ মনের দিক থেকে ভেঙে গুঁড়িয়ে শেষ হয়ে যায়।

খানিক থেমে অবিনাশ আবার বলে চললেন সে রাতে যে কোন মানুষের মতই আমার ঘুম আসেনি; ভোর বেলা বিছানা ছেড়ে অন্যদিনের মত পার্কে বেড়াতে গেলাম; ফিরে এসে স্ত্রী,ছেলে,মেয়েকে সামনে রেখে সবকথা বললাম-ওরা ভীষণ কান্না-কাটি করতে লাগল। তিন-বছরের ছোট মেয়েটি কিছু না বুঝে মা আর দাদার দেখাদেখি কাঁদতে লাগল। আমি ওদের বাধা দিলাম না-কাঁদুক; না কাঁদলে ওরা শান্ত মাথায় চিন্তা করতে পারবেনা। ওদের শক্ত হতে হবে-অনিশ্চিত ভবিষ্যতের জন্য তৈরি হতে হবে। আমার ছত্র-ছায়ায়বাঁচার দিন ওদের ফুরিয়েছে

কিন্তু, এ জগতে মিরাকলবলেও কিছু আছে-এবং তা ঘটেও;আপনার কেসে যে তা ঘটবেনা তার কোন গ্যারান্টি স্বয়ং ভগবান ছাড়া কেউ দিতে পারেনা, দৃঢ়স্বরে বললাম আমি।

মৃদু হাসতে হাসতে ঘাড় নাড়তে লাগলেন অবিনাশ সান্যাল। মুখে সেই নির্লিপ্ত ভাব।বললেন,“তা যদি হয় তাহলে ফিরে আসব ওদের কাছে-আমি ত সন্ন্যাসী হতে যাচ্ছিনা দাদা,তেমন কোন ইচ্ছা বা অনুরাগআমার নেই। কিন্তু আমি জানি কিছুদিনের মধ্যেই ওরা নতুন করে বাঁচতে শিখে যাবে                             

আমি মৃদু মৃদু ঘাড় নাড়লাম,“কিন্তু,যতদিন আছেন ততদিন ওদের কাছে থেকে ওদের আরও একটু তৈরিকরে দিতে পারতেন ভাই

ম্লান হেসে মাথা নাড়ল অবিনাশ তা হয়না দাদাভাই-ওভাবে ওরা কোনদিনই স্বাবলম্বী হবেনা-ওদের আঘাতটা অনেক বেশি লাগবে, এই আমার বিশ্বাস। সাঁতার শিখতে গেলে কিছু না জেনেই জলে ঝাঁপ দিতে হয়-যারা সেটা পারেনা তারা কোনদিন সাঁতার শেখেনা

আমি ওর কথা মানতে পারলাম না,তাই মাথা নেড়ে বললাম কিন্তু অবিনাশ,ছোট মেয়েটা ?ওর কথাটা চিন্তা করুন,ওর কি অপরাধ?ও বেচারি কিছু জানা-বোঝার আগেই পিতৃহীন হয়ে যাবে                           

সেইটাই ত ভাল দাদা,কষ্ট কম হবে তাতে-বুঝতে পারবেনা,বলল অবিনাশ।

কথাটা কঠিন আর নিষ্ঠুর শোনালেও কি জানি কেন অবিনাশকে আমার নিষ্ঠুর বা হৃদয়হীন মনে হল না। ও ঈশ্বরের বা আর কারও বিরুদ্ধে নীরবে মৌন অভিযোগ করছে এমনও মনে হলনা।

স্টেশনের বাইরে আবার বিদ্যুৎ চমকে জোরে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। অর্থহীন ভাবেই আমি সেদিকে তাকিয়ে রইলাম। বৃষ্টির ছাঁট এসে লাগছিল পায়ে।পাটা সরিয়ে নিলাম একপাশে।             

খানিক চুপ করে থেকে আবার বলে উঠলাম কিন্তু জীবনটা তো ইলেকট্রিকের বাল্ব নয় যে একসময় ফুড়ুৎ করে বন্ধ হয়ে যাবে,শত চেষ্টা করেও আর জ্বালানো যায় না। অসুখ-বিসুখ হতে পারে-ডাক্তার,হাসপাতাল করতে হতে পারে-স্বজনের অবর্তমানে কে করবে সে সব?

সেই অদ্ভুত নির্লিপ্ত হাসিতে মুখ ছেয়ে গেল অবিনাশের,বুক-পকেট থেকে একটা মাঝারি আকারের কার্ড বের করে জিজ্ঞেস করল, “টা বাজে দাদা?”

আমি ঘড়ি দেখে সময় বললাম বারোটা পঞ্চাশ

তাহলে আমার ইন্সিওরেন্সের সময় শুরু হয়ে গেছে পঞ্চাশ মিনিট আগে থেকে, কার্ডটা আমার হাতে দিয়ে বলল অবিনাশ।

আমি পড়ে দেখলাম-একটা নামী ইন্সিওরেন্স কোম্পানির কাগজ,তাতে ওর নাম,ঠিকানা,বয়স আর সদ্য-নেওয়া একটি ফটো লাগানো আছে সংগে ইন্সিওরেন্সরের মেয়াদ-শুরু আর শেষ হবার দিন আর সময়ও পরিষ্কার করে লেখা রয়েছে।

ম্লান হেসে আমার হাত থেকে কার্ডটা ফেরত নিয়ে বুক পকেটে রাখতে রাখতে বলল অবিনাশ এই কার্ডটা দেশের যে কোন হাসপাতাল বা নার্সিং হোমে গ্রাহ্য হবেযে কোন সহৃদয় মানুষ আমাকে কোন হাসপাতালে বা নার্সিং হোমে পৌঁছে দেবে তাঁকে গাড়ি ভাড়া আর হাত খরচা বাবদ পাঁচশ টাকা দেবে ইন্সিওরেন্স কোম্পানি-একথাও লেখা রয়েছে,তাইনা?”

আমি স্তম্ভিত হয়ে হালকা ঘা নাড়তে নাড়তে ওর দিকে চেয়ে রইলাম। একজন মৃত্যু-পথযাত্রী মাঝ-বয়সী মানুষ কি করে এত নিখুঁত ভাবে সবকিছু ভাবতে আর ব্যবস্থা করতে পার,যাতে কারও কোন অসুবিধে না হয়? কি অসাধারণ প্রস্থান প্রস্তুতি!                                                                                                                                (ক্রমশ)     

                                                                                            ২য় পর্ব  পড়ুন আগামী বুধবার (১৫.১২.২০২১)

লেখক পরিচিতি 

শোভনলাল আধারকার-এর স্কুলে থাকতেই শুরু হয়েছিল গল্প আর মহাকাশের উপর প্রবন্ধ লেখা। ওই সময়েই শুকতারাতে অসীমের অন্বেষণে” প্রকাশিত হয়েছিল। সীমাহীন বলেই বুঝি মহাকাশের আকর্ষণ ছিল অসীম। জ্যোতিঃশাস্ত্রের ছোটখাটো বই পড়ে কম দামী বাইনোকুলার চোখে লাগিয়ে চলতে লাগল নক্ষত্রদের সংগে নীরব বার্তালাপ। ইচ্ছা ছিল জ্যোতিঃশাস্ত্র নিয়ে পড়াশুনা করা। কিন্তু “Need to have and Nice to have” এর কলহে সেটা হতে পারেনি। কিন্তু নেশা আর পেশায় দ্বন্দ্ব কখনও হয়নি। তাই এখন এই পরিণত বয়সেও মহাকাশের আর বিজ্ঞানের অনন্ত রহস্য নতুন করে জেনে ও জানিয়ে সহজ সরল ভাষায় পরিবেষণ করে আনন্দ পা

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় আর আই. আই. টিদিল্লি থেকে পড়াশুনা ও গবেষণা,কিছুদিন অধ্যাপনা,তারপর সরকারী বৈজ্ঞানিক দপ্তরে কার্যকালে পৃথিবীর কয়েকটি দেশেও কাজ করার সৌভাগ্য হয়েছে।

ঞ্চাশটির বেশি প্রবন্ধ নামী বৈজ্ঞানিক পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসে (ইন্দোর) আমন্ত্রিত প্রবন্ধ পাঠ করার গৌরবও ভাগ্যে ঘটেছে। বিগত দেড় বছর করোনার প্রকোপে ছাপাখানা বন্ধ থাকার কারণে অনেক ই-ম্যাগাজিনে বিজ্ঞান বিষয়ক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে ও হচ্ছে।

দিল্লি থেকে প্রকাশিত বহুল জনপ্রিয় ই-ম্যাগাজিন, “তাৎক্ষণিকএর জানা-অজানা’ কলমে এখন পর্যন্ত প্রায় ৩০ টি জনপ্রিয়-বিজ্ঞান বিষয়ক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। সম্প্রতি দেশ” ওয়েব-সাইটে একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে এবং বিশেষ প্রশংসিত হয়েছে।