ডেরিয়াস , পারস্যের রাজা ।
বহুকাল রাজ্য শাসনের পর সে বড় ক্লান্ত। এবার বিশ্রাম চায় রাজা ।তবে এই বিপুল রাজকার্য কে সামলাবে, প্রজাদের কে দেখবে !! প্রজারা যে রাজার ওপর ভরসা করে । ডেরিয়াস অবসর
নিলে চাই বিচক্ষণ এক রাজা । কিন্তু সে কে ?কোথায় ?কে এই ব্যাবিলন শহরকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে ? প্রজাদের
ভালো রাখতে পারবে !!
রাজার নজরে পড়ল
এক যোগ্য ব্যক্তি তার নাম ড্যানিয়েল ,রাজা
ডেরিয়াসের প্রিয় পাত্র ।ড্যানিয়েল ইহুদি,
জেরুজালেম থেকে তাকে বন্দী
করে আনা হয়েছে ব্যাবিলন প্রদেশে।
ড্যানিয়েল সাহসী বুদ্ধিমান এবং সৎ। একমাত্র ড্যানিয়েলই রাজা হবার যোগ্য ।রাজা
ডেরিয়াস তার পারিষদ বর্গের সামনে উত্থাপন করলেন নতুন শাসকের নাম, কিন্তু একাংশ বড় বিরূপ । কোনমতেই তারা ড্যানিয়েলকে শাসক হিসেবে তাদের
ঊর্ধ্বতন হিসাবে মানতে পারবে না অসম্ভব।
কিন্তু ড্যানিয়েল কে সরাবে সেই সাধ্য কার
! ড্যানিয়েল যে স্বয়ং রাজার
প্রিয় পাত্র প্রিয় মানুষ ।
তবু পারিষদরা
হাল ছেড়ে দিল না,চেষ্টা করা যাক ।পারিষদ বর্গরা রাজার কাছে পৌঁছল ,সমস্বরে বলল,“মহামান্য রাজা,আমাদের রাজা দীর্ঘায়ু হোন। “এইবার তারা সমস্বরে এক প্রস্তাব দিল,“রাজা আপনি ১৫ দিনের জন্য একটি নতুন নিয়ম করুন। এই ১৫ দিন কেবলমাত্র আমাদের রাজাকেই আরাধনা করতে হবে। অন্য কোন
ঈশ্বরকে আরাধনা করা চলবে না।যে এই নিয়ম ভঙ্গ
করবে সে হবে রাজদ্রোহী , তার মৃত্যুদণ্ড অবধারিত । ক্ষুধার্ত সিংহের মুখে
তাকে ছুড়ে ফেলা হবে এবং তার মর্মান্তিক মৃত্যু
হবে ।” রাজা সব শুনে খুব খুশি , তার প্রজারা
এই ১৫ দিন কেবল তারই জয় গান করবে,
তার আরাধনা করবে !এ তো মহা
সৌভাগ্য! প্রজারা তাকে এত সম্মান করে এত শ্রদ্ধা করে এত ভালবাসে ।
রাজা রাজি হয়ে গেলেন। কিন্তু কেবল মুখে রাজি হলে তো
চলবে না পারিষদবর্গের অনুরোধ রাজা নিজে এই আইন লিপিবদ্ধ করে তাতে স্বাক্ষর করুন
তবেই সকল প্রজা এই আইন মানবে। আইনের বাইরে
কেউ নয় প্রতিটি নাগরিক যেন এই কথাটি মনে রাখে,আইন সকলের জন্য
সমান ।
মন্দ প্রস্তাব নয়। ঠিকই তো,রাজ আদেশে রাজার
স্বাক্ষর থাকবে সেটাই তো স্বাভাবিক তবেই না সেই নিয়মের মান্যতা। স্বাক্ষর করে
দিলেন রাজা নির্দ্বিধায় । পারিষদ রা চোখ চাওয়া চাওয়ি করল । তারা মহা খুশি,তারা
যেমনটা ভেবেছিল ঠিক তেমনটাই হতে চলেছে । এবারে আর নিস্তার নেই ডেনিয়ালের।
রাজসভার এক
কোনে উপস্থিত বিচক্ষণ ড্যানিয়েল কিন্তু সব বুঝতে পারল। এ তারই বিরুদ্ধে এক ষড়যন্ত্র এক চক্রান্ত ।
পারিষদরা চায়না ড্যানিয়েল রাজা হোক,এ তারই অভিসন্ধি । সবাই জানে
ড্যানিয়েল প্রতিদিন তার ঈশ্বরকে,ইজরায়েলের ঈশ্বরকে আরাধনা করে ,প্রতিদিন ।একটি দিনও
বাদ যায় না, এর অন্যথা হবার নয় ।এবার
ড্যানিয়েলের উভয় সংকট।
ঈশ্বরের আরাধনা না করলে সে প্রাণে
বাঁচবে বটে কিন্তু ঈশ্বরকে হারাবে
।আবার ঈশ্বরের আরাধনা করলে ক্ষুধার্ত সিংহের পেটে তার প্রাণ যাবে । কি করবে সে
!এতদিনের ভক্তি শ্রদ্ধা সব শেষ করে দেবে কেবল প্রাণের ভয়ে , প্রাণের মায়ায় ? কিন্তু ঈশ্বর কে যে ড্যানিয়েল ভালোবাসে শ্রদ্ধা করে বিশ্বাস করে এবং ভরসা
করে ! তবু তবু মনে ভয়ও
খানিক হয় বৈকি, নিজের জীবন টাও যে মহা মূল্যবান ।
সিংহের মুখে খাবার হতে কার ভালো লাগে? সেই মৃত্যু যে বড়
কষ্টের বড় যন্ত্রণার বড় অপমানের ।সে হবে পশুর খাদ্য!
প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে ড্যানিয়েল তার গৃহের দিকে পা
বাড়ালো। চিন্তা ক্লিষ্ট তার মুখ,ভারাক্রান্ত মুখে দুশ্চিন্তার
কালো ছায়া। ধীর পায়ে হেঁটে যাচ্ছে,পা যেন আর সরে না। কেবল
একটাই চিন্তা,কি করবে!
পারিষদরা তাকে দেখে মুখ টিপে টিপে হাসছে,ভাবছে এবার
বাছাধন তুমি কি করে নিজেকে বাঁচাবে! এইবারে যে তোমার মৃত্যু অবধারিত। রাজা তার
প্রিয় পাত্রকে খুব শিগগিরই নিজে হাতে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত
করবে।
ড্যানিয়েল পায়ে পায়ে নিজের গৃহে প্রবেশ করল ,যথারীতি
প্রতিদিনের মতো সোজা প্রার্থনা ঘরে গেল।
ওপর তলায় ছোট্ট প্রার্থনা ঘরটিতে সাজানো গোছানো, এটি
তার প্রিয় জায়গা ।সমুখের খিড়কি হা করে খুলে দিল ।হালকা মিষ্টি বাতাস তার সারা দেহ মন ছুঁয়ে গেল ।দুই
চোখ বন্ধ করে ,মনের সব টুকু
ভক্তি নিয়ে শুরু হল তার প্রতিদিনের প্রার্থনা ঈশ্বরের আরাধনা।
ঈশ্বরকে সে ভালবাসে ইজরায়েলের ঈশ্বরকে সে এমন করেই
প্রার্থনা করে ।বাইরে সবাই হা করে তাকিয়ে দেখল ড্যানিয়েল নিয়ম ভঙ্গ করেছে তার মানে মৃত্যু অবধারিত
।পারিষদরা তো এটাই চেয়েছিল।
আর দেরী নয় ,পারিষদরা ছুটে গেল রাজার কাছে ,তৎক্ষণাৎ
রাজার কানে পৌঁছল নিয়ম ভঙ্গের খবর । রাজা
হতবাক দিশাহারা, বড় মুষড়ে পড়ল রাজা
ডেরিয়াস । ড্যানিয়েল যে তার বড়
প্রিয় একজন ! তাকে সে কি করে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয় ! রাজা তো ভেবে রেখেছে ড্যানিয়েল
কেই রাজ্য শাসনের সমস্ত দায়ভার
দিয়ে যাবে অথচ একি বিপত্তি ! কেন
ড্যানিয়েল এই কাজটি করল? সে কি জানত না ? তাই বা হয় কি করে , সে তো সভা তে উপস্থিত ছিল ।আচ্ছা কোন উপায় কি নেই তাকে বাঁচাবার ? আইন যেমন থাকে, আইনের ফাঁক ফোকর ও তো থাকে
।রাজা খানিক সময় চাইল , ভেবে যদি কিছু উপায় বার করতে পারে , যদি কিছু পথ খুঁজে পাওয়া যায়
! তবে এও তো সত্যি আইন সে নিজেই লিখেছে আর আইনের চোখে সবাই সমান , ছোট বড় ধনী গরিব রাজা প্রজা
সৈন্য সামন্ত সবাই । এই আইন কোন
অজুহাতেই কোনভাবেই আর পরিবর্তন করা যাবে না । তবু রাজার মনে ক্ষীণ আশা ।
সন্ধে প্রায়
হয়ে এলো ,সূর্য অস্তমিত ।চারিদিকে আঁধারে ঢেকে যাচ্ছে , খুব
শিগগির রাত্রি হবে । তখন ? রাজার বুকে ঝড় তুফান উথালপাথাল ঢেউ দুই চোখ ছাপিয়ে
কান্না উথলে উঠছে । কিছুই তো মাথায় আসছে না ।
আবার
পরিষদরা ছুটে এলো রাজা যেন আইন ভুলে না জান ,আজ রাতেই ওই
রাজদ্রোহী ড্যানিয়েলকে সিংহের গুহায়
ছেড়ে দিয়ে আসতে হবে ।এতেই যে তাদের
শান্তি । নাহ , প্রিয় মানুষ টিকে বাঁচাবার কোন পথ নেই । নিরুপায় রাজা এবার আদেশ দিলেন।রাজা ডেরিয়াসের
বুকের পাঁজর যেন ভেঙ্গে গুড়িয়ে গেল
। ড্যানিয়েলের দুই হাতে দুই পায়ে শৃঙ্খল পরিয়ে তাকে টেনে
টেনে নিয়ে যাওয়া হল সিংহের গুহার কাছে ,গেল পারিষদ বর্গরা
সাথে গেলেন রাজা নিজে সৈন্য সামন্ত এবং নগরবাসী
।
ভয়ানক সিংহের গুহার সামনে তারা দাঁড়িয়ে আছে
।রাজা ড্যানিয়েলের দিকে তাকালেন , বড় কাতর বড়
অসহায় দুটি চোখ । চোখের চাউনিতে গভীর
বিষাদ। কিন্তু ড্যানিয়েলের চোখে ভয় নেই,নেই দুঃখ,আছে কেবল বিশ্বাস। ড্যানিয়েল বিশ্বাস করে ঈশ্বর তাকে
রক্ষা করবেন। অন্ধকার ঘুটঘুটে গুহার ভেতর কিছুই দেখা
যায় না । ওখানে বেশ কয়েকটি ক্ষুধার্ত সিংহর আস্ফালন স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। হৈ
হৈ করে
ড্যানিয়েল কে ছুঁড়ে ফেলা হল ,গুহার মুখ বড় পাথরে
বন্ধ করে দেওয়া হল যাতে ড্যানিয়েল কোন মতেই পালাতে না পারে ।
ভগ্ন হৃদয়ে রাজা
ফিরে এল প্রাসাদে ।সবাই যে যার গৃহে ফিরে গেল । রাজা অনুতপ্ত , এ কি সাংঘাতিক
কাজ সে করল এ মহাপাপ এ অন্যায় কারণ
ড্যানিয়েল একজন সৎ মানুষ , সত্যবাদী ,কোন পাপ কাজ সে করেনি । তার প্রিয়
এমন ভালো মানুষটির কি যন্ত্রণাদায়ক
মৃত্যু হবে ! সিংহেরা তাকে টুকরো টুকরো
করে ছিঁড়ে খাবে ভাবতেই শিউরে উঠছে রাজা । চোখ উপচে তার জল , বুকের ভেতর
কাটার মতো বেঁধে আছে যন্ত্রণা ! এমনটা তো রাজা
ডেরিয়াস চায়নি ।একা ঘরে অস্থির
পায়ে কেবল পায়চারি করছে ।
সারা রাত জেগে রইল রাজা
ডেরিয়াস ,
সেও ক্ষুধার্ত তারও মুখে পেটে কিছু পড়েনি । ধীরে ধীরে ভোর হল ,
সূর্য আলো ছড়িয়ে দিল ।পারিষদ বর্গরা অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল তাদের
জয়ের দিন । তারা উল্লাস করবে । আবারও
সবাই গুহার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো কি হয় কি হয় ! কি হয়েছে দেখার জন্য।
রাজা এলেই পাথর সরানো হবে আর তখনই দেখা যাবে ড্যানিয়েলের হাড় ,মাংস , রক্ত ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ।
কিন্তু রাজার যে আর পা সরে না, গুহায় যেতে মন চায় না ! তবু যেতেই
হবে , তিনি যে রাজা
। এত ভেঙে পড়লে তাকে মানায় না ।
রাজার আগমনে চারিদিকে জয়ধ্বনি উঠল , রাজার দীর্ঘ আয়ু হোক ।
রাজা স্তব্ধ , মুখে এতটুকু হাসি নেই কেবল ক্লান্তি
আর চিন্তা । প্রজাদের সামনে চোখের জল তাকে
মানায় না । ধরা কণ্ঠে চিৎকার করে ডাকলেন ,
“ড্যানিয়েল তোমার ঈশ্বর
কি তোমায় বাঁচিয়ে রেখেছেন ? তুমি কি বেঁচে আছো “
নিরুত্তর
, নিস্তব্ধতা । কোন সাড়া নেই ভেতর থেকে । রাজা আরেকবার ডাকলেন,
“ড্যানিয়েল তুমি কি
শুনতে পারছ ,আমি রাজা ডেরিয়াস “।
কেবলই
নিস্তব্ধতা ।কোন উত্তর নেই । আর সন্দেহ নেই ড্যানিয়েল কে সিংহ রা ছিঁড়ে ছুড়ে
খেয়েছে । গুনগুন শুরু হল প্রজাদের মধ্যে ,পারিষদ বর্গের মুখে হাসি ফুটে উঠল , পৈশাচিক হাসি । রাজার বুক চিরে
দীর্ঘশ্বাস ।তবু মন মানে না , যদি —-----!! রাজা আরও একবার চিৎকার করে ডাকলেন ,
“ড্যানিয়েল তুমি কি
বেঁচে আছো যদি বেঁচে থাকো আমার কথায় সারা দাও ।”
ভেতর থেকে ড্যানিয়েলের কণ্ঠস্বর ,স্পষ্ট ,
,
“আমার ঈশ্বর আমাকে
বাঁচিয়ে রেখেছেন।”
আনন্দে আত্মহারা রাজা ডেরিয়াস । আর দেরী নয়, তৎক্ষণাৎ আদেশ
দিলেন, এখুনি পাথর সরিয়ে দাও। গুহার ভেতর
থেকে বেরিয়ে এলো ড্যানিয়েল একেবারে অক্ষত , এক
সুন্দর সুঠাম বুদ্ধিমান ধর্মপ্রাণ যুবক। দুই হাতে জড়িয়ে ধরল রাজা বুকে টেনে নিলেন তার
পছন্দের মানুষটিকে ।রাজার আজ কি আনন্দ!! এতক্ষণের
অনুতাপ , কষ্ট সব মুহূর্তে উধাও।
ধূর্ত , শঠ , ঈর্ষা-কাতর পারিষদরা অবাক ,এমনটা তো তারা ভাবেনি !
সিংহের মুখ থেকে একেবারে অক্ষত ফিরে এল !!
এত টুকু রক্তপাত নেই , এও কি সম্ভব !! তাদের কপালে
বিন্দু বিন্দু ঘাম । এমনটা তো
ঘুণাক্ষরেও মনে হয়নি । এ এক
আশ্চর্যজনক ঘটনা ।তারা পালাতে উদ্যত।
তাদের দুরভিসন্ধি আর চাপা রইল না , তাদের কু চক্রান্ত আর
গোপন রইল না ।ক্রুদ্ধ রাজা । রাজার আদেশে তাদের সিংহের গুহায় ছুড়ে ফেলা হল ,
এই শাস্তি কেবল তাদের জন্য এই শাস্তি তাদের প্রাপ্য তারা এই শাস্তির
যোগ্য এরাই রাজদ্রোহী ,অসৎ ,সব
সর্বনাশের কারণ । গুহায় ছুড়ে ফেলার সাথে
সাথে সিংহের দল ঝাঁপিয়ে পড়ল , আর্তনাদে ভরে উঠল চারিদিক ।
রাজা ডেরিয়াস নিশ্চিন্তে শান্ত মনে ফিরে এলেন
প্রাসাদে ।তার প্রজাদের আদেশ দিলেন,
“তোমরা সবাই
ড্যানিয়েলের ঈশ্বরকে শ্রদ্ধা করো,আরাধনা কর কারণ তিনি
সর্বশক্তিমান সর্বশ্রেষ্ঠ এবং চিরকালের। তিনি সবার মঙ্গল করেন সবাইকে ভালোবাসেন
সবাইকে বিপদ থেকে উদ্ধার করেন । ”
লেখিকার অন্যান্য লেখা পড়তে এখানে ক্লিক করুন ।
লেখিকার পরিচিতি -
স্টেটস্ম্যান, সুখবর, সকালবেলা ইত্যাদি খবরের কাগজে গল্প প্রকাশিত হয়েছে। দেশ, সানন্দা, প্রসাদ, সারথি পত্রিকায় গল্প, কবিতা ও প্রবন্ধ লেখেন। 'Times of India'-তে বেশ কয়েকবার কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। কবিতা দিয়ে সাহিত্য জীবনের শুরু।বর্তমানে কিশোর ও প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য গল্প লিখতেই বেশি ভাল বাসেন । বহু e magazine এ লেখেন ।
.jpg)