Advt

Advt

rupantar-upanyas-story-galpo-part-5-by-nalinaksha-bhattacharya-tatkhanik-digital-bengali-web-bangla-online-e-magazine-রূপান্তর-নলিনাক্ষ-ভট্টাচার্য

ধারাবাহিক উপন্যাস প্রতি রবিবার

rupantar-upanyas-story-galpo-part-5-by-nalinaksha-bhattacharya-tatkhanik-digital-bengali-web-bangla-online-e-magazine-রূপান্তর-নলিনাক্ষ-ভট্টাচার্য
পর্ব - ৫

পাঁচ 

সুধাময়ী অবিনাশবাবুকে আজকাল আর বড় একটা বাধা দেননা। ত্রিশ বছর অবিনাশবাবুর সঙ্গে ঘর করে তিনি জানেন তাঁর স্বামী একবার কোন কাজে নেমে পড়লে তাকে নিরস্ত করা কিছুতেই সম্ভব নয়। তবু কণার মুখে হারু ঘোষের গুণ্ডা লেলিয়ে দেবার সম্ভাবনার কথা শুনে তার আতঙ্কে সব সময়ই বুক ঢিপ ঢিপ করে। রাতে কয়েকদিন থেকে তিনি ভালভাবে ঘুমোতে পারছেননা।

রবিবার সকালে কাগজপত্র বগলদাবা করে অবিনাশবাবু বেরোতে যাবেন,সুধাময়ী উদ্বিগ্ন মুখে এসে সামনে দাঁড়ালেন। “ ফিরবে কখন?”

কেন? ঘরে কাজ আছে কিছু?”

সুধাময়ী একবার ভাবলেন মিথ্যে কথা বলবেন। বলবেন,“অনেকদিন তোমার বড় মেয়ে সুদেষ্ণাকে দেখিনা,যাও আজ সোদপুর গিয়ে ওকে নিয়ে এস।” কিন্তু একদিন না হয় কোনো ওজুহাতে রোখা গেল। রোজ রোজ তিনি কেমন করে মিথ্যের আশ্রয় নেবেন? তাই অনেক ভেবে তাঁর মনের কথাটাই বললেন,“তাড়াতাড়ি ফিরে এস। কণার মুখে হারু ঘোষের গুন্ডা লেলিয়ে দেবার কথা শোনার পর থেকে আমার বুক ঢিপ ঢিপ করে। যেরকম শয়তান লোক কখন কী করে বসে কিছুই বলা যায়না।”

অবিনাশবাবু সুধাময়ীর কাঁধে হাত রেখে হেসে বললেন,“তুমি কি আমাকে এতই দুর্বল মনে কর সুধা? তোমার মনে নেই হাবু গুণ্ডাকে কীভাবে শায়েস্তা করেছিলাম আমি?”

সুধাময়ী দীর্ঘ নিশ্বাস চেপে বললেন,“সে বয়স কি আর তোমার আছে? এখন একটু সাবধানে থাকাই ভাল।”

বয়স না থাক মনের জোরটাতো আছে। সেটাইতো আসল।”

সুধাময়ী আর তর্ক করলেননা, বললেন, “ যা ভাল বোঝ কর। তোমাকে কথায় হারায় সাধ্য কার।” তিনি রান্নাঘরের দিকে চলে গেলেন। ঘর থেকে বেরিয়ে বাবলু এসে বলল, “আমিও যাব তোমার সঙ্গে বাবা।”

অবিনাশবাবু অনেক কষ্টে বাবলুকে নিরস্ত করে পথে বেরুলেন। আজ তিনি বস্তিতেই যাবেন ঠিক করেছেন। এ’কদিনে তাঁর কম অভিজ্ঞতা হয়নি। থানার ওসির কাছ থেকে কোন সহায়তা না পেয়ে তিনি এ অঞ্চলের এমএলএ অনিল চাকলাদারের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। সব কথা শুনে তিনি বললেন,“স্বাক্ষর সংগ্রহ করুন অবিনাশবাবু। যদি ভাল সাড়া পাওয়া যায় তবে উপর থেকে চাপ দিয়ে হয়তো কিছু করা যাবে।” তারপর থেকে অবিনাশবাবু স্বাক্ষর সংগ্রহে বেরিয়ে পড়েছেন। ইচ্ছায় হোক অনিচ্ছায় হোক এ পাড়ার ভদ্রলোকদের মধ্যে প্রায় সবাই তাকে স্বাক্ষর দিয়ে বাধিত করেছেন। অনেকে আবার স্বাক্ষর দিতে গিয়ে দু’চারটা কথাও শোনাতে ছড়েননি - “ কিচ্ছু লাভ হবেনা মশাই এসব করে। হারু ঘোষ ওস্তাদ খেলুড়ে, ওকে হারানো এত সহজ নয়।” “ তা ছোটলোকরা একটু ফূর্তি করছে, করুকনা, আপনার মাথা ব্যথা কিসের জন্য?” “মাদক বর্জন করাবেন, এ্যাঁ? আপনি দেখছি মশাই গান্ধী টুপি না পরেও গান্ধীবাদ প্রচার করতে উঠে পড়ে লেগেছেন। তা ভালই, রাজনীতিতে ঢোকার আগে একটু আধটু সমাজ সেবা মন্দ নয় কী বলেন?” একজন তো সরাসরি অবিনাশবাবুকে বলে বসল,“আমি মশাই দিশি মদ খাওয়া পছন্দ করি। সরকারের উচিৎ সব বিদেশি মদের দোকান উঠিয়ে দিশি মদের দোকান খোলা। অল্প পয়সায় খাঁটি নিজের দেশের মাল খেয়ে গরীবরা একটু ফূর্তি করবে এর চাইতে ভাল কথা আর কি হতে পারে, বলুন? সময় থাকলে মশাই আমিও আপনার মত কাগজ হাতে করে ‘ অধিক সংখ্যক দিশি মদের দোকান খোলা হোক’ এই দাবিতে স্বাক্ষর সংগ্রহ করতে বেরিয়ে পড়তাম।”

অবিনাশবাবু স্বাক্ষর সংগ্রহ করতে বেরিয়ে বুঝতে পেরেছেন নানা মতের নানা ধরণের লোকের সঙ্গে তার কাজ করতে হবে কাজেই নিজেকে সংযত রেখে যথাসম্ভব ঠান্ডা মাথায় তিনি প্রত্যেককে বোঝাবার চেষ্টা করেছেন কেন তিনি হারুর দোকান উঠিয়ে দিতে বদ্ধ পরিকর হয়েছেন। মদের নেশা কীভাবে ঘরে ঘরে দারিদ্র্য, কলহ, অন্যায় প্রবণতাকে বয়ে নিয়ে আসছে তা তিনি অসংখ্য  উদাহরণ দিয়ে বোঝাবার চেষ্টা করেছেন। মানুষের স্বাভাবিক চেতনাকে তার অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে সংগ্রামের স্পৃহাকে ভোঁতা করে দিয়ে নেশা শেষ পর্যন্ত মানুষের মনুষ্যত্বকে পর্যন্ত গ্রাস করে ফেলে, একথা তিনি বার বার বলেছেন। কেউ কেউ নীতিগতভাবে তাঁর বক্তব্যকে মেনে নিয়েও সংশয় প্রকাশ করেছেন অবিনাশবাবুর স্বাক্ষর সংগ্রহের পরিণাম সম্পর্কে। বাঁকা, ত্যারছা এমনকি অপমানজনক প্রশ্নেরও কম জবাব দেননি অবিনাশবাবু, কিন্তু সব মিলিয়ে এই স্বাক্ষর সংগ্রহে বেরিয়ে অবিনাশবাবু যেটা স্পষ্ট বুঝতে পেরেছেন এবং যে কারণে তিনি কিছুটা হতাশ হয়ে পড়েছেন সেটা এই যে তাঁর পাড়ার ভদ্রলোকদের মধ্যে এমন একজনও নেই যিনি প্রয়োজনবোধে অবিনাশবাবুকে সক্রিয় সাহায্য করতে এগিয়ে আসবেন। আশ্চর্যের ব্যাপার পাড়ার যুবকরা পর্যন্ত এ ব্যাপারে এগুতে রাজি নয়। ফুটবল,রাজনীতি এবং সিনেমার বাইরে আজকালকার যুবকদের টেনে নেওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে, দুঃখের সঙ্গে অবিনাশবাবুকে একথা স্বীকার করতে হল।

বস্তির কাছাকাছি এসে অবিনাশবাবু একটু থামলেন। এখানে তিনি কাউকে চেনেননা। হারুর খদ্দের হিসেবে এদের অনেকের মুখ হয়ত তাঁর চেনা, কিন্তু সেই পর্যন্তই। শুধু স্বাক্ষর সংগ্রহ করা নয়,এদের ভালভাবে বোঝানো দরকার। সেটা যে খুব সহজ কাজ নয় তিনি জানেন। হঠাৎ তাঁর মনে পড়ল কিছুদিন আগের রাতের সেই বিশ্রি ঘটনাটা। রাত্রে দেখলেও একটু খুঁজে সেই ছোট মাটির কুড়ে ঘরটি খুঁজে পেতে তাঁর অসুবিধা হলনা। বাড়ির সামনে ধুলোর মধ্যে দুটো বাচ্চা হুটোপুটি করছিল যেমন হারুর দোকানের সামনে মাতালগুলো সচরাচর করে থাকে অনেকটা সেরকমই – অন্তত অবিনাশবাবুর এদের দেখে সে কথাই মনে পড়ল। গলা খাঁকারি দিয়ে অবিনাশবাবু জিজ্ঞেস করলেন,“ঘরে কে আছে?”

ছোটখাট সেই বউটি ঘরের মধ্য থেকে বেরিয়ে এল। অবিনাশবাবুকে দেখে ঘোমটা টেনে বলল, “ কাকে চাই?”

আমাকে চিনতে পারছ? সেদিন রাতে তোমার মরদকে আমিই ঘরে নিয়ে এসেছিলাম।”

ভেতর থেকে আওয়াজ এল, “কে রে বামা?”

বামা ঘোমটা একটু ছোট করে বলল,“সেই বাবুগো যিনি তোমাকে নর্দমা থেকে টেইনে নিয়ে এসেছিলেন। আসুনগো বাবুমশায়, ভিতরে আসুন।”

অনিচ্ছাসত্বেও অবিনাশবাবু ভিতরে ঢুকলেন। ছোট্ট ঘুপচি ঘরের মধ্যে প্রথমটায় তিনি কিছু ভাল করে দেখতে পেলেননা। আলো হাওয়ার জন্য ছাতের কাছে একটা ছোট্ট ঘুলঘুলি ছাড়া আর কিছুই নেই। আবছা আলোয় চোখ কিছুটা অভ্যস্ত হলে অবিনাশবাবু বামার সংসার গুছনোর তারিফ না করে পারলেননা। ঘরে সামান্য যে ক’টি থালা বাসন, কাপড় চোপড়, আসবাব আছে তা এত সুন্দরভাবে গুছিয়ে রেখেছে বামা যে অন্যান্য অভাবী সংসারের মত দারিদ্র্য প্রকটিত হয়ে ওঠেনি। বামার এগিয়ে দেওয়া মোড়ায় বসে অবিনাশবাবু বললেন, “বাঃ বেশ গুছোনো মেয়েতো তুমি।”

লাজুক হাসি হেসে বামা বলল,“কী আর গুছোবো বলুন? ঘরে আছেটা কি গুছোবার মত?”

একথার কোন উত্তর নেই, তাই অবিনাশবাবু খাটের উপর বসা ঢ্যাঙা লোকটার দিকে চোখ ফেরালেন। অপরাধীর মত মুখ করে লোকটা বসে বিড়ি টানছিল। অবিনাশবাবু জিজ্ঞেস করলেন,“কী নাম তোমার?”

আজ্ঞে পরাণ।”

আমাকে চিনতে পারছতো?”

আজ্ঞে তা আর বলতে। আপনি সেদিন বড় দয়া করেছেন, কী বলে যে আপনাকে ধন্যবাদ দেব। বামা একটু চা করনা বাবু মশায়ের জন্য।”

সে আর তোমার বলতি হবেনা।” বামা চটপট ঘরের কোনে স্টোভে চায়ের জল বসাতে গেল।

অবিনাশবাবু বাধা দিলেন। “ থাক থাক, চা আমি খেয়ে এসেছি। শোন পরাণ,তোমার সঙ্গে আমার কাজের কথা আছে।”

কাজের কথা শুনে পরাণ নড়ে চড়ে বসল। তার মুখে কিছুটা ভয় এবং কিছুটা সন্দেহের রেখা ফুটে উঠল।

আজ্ঞে আপনি কি সরকারের লোক?”

অবিনাশবাবু জানেন এদের মধ্যে সরকার সম্পর্কে একটা ভীতি আছে। তার কারণও তিনি জানেন – আশপাশের অঞ্চলে কোন খুন, ডাকাতি, চুরি হলে পুলিশ প্রথমেই বস্তিতে এসে হানা দেয়। তাই তিনি হেসে পরাণকে অভয় দিলেন – “ ভয় নেই পরাণ, আমি সরকারের লোক নই।” পকেট থেকে কাগজটা বের করে তিনি বললেন,“মদ খাওয়া ছেড়ে দিতে হবে, বুঝলে?”

পরাণ প্রায় লাফিয়ে উঠল। চোখ বিস্ফারিত করে বলল,“তাহলে বাঁচবো কী করেগো বাবু মশায়?"

বামা স্টোভে চা বসিয়েছিল। ঘুরে দাঁড়িয়ে বেশ ধারালো গলায় বলে উঠল,“শোনো বাবুমশায়,শোনো কথার ছিরি। বলি রোজ সন্ধ্যায় বোতল বোতল দিশি খেয়ে পয়সা ওড়াবে আর ঘরে একদিন অন্তর একদিন সবাই উপোস করে মরবে – এইনা হোল তোমার বাঁচা? অমন বাঁচার মুখে ঝ্যাঁটা।”

পরাণ ধমক দিয়ে উঠল, “থাম বামা, সব কথার মধ্যে মাথা গলাবিনা বলে দিচ্ছি। আমার পয়সায় আমি খাই, তোর তাতে অত খার কিসের রে?”

তা বিয়ে করে ছেলেপিলে নিয়ে ঘর সংসার করতে কে মাথার দিব্যি দিয়েছিল শুনি? থাকলেই পারতে একা। যত খুশি খেয়ে নর্দমায় কুকুরের মত গড়াগড়ি খেতে দিনরাত, কেউ বলতে আসতনা।”

অবিনাশবাবু হাত তুলে উঁচু গলায় বললেন, “থাম তোমরা। আমাকে আগে দু’চারটা কথা বলতে দাও।”

দু’জনেই অবিনাশবাবুর কথা শুনে হঠাৎ চুপ করে গেল। অবিনাশবাবু এবার পরাণকে প্রশ্ন করলেন, “ মদ খেলে কি হয় জানো পরাণ?”

আজ্ঞে জলদি জলদি মানুষ মরে যায়।”

কেন মরে যায় বলতে পার?”

আজ্ঞে শুনেছি লিভার না কি যেন পচে যায়।”

বাঃ তুমি দেখছি অনেক খবর রাখ। হ্যাঁ তুমি ঠিকই বলেছ, লিভার পচে যায়। সাইরোসিসের নাম শুনেছ। ওটা লিভারের রোগ। খুব যন্ত্রণা হয়।”

বামা চায়ের কাপ অবিনাশবাবু আর পরাণের হাতে দিয়ে বলল, “ একটু ভাল করে বোঝাও বাবুমশায়। আমি বললেতো চ্যালাকাঠ নিয়ে মারতে আসে।”

পরাণ এবার আর বামাকে বাধা দিলনা, চুপচাপ মাথা নিচু করে চায়ে চুমুক দিতে থাকল। অবিনাশবাবু আবার জিজ্ঞেস করলেন, “ তুমি কোথায় কাজ কর পরাণ?”

বনোয়ারি দাস হোসিয়ারি মিলে।“

অনেক খাটতে হয় বুঝি?”

হ্যাঁ, তা হয় বইকি। লোডারের কাজ করি। ভারি ভারি বস্তা কাঁধে তুলে লরিতে পৌঁছে দিতে হয়। বেশ খাটনি আছে বাবু আমার কাজে।”

খাটনিতে শরীরের ক্ষয় হয় জানো নিশ্চয়ই, আর সেই ক্ষয় পূরণ করার জন্য ভাল পুষ্টিকর খাবার খাওয়া দরকার, সেও নিশ্চয়ই জান তুমি।”

জানি বাবু সবই জানি, কিন্তু মাছ ডিম দুধ খাবার পয়সা কোত্থেকে পাব?”

আচ্ছা পরাণ হারুর দোকানে মাসে তুমি কত টাকা খরচ কর?”

পরাণ মাথা চুলকে বলল, “ তা শ’পাঁচেক হবে।”

বামা গর্জে উঠল, “ মিথ্যে কথা! ডাহা মিথ্যে কথা বাবুমশায়, ওর কথা একদম বিশ্বাস করবেননা। হাজার টাকার এক পয়সা কম হবেনা, কালীর কিরে।”

অবিনাশবাবু একটু চমকে উঠলেন বামার চন্ডী মূর্তি দেখে। পরাণকে আবার জিজ্ঞেস করলেন, “ বামা কি মিথ্যে বলছে?”

পরাণ মুখ কাঁচু মাঁচু করে বলল, “ তা কখনো সখনো একটু ইয়ে মানে বন্ধুবান্ধবরা ছাড়তে না চাইলে কী করি বলুন?” পরাণ হঠাৎ গলা নিচু করে ফিস ফিস করে বলল, “ ব্যাটা মহা হারামি, জানেন বাবু আজকাল বোতলে জল মেশাতে শুরু করেছে। ওকে পুলিশে ধরিয়ে দিননা।”

অবিনাশবাবু হেসে বললেন, “ ও যদি বিষও মেশায়, তোমরা পয়সা দিয়ে তাই কিনবে। ঠিক বলেছি কিনা বল?  তোমরা মদ খাওয়া ছেড়ে দাও, তবেই দেখবে ও জব্দ হবে। এক হাজার টাকা কত ভাল কাজে লাগান যায় পরাণ চিন্তা করে দেখ। অন্তত দশ দিন দুধ মাছ ফল কিনে খেতে পার। ভবিষ্যতের জন্য মাসে মাসে কিছু টাকা জমিয়ে রাখতে পার। ছেলেদুটোকে একটু বড় হলে স্কুলে ঢুকিয়ে দিতে পার। এসব কখনো চিন্তা করে দেখেছ পরাণ?”

পরাণ বোকার মত অবিনাশবাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল। ঢোক গিলে বলল, “ নাতো।”

কেন চিন্তা করনি?”

পরাণ হাঁ করে অবিনাশবাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল যেন প্রশ্নটা তার বোধগম্য হয়নি। একটু পরে ভেবে বলল, “ আমরা বাবু ছোটলোক, আমাদের মাথায় চিন্তা টিন্তা আসেনা।”

অবিনাশবাবু ধমকে উঠলেন, “ মিথ্যে কথা ! আমার যেমন মাথা আছে তোমারও আছে। আমি আমার ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করতে পারলে তুমি কেন পারবেনা? তোমার নিজের যাতে ভাল হয় তার জন্য তোমার চিন্তা করতে হবে পরাণ।”

পরাণ মাথা নিচু করে চুপচাপ নখ খুঁটতে লাগল, তারপর হঠাৎ মুখ তুলে বলল, “ কিন্তু আমি যে মদ খাওয়া ছাড়তে পারবনা বাবু। বারো বছর ধরে খাচ্ছি। এত পুরনো নেশা, কী করে ছাড়ব বাবু বলতে পারেন?”

ছাড়তে হবে পরাণ, তোমার বৌ ছেলেদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে ছাড়তে হবে। একদিনে না পার ধীরে ধীরে পরিমাণ কমিয়ে এনে শেষে ছেড়ে দাও। ছ’মাস একবছর চেষ্টা কর পরাণ। চেষ্টায় কী না হয়। মদের গ্লাস যখন হাতে তুলবে একবার তোমার সংসারের কথা চিন্তা কোরো দেখবে নিজের উপর তোমার ঘেন্না হবে। নিজেকে ঘেন্না যাতে না করতে হয় তার জন্যই তোমাকে মদ খাওয়া ছাড়তে হবে। আর হ্যাঁ আমি যে জন্য এসেছি – এই নাও এইখানে সই কর। আমি হারুর দোকান এখান থেকে উঠিয়ে দেবার জন্য স্বাক্ষর সংগ্রহে নেমেছি।”

পরাণ অবিনাশের হাত থেকে কলম তুলে নিয়েও ফিরিয়ে দিল, বলল, “ আমিতো সই করতে পারবনা বাবু।”

কেন?”

আমাদের সর্দার যে রাগ করবে। আপনি সর্দারের কাছে যান বাবু, ও যদি হ্যাঁ বলে এ তল্লাটে সব্বাই আপনার কাগজে সই করবে।”

কে তোমাদের সর্দার?”

নিরাকার মণ্ডল, চলুন বাবু আপনাকে সর্দারের কাছে নিয়ে যাই।”

 ক্রমশ …………

৬ষ্ঠ পর্ব পড়ুন আগামী রবিবার

লেখক পরিচিতি      

জন্ম এবং শিক্ষা কলকাতায়;কর্মজীবন দিল্লিতে,কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রালয়ে। গল্প লেখার শুরু ষাটের দশকের শেষ দিকে। বাংলা এবং ইংরেজি দুই ভাষায় সাহিত্যচর্চা করে আসছেন গত পঞ্চাশ বছর ধরে। ইংরেজিতে চারটি উপন্যাস ও একটি গল্প সংকলন এবং বাঙলায় চারটি উপন্যাস ও দু’টি গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। বিবিসি থেকেও ওঁর কয়েকটি ইংরেজি গল্প প্রচারিত হয়েছে। দেশ,আনন্দবাজার,সাপ্তাহিক বর্তমান, নবকল্লোল, পরিচয়, কালি ও কলম(বাংলাদেশ) এবং দিল্লি ও কলকাতার অনেক সাহিত্য পত্রিকায় গল্প লেখেন নলিনাক্ষ বাবু দিল্লি থেকে প্রকাশিত ‘ কলমের সাত রঙ’ পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত আছেন।