Advt

Advt

150-bachareo-vandemataram-jatiyatabodher-gabhir-anubhuti-probondho-feature-by-arijit-hajra-tatkhanik-digital-bengali-web-bangla-online-e-magazine


"বন্দেমাতরম" কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারিকা,অরুণাচল প্রদেশ থেকে গুজরাট সমগ্র ভারত তথা বিশ্বের যে প্রান্তেই ভারতীয়রা বসবাস করুক,এই একটি শব্দের আবেগে শিহরিত হয় সকলেই।" বন্দেমাতরম" ভারতবর্ষের বর্তমানে জাতীয় সংগীত (national  song) জনগণমন জাতীয় স্তোত্রের (national anthem) পাশাপাশি সমানভাবে মর্যাদা ও জাতীয় সম্মানের আসনে প্রতিষ্ঠিত ভারতের সংবিধানে। তবে "বন্দেমাতরম " শুধুমাত্র জাতীয় সংগীত হিসাবে আমাদের কাছে প্রতিষ্ঠিত নয়, বর্তমানে এটি ভারতবাসীর অন্তর আত্মার শক্তি।

এই বন্দেমাতরম গানটির মাধ্যমে উথাল পাতাল হয়েছিল ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন। ভারতের প্রতিটি কোনায় কোনায় এই গানের মধ্য দিয়ে পৌঁছে গিয়েছিল ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের ঢেউ। ব্রিটিশ বিরোধী ভারত ছাড়ো আন্দোলন তীব্রতর রূপ নিয়েছিল এই গানের মাধ্যমে। প্রতিটি ভারতীয় প্রতিটি আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ হয়েছিল বন্দেমাতরম এর আত্মমন্ত্রে। অহিংস সহিংস প্রতিটি আন্দোলনেরই  স্বদেশপ্রেমের  স্লোগানই ছিল "বন্দেমাতরম "।

"বন্দেমাতরম" শব্দটির ব্যাকরণগত দিকটিও বেশ তাৎপর্যপূর্ণ এবং সৌন্দর্যপূর্ণ। "বন্দেমাতরম" শব্দের অর্থ হল মা তোমাকে প্রণাম। "বন্দে " শব্দের অর্থ হলো বন্দনা করা এবং "মাতরম" শব্দের অর্থ হলো মা বা মাতৃভূমি। অর্থাৎ জন্মদাত্রী মায়ের মতনই জন্মভূমির বন্দনা করা হলো "বন্দেমাতরম " শব্দের প্রকৃত অর্থ। সংস্কৃত শব্দ বন্দে" একটি ক্রিয়াপদ। এর মূল অর্থ হল বন্দনা করা । ঋগ্বেদ এবং অন্যান্য বৈদিক গ্রন্থে দেখতে পাওয়া যায় 'বন্দনা শব্দটি। বন্দনা শব্দটি এসেছে মূল বন্দ শব্দ থেকে। যার অর্থ হল প্রশংসা করা,সম্মান করা,শ্রদ্ধা করা, উপাসনা করা অথবা শ্রদ্ধার সঙ্গে কিছু নিবেদন করা। আবার মাতরম শব্দটির ইন্দো- ইউরোপীয় মূল শব্দ আছে। সবকটি শব্দেরই অর্থ হলো মা। অর্থাৎ মা বা মাতৃভূমির বন্দনা করা হলো বন্দেমাতরম।

তবে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের ক্ষেত্রে রয়েছে "বন্দেমাতরম" এর গভীর গুরুত্ব। এই শব্দটির শক্তিতেই পরাধীন ভারতবর্ষ এগিয়েছিল স্বাধীনতা ছিনিয়ে নেওয়ার পথে। "বন্দেমাতরম" গানটির রচয়িতা সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় । পরাধীন ভারতের মুক্তির জন্য তিনি তাঁর লেখনীর দ্বারা উজ্জীবিত করেছিলেন ভারতের বিপ্লবীদের তথা সমগ্র ভারতবাসীকে। তাঁর লেখনীর অমূল্য সম্পদ হলো এই বন্দেমাতরম গানটি। ১৮৭৫ সালের ৭ই নভেম্বর বন্দেমাতরম গানটি প্রথম প্রকাশিত হয় বঙ্গদর্শন পত্রিকায় ।পরবর্তীকালে ১৮৮২ সালে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কালজয়ী উপন্যাস আনন্দমঠে অন্তর্ভুক্ত হয এই গানটি। এই উপন্যাসের সন্ন্যাসীরা স্বাধীনতার জন্য গেয়ে উঠতেন বন্দেমাতরম গানটি। আনন্দমঠ উপন্যাসে "বন্দেমাতরম " গানটি স্বদেশপ্রেমের প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র। দেশবাসীর হৃদয়ে দেশ মাতৃকার প্রতি দেশপ্রেম আগ্নেয়গিরির মতন প্রজ্বলিত করেছিলেন "বন্দেমাতরম" এর মাধ্যমে ।রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই গানটির সুর দিয়েছিলেন এবং ১৮৯৬ সালে ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের কলকাতা অধিবেশনে এই গানটি গেয়ে শোনান রবীন্দ্রনাথ। "বন্দেমাতরম" গানের দুটি স্তবক নিয়মিতভাবে গাওয়া হতো জাতীয় কংগ্রেসের বৈঠকে । এরপর থেকে এই গানের জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। লর্ড কার্জন ১৯০৫ সালের ৪ঠা জুলাই বঙ্গভঙ্গের আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা এবং ১৬ই অক্টোবর পৃথকীকরণ আইন কার্যকর  কার্যকর করলে "বন্দেমাতরম প্রার্থনার মধ্য দিয়ে বাঙালিরা শোক দিবস পালন করে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে। অর্থাৎ বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদী আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে বন্দেমাতরম। ১৯০৭ সালে মাদাম ভিকাজি কামা বার্লিনের স্টুডগার্ডে ভারতের বাইরে প্রথমবার ত্রিবর্ণ পতাকা উত্তোলনের সময়ও পতাকাটিতে বন্দেমাতরম শব্দটি লেখা ছিল। এছাড়া আজাদ  হিন্দ সরকারের ঘোষণা পত্রের সময়ে বন্দেমাতরম গানটি গাওয়া হয় । ১৯৫০ সালের ২৪ শে জানুয়ারি স্বাধীন ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদ গণপরিষদে একটি বিবৃতি দিয়ে বলেন যে স্বাধীনতা সংগ্রামে " বন্দেমাতরম" এর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার পরিপ্রেক্ষিতে বন্দেমাতরম ও জাতীয় সংগীত "জনগণমন" সমান মর্যাদা পাবে এবং সমানভাবে সম্মানিত হবে। পরবর্তীকালে "বন্দেমাতরম" জাতীয় সংগীত (national song) হিসাবে গৃহীত হয় এবং জাতীয় স্তোত্রের (national anthem )মর্যাদা পায় "জন গন মন" ।

১৮৭৫ থেকে ২০২৫ দীর্ঘ ১৫০ বছর ধরে "বন্দেমাতরম" সমানভাবে প্রাসঙ্গিক । "বন্দেমাতরম" এর ১৫০ বছর পূর্তিতে সমগ্র ভারতবর্ষ ঐক্যতার গর্বে গর্বিত । জাতীয়তাবাদের অহংকারে  সর্বদা উন্মেষিত ভারত। প্রত্যেকের মনন ও চেতনায় স্বাধীন দেশের মুক্তির স্বাদ পায় "বন্দেমাতরমে" । "বন্দেমাতরম" জাতীয় সত্তা ও জাতীয়তা বোধের এক গভীর অনুভূতি।। 

লেখকের অন্যান্য লেখা পড়তে এখানে ক্লিক করুন ।

লেখক পরিচিতি -

অরিজিৎ হাজরা,পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার সদর শহর সিউড়িতে বসবাস করেন ।  দীর্ঘ ২১ বছর ধরে শিক্ষকতার কাজে নিয়োজিত।  নেশা হচ্ছে লেখালেখি এবং তথ্যের অনুসন্ধান করা। একজন প্রাবন্ধিক গল্পকার হিসেবেই বেশি পরিচিত ।