ধারাবাহিক উপন্যাস – প্রতি রবিবার
পর্ব - ৭
সাত
ক্লাসের ফাঁকে মিলি এসে কণাকে জিজ্ঞেস করল,“হ্যাঁরে,তোর বাবা
নাকি ইলেকশনে দাঁড়াবেন?”
কণা রেগে গিয়ে বলল, “ যত্তসব
বাজে কথা। কে এসব গুজব রটায় বলতো?”
মিলি চোখ বড় করে বলল, “ কেন তোদের
পাড়ার সুমিতাই-তো সবাইকে বলে বেড়াচ্ছে। তোর বাবা নাকি পাড়া থেকে মদের দোকান তুলে
দেবার জন্য স্বাক্ষর সংগ্রহ করে বেড়াচ্ছেন?”
কণা হেসে বলল, “ স্বাক্ষর
সংগ্রহ করার সঙ্গে ইলেকশনে দাঁড়াবার কী সম্পর্ক থাকতে পারে আমার তো ভাই মাথায়
ঢোকেনা।”
মিলি কণার মাথাটা ধরে ঝাঁকি দিয়ে বলল, “ তাই যদি
বুঝতিস তবে ইতিহাস না পড়ে অঙ্ক কষতিস ঠিক আমার মত। রাগ করলিনাতো? ঠাট্টা
করলাম। শোন রাজনীতিতে ঢোকার সহজ রাস্তা হচ্ছে সমাজ সেবা। সব পলিটিশিয়ানরাই একটু
আধটু সমাজ সেবা করে নিজেদের ফিল্ড তৈরি করেন। তারপর যেই ভোটের সময় আসে টুক করে একটা
পার্টিতে যোগ দিয়ে ইলেকশনে দাঁড়িয়ে যান। কি আমি কিছু মিথ্যে বলছি?”
কণা মাথা ঝাঁকিয়ে প্রতিবাদ জানাল, “ আমার বাবা
কক্ষণো ইলেকশনে দাঁড়াবেননা, তুই দেখে নিস। বাবা একরোখা, গোঁয়ার, রাজনীতির
জটিলতার মধ্যে বাবা যেতেই পারেননা।”
ঠোঁট ফুলিয়ে মিলি বলল, “ বেশ বাবা
হার মানছি। হ’লোতো। পিতৃভক্ত বালিকা আবার যেন আমার কথায় রাগ করে কাঁদতে বোসনা। আমি
কিন্তু ভাই তোমার বাবাকে যথেষ্ট শ্রদ্ধা করি, আগেই বলে
রাখলাম।”
কণা ভাবল একটু ঠেস দিয়ে বলবে, “ ছিঁচ কাদুনে মেয়ে তুই না আমি ক্লাসের সবাই জানে।” কিন্তু অনর্থক ঝগড়া বেঁধে যাবার ভয়ে কণা মুচকি হেসে শুধু বলল, “ যাঃ বেশি দিদিগিরি ফলাতে আসিসনা, মারব থাপ্পর।”
দেশবন্ধু পার্কের বেঞ্চিতে বসে তাপস বলল, “ কী রকম
চলছে তোমার বাবার স্বাক্ষর সংগ্রহের কাজ?”
“ কী জানি, শুনছি
বস্তির লোকেরা স্বাক্ষর দিতে চাইছেনা।”
“ সেতো স্বাভাবিক। হারু ঘোষের
ওরাইতো আসল খদ্দের।”
কণা হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বলল, “ আমার একদম
ভালো লাগছেনা ব্যাপারটা তাপস। বাবার নামে ওরা সব যা তা রটিয়ে বেড়াচ্ছে। কেউ বলছে
বাবা নাকি হারু ঘোষের কাছে পঞ্চাশ হাজার টাকা দাবি করেছেন স্বাক্ষর সংগ্রহ বন্ধ
করার জন্য, আবার কেউ বলছে বাবা নাকি
ইলেকশনে লড়ার জন্যই এসব করে ফিল্ড তৈরি করছেন।”
তাপস আশ্চর্য হয়ে বলল, “ তার মানে
তোমার বাবা এলাকায় বেশ কিছু লোককে খেপিয়ে দিয়েছেন, তাইনা?”
“হবে হয়তো।”
“ তা তোমার বাবা এসব গুজব শুনে
কী বলেন?”
“ বাবাকে তো জানই। কারও কথায়
ভ্রুক্ষেপ করেননা। বলেন ‘গুজবে আমি ভয় পাইনা। ওরা যা খুশি বলে যাক, আমি আমার
কাজ করবই।’”
“ বেশ দৃঢ় প্রতিজ্ঞ লোক তোমার
বাবা। যাই বল কাজটা কিন্তু উনি খারাপ করছেননা।”
কণা তাপসের হাতটা শক্ত করে চেপে ধরল।“ ঠাট্টা
করছোনাত, তাপস? সত্যি বল বাবার কাজ তুমি
সমর্থন কর?”
তাপস একটু অবাক হয়ে বলল, “ ঠাট্টা
করব কেন তোমার বাবাকে। জান আমি তোমার বাবাকে নিজের বাবার চাইতেও বেশি শ্রদ্ধা করি।
সমস্ত জীবন ধরে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে যাচ্ছেন এমন ক’টা লোক আছে বল দেখি
আজকের পৃথিবীতে? যে যাই
বলুক শেষ পর্যন্ত ওনার জয় হবেই।”
কণা তাপসের হাতটা মুঠোর মধ্যে চেপে ধরে বলল, “ তুমি
আমাকে বাঁচালে তাপস। কলেজে পাড়ায় মেয়েরা দেখা হলেই বাবাকে নিয়ে ঠাট্টা করে। কীরকম
লাগে বলোত? কখনও কখনও এত মন খারাপ হয়ে
যায় ইচ্ছে করে বাবাকে যাচ্ছেতাই বলে গালাগালি দিই নয়তো ঘর ছেড়ে চলে যাই।”
তাপস কণার চুলে হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, “ মিছামিছি
রাগ করে কী লাভ বল? যেকোন ভাল কাজেই বাধা আসে।
বাবা বলতেন ‘শ্রেয়াংসি বহু বিঘ্নানি’। কথাটা খুব সত্যি। কণা হেসে বলল, “ থাক আর
সংস্কৃত আউড়ে পান্ডিত্য জাহির করতে হবেনা। আমাদের বাড়ি কবে আসছ বল? জানইতো
বাবাকে উৎসাহ দেবার মত কেউ নেই। তুমি এলে বাবা খুশি হবেন।”
আসব বইকি, শিগগিরই
আসব। তবে দেখ তোমার বাবার সঙ্গে যেন আবার লাঠি সড়কি নিয়ে না বেরোতে হয়। সেটা
কিন্তু তোমার দায়িত্ব।”
কণা তাপসের হাতে চিমটি কেটে বলল, “ আচ্ছা
বাবা আচ্ছা, ভিতুরাম কোথাকার।”
নিরকার
মণ্ডল অবিনাশবাবুকে দেখে খিঁচিয়ে উঠল। “ বারবার আমার কাছে কেন আসেন? যাননা ঘরে
ঘরে লেকচার দিন গিয়ে, যার ইচ্ছা সেই সই করবে।”
অবিনাশবাবু ম্লান হেসে বললেন, “ তুমিতো
জান নিরাকার এই বস্তির সবাই তোমাকে সর্দার হিসেবে মানে, তুমি না
বললে ওরা সই করবে কেন?”
নিরাকার গোমড়া মুখে বলল, “ আমিতো বলে
দিয়েছি আপনাকে হারুর ব্যাপারে আমি মাথা গলাতে যাবনা।”
“ কিন্তু ও যে তোমাদের সর্বনাশ
করছে নিরাকার। ঘরে আগুন লাগিয়ে দিচ্ছে, তার
প্রতিকার করা সর্দার হিসেবে তোমার কর্তব্য নয়?”
নিরাকার রেগে গিয়ে বলল, “ দেখুন
মশাই বেশি বুকনি ঝাড়বেননা। আপনাদের সবাইকে আমার চেনা আছে। হারুর চ্যালা চামুন্ডা
অনেক আছে। ওরা যদি এসে অত্যাচার শুরু করে বস্তির মানুষদের উপরে, যদি বোমা
ছোড়ে, ঘরদোরে আগুন লাগিয়ে দিয়ে যায়, তখন আপনি
আসবেন এদের বাঁচাতে? সব রকম ঝক্কি তখন আমার ঘাড়ে
এসে পড়বে।”
অবিনাশবাবু দৃঢ়ভাবে বললেন, “ নিরাকার
তুমি ভেবনা আমি গুন্ডা বদমাশ দেখিনি। ওরা বাইরে যতটা সাহসি মনে হয়, ভিতরে
ততটাই ভিতু। তোমরা সবাই একবার একজোট হয়ে দাঁড়াও, দেখবে
হারু সাহস পাবেনা তোমাদের গায়ে হাত দিতে। এ আমি আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। আর যদি
সত্যিই ও গুন্ডা লেলিয়ে দেয় তবে সবার আগে আমি রুখে দাঁড়াব। গুন্ডা বদমাশকে আমি ভয়
করিনা।”
নিরাকার এ কথার কোন প্রতিবাদ করলনা। হুশ হুশ
করে কয়েকটা টান দিয়ে হাতের বিড়িটা ছুঁড়ে ফেলে বলল, “ আপনি
দেখছি বাবু নাছোড়বান্দা। আচ্ছা আমার একটা কথার জবাব দেবেন? হারু
ঘোষের দোকান উঠে গেলে আপনার কি লাভ?”
অবিনাশবাবু চট করে নিরাকারের এ প্রশ্নের জবাব
দিতে পারলেননা। হারু এবং তার দোকানের কলুষিত পরিবেশকে অবিনাশবাবু মনে প্রানে ঘৃণা
করেন। আর এই ঘৃনাপ্রসূত বিদ্বেষ থেকেই তিনি এগিয়ে এসেছেন স্বাক্ষর সংগ্রহে। কিন্তু
আশ্চর্যের বিষয় যত লোকের সঙ্গে তিনি আজ পর্যন্ত স্বাক্ষর সংগ্রহের ব্যাপারে কথা
বলেছেন, কেউই যেন হারুকে স্পষ্ট নিন্দা করতে রাজি নন। হারু এবং তার মদের দোকানের
উপস্থিতি যেন খুবই স্বাভাবিক এবং সেকারণেই এ ব্যাপারে উদাসীন থাকার মধ্যে কোন দোষ
নেই। চারপাশের লোকদের মধ্যে এ মনোভাব প্রত্যক্ষ করে অবিনাশবাবুর কখনো কখনো মনে
হয়েছে, তবে কি এটা একান্তই তাঁর ব্যক্তিগত বিদ্রোহ? গণসমর্থনের
অভাব কি এটাই প্রমাণিত করেনা হারু এবং তার দোকান এ অঞ্চলের মানুষের তেমন কোনই
ক্ষতি করছেনা, শুধু তিনিই হারুর প্রতি
ব্যক্তগত বিদ্বেষের কারণে এ এলাকার মানুষদের তার পিছনে লেলিয়ে দিতে চাইছেন? নিরাকারের
প্রশ্নে অবিনাশবাবুর মনে এসব কথাই ঘুরপাক খেতে লাগল।
“ কী ব্যাপার? চুপ হয়ে
গেলেন যে?”
অবিনাশবাবু একটু চমকে উঠে বললেন, “ হ্যাঁ
নিরাকার, কী যেন বলছিলে? এতে আমার কী লাভ? দেখ
নিরাকার, পৃথিবিতে লাভ লোকসানের কথা ভেবে সবাই সব কাজ করেনা। হারু উঠে গেলে আমার লাভ এইটুকু যে
আমাকে রোজ রোজ মাতালদের বেলাল্লাপানা দেখতে হবেনা। তা তোমাদের কি কোন লাভ নেই? ভেবে দেখ
দেখি প্রতি মাসে তোমরা যে টাকা মদে উড়িয়ে দাও সেগুলো বাঁচলে তা দিয়ে কত কি করা
যায়।”
নিরাকার হঠাৎ হো হো করে হেসে উঠল। “ আপনি কী
মনে করেন হারুর দোকান উঠে গেলেই এ তল্লাটের লোক মদ ছেড়ে সরবত খেতে শুরু করবে? নেশা বড়
কঠিন জিনিষ অবিনাশবাবু, আপনি বুঝবেননা।”
অবিনাশবাবু বুঝতে পারলেন নিরাকারকে হার মানানো
শক্ত। তবু জোর দিয়ে বললেন, “ মানলাম ওরা রাতারাতি মদ ছেড়ে
সরবত খেতে শুরু করবেনা। কিন্তু এটাতো ঠিক যে হাতের কাছে বোতল না পেলে অন্তত ওদের
মদ খাবার প্রবণতা কিছুটা কমে যাবে। সারাদিন খাটুনির পর কটা লোক তিন মাইল ঠেঙিয়ে
রোজ রোজ মদ কিনতে যাবে? আর এটা কেন ভাবছ হারুকে
উঠিয়ে দিয়েই আমরা ক্ষান্ত হব? এটা শুধু
প্রথম পদক্ষেপ। একবার হারুকে ওঠাতে পারলে দেখবে আশপাশের অনেক হারুর টনক নড়ে যাবে।
আর শুধু দোকান তুলে দেওয়াইতো নয়, মদের বিরুদ্ধে
আমরা ঘরে ঘরে প্রচার করব।”
অবিনাশবাবুর বক্তৃতা শুনে নিরাকার মিটিমিটি
হাসছিল। অবিনাশবাবু থামলে হাই তুলে বলল, “ যত খুশি
বক্তিমে দিন, প্রচার করুন, কিস্যু
হবেনা। কোন শালা মদ ছাড়বেনা এই আপনাকে বলে দিচ্ছি। আর ছেড়ে করবেটা কী বলতে পারেন? সারাদিন
শালার গাধার খাটুনি, উপরওয়ালার গালাগালি শুনে জান
কয়লা হয়ে যায়। তারপরও যদি একটু মাল টেনে হালকা না হতে পারি তো বাঁচবো কেমন করে
বলতে পারেন? নাঃ মশাই, মদ ছাড়া
আমরা বাঁচবনা। কেউ যদি মদের দাম কমাবার জন্য আপনার মত কাগজ নিয়ে বেরোয় তবে একটু
কষ্ট করে আমাদের একটা খবর দেবেন, দলে দলে
গিয়ে সই করে আসব।”
অবিনাশবাবু এর পরে আর নিরাকারের সঙ্গে কথা বলা
অনর্থক মনে করে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বাইরে রাস্তায় এসে দাঁড়ালেন।
ক্রমশ …………
৮ম ও
৯ম পর্ব পড়ুন আগামী রবিবার
লেখক পরিচিতি –
জন্ম এবং শিক্ষা কলকাতায়;কর্মজীবন দিল্লিতে,কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রালয়ে। গল্প লেখার শুরু ষাটের দশকের শেষ
দিকে। বাংলা এবং ইংরেজি দুই ভাষায় সাহিত্যচর্চা করে আসছেন গত পঞ্চাশ বছর ধরে।
ইংরেজিতে চারটি উপন্যাস ও একটি গল্প সংকলন এবং বাঙলায় চারটি উপন্যাস ও দু’টি
গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। বিবিসি থেকেও ওঁর কয়েকটি ইংরেজি গল্প প্রচারিত হয়েছে।
দেশ,আনন্দবাজার,সাপ্তাহিক বর্তমান,
নবকল্লোল, পরিচয়, কালি ও
কলম(বাংলাদেশ) এবং দিল্লি ও কলকাতার অনেক সাহিত্য পত্রিকায় গল্প লেখেন নলিনাক্ষ
বাবু। দিল্লি থেকে প্রকাশিত ‘ কলমের সাত রঙ’ পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত আছেন।
.jpg)