ধারাবাহিক উপন্যাস – প্রতি রবিবার
পর্ব - ৪
চার
কলেজ থেকে বেরিয়ে পূর্ব নির্ধারিত সময়ে গড়িয়ার
কাছে একটা পার্কে কণা দেখা করল তাপসের সঙ্গে। তাপস যাদবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে
ফোর্থ সেমিস্টারের পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। শীত আসতে বেশি দেরী নেই।
বাতাসে হাল্কা হিমের আভাস। কয়েকটি শিশু, একটা
কুকুর আর জন দুই বৃদ্ধ ছাড়া পার্কে এখন কেউ নেই। ভিড় শুরু হবে বিকেল পাঁচটার পর
থেকে। বোগেনভেলিয়ার ঝোঁপের পাশেই নিরিবিলি একটা বেঞ্চি বেছে নিয়ে ওরা পাশাপাশি বসে
পড়ল।
তাপস বলল,“তোমার
বাবা শুনছি কোন হারু ঘোষের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেছেন?”
কণা একটু অবাক হয়ে বলল, “তুমি এসব
খবর কোত্থেকে পাও বলোত? স্পাই লাগিয়েছ নাকি আমার
বাবার পিছনে?”
তাপস হেসে বলল, “ না, এখন
পর্যন্ত সে স্টেজে আসিনি, তবে ভবিষ্যতে লাগাতে হতে
পারে ভেবে আগে থেকেই তোমার বাবার গতিবিধির একটু আধটু খবর রাখছি। তা ব্যাপারটা কি
বলোত?”
কণা বলল, “ব্যাপার
আর কি? হারু ঘোষের মদের দোকানে হৈ হল্লা হয়, তাতে বাবা
প্রতিবাদ জানান। হারু নাকি বলেছে ‘ মদের গন্ধ, হৈ
হুল্লোড় এসব যদি সহ্য না করতে পারেন তবে বাড়ি বিক্রি করে চলে যান।’ বাবতো রেগে
আগুন, বলেছেন, ‘ওর দোকান আমি তুলে দেব এখান
থেকে।’”
“তোমার পিতৃদেবকে একটু সামলে
রেখ,কণা। বলা যায়না কখন হারু ঘোষের সঙ্গে লাঠালাঠি শুরু করে দেবেন। তিরিশ বছর
আগে যখন পার্টি করতেন তখনতো এসবই করতেন শুনেছি।”
“তা করতেন বইকি। মিছিল করে
পুলিশের কর্ডন ভাঙতে গিয়ে একবার জেলও খেটে এসেছিলেন কয়েকদিনের জন্য।”
তাপস এবার একটু গম্ভীর হয়ে বলল, “ওসব পুরনো
দিনের কথা ছেড়ে দাও। হারু ঘোষের মত বদমাশ লোক এক আধটা গুন্ডা পিছনে লেলিয়ে দিতে
কতক্ষণ? এসব ব্যাপারে না যাওয়াই ভাল। একটু বুঝিয়ে বল তোমার বাবাকে।”
গুন্ডার কথা শুনে কণা একটু ভয় পেয়ে গেল। এ
ব্যাপারটা সে আগে ভেবে দেখেনি। “ কারও কথা শুনলেতো, মা-তো বলে
বলে হয়রান হয়ে গেছেন। এইতো দিন দুয়েক আগে থানায় গিয়েছিলেন রিপোর্ট করতে। থানার ওসি
নাকি স্পষ্ট বলে দিয়েছেন যতক্ষণ হারু ঘোষের কাছে লাইসেন্স আছে পুলিশ কিছু করতে
পারবেনা।”
“সেতো জানা কথাই। হারু ঘোষ এত
কাঁচা লোক নয়। দরকার হলে পুলিশকে ঘুষ দিয়ে বশ করবে।”
“এখন বলছেন বাড়ি বাড়ি গিয়ে
স্বাক্ষর সংগ্রহ করবেন। তারপর নবান্নে গিয়ে কোন মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করবেন, আরও সব কত
কি প্ল্যান করছেন। মাঝে মাঝে বাবার জন্য সত্যিই খুব চিন্তা হয়,তাপস।
হারু ঘোষ গুন্ডা লেলিয়ে দিলে সত্যিই ওখানে টিকে থাকা আমাদের মুস্কিল হবে। তুমি
একটু বুঝিয়ে বলনা।”
তাপস প্রায় লাফিয়ে উঠল, বলল, “আমি? তোমার
মাথা খারাপ। আমাকে যদি জিজ্ঞেস করেন, ‘তুমি কে
হে ছোকরা?’ তখন আমি কী জবাব দেব?”
কণা তাপসের হাতে চিমটি কেটে বলল, “কেন,বলবে আমি
আপনার কন্যার পানিপ্রার্থী, ভাবি জামাতা।”
তাপস বলল,“সে বললে
তো আরও মুস্কিল। ভাবি জামাতার হাতে লাঠি ধরিয়ে দিয়ে বলবেন,‘তোমার
প্রার্থনা মঞ্জুর হবার আগে তোমার যোগ্যতা নির্ণয় করা অতীব প্রয়োজন। যাও দেখি বাবা
হারু ঘোষের মাথাটা ফাটিয়ে দিয়ে এসোতো চটপট।’ না বাবা, আমি ও
কঠিন পরীক্ষায় অবতীর্ন হতে রাজি নই।”
কণা ঠাট্টা করে বলল, “ সেই ভয়েই
কি তুমি আমাদের বাড়ি আসা ছেড়ে দিয়েছ? মা তোমার
কথা জিজ্ঞেস করছিলেন।”
“ আরে না না, অতটা ভিতু
ভেবনা আমাকে। মারামারি আমিও একটু আধটু করেছি বইকি। আসলে কলেজে পড়ার চাপটা দিনকে দিন
এমন বেড়ে যাচ্ছেনা কী বলব। চলে আসব একদিন, আর কী।”
কণা সামনে বোগেনভেলিয়ার একটা পাতা ছিঁড়ে কুটি
কুটি করতে হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, “ একটা কথা জিজ্ঞেস করব তাপস? কিছু মনে
করবেনাতো ?”
তাপস কণার হাতটা নিজের হাতের মুঠোর মধ্যে নিয়ে
একটু চাপ দিয়ে বলল, “ বলো।”
“আচ্ছা তাপস তুমি কি মদ খাও?”
“কি ব্যাপার? তোমাকেও
তোমার বাবার রোগে ধরল নাকি?”
কণা হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে তাপসের কপালের ওপর এসে
পড়া একগুচ্ছ চুল সরিয়ে দিতে দিতে বলল,“যাঃ কি যে
বল তুমি। এমনিই জিজ্ঞেস করছিলাম।”
তাপস কণার হাতটা ঠোঁটে ছুঁইয়ে বলল, “নাঃ আমি
মদ খাইনা। একবার ডায়মন্ড হারবারে পিকনিকে গিয়ে কলেজের কয়েকজন বন্ধু জোর করে একটু
খাইয়ে দিয়েছিল। উঃ কি বিচ্ছিরি স্বাদ! টেস্টটা অত খারাপ না হলে হয়ত এক আধবার চেখে
দেখতাম। কিন্তু ওই প্রথম অভিজ্ঞতার পর আর সাহস হয়নি।”
কণা ওর হাতটা ঠোঁটের উপর চেপে ধরল। “সত্যি বলতে
কি আমিও গন্ধটা একেবারেই সহ্য করতে পারিনা, তাপস।
তোমারও ভাল লাগেনা জেনে নিশ্চিন্ত হলাম। আচ্ছা মদ খেলে কি সত্যিই খুব আনন্দ হয়?”
“হয় নিশ্চয়ই, নইলে এত
লোকে খাবে কেন?”
“কী ভয়ঙ্কর আনন্দ বাবা, দেখলে গা
শির শির করে। হারু ঘোষের দোকানে রোজই গোটা দুই লোক মারামারি করে, তারপর
কাদার মধ্যে গড়াগড়ি খায়। এ কি রকমের আনন্দ বলোত?”
“কি করে বলব বল কণা? আমি যে ও
রসে বঞ্চিত।”
“তুমি সত্যিই খুব ভাল ছেলে।
আমার সঙ্গে তোমার অনেক মিল, এজন্যই তোমাকে আমার এত ভাল
লাগে।”
ক্রমশ …………
৫ম
পর্ব পড়ুন আগামী রবিবার
লেখক পরিচিতি –
জন্ম এবং শিক্ষা কলকাতায়;কর্মজীবন দিল্লিতে,কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রালয়ে। গল্প লেখার শুরু ষাটের দশকের শেষ
দিকে। বাংলা এবং ইংরেজি দুই ভাষায় সাহিত্যচর্চা করে আসছেন গত পঞ্চাশ বছর ধরে।
ইংরেজিতে চারটি উপন্যাস ও একটি গল্প সংকলন এবং বাঙলায় চারটি উপন্যাস ও দু’টি
গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। বিবিসি থেকেও ওঁর কয়েকটি ইংরেজি গল্প প্রচারিত হয়েছে।
দেশ,আনন্দবাজার,সাপ্তাহিক বর্তমান,
নবকল্লোল, পরিচয়, কালি ও
কলম(বাংলাদেশ) এবং দিল্লি ও কলকাতার অনেক সাহিত্য পত্রিকায় গল্প লেখেন নলিনাক্ষ
বাবু। দিল্লি থেকে প্রকাশিত ‘ কলমের সাত রঙ’ পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত আছেন।
.jpg)