উত্তরবঙ্গের
অন্তরস্থ জঙ্গলে, যেখানে পাহাড় মিশেছে নদীর স্রোতে, আর ইতিহাসের
নিঃশব্দ প্রতিধ্বনি শোনা যায় বাতাসে—সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে বক্সা দুর্গ, লেপচাখা, এবং জয়ন্তী।
লুকিয়ে আছে অসংখ্য অনাবিষ্কৃত সৌন্দর্য, ইতিহাস ও রহস্যের ভাণ্ডার। যেখানে প্রকৃতি, ইতিহাস ও রোমাঞ্চ
মিলেমিশে একাকার।এই অঞ্চল শুধুমাত্র একটি পর্যটন কেন্দ্র নয়, বরং ভারতীয়
স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস, ভুটানি রাজাদের উত্তরাধিকার, এবং প্রকৃতির
অপরূপ মহিমার এক সম্মিলিত প্রতীক।
শিলিগুড়ি
অ্যাথলেটিক্স ওয়েলফেয়ার অর্গানাইজেশনের উদ্যোগে, ৮৯ জন শিক্ষার্থী ও ১২ জন প্রশিক্ষকের
এক দুরন্ত দল ১৯ এপ্রিল ২০২৪ সালে রওনা দেয় এই ইতিহাস-ভরা অভিযাত্রায়। এই অভিযান
শুধুমাত্র পাহাড়ে ওঠা নয়—এটি ছিল মননের এক যাত্রা, কেবল পাহাড়-নদী পেরোনো নয়—এটি ছিল
আত্ম-অনুসন্ধান, দলগত মনোবল ও ঐতিহাসিক উত্তরাধিকারের সঙ্গে গভীর সংযোগ স্থাপনের
এক শিক্ষামূলক যাত্রা। ইতিহাসকে অনুভব করা, এবং প্রকৃতির কোলে আত্মাকে ছুঁয়ে দেখার
এক অনন্য অভিজ্ঞতা।
প্রথম
অধ্যায়:-
যাত্রার
সূচনা — শিলিগুড়ি থেকে বক্সার পথে
১৯
এপ্রিল, শনিবার। ভোরের আলো
তখনও ফোটেনি। শিলিগুড়ি জংশন রেলস্টেশন তখন উৎসাহী
কিশোর-কিশোরীদের কোলাহলে মুখর। প্রত্যেকের চোখেমুখে ছিল উচ্ছ্বাস আর প্রত্যাশা।
৪:৩২ মিনিটে শিলিগুড়ি জংশন রেলস্টেশনে একত্রিত হলো ১০১ জন অভিযাত্রী। ব্যাগে খাবার, জল, রেনকোট, স্লিপিং ব্যাগ—আর
চোখে অজানার আহ্বান। সকাল ৫টায় ডিএমইউ ইন্টার-সিটি এক্সপ্রেস গড়িয়ে দিল রেলেরচাকা, যখন ধীরে ধীরে প্ল্যাটফর্ম ছাড়ল, তখন সূর্যের প্রথম কিরণ যেন আশীর্বাদ
জানিয়ে বিদায় দিল আমাদের যাত্রাকে।
সবুজের
বুক চিরে ট্রেন ছুটে চলল—গুলমা, সেভক, ওডলাবাড়ি, চালসা, ম্যালবাজার, হাসিমারা, ফালাকাটা… প্রতিটি স্টেশনে যেন এক একটি দৃশ্যপট:
একদিকে চা-বাগান, অন্যদিকে পাহাড়ি নদী আর মেঘে মোড়া আকাশ। অবশেষে সকাল ১০:৩০-এ পৌঁছলাম আলিপুরদুয়ার জংশন-এ। অপেক্ষা করছিল দুটি বাস, সকলে একসঙ্গে তোলা হলো স্মরণীয় গ্রুপ ফটো। প্রাতরাশের প্যাকেট
হাতে নিয়ে আমরা রওনা দিলাম সুনতলাবাড়ি—যা বক্সা টাইগার রিজার্ভ-এর প্রবেশদ্বার এবং
আমাদের ট্রেকিং রুটের সূচনা বিন্দু। এখানেই শুরু হলো আমাদের আসল অভিযান—প্রকৃতির কোলে
পায়ে হেঁটে এগিয়ে চলা।
দ্বিতীয়
অধ্যায়:-
ঐতিহাসিক
বক্সা দুর্গ: স্বাধীনতার নীরব সাক্ষী
সুনতলাবাড়ি
থেকে প্রায় দেড় ঘণ্টার উর্ধ্বমুখী হাঁটা শেষে চোখে পড়ল ইতিহাসের এক জীবন্ত নিদর্শন—বক্সা
ফোর্ট। ৮৬৭ মিটার (২,৮৪৪ ফুট) উচ্চতায় অবস্থিত এই দুর্গকে ঘিরে রয়েছে প্রায় তেরো
শতকের ইতিহাস। বক্সা দুর্গের আশেপাশে ঘন বন, বাঁশবন ও বুনো অর্কিডে ভরপুর। পাহাড়ি
বাতাসে ভেসে আসে অজানা ফুলের গন্ধ। দূরে শোনা যায় হাতির চিৎকার, ভুটানি পাখির
ডাক—সব মিলিয়ে এক রহস্যময় পরিবেশ।
প্রাচীন
তিব্বতের রাজা সংস্তান গাম্পো সপ্তম শতকে এই দুর্গ নির্মাণ করেন। বহু শতাব্দী পরে এটি
হয়ে ওঠে ভারত-ভুটান সীমান্তের এক কৌশলগত দুর্গ। ১৮৬৫ সালে দ্বিতীয় ডুয়ার্স যুদ্ধে
ব্রিটিশরা ভুটানিদের পরাজিত করে এই দুর্গ দখল করে নেয় এবং সিঞ্চুলা চুক্তির মাধ্যমে
এটি আনুষ্ঠানিকভাবে ব্রিটিশ ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়।
পরবর্তীকালে
ব্রিটিশরা বাঁশের তৈরি দুর্গটিকে পাথরে পুনর্নির্মাণ করে সেটিকে রূপান্তরিত করে রাজনৈতিক
বন্দীশিবিরে। এখানে বন্দি ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, অনিল রায়, প্রফুল্ল গুপ্ত, যতীন দাস প্রমুখ।
কিংবদন্তি অনুসারে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুকেও নাকি কয়েকদিনের জন্য এখানে আটক রাখা
হয়েছিল এবং তিনি লামাদের সহযোগিতায় ছদ্মবেশে পালিয়ে যান।
১৯৫০
সালে চীনের তিব্বত দখলের পর বহু তিব্বতি শরণার্থী এই দুর্গে আশ্রয় নেন। পরে ১৯৮৩ সালে
এটি ঘোষণা করা হয় বক্সা টাইগার রিজার্ভ, এবং ১৯৯৭ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার একে
জাতীয় উদ্যান হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। আজ এটি শুধুমাত্র ঐতিহাসিক স্থান নয়—এটি প্রকৃতি, ঐতিহ্য ও সংগ্রামের
প্রতীক।
তৃতীয়
অধ্যায়:-
লেপচাখা:
ডুয়ার্সের রানি
বক্সা
ফোর্ট থেকে পাহাড়ি পথ ধরে আরও কিছুটা এগিয়ে গেলে দেখা মেলে মেঘেঢাকা স্বপ্ন গ্রাম লেপচাখা-র।
প্রায় ৩,৫০০
ফুট উচ্চতায় অবস্থিত এই দ্রুকপা সম্প্রদায়ের গ্রামটিকে স্থানীয়রা বলেন—“ডুয়ার্সের
রানী”।
গ্রামের
প্রতিটি কোণে শান্তি ও সৌন্দর্যের স্নিগ্ধ
ছোঁয়া। দূর থেকে দেখা যায় ১২টি নদীর আঁকাবাঁকা গতিপথ—জয়ন্তী, রাইডাক, তোর্সা, সানখোষ—সব
যেন একসঙ্গে এসে মিলেছে লেপচাখার চূড়া থেকে আমাদের চোখের সামনে।
সন্ধ্যায়
শিক্ষার্থীরা জড়ো হয় আগুনের চারপাশে। কেউ গান গায়, কেউ কবিতা আবৃত্তি করে, কেউ আবার নিজের
দিনের অভিজ্ঞতা ভাগ করে। পাহাড়ের সেই নীরবতার মধ্যে প্রতিধ্বনিত হয় তাদের হাসি ও
উচ্ছ্বাস—যা হয়তো আজও ভেসে বেড়ায় বক্সা পাহাড়ের বুকের উপর।
চতুর্থ
অধ্যায়:-
লেপচাখা
থেকে জয়ন্তী: অ্যাডভেঞ্চারের শিখর
পরদিন
ভোরের সূর্যোদয় যেন নতুন অধ্যায়ের সূচনা করল। ব্রাশ, প্রাতরাশ ও ফটোসেশন শেষে সকাল ৮:১০-এ
রওনা হলাম জয়ন্তী-র উদ্দেশ্যে। প্রায় ১২ কিলোমিটার দীর্ঘ এই ট্রেইল সত্যিকারের অ্যাডভেঞ্চার
প্রেমীদের জন্য স্বর্গসম।
কখনও
নদীর বালুচর, কখনও খরস্রোতা জলের স্রোত, কখনও বা বিশাল পাথরের গায়ে হাত রেখে
সাবধানে অগ্রসর হতে হচ্ছিল। পথে তিনটি পাহাড়ি কুকুর আমাদের সঙ্গী হয়ে ওঠে—যেন প্রকৃতির
দূত হয়ে দিশা দেখাচ্ছিল।
ছয়
ঘণ্টার কষ্টকর পদযাত্রার শেষে আমরা পৌঁছই মহাকাল মন্দিরে—যা পাহাড়ি গুহার গভীরে অবস্থিত।
মন্দিরের চারপাশে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল শাঁখ, ঘণ্টা আর ভক্তির সুর। মনে হচ্ছিল, এই পথ যেন
আত্মাকে শুদ্ধ করে দিয়ে যায়, ক্লান্ত শরীরকে দেয় অদ্ভুত এক প্রশান্তি।
পঞ্চম
অধ্যায়:-
সংগঠনের
দায়িত্ব ও নেতৃত্ব
এই
অভিযানের সাফল্যের মূল স্তম্ভ ছিল প্রশিক্ষকদের সংগঠন ও দায়িত্ববোধ। প্রতিটি শিক্ষার্থীর নিরাপত্তা, খাবার, বিশ্রাম—সব কিছুর প্রতি ছিল কঠোর নজর।
বিশেষভাবে
উল্লেখযোগ্য সুমিত, যিনি আলিপুরদুয়ার থেকে থাকা, খাওয়া ও পরিবহণের
যাবতীয় দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে সামলেছিলেন।
ষষ্ঠ
অধ্যায় :-
বিদায়ের
সুর
দুর্গম
পথ পেরিয়ে দুপুর ১:৪০-এ যখন আমরা পৌঁছই জয়ন্তী-তে, তখন আকাশ কালো হয়ে এলো। প্রকৃতি যেন
নিজের অশ্রু ঝরিয়ে বিদায় জানাল ছোট ছোট অভিযাত্রীদের। বৃষ্টির প্রতিটি ফোঁটায় যেন
বাজছিল একটাই বার্তা—
“আবার এসো, আমার কোলে ফিরে এসো।”
বিকেল
২:১৫-এ বাস রওনা দিল আলিপুরদুয়ার স্টেশনের দিকে। সেখানে অপেক্ষা করছিল ফ্রাইড রাইস
ও ডিমের কারি—সুমিতের দলের ভালোবাসায় তৈরি। কাঞ্চন কন্যা এক্সপ্রেস ধরে সন্ধ্যা ৭টায়
ফিরে এলাম শিলিগুড়ি জংশনে। বিদায়ের মুহূর্তে যেন পাহাড়ের নীরবতা ঢেকে গেল আমাদের
অগণিত স্মৃতির গুঞ্জনে।
উপসংহার :-
এই
অভিযান শুধুমাত্র একটি ট্রেক নয়—এটি ছিল এক জীবন্ত ইতিহাসের সঙ্গে আমাদের প্রত্যক্ষ
পরিচয়। এটি শিখিয়েছে দলগত চেতনা, শৃঙ্খলা, সহনশীলতা এবং
প্রকৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা।
বক্সা-লেপচাখার
পথে আমরা খুঁজে পেয়েছি নিজেদের ভেতরের এক নতুন শক্তি—যা ভবিষ্যতের প্রতিটি পদচারণায়
পথ দেখাবে।
ট্রেক রুট
মানচিত্র ও পথ নির্দেশিকা :-
ট্রেক রুট
:-
সুনতলাবাড়ি
→ বক্সা দুর্গ
→ লেপচাখা → মহাকাল মন্দির → জয়ন্তী
ধাপ রুট
দূরত্ব সময়
বৈশিষ্ট্য
১ সুনতলাবাড়ি → বক্সা ফোর্ট ৩.৫ কিম ১.৫ ঘণ্টা
পাথুরে উর্ধ্বমুখী জঙ্গল পথ
২ বক্সা ফোর্ট → লেপচাখা গ্রাম ১.৫ কিমি ৪৫ মিনিট
বাঁশবন ও পাহাড়ি গ্রামাঞ্চল
৩ লেপচাখা → মহাকাল
মন্দির → জয়ন্তী ১২
কিমি ৫–৬ ঘণ্টা নদী পারাপার,
বাঁশের সাঁকো,বড় পাথর ও গভীর বন ।
সুবিধাজনক সময়: -নভেম্বর–এপ্রিল
নিবাস:- স্থানীয় দ্রুকপা হোমস্টে
গাইডের প্রয়োজন:- অবশ্যই প্রয়োজনীয় (স্থানীয় গাইড বা বনবিভাগ
অনুমোদিত গাইড)।
বন্যপ্রাণী:-
হাতি, গৌর, হরিণ, বুনো শূকর, নানা প্রজাতির
পাখি ও প্রজাপতি।
মানচিত্র:
লেখক পরিচিতি :-
দেবব্রত চক্রবর্তী পেশায় ব্যাংক কর্মচারী হলেও মন তাঁর নিবেদিত পরিবেশ ও সমাজসেবায়। তিনি “Green Environment Preservation
Society (GEPS)”-এর সঙ্গে যুক্ত থেকে পরিবেশ সচেতনতা, ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য প্রকৃতি-শিক্ষা শিবির,অ্যাডভেঞ্চার ট্রেকিং ও খেলাধুলা সম্পর্কিত কর্মসূচির মাধ্যমে
আগামী প্রজন্মের মধ্যে প্রকৃতি ও জীবনের প্রতি শ্রদ্ধা গড়ে তোলার প্রচেষ্টা চালিয়ে
যাচ্ছেন। প্রকৃতি, ইতিহাস, সংস্কৃতি ও অভিযানের প্রতি গভীর ভালোবাসাই তাঁকে এই ভ্রমণকাহিনী
রচনায় উদ্বুদ্ধ করেছে।
.jpg)




