আব্রাহাম এখন বয়সের ভারে
ন্যুব্জ । সে ঘরেই থাকে । দেহ ক্রমশ জীর্ণ । শক্তিও তেমন নেই , কেবল শোয়া
আর বসা । আব্রাহাম বোঝে খুব শিগগিরই তাঁর ডাক আসবে । স্ত্রী সারাহ আগেই চলে গেছে
মায়া কাটিয়ে । কিন্তু আব্রাহামের কাঁধে যে এখন অনেক বড় দায়িত্ব । একমাত্র সন্তান
কে সংসারে থিতু করতে হবে , তার একটা পরিবার হবে এবং
প্রভুর ইচ্ছে অনুসারে তারা হবে এই ক্যানন প্রদেশের উত্তরাধিকারী ।
ঘরে বসে থাকলে চলবে না , উপযুক্ত
পাত্রী খুঁজতে হবে আইজ্যাকের জন্য । আব্রাহাম তাঁর প্রিয় বিশ্বস্ত সহচরকে খবর
পাঠাল , “ তুমি মেসোপটেমিয়া যাও । আমার জন্মভূমি । আমার লোকজনের
মধ্যে থেকে এক সুশীলা , সুন্দরী , কন্যা
নিয়ে এসো । আমার এখন বয়স হয়েছে, তাঁর ওপর
এত দায়িত্ব । তোমাকেই যেতে হবে । তুমি আমাদের পরিবারের শুভাকাঙ্ক্ষী ’’ ।
কিন্তু সে তো বড় কঠিন
কাজ । বন্ধুর কপালে ভাঁজ । যদি সে কন্যা এতদূর আসতে রাজি না হয়! তবে কি সে আইজ্যাক
কে সঙ্গে করে নিয়ে যাবে !! আব্রাহামের গলায় আশ্বস্তের সুর ,
_ কন্যা না
এলে সে তোমার দোষ নয় । তোমার কোন শাস্তি হবে না । আমি তোমায় ভুল বুঝব না । তুমি
একাই যাও , আইজ্যাক যাবে না । ঈশ্বর
তাকে এখানেই থাকার নির্দেশ দিয়েছেন ।
****
দূত রওনা হোল মেসোপটেমিয়ার
উদ্দেশ্যে , সাথে দশটি উট এবং কিছু লোক ।
দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে এসে পৌঁছুল মেসোপটেমিয়ায় । দূত জানে এখানেই থাকে আব্রাহামের
জ্ঞাতি গোষ্ঠী , আব্রাহামের ভাই , নাহর ।
তাঁর সাথে দেখা হলে আব্রাহামের গল্প করবে , করবে
আইজ্যাকের গল্প , কত কি বলার আছে । কিন্তু এত
বড় শহরে তাকে কোথায় খুঁজবে !! নাহর কি চিনতে পারবে ? বিশ্বাস
করবে তার কথা ? যদি বিশ্বাস না করে তবে উপায়
?
প্রায় অন্ধকার হয়ে এসেছে , ঘুরতে
ঘুরতে দূত এসে পৌঁছুল এক কুয়োর ধারে । দূত জানে শহরের সব মহিলারা এখানে আসে জল
নিতে , এখানেই আইজ্যাকের জন্য উপযুক্ত কন্যা পাওয়া যেতে পারে । দূত একটি পরিকল্পনা
করল , কোন কন্যার কাছে জল চাইলে সে যদি নির্দ্বিধায় জল দেয় এবং তাঁর দশটি উটের
জন্য জলের ব্যবস্থা করে তবে বোঝা যাবে সেই কন্যা উদার , সুন্দর
সহজ সরল মনের । তাকেই সে নিয়ে যাবে সদাশয় ধর্মপ্রাণা আব্রাহামের পুত্র আইজ্যাকের
জন্য। এমন কন্যাই তাঁর পরিবারে মানায়।
বসে রইল দূত কুয়োর ধারে । এক
অপূর্ব সুন্দরী কন্যা এলো , দেখেই মুগ্ধ দূত । তবে রূপটা
সব নয় , তাকে জানতে হবে কন্যার স্বভাব , চরিত্র ।
দূত ধীর পায়ে সামনে এগিয়ে এলো ,
_ একটু জল
চাই ,একটু খাবার জল দেবে ! খুব তেষ্টা !
_ নিশ্চয়ই ।
আপনি বসুন , আমি আমার পাত্র দিয়ে জল তুলে
আপনাকে দিচ্ছি ।
কুয়ো থেকে জল তুলে কন্যা
তেষ্টা মেটাল । এইবার কন্যার চোখ পড়ল তৃষ্ণায় কাতর উট দের দিকে ,
__আহা ওদের
চোখ মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে ওরা ক্লান্ত, পিপাসায়
কাতর। এই উটদেরও জলের দরকার । আমি ওদের জন্যও জলের ব্যবস্থা করি । কন্যা কুয়ো
থেকে জল এনে একে একে দশটি উটের তৃষ্ণা মেটাল।
দূতের আনন্দ আর ধরে না । এই
কন্যাই আইজ্যাকের উপযুক্ত । কন্যার এমন আচরণে সে আপ্লুত । জানতে পারল কন্যার নাম , রেবেকা ।
রেবেকার বাবা বেথুএল । বেথুএল নাহরের সন্তান। খুশির ঢেউ দূতের বুকে। নাহর!! সে তো
আব্রাহামের ভাই!! কি আশ্চর্য!! ঈশ্বর ঠিক তাকে আব্রাহামের পরিবারের কাছে পৌঁছে
দিয়েছেন। আর দেরি নয়। দূত কন্যার বাড়ি পৌঁছল। রেবেকা তাঁর মা এবং দাদা লাবান এর
সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। ওদের আতিথেয়তায় মুগ্ধ দূত। সবাই মিলে এক সাথে খাওয়া হোল , হল গল্প।
দূত রেবেকা এবং লাবানকে উপহার দিল। অমায়িক এই মা, মেয়ে এবং
ছেলে অতিথিকে বিশ্বাস করেছে । তাদের মনে কোন সন্দেহ নেই, সাদা
কাগজের মতই অমলিন তাদের মন।
নাহ , আর দেরি
নয় । দূত এইবারে তাঁর পরিকল্পনা জানাল । রেবেকার গৃহে খুশির বাধ ভেঙ্গে পড়ল । এ যে
জল না চাইতেই মেঘ । কোন দ্বিমত নয় । আব্রাহামের পরিবারে যাচ্ছে রেবেকা , এর চাইতে
আনন্দের আর কি হতে পারে !!
শুরু হোল সাজ সাজ রব ।
কন্যাকে নিজের হাতে সাজাল মা । গুছিয়ে দিল তার পথে চলার নানা সামগ্রী । দিল নানা
উপহার । বহু দুর যেতে হবে , দীর্ঘ পথ । আর দেরি নয় , এইবারে পা
বাড়াল দূত রেবেকাকে সঙ্গে নিয়ে ।
দাদা লাবানের চোখে জল , মায়ের
চোখে অশ্রুধারা । প্রিয় কন্যাকে পাঠিয়ে দিচ্ছে তাঁর শ্বশুরালয়ে , সে যে বহু
দুর!! কেউ জানে না আবার কবে দেখা হবে, আদৌ হবে
কি না। কেমন থাকবে কন্যা, সুখী হবে তো!!
স্বামী তাকে ভালবাসবে তো !! মায়ের মনে প্রশ্নের ভীড়। ইস , আরও কয়েক
দিন যদি থেকে যে তো মায়ের কাছে!! মেয়েকে ছাড়তে
যে মন চায় না। মেয়ে যে চোখের মনি। দাদা লাবানের ও মন ভারাক্রান্ত , আবার কবে
দেখা হবে! সে যে বহু দূর চলে যাচ্ছে!!
রেবেকা চোখ মুছতে মুছতে
ক্যাননের পথে এগোল, সাথে দূত এবং উটের দল । দূত
সর্বদা সজাগ । কন্যা সম রেবেকার যেন কোন অসুবিধে না হয় । পথে নানা বিপদ ওত পেতে
থাকে । সব বিপদ থেকে তাকে আগলে রাখতে হবে , ফুলের মত
নরম এই মেয়ে কে ।
ওদিকে আইজ্যাক অধির আগ্রহে
অপেক্ষায় । কেমন কন্যা আসবে! সে কতটা সুন্দরী হবে! কেমন হবে তাঁর স্বভাব! তাঁর চাল
চলন কেমন হবে! সে ভালবাসবে তো আইজ্যাক
কে! পিতা আব্রাহামকে শ্রদ্ধা করবে তো! এত সব প্রশ্ন মনে।
এক বিকেলে সূর্য যখন প্রায়
অস্তমিত , আইজ্যাক দেখতে পেল ঐ দুর
দিগন্তে সারি সারি উটের দল , এগিয়ে আসছে তারই তাঁবুর দিকে
। বুকের মাঝে ছলাৎ করে উঠল । ঐ বুঝি সে এলো । তাঁবুর বাইরে ছুটে এলো আইজ্যাক । হবু
স্ত্রী কে নিয়ে অনেক কৌতূহল । ঐ তো সে আসছে। উটের দল এগিয়ে আসছে । রেবেকা উটের পিঠ
থেকে নেমে এলো , মুখ তাঁর ওড়নার আড়ালে, তার মনেও
আজ বসন্তের দোলা । দুজনে দুজনকে দেখল, মুগ্ধ হয়ে
গেল। দুটি প্রাণ, দুটি হৃদয় এক হল। আজ খুশির
জোয়াড় আব্রাহামের পরিবারে। তবু এই আনন্দের মুহূর্তে আব্রাহামের বুকের ভেতর
যন্ত্রণা হচ্ছিল। এমন খুশি তো সারাহ ও
দেখতে চেয়েছিল। কিন্তু—-----!!! আব্রাহামের বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস। দুই হাতে
আশীর্বাদ করল নব দম্পতিকে।
লেখিকার অন্যান্য লেখা পড়তে এখানে ক্লিক করুন ।
লেখিকার পরিচিতি -
স্টেটস্ম্যান, সুখবর, সকালবেলা ইত্যাদি খবরের কাগজে গল্প প্রকাশিত হয়েছে। দেশ, সানন্দা, প্রসাদ, সারথি পত্রিকায় গল্প, কবিতা ও প্রবন্ধ লেখেন। 'Times of India'-তে বেশ কয়েকবার কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। কবিতা দিয়ে সাহিত্য জীবনের শুরু।বর্তমানে কিশোর ও প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য গল্প লিখতেই বেশি ভাল বাসেন । বহু e magazine এ লেখেন ।