Advt

Advt

prakritir-pratisodh-o-shabda-dushaner-chhaya-feature-probondho-by-debabrata-chakraborty-tatkhanik-digital-bengali-web-bangla-online-e-magazine

prakritir-pratisodh-o-shabda-dushaner-chhaya-feature-probondho-by-debabrata-chakraborty-tatkhanik-digital-bengali-web-bangla-online-e-magazine
 

উত্তরবঙ্গের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য একসময় ছিল দেশের গর্ব—বনভূমি, নদী, পাহাড় আর সবুজে ঘেরা এই অঞ্চল আজ এক গভীর সংকটে। সাম্প্রতিক প্রলয়ঙ্করী বর্ষায় ডুয়ার্স, জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার, কালিম্পং, দার্জিলিং ও কোচবিহারের বহু এলাকা প্রকৃতির রোষে তছনছ হয়েছে। মাত্র দু’দিনের প্রবল বর্ষণে নদীর বাঁধ ভেঙে, পাহাড়ে ধস নেমে, বহু গ্রাম, চা-বাগান এলাকা ও বসতি সম্পূর্ণ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে।

প্রকৃতির রোষে বিপর্যস্ত জীবন ও অর্থনীতি

নদীগুলো—মহানন্দা, বালাসন, সংকোশ, জলঢাকা, কালজানি,  তিস্তা, তোর্ষা, এবং জলঢাকা—সবকটিই তাদের গতিপথ হারিয়েছে। শত শত গ্রাম প্লাবিত হয়েছে, চাষের জমি বালিতে ঢেকে গেছে, ফসল সম্পূর্ণ নষ্ট। ডুয়ার্স ও পাহাড়ের অসংখ্য চা-বাগান শ্রমিকরা কাজ হারিয়ে পড়েছেন চরম আর্থিক অনিশ্চয়তায়।

বন্যা ও ভূমিধসে ভেসে গেছে সড়ক, সেতু ও বিদ্যুতের লাইন। বহু পরিবার ঘরবাড়ি হারিয়ে আশ্রয়হীন, স্কুলগুলো অচল, চিকিৎসা পরিষেবা ব্যাহত, যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত। উত্তরবঙ্গের অর্থনীতির মেরুদণ্ড—চা ও পর্যটন শিল্প—এখন প্রায় বিপর্যস্ত অবস্থায়। হাজার হাজার পরিবার এখন দিন আনে দিন খায় অবস্থায় ফিরে গেছে।

এই প্রাকৃতিক দুর্যোগের পেছনে রয়েছে মানুষের তৈরি উন্নয়নের বিকৃত রূপ। পাহাড়ে নির্বিচারে গাছ কাটা, অপরিকল্পিতভাবে উঁচু ইমারত নির্মাণ,  নদীর পাড় দখল এবং অযথা অপরিকল্পিতভাবে হোটেল-রিসর্ট নির্মাণের ফলে প্রকৃতির স্বাভাবিক ভারসাম্য নষ্ট হয়েছে।


প্রকৃতি ধ্বংসের প্রমাণ:

নদীতে ভেসে চলা গাছের গুঁড়ি দুর্যোগের দিনগুলিতে সংবাদমাধ্যমে, সোশ্যাল মিডিয়ায় ধরা পড়েছে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্য—নদীর স্রোতে ভেসে চলেছে হাজার হাজার গাছের গুঁড়ি। এগুলো প্রমাণ করে, বছরের পর বছর ধরে বনাঞ্চলে কীভাবে নির্বিচারে বৃক্ষছেদন হয়েছে। উন্নয়নের নামে বা ব্যবসায়িক স্বার্থে কাটা সেই গাছগুলিই আজ নদীর বুকে মৃতপ্রমাণ হয়ে ফিরে এসেছে।

চোখের সামনে ভেসে চলা কাঠের গুঁড়ি যেন প্রকৃতিরই আর্তনাদ—“ আমার দেহ কেটে তোমরা উন্নয়নের নাম দিচ্ছো!”

দুঃখজনকভাবে, এই কাঠ সংগ্রহ করে এখন অনেকেই অর্থ উপার্জনের রাস্তা খুঁজছেন—যা একদিকে নৈতিক অবক্ষয়, অন্যদিকে পরিবেশগত সংকটের নতুন অধ্যায়।

সামাজিক জীবনে বিপর্যয়: এক মানবিক সংকট এই বিপর্যয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে হাজারো পরিবার। পাহাড় ও ডুয়ার্সের আদিবাসী গ্রাম, চা-বাগান এলাকা, নদীপাড়ের বসতিগুলোতে মানুষ এখন ভয় ও অনিশ্চয়তার মধ্যে বেঁচে আছে। শিশুরা স্কুল হারিয়েছে, বৃদ্ধরা চিকিৎসার অভাবে কষ্টে, গবাদিপশু মারা যাচ্ছে খাদ্য ও আশ্রয়ের অভাবে। বহু বন্য প্রাণীর মৃত্যু হয়েছে এই প্রাকৃতিক দুর্যোগে।

এ যেন এক মানবিক ট্র্যাজেডি—যেখানে উন্নয়নের নামেই মানুষ আজ নিজের বেঁচে থাকার অধিকার হারাচ্ছে।

প্রশাসনিক উদাসীনতা ও বাস্তবতা :ইরিগেশন ডিপার্টমেন্ট থেকে স্থানীয় প্রশাসন—সবার মুখে এক কথা, “বাজেট নেই।” অথচ বছরের পর বছর নদী সংস্কার, ড্রেজিং, ড্রেনেজ উন্নয়ন, বৃক্ষরোপণ বা পলিথিন নিয়ন্ত্রণের কাজ উপেক্ষিতই রয়ে গেছে। যদি সময়মতো পদক্ষেপ নেওয়া হতো, নদীর জলধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি করা যেত, বৃক্ষরোপণ বাড়ানো যেত, তবে হয়তো এই বিপর্যয় এড়ানো সম্ভব হতো।

আজ প্রয়োজন একটি দীর্ঘমেয়াদি নদী পুনরুজ্জীবন প্রকল্প—যাতে নদী শুধু জল নয়, জীবন বহন করে।


আলো নয়, শব্দ নয় — শান্ত দীপাবলির আহ্বান :

এই বিপর্যয়ের পর ঠিক যখন প্রকৃতি ধীরে ধীরে নিজেকে সামলাচ্ছে, তখন সামনে দীপাবলি উৎসব। আলোয় আলোকিত হোক আমাদের মন, কিন্তু শব্দে নয়। বিকট শব্দবাজির বিকিরণ পশু, পাখি, গবাদিপশু এবং এমনকি বয়স্ক, অসুস্থ মানুষদের ওপর ভয়াবহ প্রভাব ফেলে। শব্দদূষণ শুধু সাময়িক অস্বস্তি নয়—এটি হৃদরোগ, মানসিক চাপ, এবং শ্রবণশক্তি হ্রাসের অন্যতম কারণ।

দীপাবলির আনন্দ হোক নিঃশব্দ ও নির্মল, যেন প্রকৃতিও আমাদের সঙ্গে হাসে।

প্রশাসনের কাছে আবেদন—আইন মেনে শব্দবাজি রোধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হোক এবং মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা হোক।

শেষ কথা: প্রকৃতির সঙ্গে সহাবস্থানই একমাত্র পথ।  আজ উত্তরবঙ্গের এই দুর্যোগ আমাদের শেখাচ্ছে—প্রকৃতি ছাড়া উন্নয়ন সম্ভব নয়।আমরা যদি আজ প্রকৃতিকে রক্ষা করতে শিখি, তবে প্রকৃতিও আগামী প্রজন্মকে রক্ষা করবে। উন্নয়নের সংজ্ঞা হোক সবুজে উন্নয়ন, সহানুভূতিতে মানবিক।

Green and Clean is Our Perfect Dream — এই মন্ত্র হোক আমাদের প্রতিটি সিদ্ধান্তের ভিত্তি।

লেখক পরিচিতি :

শিলিগুড়ির মাটিতে ১৯৬৬ সালের ১৪ই মার্চ জন্মগ্রহণ করেন দেবব্রত চক্রবর্তী। পিতা স্বর্গীয় দীনেশচন্দ্র চক্রবর্তী এবং মাতা স্বর্গীয়া আশালতা চক্রবর্তী। কর্মজীবনে তিনি দীর্ঘদিন ব্যাংক কর্মচারী হিসেবে নিষ্ঠা ও সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন। তবে পেশার গণ্ডি ছাড়িয়ে তাঁর হৃদয় জুড়ে আছে প্রকৃতি ও পরিবেশের প্রতি গভীর ভালোবাসা।

দেবব্রতবাবু বহু বছর ধরে পরিবেশ সংরক্ষণ ও সচেতনতা বৃদ্ধির কাজে সক্রিয়ভাবে যুক্ত রয়েছেন। ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে প্রকৃতি ও পরিবেশের প্রতি আগ্রহ, ভালোবাসা ও দায়িত্ববোধ গড়ে তোলাই তাঁর অন্যতম লক্ষ্য। তাঁর রচনায় যেমন প্রকৃতির প্রতি মমতা প্রকাশ পেয়েছে, তেমনি ফুটে উঠেছে মানবিকতা, সমাজবোধ ও জীবনের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা।

সম্পাদক, গ্রীন এনভায়রনমেন্ট প্রিজারভেশন সোসাইটি (GEPS), শিলিগুড়ি