১৮৫৯ সালে ইভান
আলেকসান্দ্রোভিচ গনচারোভের রচিত উপন্যাস
অবলোমভ কোনও প্রথাগত সাঁচে বাধা নয়। তবে এই উপন্যাসটির একটা মনস্তাত্ত্বিক দিক
রয়েছে। মানুষকে অন্তর্মুখী করে তোলা। এই
উপন্যাসের মূল বিষয় হল অবলোমভিজম(একটি
রুশ শব্দ)। প্রেক্ষাপটে দেখা যায় প্রাদেশিক এক শহরের গোরোখোভায়ার এক
আবাসনে শুয়ে আছে উপন্যাসের নায়ক। নাম ইলিয়া ইলিচ অবলোমভ। এক সম্ভ্রান্ত
পরিবারের ভূস্বামী। ঘরের ছাঁদ ও দেওয়ালের
দিকে সে নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকে, যেন এটাই
জীবন। বাইরের কোনো কিছু তাকে প্রভাবিত করতে পারে না। ঘরের মধ্যে বন্দি হয়ে থাকতে
পছন্দ করে। উপন্যাসের প্রথম পঞ্চাশ পৃষ্ঠায় তাকে একবার বিছানা থেকে উঠে চেয়ারে
বসতে দেখা যায়। জীবনের প্রতি সম্পূর্ণ উদাসীন। ফলে এক আশ্চর্য বৈশিষ্ট্য তার
জীবনে ফুটে ওঠে। একদিন সকালবেলা তার কাছে একটি চিঠি পৌঁছোয়। পরগনার ম্যানেজার
জানায় এস্টেটের আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ। তাকে খুব তাড়াতাড়ি পরিদর্শনে যেতে
হবে। প্রায় ১০০০ মাইল পাড়ি দিতে হবে। কিন্তু যে বিছানায় শুয়ে থাকতেই সব থেকে
বেশি পছন্দ করে। তার পক্ষে এত দূর যাওয়া কোনওমতেই সম্ভব নয়। কবি জীবনানন্দ দাশ
লিখেছিলেন,"চিরদিন কেবলই পথহারা পথিকের
মতো,আমি হারায়েছি স্বপ্নের ভেতর স্বপ্নে।"
অবলোমভও তাই; বাস্তবকে
পাশ কাটিয়ে সে ঘুম ও কল্পনার ভেতরেই জীবন খুঁজে নেয়। একটু পরেই সে আবার ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুমের মধ্যে
বাল্যকালের স্মৃতি-সরণিতে ফিরে যায়।
স্কুল বন্ধ থাকলে কোনওভাবেই বাবা-মা বাইরে নিয়ে যেতে পারত না। কিন্তু তার বন্ধু
স্টোলৎস ছিল ভিন্ন প্রকৃতির মানুষ। মাঝে মাঝে এই বন্ধুই এসে তাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে
তুলত।ওলগা নামে এক সুন্দরী তরুণীর সাথে তার পরিচয় করিয়ে দেয়। অবশেষে এই তরুণীর
সঙ্গে সে প্রেমের বন্ধনে আবদ্ধ হয়। কিন্তু অবলোমভের কুঁড়েমি ও সিদ্ধান্তহীনতা
ওলগাকে চলে যেতে বাধ্য করে। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন,"যে কাজে
অনন্ত শক্তি আছে, সে কাজের দ্বারেই জীবন ধরা
দেয়; উদাসীনতা কেবল মৃত্যু ডেকে আনে।"
অবলোমভের প্রেমভঙ্গ সেই
মৃত্যুরই প্রতীক। তার পরের স্বপ্ন হল তার ছদ্মবেশী বন্ধু তারানতিয়েভ এবং ইভান
মাতভেয়েভিচ তাকে বিভিন্নভাবে ঠকাতে থাকে। এভাবে স্বপ্নের ভিতরে চলতে থাকে তার
জীবন। এক সময় সে তার বিধবা বাড়িওয়ালি আগাফিয়ার সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ
হয়।কিন্তু সেখানেও সক্রিয়তা নেই।
দার্শনিক শোপেনহাওয়ার বলেছিলেন, "মানুষ সুখ
চায়,কিন্তু তার স্বভাবই যে উদাসীনতা ও দুঃখের অনুকূল ।" অবলোমভ সেই দুঃখ
এড়িয়ে কেবল নিস্তরঙ্গ প্রশান্তি খুঁজে। এসব কার্যকলাপ ঘুমের ভেতরেই চলতে থাকে।
এমনকি সে ভাবে তার মৃত্যু হয়েছে গভীর ঘুমের ভেতরে।
কিন্তু ঘরের ভিতরে ঘুমিয়ে
ঘুমিয়ে অবলোমভ কি করতে চায়? সে কি বই
পড়ে সময় কাটায়? হ্যাঁ,তার হাতে
অবশ্যই কখনও-সখনও খবরের কাগজ কিংবা বই থাকে। কিন্তু সে এক গভীর শীতলতায় সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে।
আর না-পড়া বইটি তার পাশে পড়ে থাকে চরম অবহেলায়। তার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ছিল দার্শনিকাসুলভ। জীবনের শেষে একজন মানুষ কি চায়? সে যে
অনুমিত সত্যের পূজারী। তাই বিখ্যাত দার্শনিকরাও তার মধ্যে জ্ঞানের তৃষ্ণা জাগাতে
পারে না। তবে জীবনের ভেতরে একটা সুখকর মুহূর্ত আছে, যা তাকে
কখনওই প্রতারিত করে না। জীবনকে সে দু-ভাবে
দেখতে চায়। একদিকে কর্মময় জীবন আর চরম একঘেয়েমি, অন্যদিকে
প্রশান্তি আর নির্ঝঞ্ঝাট জীবনযাপন।
এই নিঃসঙ্গ মানুষটিকে তার
ভৃত্য জাকার দেখাশোনা করত। সে বোধহয়
খানিকটা তার মালিকের অন্তর্নিহিত জীবনের রহস্য বুঝতে পারত। সে ভাবত এটাই বাঁচার
একমাত্র উপায়। এভাবে একদিন দীর্ঘ
রোগভোগের পর অবলোমভ মারা যায়। কিন্তু কি ঘটল তার এই শ্লথ জীবনবোধের? সে এখন
কোথায় থাকে? গল্পকার জানাচ্ছেন যে বাড়ির কাছেই সমাধিক্ষেত্রে এক
প্রশান্তিময় কবরে ঝোপঝাড়ের আড়ালে নিশ্চুপ তার দেহ বিশ্রাম করছে এখন। লতাগুল্মে
ঢেকে গেছে কবর। আর দেবতারা তার গভীর ঘুমকে পাহারা দিচ্ছে। অবলোমভের মনে করত জীবন
আসলে স্বপ্নময় এক অভিযাত্রা। উপন্যাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ে আমরা দেখি
অবলোমভের ছোটবেলার গ্রাম অবলোমভা,যা
নিদ্রাময় রাশিয়ার প্রতীক হয়ে ওঠে। এখানে সবাই দৈনন্দিন কাজ করে কিন্তু সকলেই আবার
যেন ঘুমগ্রস্ত। কেউ সিদ্ধান্ত নেয় না, উদ্যোগী
নয়, ঠিক স্বপ্নের ভিতরে যেমনটা ঘটে।
উপন্যাসের শেষের দিকে
স্টোলৎস গির্জার কাছে ভিক্ষুকদের মাঝে অবলোমভের ভৃত্য জাকারকে দেখতে পায়। সে তাকে
পুনর্বাসন দিতে চায়। কিন্তু জাকার যেতে অস্বীকার করে। কারণ সে এখান থেকে তার
প্রভুকে পাহারা দিতে চায়। তবে এই ধরনের জীবন দর্শনকে অবধূতীয় বোধ বলা হয় যা
হিতবাদী দর্শন-সত্তার বহিঃপ্রকাশ।
পৃথিবীকে রক্ষা করার এক মানবিক অভিপ্রায়। বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের মতে, "মানুষ
সুখী হয় অল্পতেই; দুঃখী হয় তার অসংযমে।"
অবলোমভ খুঁজেছিলেন সুখ, কিন্তু
সেই সুখ ছিল এক নিঃসঙ্গ শূন্যতার ভেতরে। মানুষের ভিতরে যে অন্তর্নিহিত জ্ঞানের
প্রদীপ রয়েছে, সেখানে সুখী হওয়ার উপায়
নানা আঙ্গিকে বিন্যস্ত এবং বিস্ত্রস্ত। অবলোমভের জীবন দর্শন একা একাই বিন্যস্ত, ঘরের
ভিতরে, একই দৃষ্টিভঙ্গিতে, যেখানে সুখের মতো একটা কিছু
রয়ে যেতে চায়, হারিয়ে যাওয়ার মধুর
দূরত্বে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, 'বিরস দিন
বিরল কাজ।'
আবার রবীন্দ্রনাথ অন্য
জায়গায় বলেছেন, "বন্ধন? বন্ধন বটে, সকলি
বন্ধন--
স্নেহ প্রেম
সুখতৃষ্ণা...."
লেখক পরিচিতি -
সত্যের উষ্ণতা বুকে নিয়ে কবিতা লেখেন অজিত দেবনাথ। জন্ম উত্তরবঙ্গের আলিপুরদুয়ারে। উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। বর্তমানে বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরে রামানন্দ কলেজে ইতিহাস বিভাগে অধ্যাপনায় রত। ছোটবেলা থেকেই কবিতার প্রতি তীব্র অনুরাগ। শব্দের ভেতর দিয়ে পথ অতিক্রম করতে তিনি ভালবাসেন। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের নিবিড় সম্পর্ক,কথার আকাশে শব্দের অনুত্ত বিন্যাস এবং পরাবাস্তবতা তার কবিতায় বারবার ফিরে এসেছে। অসংখ্য লিটিল ম্যাগাজিনে তার কবিতা নিয়মিত প্রকাশিত হয়। নীরবে কাব্য সাধনায় এক ব্যতিক্রমী চরিত্র। প্রথম কাব্যগ্রন্থের নাম স্বপ্ন খোঁজে স্পর্শের মগ্নতা।