Advt

Advt

upalabdhi-story-galpo-by-ajit-debnath-tatkhanik-digital-bengali-web-bangla-online-e-magazine-উপলব্ধি-গল্প-অজিত-দেবনাথ

upalabdhi-story-galpo-by-ajit-debnath-tatkhanik-digital-bengali-web-bangla-online-e-magazine-উপলব্ধি-গল্প-অজিত-দেবনাথ

সন্ধ্যা আজ  যেন শহরের গায়ে মিশিয়ে দিয়েছে বৃষ্টির গন্ধ। আকাশে ধূসর রঙের চাদরে ভিজে রয়েছে রাস্তার বাতি,আর বাতাসে কেমন এক অচেনা হাহাকার। অফিস থেকে বেরিয়ে সুবীর ধীর পায়ে হাঁটছে। হাতে  প্রমোশনের খাম। অফিসের সহকর্মীরা দুপুরে হাসিমুখে ঘিরে ধরেছিল,“স্যার,অবশেষে পেলেন! আপনার যোগ্য সম্মান।” সুবীর মাথা নেড়ে হেসেছিল,কিন্তু সেই হাসি ছিল যেন ঠোঁটে আটকে থাকা এক নিস্তেজ আলো। মনের মধ্যে কোনও আনন্দ নেই। বাড়ির দরজায় এসে দাঁড়াতেই প্রথমেই টের পেল  এখানে দিনের আলো ঢোকে না। দেয়ালের রং ফ্যাকাসে,করিডোরের আলো ম্লান  যেন সময়ের ধুলো জমে আছে। দরজার কাছে তার স্ত্রী মায়া দাঁড়িয়ে আছে । চুলে সাদা রেখা, চোখে এক অব্যক্ত ক্লান্তি। “এসেছো?” শব্দটা অভ্যাসে উচ্চারিত,আবেগে নয়। ড্রয়িংরুমে পা রাখতেই চোখে পড়ল নয়ন জানালার ধারে বসে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। মুখে কোনও অভিব্যক্তি নেই, দৃষ্টি যেন অদেখা আকাশে। বাইরে বৃষ্টির ফোঁটা কাচে টুপটাপ পড়ছে, আর সেই শব্দ নয়নের নীরবতার সঙ্গে লুকোচুরি খেলছে। ডাক্তারের ভাষায় মানসিক বিচ্ছিন্নতার জটিল অসুখ। মাঝে মাঝে ওষুধে সামলে ওঠে,আবার ডুবে যায় নিজের ভেতরে। সুবীর জানে এই রোগ শুধু নয়নের নয়, তাদের সংসারেরও। সুবীরের মনে ভেসে উঠল এক মায়াবী দুপুর। তখন নয়ন মাত্র সাত বছরের। বসার ঘরের মেঝেতে রঙিন পেনসিল ছড়িয়ে বসে আছে,খাতায় আঁকছে একটি পাখি, লাল ডানা, নীল আকাশ, আর চারপাশে অসংখ্য ছোট ছোট ফুল।

বাবা, দেখো না! আমার পাখিটা উড়ছে পাহাড়ের ওপরে!”

সুবীর তখন ল্যাপটপে মগ্ন। এক জরুরি রিপোর্ট শেষ করতে হবে। “দেখব পরে, এখন কাজ আছে।”

নয়ন তখন একটু চুপ করে পাখির ডানায় আরেকটা রেখা টেনে দিল  যেন ডানাটা একটু ভেঙে যায়। সেই আঁকা পরে খাতার ভাঁজে চাপা পড়ে  যায়। সেই দিনটি আজও ফিরে আসেনি। রাত ঘনিয়ে এলো। মায়া রান্নাঘরে ভাত বসিয়েছে, গন্ধ ভেসে আসছে। কিন্তু ঘরে কথার শব্দ নেই, নেই হাসির আলো। হঠাৎ নয়নের গলা,

বাবা

হ্যাঁ রে?”

তুমি কি জানো, পাখিরা রাতে কোথায় যায়?”

না রে,বল।”

নয়নের চোখে এক অদ্ভুত স্বচ্ছতা যেন বৃষ্টির পর নির্মল আকাশ।

ওরা উড়ে যায় এমন জায়গায়,যেখানে কেউ তাদের ধরে রাখে না কেউ না।”

শব্দগুলো সুবীরের বুকের ভেতর এক ধরনের আতঙ্কের সৃষ্টি করল। সে উঠে এসে ছেলেকে জড়িয়ে ধরল আলতো করে  যেন ভয় হচ্ছে ডানা ভেঙে যাবে। নয়ন কিছুক্ষণ  চুপ করে রইল।  তার পর মাথা গুঁজে দিল বাবার কাঁধে। মায়া রান্নাঘর থেকে এই দৃশ্য দেখে থমকে গেল। রাত এখন গভীর। মায়া ঘুমিয়ে পড়েছে । নয়নও চুপ করে  শুয়ে আছে। সুবীর জানালার পাশে বসে বাইরে দিকে তাকিয়ে আছে। দূরের গলিতে একটি কুকুর হঠাৎ ডেকে উঠল।  তার পর আবার নিস্তব্ধতা।

মনে প্রশ্ন জাগে, “আমি কি ঠিক সময়ে ঠিক ছেলেটার পাশে ছিলাম? নাকি নিজের সাফল্যের দৌড়ে তাকে অনেক দূর  ফেলে রেখে এসেছি?”

বৃষ্টির ফোঁটা কাচ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে। প্রতিটি ফোঁটা যেন একেকটি অপূরণীয় মুহূর্ত—যা হাতে নিয়ে রাখার আগেই ঝরে পড়ল মাটিতে।

প্রমোশন কি সত্যিই কোনও উন্নতি? যদি বাড়ি ফিরে দেখি আমার নিজের মানুষটাই হারিয়ে গেছে ?”

তার বুকের ভিতর থেকে না শব্দটা বেরিয়ে এলো। পরদিন সকালবেলা বৃষ্টির পরে এক ঝকঝকে আকাশ। রাস্তায় জল জমে রোদে ঝিলমিল করছে। সুবীর নয়নকে নিয়ে বেরোল পুরনো  লেকের ধারে। মায়া দরজায় দাঁড়িয়ে রইল, চোখে এক অনিশ্চিত আশার ছায়া। লেকের ধারে গিয়ে নয়ন থমকে দাঁড়াল। জলের ওপরে ভাসছে কয়েকটি সাদা বক, হঠাৎ ডানা মেলে উড়ে গেল। নয়নের চোখ সেই উড়ান অনুসরণ করল  যেন ডানার শব্দ তার ভেতরের নীরবতা ভেঙে দিল।

বাবা ওরা কোথায় যাবে?”

সুবীর হাসল,“যেখানে কেউ তাদের ধরে রাখবে না।”

নয়ন তাকিয়ে রইল।  আর সুবীর মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল এবার পরে নয়, আজই। টেবিলে প্রমোশনের খাম পড়ে রইল  অবহেলায়। কিন্তু সুবীর বুঝতে পারল আজ তার জীবনের সত্যিকারের প্রমোশন হয়েছে  নিজের ছেলের আকাশের কাছে। বাড়ি ফেরার পথে আকাশে উড়ে চলেছে একদল পাখি।  ভোরের বাতাস আর স্বাধীনতার রং  মিশে আছে তাদের ডানায়। সুবীর মনে করল হয়তো এই উড়ানেই লুকিয়ে আছে মুক্তি এবং ভালোবাসার নতুন তাৎপর্য।

লেখকের অন্যান্য লেখা পড়তে এখানে ক্লিক করুন ।

লেখক পরিচিতি 

সত্যের উষ্ণতা বুকে নিয়ে কবিতা লেখেন অজিত দেবনাথ। জন্ম উত্তরবঙ্গের আলিপুরদুয়ারে। উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। বর্তমানে বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরে রামানন্দ কলেজে ইতিহাস বিভাগে অধ্যাপনায় রত। ছোটবেলা থেকেই কবিতার প্রতি তীব্র  অনুরাগ। শব্দের ভেতর দিয়ে পথ অতিক্রম করতে তিনি ভালবাসেন। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের নিবিড় সম্পর্ক,কথার আকাশে শব্দের অনুত্ত বিন্যাস এবং পরাবাস্তবতা তার কবিতায় বারবার ফিরে এসেছে। অসংখ্য লিটিল ম্যাগাজিনে তার কবিতা নিয়মিত প্রকাশিত হয়। নীরবে কাব্য সাধনায় এক ব্যতিক্রমী চরিত্র। প্রথম কাব্যগ্রন্থের নাম স্বপ্ন খোঁজে স্পর্শের মগ্নতা।