( ১ )
যাত্রার দিন দেখে ভবেন মল্লিকের
চক্ষক্ষু চড়কগাছ । মেজাজ সপ্তমে । তিনি ভেবে পান না কোন সাহসে বড়ছেলে সুমন্ত তাঁর
কথা অমান্য করে ! সারাদিন
তিনি পাঁজি ঘেঁটে তিন—তিনটে শুভ
দিন যাত্রার জন্য বার করে,পইপই করে
বলে দিয়েছিলেন –টিকিট যেন
এই শুভ দিনগুলির মধ্যেই কাটা হয়।
বাজখাঁই গলায় ভবেন মল্লিক বড়ছেলেকে
জিজ্ঞেস করলেন - হ্যাঁ রে সমু ,
তুই শুভ দিনে টিকট না করে অযাত্রার দিনে কেন টিকিট করেছিস ?
সুমন্ত অবাক গলায় বলল – অযাত্রার দিন !
তোমার দেওয়া দিনগুলোতে রিজার্ভেশন পাইনি তাই বাধ্য হয়েই ৩১শে মার্চের টিকিট কাটলাম
। ওই দিন সাতখানা টিকিটের রিজার্ভেশন একসঙ্গে এ.
সি. থ্রিটায়ারে পেয়ে গেলাম । তাই কেটে
নিলাম ।
-- অশুভ দিনে যাত্রা নাস্তি । আমি
পাঁজি দেখে আরো কয়েকটা শুভ দিন যাত্রার জন্য দেখে দিচ্ছি । তুই এই টিকিটগুলি ফেরৎ
দিয়ে আয় । আর শুভদিন দেখে টিকিট কেটে আন । আদেশের গলায় বললেন ভবেন মল্লিক ।
সুমন্ত ঝাঁঝের গলায় বলল – শুভদিন দেখে দিলেই হবে না । ষাট দিনের আগে না হলে
রিজার্ভেশন পাওয়া যায় না । আর তুমি তো হুকুম করেই খালাস । এদিকে আমার হয়রানির
একশেষ ! এই পীক সীজনে রিজার্ভেশন পওয়াই
দুষ্কর । অফিস ছুটি নিয়ে দু দিন ধরে স্টেশনে ছুটছি । তোমার তো আবার হাজারটা
ফ্যাচাং । চৈত্র মাসে বাড়ি থেকে বেরুলে ,
চৈত্র মাসেই আবার বাড়ি ফিরে আসতে হবে । সব দিক দেখে ভেবেচিন্তেই আমি টিকিট
কটেছি । টিকিট আমি ক্যান্সেল করাব না ।
ভবেন মল্লিক চিড়বিড়িয়ে জ্বলে উঠে
কঠিন গলায় বললেন – অযাত্রার
দিন আমি কারুকে বাড়ি থেকে রওনা হতে দেব না ।
এ যেন কোনও মিলিটারী অফিসারের
হুকুম । হুকুম অমান্য করলেই কোর্টমার্শল ।
সুমন্ত তিক্ত গলায় বলে উঠল – ওই অযাত্রার দিনই আমরা রওনা দেব । বাচ্চাদের পরীক্ষা হয়ে
গেছে । ওরা যাওয়ার জন্য নেচে আছে । তোমাদের যদি যেতে ইচ্ছে না হয় , যেও না । তোমার ও মায়ের টিকিট ক্যান্সেল করিয়ে দেব । নিজের
বক্তব্য পেশ করেই সুমন্ত বাবার সামনে থেকে সরে পড়ে ।
ভবেন মল্লিকের মেজাজ চড়াৎ করে সপ্তমে উঠে যায় । গিন্নীর দিকে
কঠিন দৃষ্টি হেনে বললেন – শুনলে
তোমার গুণধর পুত্রের কথা ! দিনে-দিনে কত উন্নতিই না হচ্ছে । আমার কথার ওপর কথা!
অমলাদেবী বড় ছেলেকে বোঝাতে ছুটলেন
। তার আগেই সুমন্ত বাড়ি থেকে হাওয়া । বাড়িতে থাকলেই বাবার সঙ্গে ধুন্ধুমার বাকযুদ্ধ
লেগে যাবে ।
ভবেন মল্লিকের মেজাজ সব সময় সপ্তমে চড়েই থাকে । একটু এদিক-ওদিক হলেই কিংবা তাঁর মনের মত কিছু না হলেই বাড়ি মাথায় করে
নেন । হিটলারের মত চাল-চলন। দুর্ভাগ্যক্রমে
শরীরটাই যা বাধ সেধেছে । সাধারণ বাঙ্গালীর উচ্চতার চাইতে বেশ খাটোই বলতে হবে ।
রোগা-পটকা শরীর কিন্তু গোঁফখানা দর্শনীয়
। ঝাড়ু মার্কা ঘন সাদা-কালো গোঁফ
। এক সময় তাঁর দাপটে ছেলে মেয়েরা বোবা হয়ে থাকত আর পৃথুলা অমলাদেবী, তিনি তো তাঁর হুমকিতে সর্বক্ষণই যেন থরহরি কম্পমান।
অবশ্য এখন আর আগের মত দিনকাল নেই ।
ছেলেদের বিয়ে-থা হয়ে
গেছে । নাতি-নাতনীদের
নিয়ে ভরা সংসার ভবেন মল্লিকের । ছেলেরা যে
যার নিজের মর্জির মালিক এখন । তবু এই নিয়ম শৃঙ্খলাহীন যুগে, ভবেন মল্লিক,
তাঁর পরিবারের মধ্যে নিজের দাপট ও মেজাজ বজায় রাখার চেষ্টা করেন, অহেতুক ।
নাতি-নাতনীরা অবশ্য দাদুকে একটুও ভয় পায় না । তারা তো জন্ম থেকেই
দাদুর কড়া মেজাজ ও দাপট দেখে আসছে । দাদুর বকুনি তাদের গা সওয়া ।
( ২ )
ভবেন মল্লিক বিপাকে পড়লেন । সত্যি-সত্যি সুমন্ত যদি তাঁদের টিকিট ক্যান্সেল করিয়ে দেয় তাহলে
তাঁদের আর এ বছর হরিদ্বার-হৃষীকেশ
যাওয়া হবে না । কী করবেন ভেবে পাননা । হঠাৎ অত্যুৎসাহের সঙ্গে চিৎকার করে গিন্নীকে
ডেকে বললেন - জানো, ৩১শে মার্চ বুধবার ।
অমলাদেবী অবাক চোখে স্বামীর দিকে
তাকিয়ে বললেন - হবে হয়ত । কিন্তু তাতে হয়েছেটা কী ?
- বুধবারে আমাদের যাওয়াতে কোন বাধা
নেই ।
অমলাদেবী স্বামীর কথার হদিশ পান না
। উপহাসের গলায় বললেন – এই তো
তুমি সমুকে বললে ৩১শে মার্চ অযাত্রার দিন ! ওই দিন কিছুতেই যাওয়া হবে না আর এখন বলছ কোনও অসুবিধে নেই।
তোমাকে বোঝে কার সাধ্যি !
-- চুপ করো তো
। গিন্নীকে ধমক দিয়ে উঠলেন ভবেন মল্লিক । তোমাদের
মেয়েছেলেদের বুদ্ধিতো হাঁটুতে থাকে । তোমরা তো কিছু বোঝ না , কিছুই জানো না । শাস্ত্রে আছে বুধে পা যেথা ইচ্ছে সেথা যা
। বুঝলে !
-- তাহলে
অযাত্রার কথা এল কী করে !
-- আমি তো
দিনটা দেখেছিলাম বারটা তো দেখিনি !!
ভবেন মল্লিক ও অমলাদেবীর তুমুল বাকযুদ্ধ
লেগে গেল । অমলাদেবী আগে স্বামীকে যমের মত ভয় পেতেন । এখন আর পাননা । বিবাহিত
জীবনের পঞ্চাশ বছর অতিক্রম করে এসেছেন এখন তিনিও পিছু হটেন না। চুপচাপ মেনে নেন না । কোমর বেঁধে
যুদ্ধক্ষেত্রে নেমে পড়েন । অবশ্য ছেলেদের
সঙ্গে কিংবা নাতি-নাতনীদের
সঙ্গে যখন ভবেন মল্লিকের বাকযুদ্ধ লেগে যায় তখন তিনি অম্লান বদনে থাকেন স্বামীর
পক্ষে । তখন তিনি ন্যায়-অন্যায়.ঠিক-বেঠিক
দেখেন না । চোখ বুজে স্বামীকে সাপোর্ট করেন
এবং শুধু সাপোর্টই নয় স্বামীর সঙ্গে গলা মিলিয়ে তিনিও সপ্তমে বেজে ওঠেন মুহুর্মুহু
।
আড়ালে বৌয়েরা বলাবলি করে – একা রাম রক্ষে নেই সুগ্রীব দোসর !
(
৩ )
বাগবাজারের মল্লিক বাড়িতে সাজ-সাজ
রব । ভবেন মল্লিক বড় ছেলের পল্টনের সঙ্গে চলেছেন তীর্থ যাত্রায় হরিদ্বার-হৃষীকেশ । ভবেন
মল্লিক ,অমলাদেবী, বাড়ির তিন ছেলে,তিন বৌ, মায় নাতি-নাতনীরা পর্যন্ত সবাই ব্যস্ত
ত্রস্ত । সকাল থেকে হুলুস্থুল কাণ্ড । ভোরবেলা থেকেই তিন বৌ রান্নাঘরে ঢুকে পড়েছে
। ট্রেনে নিয়ে যাওয়ার জন্য : শ'দুয়েক লুচি , ডজন দুই ফিশ ফ্রাই, পটলের দোর্মা, আলু
ভাজা, দু কেজি কিমার, কিমা মটর ইত্যাদি । এসব রান্না ছাড়াও মিষ্টি,বিস্কিট, চিঁড়ে,
নানারকম সল্টেড কুকিস ও ওষুধপত্র, সর্দি জ্বর, বমি ও পেটখারাপের ।
হোমিওপ্যাথি, এ্যালোপ্যাথি ও
বায়োকেমিক । এ ঘর ও ঘর ছুটোছুটি করে তদারক করছেন ভবেন মল্লিক নিজে, সব ঠিকমত নেওয়া
হল কিনা । হাঁক-ডাক পেড়ে সবাইকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলছেন । তৈরি হওয়া নিয়ে
হুড়োহুড়ি, রাগারাগি ও ফাটাফাটি সবই চলছে সমান তালে ।
ভবেন মল্লিক মুখে ও ঘাড়ে পাউডার
ঢেলে একটার মধ্যেই মাংসের ঝোল ভাত খেয়ে নিয়ে সবাইকে তাড়া দিতে শুরু করলেন
। বিকেল পাঁচটার মধ্যেই চা জলবার খেয়ে,প্যান্ট-সার্ট
পরে এক্কেবারে রেডি । এমনিতে বাড়িতে সব সময় তিনি খালি গায়ে থাকেন ও ছেঁড়া লুঙ্গি
থাকে পরিধানে । কিন্তু কোনও গেষ্ট এলেই ভোল পাল্টে নেন । মুখে খানিকটা পাউডারের
প্রলেপ দিয়ে পাট ভাঙ্গা পাজামা পাঞ্জাবী পরে নেন । শীতকালে প্যান্ট-সার্টের ওপর ওভারকোট চাপিয়ে মুখে পাইপ গুঁজে গটগট করে
হাঁটেন আর গুরু গম্ভীর গলায় তখন বাজেন ।
বাড়ির বৌয়েরা আপসে বলাবলি করে – ওই বাঁশির মত রোগাপটকা শরীর থেকে কি করে যে বজ্রনিনাদের মত
শব্দ বেরোয় ঈশ্বরই জানেন !
পাহাড় প্রমাণ লটবহর নিয়ে দু
ট্যাক্সি বোঝাই করে সন্ধ্যে ছটার মধ্যেই সস্ত্রীক ভবেন মল্লিক বড় ছেলের পল্টনের সঙ্গে হাওড়ার দিকে রওনা দিলেন ।
ট্রেন ছাড়ার নির্ধারিত সময়ের দু ঘন্টা আগেই ভবেন মল্লিক ও তাঁর পরিবারের সকলে এসে
পৌঁছলেন হাওড়ায় । স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে তিনি বললেন – যাক্ ভাগ্য আমাদের ভাল ।
ট্যাক্সি কোনও মিছিল কিংবা জ্যামে আটকে
পড়েনি । আমরা ঠিক সময় এসে পৌঁছেছি । সুমন্ত বিরক্ত গলায় বলল – ঠিক নয়, অনেক আগেই
এসে পৌঁছেছি । এখন এই গরমের মধ্যে ভিড়ের
মধ্যে প্ল্যাটফর্মে কাটাতে হবে ।
প্রতীক্ষার সময় আর কাটতে চায় না ।
বহু কাঙ্ক্ষিত সময়,সাড়ে আটটাও বেজে যায় কিন্তু দুন এক্সপ্রেসের আসার নাম নেই ।
ক্রমশ নটা,দশটা, এ্যাাগারোটা ও বারোটা বেজে যায় । ট্রেনের দেখা নেই । প্ল্যাটফর্মে
ভিড় থিক-থিক করছে । লোকে লোকারণ্য ।
চিৎকার চেঁচামেচি । তিরিক্ষে মেজাজে ভবেন মল্লিক গিন্নী ও বড় ছেলের ওপর ফেটে পড়লেন
– তোমাদের মাথায় বিন্দুমাত্র যদি গ্রে ম্যাটার থাকত তাহলে এত দুর্ভোগ হত না । বাড়ি
থেকে বেরুনোর আগে একবার স্টেশানে ফোন করে জেনে নিলে পারতে । ট্রেন লেট আছে কিনা
সেই হিসাবে বেরুনো যেত ।
সুমন্ত তিতি বিরক্ত গলায় বলল – তুমিই
তো তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে পড়লে । কিছু ভাববার ও করার সমই দিলে না ।
অমলাদেবীও টুক করে বলে ফেললেন –
গ্রে ম্যাটারটা তো তোমার মাথায় একটু বেশী মাত্রায় আছে, তা তুমিই না হয় একটু ফোন করে সময়টা জেনে নিতে ।
আগুনে ঘি পড়ার মত ভবেন মল্লিক
ভয়ংকর ভাবে জ্বলে উঠে বললেন –
তুমি থামবে । আজকাল বড্ড বেশী কথা বলো তুমি । একে তো মাথায় নেই কিছু ঘিলু তারওপরে .....
সুমন্ত, ভবেন মল্লিককে স্মরণ করিয়ে দেয় - বাবা,
এটা পাব্লিক প্লেস । বাড়ি নয় ।
যাত্রীদের মুখে-মুখে ট্রেন লেট হওয়ার নানান কারণ শোনা যায় । কেউ বলে
বর্ধমানে কোনও ট্রেন দুর্ঘটনা হয়ছে । কেউ বলে দুন এক্সপ্রেসের এ. সি কম্পার্টমেন্টে আগুন লেগে গেছে তাই দেরী হচ্ছে।
ইনকোয়ারীতে জিজ্ঞেস করলে ট্রেন কতটা লেট আছে সেই খবরটি দেয়
।
অবশেষে ঠিক রাত দুপুর একটায় ঘোর
চেঁচামেচি ও চরম বিশৃঙ্খলার মধ্যে ভবেন মল্লিক ও তাঁর পরিবার সকলে ট্রেনে উঠে
পড়লেন । নিয়মানুবর্তিতায় ঘোর বিশ্বাসী ভবেন মল্লিক রাত্রির ভোজন পর্ব
প্ল্যাটফর্মেই সেরে নিয়েছিলেন এবং ট্রেনে উঠেই শোওয়ার জন্য তোড়জোড় শুরু করে দিলেন
। এবং অমলাদেবীকে বললেন - দাও, মিষ্টির বাক্সটা বার করে দাও । মিষ্টি জল খেয়ে শুয়ে পড়ি ।
সুমন্ত রাগত স্বরে বলল - বাবা,
এই তো সবে ট্র্রেন ছাড়ল একটু সবুর করো । আমি
আর তোমার বড় বৌমা এখনও খাইনি । আমরা খেয়ে নিই তারপর শুয়ো । অগত্যা ভবেন মল্লিক
ব্যাজার মুখ করে খবরের কাগজ নিয়ে বসলেন ।
ট্রেনটা প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে কিছু দূর গিয়েই আবার থেমে গেল । একে তো চার সাড়ে
চার ঘন্টা লেটে ট্রেন ছাড়ল তারপর একটু দূর এগোতে না এগোতেই আবার থেমে গেল ।
স্বভাবতই যাত্রীরা বিরক্ত ও ক্ষুব্ধ । শোয়া হল না বলে রীতিমত ক্ষুব্ধ ভবেন মল্লিক
রেলকোম্পানির মুন্ডুপাত শুরু করে দিলেন । তক্ষুনি ট্রেন আবার চলতে শুরু করে দিল।
ভবেন মল্লিকের সবচেয়ে ছোটনাতি,শুভম
বাঙ্কে শুয়েছিল হাসতে হাসতে বলল -
দাদু, তুমি রিয়েলি দি গ্রেট । তোমার
বকুনির চোটে ট্রেনও ভয় পেয়ে চলতে শুরু করে দিল । এদিকে অমলাদেবী ট্রেন থেমে আছে
দেখে টয়লেট যাওয়ার উদ্দেশ্যে উঠেছিলেন । আচমকা
ট্রেন আবার চলতে শুরু করাতে তিনি নিজের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে ধপাস করে পড়লেন গিয়ে
এক্কেবারে ভবেন মল্লিকের কোলে । সে এক কেলেঙ্কারি কাণ্ড ! এদিকে ভারী শরীর নিয়ে অমলাদেবীর নিজে থেকে ওঠবার ক্ষমতা নেই । একনাগাড়ে চার
পাঁচ ঘন্টা বসে থেকে তাঁর কোমর ধরে গেছে । এমনিতেই তিনি বাতের রুগী । ওদিকে ভবেন
মল্লিকের ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা । চিঁড়েচেপটা হয়ে আছেন ।
সাধ্য কি তাঁর একশো কেজী ভার নিজের কোল থেকে সরান । ভবেন
মল্লিকের দুই নাতনী , বিপাশা ও
রিয়াশা জানলার দিকে মুখ করে প্রাণপনে হাসি চাপার চেষ্টা করছে ততই হাসির বুড়বুড়ি যেন
বুক ঠেলে উঠে আসছে । পুত্রবধু,
মিতার অবস্থা আরও করুণ । শ্বশুর ও শাশুড়ির সামনে প্রাণখুলে হাসতেও পারছে না বেচারী
! অপ্রতিরোধ্য হাসির গমক চাপা
দেওয়ার অছিলায় মেয়েদের চাপা গলায় বকতে থাকে –
এই তোরা ঠাম্মাকে তোল না । এহেন দৃশ্য দেখে শুভম বাঙ্কের থেকে তড়াক করে লাফ দিয়ে
নিচে নামে । ভবেন মল্লিকের করুণ দশা । কোনও প্রকারে নাতিকে বললেন – এই বাঁদর !
ঠাম্মাকে তোল না । নাতি নাতনীরা ঠাম্মাকে তুলবে কি তারা হেসেই খুন । খিঃ খিঃ খিঃ ।
আর . এ . সি তে বসা এক তরুণ দম্পতি তারাও হেসেই কুটিপাটি ।
অনেক যাত্রীর মত সুমন্ত ট্রেন[m1]
থেকে নেমে জানতে গিয়েছিল , ট্রেন হঠাৎ থেমে গেল কেন । ট্রেন চলা শুরু হতেই আবার
কম্পার্টমেন্টে উঠে এসেছে । মাকে বাবার কোলে বসে থাকতে দেখে ভ্যাবাচাকা খেয়ে যায় ।
ইতিমধ্যে গাড়ী বেশ স্পীড নিয়ে নিয়েছে । দ্রুত গতিতে ধাবমান গাড়ীতে সার্কাসের
জাগলারের মত ব্যালেন্স করতে করতে সুমন্ত বাতে কাহিল অমলাদেবীকে ভবেন মল্লিকের কোল
থেকে টেনে তোলে ।
ভবেন মল্লিকের মনে হচ্ছিল এক জগদ্দল পাষাণ প্রস্তরের তলায় যেন তিনি চাপা
পড়েছিলেন । দম বন্ধ হয়ে আসছিল । আস্তে আস্তে দম ফিরে পাচ্ছিলেন । একটু ধাতস্থ হতেই
ভবেন মল্লিক নাতি নাতনীদের ওপর খেঁকিয়ে ওঠেন - এ্যাঁ, এ্যাঁ এত হাসির কি আছে ? তোর
ঠাম্মা তো আর অন্যের কোলে গিয়ে বসেনি । কোথায় ঠাম্মাকে টেনে তুলবি না হেসেই অস্থির
। এই তোদের শিক্ষা-দীক্ষা । তারপর গিন্নীর
দিকে ঘুরেই কটমট চোখে আগুন ঝরিয়ে বললেন – বলিহারী যাই তোমার, তুমি আর বসার জায়গা
পেলে না । লজ্জায় রাঙা মুখ , অমলাদেবী মনে মনে ভাবলেন – তোমার কোলে সাধে কি বসতে
গেছি ভাগ্যের ফের । এক পলকেই দেখে নিলেন
রাগে অগ্নিশর্মা, স্বামীর মুখ । তাই আর সাফাই দেওয়ার চেষ্টা করলেন না । মৌন হয়ে রইলেন ।
(
৪ )
পরের দিন সকালে ট্রেনে প্রাতরাশ
করতে গিয়ে ভবেন মল্লিকের মাথায় হাত । হায় ! হায় ! হায় ! অত সুস্বাদু খাবার সব নষ্ট
হয়ে গেছে । কিমা মটর থেকে টকটক গন্ধ বেরুচ্ছে । পটলের দোর্মা সেটাও গেছে নষ্ট হয়ে
। কয়েকটা ফিশ ফ্রাই, আলুভাজা ও লুচি ছাড়া সব খাবারই
ফেলে দিতে হল । ট্রেনে দু রাত্রী থাকতে হবে । সেই মত ভবেন মল্লিক অমলাদেবীকে আমিষ
নিতে বলেছিলেন । এ সি কম্পার্টমেন্ট । খাবার খারাপ হবে না । ট্রেনে ননভেজ খাবার অর্ডার
দিলে সাধারণতঃ চিকেন ও এগই দেয় । আর এখন সারা দেশ বার্ড ফ্ল্যুর আতঙ্কে আক্রান্ত ।
ভবেন মল্লিক ও তাঁর পরিবার সকলে তিন মাস ধরে মুর্গী ও ডিম খাচ্ছেন না যদিও স্বাস্থ
মন্ত্রালয় থেকে বলা হয়েছে যে ভারতে একটাও বার্ড ফ্ল্যুর ঘটনা ঘটেনি । তবু সাবধানের
মার নেই । ট্রেনে ননভেজ অর্ডার দেওয়া যাবে না এবং হরিদ্বার-হৃষীকেশেও ননভেজ খাবার পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম । এই সব সাত
পাঁচ ভেবে ভবেন মল্লিক ট্রেনের জন্য মেন্যু
ঠিক করেছিলেন । হায় ! হায়! সব খাবার নষ্ট হয়ে গেল । ভবেন মল্লিকের আপসোসের সীমা
রইল না ।
(
৫ )
ভবেন মল্লিক ও তাঁর পরিবারের সকলে
রাত আটটায় হরিদ্বারে পৌঁছলেন এবং হর কি পৌড়িতে হোটেল,জ্ঞানে উঠলেন । হোটেলে ইন
করার সঙ্গে সঙ্গেই ভবেন মল্লিক সর্ব প্রথম দখল করে নিলেন টয়লেট। পাকাপাকিভাবে ।
শুরু হয়ে গেল তাঁর যাওয়া আর আসা । বিরামহীন ।
স্টেশানেই তাঁর পেটে ভুটভাট, গুড়গুড় শব্দের নিনাদ বাজছিল। স্টেশানেই সুমন্তর কাছ থেকে
হোমিয়োপ্যাথি ওষুধ নিয়ে খেয়ে নিয়েছিলেন কিন্তু তাঁর প্যাথেটিক অবস্থা হোমিয়োপ্যাথি
সামাল দিতে পারল না । শেষে দুটো টিফ্লক্স খেয়ে বেডে চুপচাপ শুয়ে রইলেন ।
সুমন্ত বলল - বাবা,
আজ রাতটা উপোস দাও ।
পরের দিন সকালেও ভবেন মল্লিক বেডে
চুপচাপ শুয়ে রইলেন । থেমে গেছে তাঁর তর্জন গর্জন । কাহিল অবস্থা । পেটের গতিক
বিশেষ সুবিধের নয় । শুধুমাত্র চিঁড়ে খেয়ে রয়েছেন । ডাক্তার এসে দেখে গেছেন ।
প্রেশার ইত্যাদি সব নরমাল ।
সুমন্ত বলল - বাবা, আজ তুমি সম্পূর্ণ
রেস্ট নাও । কাল অবধি ঠিক হয়ে যাবে । মাকে
নিয়ে আমরা একটু বেরুচ্ছি । হরকে পৌড়ি , চণ্ডী
মন্দির, মনসা মন্দির ইত্যাদি দেখে ফিরব ।
অমলাদেবী নিরুৎসাহ গলায় বললেন – পর্বত চূড়ায় মা মনসা দেবীর মন্দির তো আমি উঠতে পারব না ।
শুভম উৎসাহের গলায় বলল – তোমাকে পাহাড়ে চড়তে হবে না ঠাম্মা । আমরা তো রোপওয়েতে যাব
।
অমলাদেবী
মনে মনে ভাবেন – ওঁরই কত
শখ ছিল রোপওয়েতে চড়ার । হরিদ্বার –
হৃষীকেশে কোথায়-কোথায়
ঘুরবেন সব ডাইরিতে লিখে নিয়ে এসেছেন। হায় ! উনিই
যেতে পারবেন না আর আমি যাব । এক যাত্রায় পৃথক ফল । অমলাদেবী করুণ কন্ঠে ছেলেকে
বললেন – না রে বাবা , আমি আজ যেতে পারব না । কোমরে ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছে ।
লেখিকার
অন্যান্য লেখা পড়তে হলে এখানে ক্লিক করুন।
লেখিকার পরিচিতি-