Advt

Advt

bhaben-malliker-tirtha-yatra-story-galpo-by-rekha-nath-tatkhanik-digital-bengali-web-bangla-online-e-magazine-ভবেন-মল্লিকের-তীর্থযাত্রা-গল্প-রেখা-নাথ

bhaben-malliker-tirtha-yatra-story-galpo-by-rekha-nath-tatkhanik-digital-bengali-web-bangla-online-e-magazine-ভবেন-মল্লিকের-তীর্থযাত্রা-গল্প-রেখা-নাথ

                      ()                          

যাত্রার দিন দেখে ভবেন মল্লিকের চক্ষক্ষু চড়কগাছ । মেজাজ সপ্তমে । তিনি ভেবে পান না কোন সাহসে বড়ছেলে সুমন্ত তাঁর কথা অমান্য করে ! সারাদিন তিনি পাঁজি ঘেঁটে তিনতিনটে শুভ দিন যাত্রার জন্য বার করে,পইপই করে বলে দিয়েছিলেন টিকিট যেন এই শুভ দিনগুলির মধ্যেই কাটা হয়

বাজখাঁই গলায় ভবেন মল্লিক বড়ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন -  হ্যাঁ রে সমু , তুই শুভ দিনে টিকট না করে অযাত্রার দিনে কেন টিকিট করেছিস ?

সুমন্ত অবাক গলায় বলল অযাত্রার দিন ! তোমার দেওয়া দিনগুলোতে রিজার্ভেশন পাইনি তাই বাধ্য হয়েই ৩১শে মার্চের টিকিট কাটলাম । ওই দিন সাতখানা টিকিটের রিজার্ভেশন একসঙ্গে এ. সি. থ্রিটায়ারে পেয়ে গেলাম । তাই কেটে নিলাম ।

-- অশুভ দিনে যাত্রা নাস্তি । আমি পাঁজি দেখে আরো কয়েকটা শুভ দিন যাত্রার জন্য দেখে দিচ্ছি । তুই এই টিকিটগুলি ফেরৎ দিয়ে আয় । আর শুভদিন দেখে টিকিট কেটে আন । আদেশের গলায় বললেন ভবেন মল্লিক ।

সুমন্ত ঝাঁঝের গলায় বলল শুভদিন দেখে দিলেই হবে না । ষাট দিনের আগে না হলে রিজার্ভেশন পাওয়া যায় না । আর তুমি তো হুকুম করেই খালাস । এদিকে আমার হয়রানির একশেষ ! এই পীক সীজনে রিজার্ভেশন পওয়াই দুষ্কর । অফিস ছুটি নিয়ে দু দিন ধরে স্টেশনে ছুটছি । তোমার তো আবার হাজারটা ফ্যাচাং । চৈত্র মাসে বাড়ি থেকে বেরুলে , চৈত্র মাসেই আবার বাড়ি ফিরে আসতে হবে । সব দিক দেখে ভেবেচিন্তেই আমি টিকিট কটেছি  । টিকিট আমি ক্যান্সেল করাব  না ।

ভবেন মল্লিক চিড়বিড়িয়ে জ্বলে উঠে কঠিন গলায় বললেন অযাত্রার দিন আমি কারুকে বাড়ি থেকে রওনা হতে দেব না ।

এ যেন কোনও মিলিটারী অফিসারের হুকুম । হুকুম অমান্য করলেই কোর্টমার্শল ।

সুমন্ত তিক্ত গলায় বলে উঠল ওই অযাত্রার দিনই আমরা রওনা দেব । বাচ্চাদের পরীক্ষা হয়ে গেছে । ওরা যাওয়ার জন্য নেচে আছে । তোমাদের যদি যেতে ইচ্ছে না হয় , যেও না । তোমার ও মায়ের টিকিট ক্যান্সেল করিয়ে দেব । নিজের বক্তব্য পেশ করেই সুমন্ত বাবার সামনে থেকে সরে পড়ে ।

ভবেন মল্লিকের  মেজাজ চড়াৎ করে সপ্তমে উঠে যায় । গিন্নীর দিকে কঠিন দৃষ্টি হেনে বললেন শুনলে তোমার গুণধর পুত্রের কথা ! দিনে-দিনে কত উন্নতিই না হচ্ছে । আমার কথার ওপর কথা!

অমলাদেবী বড় ছেলেকে বোঝাতে ছুটলেন । তার আগেই সুমন্ত বাড়ি থেকে হাওয়া । বাড়িতে থাকলেই বাবার সঙ্গে ধুন্ধুমার বাকযুদ্ধ লেগে যাবে ।

ভবেন মল্লিকের  মেজাজ সব সময় সপ্তমে চড়েই থাকে । একটু এদিক-ওদিক হলেই কিংবা তাঁর মনের মত কিছু না হলেই বাড়ি মাথায় করে নেন । হিটলারের মত চাল-চলন। দুর্ভাগ্যক্রমে শরীরটাই যা বাধ সেধেছে । সাধারণ বাঙ্গালীর উচ্চতার চাইতে বেশ খাটোই বলতে হবে । রোগা-পটকা শরীর কিন্তু গোঁফখানা দর্শনীয় । ঝাড়ু মার্কা ঘন সাদা-কালো গোঁফ । এক সময় তাঁর দাপটে ছেলে মেয়েরা বোবা হয়ে থাকত আর পৃথুলা অমলাদেবী, তিনি তো তাঁর হুমকিতে সর্বক্ষণই যেন থরহরি কম্পমান।

অবশ্য এখন আর আগের মত দিনকাল নেই । ছেলেদের বিয়ে-থা হয়ে গেছে । নাতি-নাতনীদের নিয়ে ভরা সংসার ভবেন মল্লিকের  । ছেলেরা যে যার নিজের মর্জির মালিক এখন । তবু এই নিয়ম শৃঙ্খলাহীন যুগে, ভবেন মল্লিক, তাঁর পরিবারের মধ্যে নিজের দাপট ও মেজাজ বজায় রাখার চেষ্টা করেন, অহেতুক

নাতি-নাতনীরা অবশ্য দাদুকে একটুও ভয় পায় না । তারা তো জন্ম থেকেই দাদুর কড়া মেজাজ ও দাপট দেখে আসছে । দাদুর বকুনি তাদের গা সওয়া ।

               ()

ভবেন মল্লিক বিপাকে পড়লেন । সত্যি-সত্যি সুমন্ত যদি তাঁদের টিকিট ক্যান্সেল করিয়ে দেয় তাহলে তাঁদের আর এ বছর হরিদ্বার-হৃষীকেশ যাওয়া হবে না । কী করবেন ভেবে পাননা । হঠাৎ অত্যুৎসাহের সঙ্গে চিৎকার করে গিন্নীকে ডেকে বললেন - জানো, ৩১শে মার্চ বুধবার ।

অমলাদেবী অবাক চোখে স্বামীর দিকে তাকিয়ে বললেন  - হবে হয়ত । কিন্তু তাতে হয়েছেটা কী ?

- বুধবারে আমাদের যাওয়াতে কোন বাধা নেই ।

অমলাদেবী স্বামীর কথার হদিশ পান না । উপহাসের গলায় বললেন এই তো তুমি সমুকে বললে  ৩১শে মার্চ অযাত্রার দিন ! ওই দিন কিছুতেই যাওয়া হবে না আর এখন বলছ কোনও অসুবিধে নেইতোমাকে বোঝে কার সাধ্যি !

-- চুপ করো তো গিন্নীকে ধমক দিয়ে উঠলেন ভবেন মল্লিক । তোমাদের মেয়েছেলেদের বুদ্ধিতো হাঁটুতে থাকে । তোমরা তো কিছু বোঝ না , কিছুই জানো না । শাস্ত্রে আছে বুধে পা যেথা ইচ্ছে সেথা যা । বুঝলে !

-- তাহলে অযাত্রার কথা এল কী করে !

-- আমি তো দিনটা দেখেছিলাম বারটা তো দেখিনি !!

ভবেন মল্লিক ও অমলাদেবীর তুমুল বাকযুদ্ধ লেগে গেল । অমলাদেবী আগে স্বামীকে যমের মত ভয় পেতেন । এখন আর পাননা । বিবাহিত জীবনের পঞ্চাশ বছর অতিক্রম করে এসেছেন এখন তিনিও পিছু হটেন না।  চুপচাপ মেনে নেন না । কোমর বেঁধে যুদ্ধক্ষেত্রে  নেমে পড়েন । অবশ্য ছেলেদের সঙ্গে কিংবা নাতি-নাতনীদের সঙ্গে যখন ভবেন মল্লিকের বাকযুদ্ধ লেগে যায় তখন তিনি অম্লান বদনে থাকেন স্বামীর পক্ষে । তখন তিনি ন্যায়-অন্যায়.ঠিক-বেঠিক দেখেন না চোখ বুজে স্বামীকে সাপোর্ট করেন এবং শুধু সাপোর্টই নয় স্বামীর সঙ্গে গলা মিলিয়ে তিনিও সপ্তমে বেজে ওঠেন মুহুর্মুহু ।

আড়ালে বৌয়েরা বলাবলি করে একা রাম রক্ষে নেই সুগ্রীব দোসর !

             ()

বাগবাজারের মল্লিক বাড়িতে সাজ-সাজ রব । ভবেন মল্লিক বড় ছেলের পল্টনের সঙ্গে চলেছেন তীর্থ যাত্রায় হরিদ্বার-হৃষীকেশ ।  ভবেন মল্লিক ,অমলাদেবী, বাড়ির তিন ছেলে,তিন বৌ, মায় নাতি-নাতনীরা পর্যন্ত সবাই ব্যস্ত ত্রস্ত । সকাল থেকে হুলুস্থুল কাণ্ড । ভোরবেলা থেকেই তিন বৌ রান্নাঘরে ঢুকে পড়েছে । ট্রেনে নিয়ে যাওয়ার জন্য : শ'দুয়েক লুচি , ডজন দুই ফিশ ফ্রাই, পটলের দোর্মা, আলু ভাজা, দু কেজি কিমার, কিমা মটর ইত্যাদি । এসব রান্না ছাড়াও মিষ্টি,বিস্কিট, চিঁড়ে, নানারকম সল্টেড কুকিস ও ওষুধপত্র, সর্দি জ্বর, বমি ও পেটখারাপের ।

হোমিওপ্যাথি, এ্যালোপ্যাথি ও বায়োকেমিক । এ ঘর ও ঘর ছুটোছুটি করে তদারক করছেন ভবেন মল্লিক নিজে, সব ঠিকমত নেওয়া হল কিনা । হাঁক-ডাক পেড়ে সবাইকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলছেন । তৈরি হওয়া নিয়ে হুড়োহুড়ি, রাগারাগি ও ফাটাফাটি সবই চলছে সমান তালে ।

ভবেন মল্লিক মুখে ও ঘাড়ে পাউডার ঢেলে একটার মধ্যেই মাংসের ঝোল ভাত খেয়ে নিয়ে সবাইকে  তাড়া দিতে শুরু করলেনবিকেল পাঁচটার মধ্যেই চা জলবার খেয়ে,প্যান্ট-সার্ট পরে এক্কেবারে রেডি । এমনিতে বাড়িতে সব সময় তিনি খালি গায়ে থাকেন ও ছেঁড়া লুঙ্গি থাকে পরিধানে । কিন্তু কোনও গেষ্ট এলেই ভোল পাল্টে নেন । মুখে খানিকটা পাউডারের প্রলেপ দিয়ে পাট ভাঙ্গা পাজামা পাঞ্জাবী পরে নেন । শীতকালে প্যান্ট-সার্টের ওপর ওভারকোট চাপিয়ে মুখে পাইপ গুঁজে গটগট করে হাঁটেন আর গুরু গম্ভীর গলায়  তখন বাজেন ।

বাড়ির বৌয়েরা আপসে বলাবলি করে ওই বাঁশির মত রোগাপটকা শরীর থেকে কি করে যে বজ্রনিনাদের মত শব্দ বেরোয় ঈশ্বরই জানেন !

পাহাড় প্রমাণ লটবহর নিয়ে দু ট্যাক্সি বোঝাই করে সন্ধ্যে ছটার মধ্যেই সস্ত্রীক ভবেন মল্লিক বড়  ছেলের পল্টনের সঙ্গে হাওড়ার দিকে রওনা দিলেন । ট্রেন ছাড়ার নির্ধারিত সময়ের দু ঘন্টা আগেই ভবেন মল্লিক ও তাঁর পরিবারের সকলে এসে পৌঁছলেন হাওড়ায় । স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে তিনি বললেন – যাক্ ভাগ্য আমাদের ভাল । ট্যাক্সি কোনও মিছিল কিংবা  জ্যামে আটকে পড়েনি । আমরা ঠিক সময় এসে পৌঁছেছি । সুমন্ত বিরক্ত গলায় বলল – ঠিক নয়, অনেক আগেই এসে  পৌঁছেছি । এখন এই গরমের মধ্যে ভিড়ের মধ্যে প্ল্যাটফর্মে কাটাতে হবে ।

প্রতীক্ষার সময় আর কাটতে চায় না । বহু কাঙ্ক্ষিত সময়,সাড়ে আটটাও বেজে যায় কিন্তু দুন এক্সপ্রেসের আসার নাম নেই । ক্রমশ নটা,দশটা, এ্যাাগারোটা ও বারোটা বেজে যায় । ট্রেনের দেখা নেই । প্ল্যাটফর্মে ভিড় থিক-থিক করছে । লোকে  লোকারণ্য । চিৎকার চেঁচামেচি । তিরিক্ষে মেজাজে ভবেন মল্লিক গিন্নী ও বড় ছেলের ওপর ফেটে পড়লেন – তোমাদের মাথায় বিন্দুমাত্র যদি গ্রে ম্যাটার থাকত তাহলে এত দুর্ভোগ হত না । বাড়ি থেকে বেরুনোর আগে একবার স্টেশানে ফোন করে জেনে নিলে পারতে । ট্রেন লেট আছে কিনা সেই হিসাবে বেরুনো যেত ।

সুমন্ত তিতি বিরক্ত গলায় বলল – তুমিই তো তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে পড়লে । কিছু ভাববার ও করার সমই দিলে না ।

অমলাদেবীও টুক করে বলে ফেললেন – গ্রে ম্যাটারটা তো তোমার মাথায় একটু বেশী মাত্রায় আছে, তা তুমিই না  হয় একটু ফোন করে সময়টা জেনে নিতে ।

আগুনে ঘি পড়ার মত ভবেন মল্লিক ভয়ংকর ভাবে জ্বলে উঠে বললেন তুমি থামবে । আজকাল বড্ড বেশী কথা বলো তুমি । একে তো মাথায় নেই কিছু ঘিলু তারওপরে .....

সুমন্ত, ভবেন মল্লিককে স্মরণ করিয়ে দেয় - বাবা, এটা পাব্লিক প্লেস । বাড়ি নয় ।

যাত্রীদের মুখে-মুখে ট্রেন লেট হওয়ার নানান কারণ শোনা যায় । কেউ বলে বর্ধমানে কোনও ট্রেন দুর্ঘটনা হয়ছে । কেউ বলে দুন এক্সপ্রেসের এ. সি কম্পার্টমেন্টে আগুন লেগে গেছে তাই দেরী হচ্ছেইনকোয়ারীতে জিজ্ঞেস করলে ট্রেন কতটা লেট আছে সেই খবরটি দেয় ।

অবশেষে ঠিক রাত দুপুর একটায় ঘোর চেঁচামেচি ও চরম বিশৃঙ্খলার মধ্যে ভবেন মল্লিক ও তাঁর পরিবার সকলে ট্রেনে উঠে পড়লেন । নিয়মানুবর্তিতায় ঘোর বিশ্বাসী ভবেন মল্লিক রাত্রির ভোজন পর্ব প্ল্যাটফর্মেই সেরে নিয়েছিলেন এবং ট্রেনে উঠেই শোওয়ার জন্য তোড়জোড় শুরু করে দিলেন । এবং অমলাদেবীকে বললেন - দাও, মিষ্টির বাক্সটা বার করে দাও । মিষ্টি জল খেয়ে শুয়ে পড়ি ।

সুমন্ত রাগত স্বরে বলল - বাবা, এই তো সবে ট্র্রেন ছাড়ল একটু সবুর করো আমি আর তোমার বড় বৌমা এখনও খাইনি । আমরা খেয়ে নিই তারপর শুয়ো । অগত্যা ভবেন মল্লিক ব্যাজার মুখ করে খবরের কাগজ নিয়ে বসলেন ।  ট্রেনটা প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে কিছু দূর গিয়েই আবার থেমে গেল । একে তো চার সাড়ে চার ঘন্টা লেটে ট্রেন ছাড়ল তারপর একটু দূর এগোতে না এগোতেই আবার থেমে গেল । স্বভাবতই যাত্রীরা বিরক্ত ও ক্ষুব্ধ । শোয়া হল না বলে রীতিমত ক্ষুব্ধ ভবেন মল্লিক রেলকোম্পানির মুন্ডুপাত শুরু করে দিলেন । তক্ষুনি ট্রেন আবার চলতে শুরু করে দিল। ভবেন মল্লিকের সবচেয়ে ছোটনাতি,শুভম বাঙ্কে শুয়েছিল হাসতে হাসতে বলল - দাদু, তুমি রিয়েলি দি গ্রেট । তোমার বকুনির চোটে ট্রেনও ভয় পেয়ে চলতে শুরু করে দিল । এদিকে অমলাদেবী ট্রেন থেমে আছে দেখে টয়লেট যাওয়ার উদ্দেশ্যে উঠেছিলেন আচমকা ট্রেন আবার চলতে শুরু করাতে তিনি নিজের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে ধপাস করে পড়লেন গিয়ে এক্কেবারে ভবেন মল্লিকের কোলে । সে এক কেলেঙ্কারি কাণ্ড ! এদিকে ভারী শরীর নিয়ে অমলাদেবীর  নিজে থেকে ওঠবার ক্ষমতা নেই । একনাগাড়ে চার পাঁচ ঘন্টা বসে থেকে তাঁর কোমর ধরে গেছে । এমনিতেই তিনি বাতের রুগী । ওদিকে ভবেন মল্লিকের ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা । চিঁড়েচেপটা হয়ে আছেন সাধ্য কি তাঁর একশো কেজী ভার নিজের কোল থেকে সরান । ভবেন মল্লিকের দুই নাতনী , বিপাশা ও রিয়াশা জানলার দিকে মুখ করে প্রাণপনে হাসি চাপার চেষ্টা করছে ততই হাসির বুড়বুড়ি যেন বুক ঠেলে উঠে আসছে । পুত্রবধু, মিতার অবস্থা আরও করুণ । শ্বশুর ও শাশুড়ির সামনে প্রাণখুলে হাসতেও পারছে না বেচারী ! অপ্রতিরোধ্য হাসির গমক চাপা দেওয়ার অছিলায় মেয়েদের চাপা গলায় বকতে থাকে এই তোরা ঠাম্মাকে তোল না । এহেন দৃশ্য দেখে শুভম বাঙ্কের থেকে তড়াক করে লাফ দিয়ে নিচে নামে । ভবেন মল্লিকের করুণ দশা । কোনও প্রকারে নাতিকে বললেন – এই বাঁদর ! ঠাম্মাকে তোল না । নাতি নাতনীরা ঠাম্মাকে তুলবে কি তারা হেসেই খুন । খিঃ খিঃ খিঃ । আর . এ . সি তে বসা এক তরুণ দম্পতি তারাও হেসেই কুটিপাটি ।

অনেক যাত্রীর মত সুমন্ত ট্রেন[m1]  থেকে নেমে জানতে গিয়েছিল , ট্রেন হঠাৎ থেমে গেল কেন । ট্রেন চলা শুরু হতেই আবার কম্পার্টমেন্টে উঠে এসেছে । মাকে বাবার কোলে বসে থাকতে দেখে ভ্যাবাচাকা খেয়ে যায় । ইতিমধ্যে গাড়ী বেশ স্পীড নিয়ে নিয়েছে । দ্রুত গতিতে ধাবমান গাড়ীতে সার্কাসের জাগলারের মত ব্যালেন্স করতে করতে সুমন্ত বাতে কাহিল অমলাদেবীকে ভবেন মল্লিকের কোল থেকে টেনে তোলে ।

ভবেন মল্লিকের মনে হচ্ছিল  এক জগদ্দল পাষাণ প্রস্তরের তলায় যেন তিনি চাপা পড়েছিলেন । দম বন্ধ হয়ে আসছিল । আস্তে আস্তে দম ফিরে পাচ্ছিলেন । একটু ধাতস্থ হতেই ভবেন মল্লিক নাতি নাতনীদের ওপর খেঁকিয়ে ওঠেন - এ্যাঁ, এ্যাঁ এত হাসির কি আছে ? তোর ঠাম্মা তো আর অন্যের কোলে গিয়ে বসেনি । কোথায় ঠাম্মাকে টেনে তুলবি না হেসেই অস্থির । এই  তোদের শিক্ষা-দীক্ষা । তারপর গিন্নীর দিকে ঘুরেই কটমট চোখে আগুন ঝরিয়ে বললেন – বলিহারী যাই তোমার, তুমি আর বসার জায়গা পেলে না । লজ্জায় রাঙা মুখ , অমলাদেবী মনে মনে ভাবলেন – তোমার কোলে সাধে কি বসতে গেছি  ভাগ্যের ফের । এক পলকেই দেখে নিলেন রাগে অগ্নিশর্মা, স্বামীর মুখ । তাই আর সাফাই দেওয়ার চেষ্টা করলেন না ।  মৌন হয়ে রইলেন ।

               ( ৪ )

পরের দিন সকালে ট্রেনে প্রাতরাশ করতে গিয়ে ভবেন মল্লিকের মাথায় হাত । হায় ! হায় ! হায় ! অত সুস্বাদু খাবার সব নষ্ট হয়ে গেছে । কিমা মটর থেকে টকটক গন্ধ বেরুচ্ছে । পটলের দোর্মা সেটাও গেছে নষ্ট হয়ে । কয়েকটা ফিশ ফ্রাই, আলুভাজা ও লুচি ছাড়া সব  খাবারই ফেলে দিতে হল । ট্রেনে দু রাত্রী থাকতে হবে । সেই মত ভবেন মল্লিক অমলাদেবীকে আমিষ নিতে বলেছিলেন । এ সি কম্পার্টমেন্ট । খাবার খারাপ হবে না । ট্রেনে ননভেজ খাবার অর্ডার দিলে সাধারণতঃ চিকেন ও এগই দেয় । আর এখন সারা দেশ বার্ড ফ্ল্যুর আতঙ্কে আক্রান্ত । ভবেন মল্লিক ও তাঁর পরিবার সকলে তিন মাস ধরে মুর্গী ও ডিম খাচ্ছেন না যদিও স্বাস্থ মন্ত্রালয় থেকে বলা হয়েছে যে ভারতে একটাও বার্ড ফ্ল্যুর ঘটনা ঘটেনি । তবু সাবধানের মার নেই । ট্রেনে ননভেজ অর্ডার দেওয়া যাবে না এবং হরিদ্বার-হৃষীকেশেও ননভেজ খাবার পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম । এই সব সাত পাঁচ  ভেবে ভবেন মল্লিক ট্রেনের জন্য মেন্যু ঠিক করেছিলেন । হায় ! হায়! সব খাবার নষ্ট হয়ে গেল । ভবেন মল্লিকের আপসোসের সীমা রইল না ।

               ( ৫ )

ভবেন মল্লিক ও তাঁর পরিবারের সকলে রাত আটটায় হরিদ্বারে পৌঁছলেন এবং হর কি পৌড়িতে হোটেল,জ্ঞানে উঠলেন । হোটেলে ইন করার সঙ্গে সঙ্গেই ভবেন মল্লিক সর্ব প্রথম দখল করে নিলেন টয়লেট। পাকাপাকিভাবে । শুরু হয়ে গেল তাঁর যাওয়া আর আসা । বিরামহীন । স্টেশানেই তাঁর পেটে ভুটভাট, গুড়গুড় শব্দের নিনাদ বাজছিল। স্টেশানেই সুমন্তর কাছ থেকে হোমিয়োপ্যাথি ওষুধ নিয়ে খেয়ে নিয়েছিলেন কিন্তু তাঁর প্যাথেটিক অবস্থা হোমিয়োপ্যাথি সামাল দিতে পারল না । শেষে দুটো টিফ্লক্স খেয়ে বেডে চুপচাপ শুয়ে রইলেন ।

সুমন্ত বলল - বাবা, আজ রাতটা উপোস দাও ।

পরের দিন সকালেও ভবেন মল্লিক বেডে চুপচাপ শুয়ে রইলেন । থেমে গেছে তাঁর তর্জন গর্জন । কাহিল অবস্থা । পেটের গতিক বিশেষ সুবিধের নয় । শুধুমাত্র চিঁড়ে খেয়ে রয়েছেন । ডাক্তার এসে দেখে গেছেন । প্রেশার ইত্যাদি সব নরমাল ।

সুমন্ত বলল - বাবা, আজ  তুমি সম্পূর্ণ রেস্ট নাও ।  কাল অবধি ঠিক হয়ে যাবে । মাকে নিয়ে আমরা একটু বেরুচ্ছি । হরকে পৌড়ি , চণ্ডী মন্দির, মনসা মন্দির ইত্যাদি দেখে ফিরব ।

অমলাদেবী নিরুৎসাহ গলায় বললেন পর্বত চূড়ায় মা মনসা দেবীর মন্দির তো আমি উঠতে পারব না ।

শুভম উৎসাহের গলায় বলল তোমাকে পাহাড়ে চড়তে হবে না ঠাম্মা । আমরা তো রোপওয়েতে যাব ।

অমলাদেবী মনে মনে ভাবেন ওঁরই কত শখ ছিল রোপওয়েতে চড়ার । হরিদ্বার হৃষীকেশে কোথায়-কোথায় ঘুরবেন সব ডাইরিতে লিখে নিয়ে এসেছেন। হায় ! উনিই যেতে পারবেন না আর আমি যাব । এক যাত্রায় পৃথক ফল । অমলাদেবী করুণ কন্ঠে ছেলেকে বললেন না রে বাবা , আমি আজ যেতে পারব না । কোমরে ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছে ।

 

লেখিকার অন্যান্য লেখা পড়তে হলে এখানে ক্লিক করুন

লেখিকার পরিচিতি-

লেখিকার জন্ম পলাশীপাড়া, নদিয়া জেলা, পশ্চিমবঙ্গ কিন্তু তাঁর শৈশব, বেড়ে ওঠা, শিক্ষা-দীক্ষা ও কর্ম জীবন সব এলাহাবাদেই এলাহাবাদ ইউনিভার্সিটি থেকে অর্থশাস্ত্রে স্নাতকোত্তর ১৯৮২ সালে এলাহাবাদ থেকে একটি ত্রৈমাসিক সাহিত্য পত্রিকাতূণীরপ্রকাশ করতেন বিবাহসূত্রে দিল্লি বাসী লেখিকার বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় (দেশে ও বিদেশে)গল্প,কবিতা ও প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় হিন্দি ও ইংরেজিতেও লেখা প্রকাশিত হয়েছে পানামার কবি রোখেলিও সিনানের দশটি স্প্যানিশ কবিতা বাংলায় অনুবাদ করেছেন

২০১০ সালে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর একটি অণুগল্প ও ছোট গল্প সংকলনঈশ্বর ও মানুষ ডিসেম্বর ২০২২ সালে গাঙচিল প্রকাশন(কলকাতা) থেকে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর করোনা সংক্রান্ত বইকোভিড-১৯ আমার জীবন আমার লড়াই

দিল্লি বইমেলা, মার্চ,২০২৫ সালে কথোপকথন প্রোডাকশন(কলকাতা) থেকে প্রকাশিত হয়েছেআত্মজগল্প সংকলন

 “উন্মুক্ত উচ্ছ্বাসপত্রিকা (দিল্লি) থেকে গল্পের জন্য পুরস্কৃত হয়েছেন ১৯৯৬ সালেকফিহাউসপত্রিকা (কলকাতা)থেকে অণুগল্পের জন্য সম্মান পত্র পেয়েছেন ২০০৬ সালেঅনুশীলন পত্রিকা”, সুইডেন থেকেরাইটার্স অ্যাওয়ার্ডপেয়েছেন ২০১৩ সালে