নার্সিংহোমে
আমার বেড নম্বর ১০৪১।
সুন্দরী
ডায়েটিসিয়ান হেসে বলেন, সুপ্রভাত মিস্টার রায়।
- সুপ্রভাত। আমি হেসে জবাব দিই।
- রাতে ভালমতো ঘুমিয়েছেন?
- হ্যাঁ।
- পরিষেবা ঠিক আছে?
- হ্যাঁ।
- যে কোন প্রয়োজনে বেল বাজাবেন।
- নিশ্চয়ই।
- রিগার্ডিং ডায়েট, এনি
সাজেশন?
- নো, ফাইন।
গতকাল
রাতে দিতি ফোন করেছিল,
শরীর কেমন?
বললাম, ভাল।
- খাওয়াদাওয়া?
- রেসট্রিকটেড।
- ঘুমের ওষুধ দিয়েছে?
- আগে থেকেই খাই।
- ব্যথা যন্ত্রণা?
- এখন কম বোধ হচ্ছে।
- ফারদার চেক আপ?
- আট সপ্তাহ পরে। আর কিছু? আমি
জিজ্ঞেস করলাম।
- নো। থ্যাংকস। দিতি ফোন কেটে দিল।
কে যেন
বেল বাজাল। বিছানা থেকেই ডাকলাম, মিনুদি? দেখ
তো,
কে এসেছে।
নার্সিংহোম
থেকে বাড়ি এসেছি পাঁচ দিন। ডাক্তারের নির্দেশ, দু মাস
পূর্ণ বিশ্রাম। তার সঙ্গে হাজাররকম বিধিনিষেধ।
তারপরেও,ইনফর্ম
হসপিটাল ইন কেস অফ ক্লিনিকাল কমপ্লিকেশন।
সুজন বলল,অনেস্টলি
বলছি,
তোমাকে পেসেন্টের মতো দেখাচ্ছে না।
- আমাকে আমার মতো দেখাচ্ছে। আমি বললাম।
- না। একটু অন্যরকম। আগের চেয়ে বেটার এন্ড
ফাইনার।
- শরীরে কোন বল নেই।
- রেস্ট নাও। সব ঠিক হয়ে যাবে।
- আগের অবস্থায় ফিরতে পারব? আমি
জানতে চাইলাম।
- না পারার কী আছে? অপারেশনের
পর সবারই এমনটা হয়।
আমি চুপ
করে রইলাম। সব কথা বলা যায় না। বললেও সুজন মানতে চাইবে না। আমাকে সাহস দেওয়ার জন্য
যুক্তি,
পাল্টা যুক্তি, মিথ্যে
স্তোক বাক্য, এ সবের বন্যা বইয়ে দেবে।
- কেমন দেখছেন ডাক্তারবাবু? আমি
জানতে চাইলাম।
- আপনার সঙ্গে বাড়ির লোক কে আছেন? ডাক্তারবাবু
জিজ্ঞেস করলেন।
- কেউ নেই। ভালমন্দ যা বলার, আমাকেই
বলুন।
- এক্স-রে দেখে যা মনে হয়েছিল, রোগটা
তার চেয়েও বেশী ছড়িয়ে গেছে। আমি আমার সাধ্যমত চেষ্টা করছি। মনে হয় এ যাত্রায় রক্ষা
পেলেন। তবে রেসট্রিকশন। তার সঙ্গে নিয়মিত চেক আপ।
ঘরের
জানলায় বসলে দেখতে পাই, পুকুর পাড়ে একটি লোক ছোট ছোট পা
ফেলে পায়চারি করছে। লোকটির প্যান্টের পকেটে ইটের টুকরো আছে। হঠাৎ হঠাৎ থেমে পড়ে, টুকরো
ইট ছুঁড়ছে পুকুর লক্ষ্য করে। পানকৌড়ি বা বক, যাতে মাছ
চুরি করতে না পারে, তার জন্য পুকুরের ওপর নাইলনের সরু
জাল টাঙিয়েছে পুকুর মালিক।
তারপরেও
একজন লোককে পাহারা দিতে হচ্ছে। ইটের টুকরো ছুঁড়ে বক, পানকৌড়ি
তাড়াতে হচ্ছে।
আমার
অসুখের খবর শুনে দিতি ডুকরে কেঁদে উঠেছিল। আমি যেন একজন অপ্রকৃতিস্থ মানুষ, এমনভাবে
আমার দু কাঁধ ধরে ঝাঁকানি দিয়েছিল,কী বলছ? ডাক্তার
কি কনফার্ম করেছে?
আমি
দিতিকে কোনদিন কাঁদতে দেখিনি। কান্নাও ওর সৌন্দর্যকে ম্লান করতে পারে না। আমি
দিতির দু বুকের মধ্যে মাথা গুঁজে দিলাম। আর লম্বা করে শ্বাস ফেললাম। আশ্চর্যরকম
হাল্কা লাগতে লাগল নিজেকে।
- আমি তোমার সঙ্গে যাব। দিতি বলল।
- কোথায়? আমি
জিজ্ঞেস করলাম।
- ডাক্তারের কাছে।
- কেন?
- ডিটেলস্ সব জানতে চাইব। সত্যি তোমার কী হয়েছে।
- আমি তো তোমায় ইন ডিটেলস্ সত্যি কথাটাই বললাম।
দিতি আমার
মাথাটি আন্তো করে ধরে বালিশে শুইয়ে দিল। তারপর দু হাঁটুর মধ্যে মুখ গুঁজে কাঁদতে
লাগল।
সেদিন কি
দিতি খুব দুঃখ পেয়েছিল? নাকি ভয়? অথবা
কান্নাই ছিল সেই মুহূর্তে, দূরত্ব তৈরির নিখুঁত হাতিয়ার!
গতকাল
রাতের ফোন ছাড়া, দিতির সঙ্গে আর কোন যোগাযোগ নেই।
অনেকদিন হয়ে গেল। সুন্দরী দিতি অরক্ষিত জেনেও আমার কোন উৎকণ্ঠা হয় না। দিতির জন্য
কোন পাহারাদারের কথা আমার ভাবনাতেই আসে না।
নার্সিংহোমের
সাফাইকর্মী কনকদিকে কথা দিয়েছি, ওর প্রতিবন্ধী মেয়ের জন্য
সরকারী ভাতার ব্যবস্থা করে দেব। কনকদির সঙ্গে আর যদি দেখা না হয়। ও ওর মেয়ের ছবি, ডাক্তার
সার্টিফিকেট, অঞ্চল প্রধানের রেকমেন্ড করা আবেদনপত্র এগুলি
জোগাড় করে রেখেছে।
সুজন বলল, এবার
পাড়ার দুর্গাপুজোর রজত জয়ন্তী বছর, মনে আছে?
ঘাড় নেড়ে
বললাম,
হ্যাঁ। তো?
- সামনের মাসে জেনারেল মিটিং। ডেট এখনও ঠিক হয়নি।
ভেনুটা,
বলো তো, তোমার বাড়িতেও করা যেতে
পারে।
আমার হাসি
পেল। সুজন আমার অসুস্থতার কথা মনে রেখেই হয়ত, মিটিংটা
অমার বাড়িতে করার কথা বলছে।
কিন্তু
এখানে আমার ভূমিকা কী? আমি কোনদিনই এ সবের মধ্যে
সক্রিয়ভাবে ছিলাম না। আজও কোন আগ্রহ নেই।
সুজন আবার
বলল,
এবার কালচারাল ফাংশনের ওপর জোর দেওয়া হবে। আমার মতো অনেকের
প্রপোজাল, দিতিদির নাচের স্কুলের প্রোগ্রাম। সপ্তমী
কিম্বা নবমী।
- ডাক্তারবাবু, আমি আবার
কবে বেড়াতে যেতে পারব?
- কোথায়?
- পাহাড়ে কিম্বা জঙ্গলে।
- যে কোন একটা জায়গা বেছে নিন। ডাক্তারবাবু
হাসলেন।
- পাহাড়। আমি বললাম, পাটনিটপ।
চারদিক পাহাড় ঘেরা ছোট্ট একটা জনপদ। পাহাড়ের মাথায় বরফের চাদর। দূরে দূরে একটা
দুটো টিনের ছাউনি দেওয়া ঘর। ঘরের কোলে এক টুকরো ক্ষেত। পাখির ডাক ছাড়া আর কোনও
শব্দ নেই। ঢালু রাস্তা ধরে উঠতে হাঁফ ধরে যায়। সন্ধ্যা নামে আটটার পর।
- আপনি নস্টালজিক হয়ে পড়ছেন।
- সরি।
- নো ম্যাটারস। ডাক্তারবাবু কাঁধ ঝাঁকালেন।
আমাদের প্রত্যেকের মধ্যেই একজন করে যাযাবর মানুষ আছে। কেউ সুযোগ পায়। কেউ পায় না।
যার অবস্থা আমার মতো, তার পুজোও নেই। খ্রিস্টমাসও নেই।
মিনুদিকে
ডাকি। ও কপালে হাত ঠেকিয়ে বলে, মামা, আপনার
জ্বর আসছে।
খাওয়াতেও
অনীহা জন্মেছে। মুখের মধ্যে বিস্বাদ ভাব। অনেক রাতে ঘুম আসে।
যতক্ষণ না
ঘুম আসে,
সারা শরীর জুড়ে অসহ্য যন্ত্রণা। ছেঁড়া ছেঁড়া ঘুমের মধ্যে
এলোমেলো স্বপ্ন দেখি। মৃত মানুষেরা ভিড় করে আসে স্বপ্নের মধ্যে। তারা আমার বাবা মা
ভাই প্রিয় বন্ধু। শরীরে আকৃতিতে কথাবার্তায় তাদের কেমন আবছা অস্পষ্ট লাগে।
সুজন কথা
দিয়েছিল প্রায়ই আসবে। সুজনের মুখটাও ইদানীং কেমন ঝাপসা মনে পড়ে।
কেমন আছ
তুমি দিতি?
কেমন চলছে
তোমার নাচের স্কুল? এ বছরের প্রস্তুতি কী? চিত্রাঙ্গদা? কালসন্ধ্যা?
নাকি সোজন
বাদিয়ার ঘাট? ঝাঁকড়া চুলের সেই ছেলেটি, কখনও
খোল মৃদঙ্গ, আবার কখনও বাঁশি বাজায়, আয়ত
চোখে তোমার দিকে তাকায়, ছবি তোলার সময়ে ঠিক তোমার পাশটিতে
এসে দাঁড়ায়, আরও কী যেন সব...!
ইদানীং
পুরনো কিছু ভাবতে গেলেই মাথার মধ্যে সব তালগোল পাকিয়ে যায়।
তখন মনে
হয় এক লাফে বিছানা থেকে উঠে, দৌড়ে গিয়ে দেখে আসি, আগের
মতো সব ঠিক ঠিক আছে কিনা।
- মিস্টার রায়?
- বলুন ডাক্তারবাবু। আমি সাড়া দিই।
- প্রয়োজনে হালকা বই পড়বেন। এই যেমন ধরুন সুকুমার
রায়,
হাঁদা ভোঁদা বা জাতকের গল্প। টি.ভি-তে কার্টুন কমিক্স
দেখবেন বা লাইট কোন ছবি। মাথা ঘামাতে হয় এমন কিছুর মধ্যে যাবেন না।
- এইভাবেই চলতে থাকবে?
- ক্ষতি কী? ডাক্তারবাবু
বলেন,
কত মানুষ তো এসব নিয়েই সারা জীবন দিব্যি কাটিয়ে যায়।
- ডাক্তারবাবু, আমি কি
ছাদে পায়চারি করব?
- উহু, সিঁড়ি
ভাঙ্গবেন না। ঘরের মধ্যে হাঁটবেন ছোট ছোট পা ফেলে।
- বাইরে বেরব কবে?
- সময় এলে, বলে দেব।
এবারে
নার্সিংহোমে আমি থার্ড ফ্লোরে। বেড নম্বর ৯৭৪। কপালে হাত বুলিয়ে দেয় অ্যাটেনডান্ট।
জিজ্ঞেস করে, মুখ ধুইয়ে দেব?
আমি ঘাড়
নেড়ে বলি, না। আর একটু পরে।
নার্সিংহোমের
ধারেকাছে কোথাও পুজো হচ্ছে। মাইকে পুরনো দিনের বাংলা গান বাজছে। হেমন্তর কণ্ঠ। ঘাড়
কাত করে জানলা দিয়ে আকাশ দেখি। স্বচ্ছ পরিষ্কার। বাতাসে গা শিরশিরে ভাব। নিজে
নিজেই চাদরটাকে টেনে নিই গলা অব্দি। চোখ বুজে চুপ করে শুয়ে থাকি।
- মিস্টার রায়?
চোখ খুলে
দেখি,
সুন্দরী ডায়েটিসিয়ান আমার বেডের গা ঘেঁসে দাঁড়িয়ে হাসছেন, সুপ্রভাত।
- সুপ্রভাত। বলে আমি নিজে থেকে উঠে বসার চেষ্টা
করি।
অ্যাটেনডান্ট
দৌড়ে আসে, দাঁড়ান। ধরছি।
- পারব। ঠিক পারব। আমি বলি।
ডায়েটিসিয়ান
আমার পিঠে আস্তো হাত রাখেন, পারবেন। আপনি নিজেই পারবেন।
- মিস্টার রায়?
- বলুন ম্যাডাম।
- আজ আপনাকে বেশ ফ্রেস দেখাচ্ছে।
- থ্যাংক ইউ। ম্যাডাম।
- রাতে ভালমতো ঘুমিয়েছেন নিশ্চয়ই।
- হ্যাঁ
- পরিষেবা ঠিক আছে?
- ও.কে.।
- দুপুরে স্যুপ। সঙ্গে টোস্ট। এনি মোর?
- নো। এনাফ।
- ডাক্তারবাবু, কেমন
দেখছেন?
আমি জানতে চাই।
- যে অবস্থায় এসেছিলেন, তার
চেয়ে বেটার। রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রাও বেড়েছে।
- ছুটি দেবেন কবে?
- আর কয়েকটা দিন অবজারভেশনে থাকুন।
অ্যাটেনডান্টকে
দিয়ে কনকদিকে ডেকে পাঠাই। তারিখ বার কিছুই মনে পড়ে না।
কনকদিকে
জিজ্ঞেস করি, পুজো শুরু হয়ে গেছে?
- হ্যাঁ। আজ সপ্তমী। কনকদি আমার মুখের ওপর ঝুঁকে
পড়ে,
কাল অষ্টমী। মায়ের থানে আপনার নামে মানত করেছি। খুব জাগ্রত
ঠাকুর। আদ্যি বাড়ির বুড়ি মা। এ বছর দুশো পাঁচ।
আমি আপন
মনেই বলি, আমার পাড়ার পুজোর এ বছর রজত জয়ন্তী বছর। দিতির
নাচের স্কুলের অনুষ্ঠান হবে। আজ সপ্তমী, তা না হলে
পরশু নবমীর দিন।
কনকদি বলে, কিছু
বলছেন দাদাবাবু?
- পুজো
মানেই আনন্দ। আমি হেসে বলি, পুজো মানেই শুভ।
- ওই আর কি!
- ওই নয়। যা বলছি ঠিক। তোমার মেয়ের ছবি আর
কাগজপত্রগুলো গুছিয়ে নিয়ে আসবে। যেদিন আমার ছুটি হবে, মনে
করে দেবে।
- সঙ্গেই আছে। কনকদি বলে।
- নিয়ে এসো।
- আজই নেবেন?
- আজই দাও।
নার্সিংহোমের
বেডে চুপ করে বসে আছি। অ্যাটেনডান্ট মেয়েটি আমাকে পরিচ্ছন্ন করবে বলে গোছগাছ করছে।
সুন্দরী
ডায়েটিসিয়ান কোণের বেডের পেসেন্টের সঙ্গে কথা বলছেন। আমি জানি ঘর ছেড়ে বেরবার আগে,একবার
আমার দিকে ফিরে হাসবেন। তখন আমি বলব, পুজো ভাল
কাটুক ম্যাডাম।
আর?
কনকদি তার
প্রতিবন্ধী মেয়ের ছবি আর প্রয়োজনীয় কাগজপত্রগুলি নিয়ে এলে,সেগুলি
সাজিয়ে গুছিয়ে নিজের মাথার বালিশের নীচে রাখব।
তারপর?
তারপর
ইচ্ছে হলে এভাবে আর কিছুক্ষণ বসে থাকব।
না হলে
বালিশে মাথা রেখে পাশ ফিরে শুয়ে দু চোখ বুজে, সেই পুকুর
পাহারাদারের কথা ভাবব,যে ইটের টুকরো ছুঁড়ে বক পানকৌড়ি
তাড়ায়,
যাতে তারা নাইলনের জাল ভেদ করে মাছ চুরি করতে না পারে।
লেখকের অন্যান্য লেখা পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
লেখক পরিচিতি –
লেখালেখির শুরু নব্বই দশকে। বর্তমানে সাতটি গল্প সংকলন এবং তিনটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে। রাজ্য সরকারের উচ্চপদস্থ আধিকারিক হিসেবে সম্প্রতি অবসর গ্রহণ করেছেন।
একটি বানিজ্যিক লিটল মাগাজিনের নিয়মিত লেখক। ২০১৬ সালে কলকাতা লিটল ম্যাগাগিন লাইব্রেরি ও গবেষণা কেন্দ্র দ্বারা সেরা গল্পকারের পুরস্কার লাভ করেন।
' সাইন্যাকস' পত্রিকা এবং 'অনুভব' সাহিত্য পত্রিকাদ্বারা সেরা গল্পকার হিসেবে সম্মানিত।
.jpg)
