পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার প্রায় অখ্যাত এক গ্রাম এই
ভাণ্ডীরবন। বীরভূমের সিউড়ি থেকে প্রায় ৬ মাইল দূরে এই ভাণ্ডীরবন অনেকের কাছে
পরিচিত ঋষি বিভাস্তকের তপস্যাভূমি বলে। এখানে রয়েছে প্রায় আড়াইশো বছরের প্রাচীন
শিব ও গোপাল মন্দির।
এখানকার ভান্ডীশ্বর শিবমন্দিরের ইতিহাস জানতে গেলে
পিছিয়ে যেতে হবে সেই নবাবি আমলে। নবাব আলিবর্দি খাঁর রাজত্বকালে। সন ১৭৫৪। নবাব
আলিবর্দির রাজপ্রাসাদের উচ্চ পদস্থ কর্মচারী ছিলেন রামনাথ ভাদুড়ি। সেই সময় এই
ভাণ্ডারীবন অঞ্চলের শাসক ছিলেন আসাদুজ্জামান খাঁ। আসাদুজ্জামান খাঁ খাজনা আদায়ে
ব্যর্থ হলে নবাব আলিবর্দি খাঁ তাঁর বদলে রামনাথ ভাদুড়ীকে এই অঞ্চলের খাজনা আদায়ের
উদ্দেশ্যে প্রেরণ করেন।
জনশ্রুতি আছে,রামনাথ ভাদুড়ী এখানে আসার পর একের পর
এক অলৌকিক ঘটনা ঘটতে থাকে। রামনাথ ভাদুড়ী হঠাৎ করেই ভগবান শিবের মাহাত্ম্যে
আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন। তিনি বিশেষ কৃতিত্বে বহু খাজনা মকুবও করিয়ে দেন। রামনাথ ভাদুড়ীর
প্রতি খুশি হয়ে আসাদুজ্জামান তাঁকে এই ভাণ্ডারীবন সহ বীর সিংহপুর, রাইপুর এবং আড়াইপুর মৌজা উপহার স্বরূপ প্রদান করেন। রামনাথ ভাদুড়ী সেই
মৌজাতেই তৈরি করেন মন্দির। ভাণ্ডেশ্বর শিব,গোপাল ও মা কালীর
পুজোর জন্য উৎসর্গ করেন সেই মন্দির।
১৬৭৬ শকাব্দ বা ইংরেজি ১৭৫৪ সালে ভান্ডীশ্বর শিবমন্দিরটি
নির্মাণ করা হয়। রামনাথ মুর্শিদাবাদ থেকে কারিগর এনে মন্দির নির্মাণ করান।
একসময় এই অঞ্চল ছিল জঙ্গলাকীর্ণ। এই জঙ্গলে বসেই তপস্যা
এবং সিদ্ধিলাভকরেন বিভান্তক মুনি।
মন্দিরটির উচ্চতা প্রায় ৪৫ ফুট। মাকড়া পাথরে নির্মিত এটি
একটি দেউল।
মন্দিরের গর্ভগৃহে প্রায় ৫ ফুট নীচে অবস্থান অনাদিলিঙ্গ
শিবের। তবে মন্দিরটি ইষ্টক নির্মিত না প্রস্তরে নির্মিত,তা নিয়ে মতভেদ
আছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগের প্রত্নতত্ত্ব ও সংগ্রহালয় বইটিতে
লেখা হয়েছে- মন্দিরের প্রবেশদ্বারের উপর খোদিত লেখ হইতে অবগত হওয়া যায় যে,মন্দিরটি ইষ্টক নির্মিত,কিন্তু প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের
উপরোক্ত রিপোর্টে এটি প্রস্তরমন্দির রূপে কী কারণে অভিহিত হইল বোধগম্য হয় না।
মন্দিরের প্রবেশপথেই রয়েছে এক সুপ্রাচীন বটগাছ। মন্দিরের
বেশ কয়েকধাপ সিঁড়ি রয়েছে। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি সিঁড়ি ভেঙে মূল মন্দিরের দরজা অবধি
যাওয়া যায়। এখান থেকে মহাদেবকে দর্শন করা গেলেও কাছে যাওয়ার জন্য ভাঙতে হবে আরও
কয়েক ধাপ সিঁড়ি। মন্দিরে জৌলুস তেমন একটা না থাকলেও আছে অসীম পবিত্রতা।
মন্দিরে রয়েছেন সেবায়েত। তাঁরাই পুজোর ব্যবস্থা করেন।
এখানে ভোগ পাওয়ারও ব্যবস্থা আছে।
এই গ্রামেই রয়েছে অপর একটি প্রাচীন মন্দির ও
পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন। শ্রী শ্রী গোপালদেবের মন্দির। এই মন্দিরটিও রামনাথ ভাদুড়ী
প্রতিষ্ঠা করেন বলে কথিত।
ভাণ্ডারীবনের শিবমন্দিরটি থেকে প্রায় ৩০ মিটার দূরে এই
মন্দির। এটিও ১৭৫৪ সালের আশপাশেই নির্মিত হয়েছিল বলে অনেকের মত। এই গোপাল
মন্দিরটির প্রবেশদ্বার পূর্বমুখী। সামনেই রয়েছে নহবৎখানা। মন্দিরের বাইরে একটি রথ
রাখা আছে। প্রবেশদ্বার পার করলেই নাটমন্দির। নাটমন্দিরটি দারুণ শিল্পশোভিত
স্তম্ভের উপর রয়েছে। সিঁড়ি বেয়ে কয়েক ধাপ উঠলেই মূল মন্দিরের বারান্দা। মন্দিরের
ভিতরে গোপালজিউর দারুমূর্তি। তবে এখানে গোপালমূর্তির পাশে নেই রাধা মূর্তি। রয়েছে
ভোগঘর। সম্পূর্ণ মন্দির চত্বরটিই গাছগাছালির স্নিগ্ধ ছায়ায় আবৃত। সম্পূর্ণ মন্দির
প্রাঙ্গণটিই প্রাচীর দিয়ে ঘেরা।
ভাণ্ডারীবনের কাছেই অবস্থিত বীরসিংহপুর বা বীরপুর।
এখানকার দেবী কালিকামূর্তির মাহাত্ম্য নিয়ে প্রচুর জনশ্রুতি রয়েছে। বলা হয় একসময়
রাজনগরের কালীদহের মধ্যে অবস্থিত একটি দ্বীপের ওপর এই কালিকা মন্দির প্রতিষ্ঠিত
ছিল। পরে কোনও এক প্লাবনের ফলে দেবী এখানে চলে এলে এখানেই তিনি অবস্থান করেন। সেই
থেকে অদ্যাবধি এখানেই দেবী অবস্থান করছেন। মন্দিরটি বর্তমানে ভগ্নপ্রায়। এখানে
দেবীর সঙ্গে বিরাজ করছেন ধর্মঠাকুর ও গ্রামদেবতা।
বীরভূমের সদর শহর হল সিউড়ি। এই সিউড়ি থেকে ৯ কিমি বা ৬
মাইল পশ্চিমে ভাণ্ডারীবন। কলকাতা থেকে সরাসরি বাস যাচ্ছে সিউড়ি। সিউড়ি থেকে অটো বা
গাড়িতে যেতে হবে ভাণ্ডারীবন। সময় লাগে প্রায় ২৫ মিনিট।
এখানে থাকার জন্য সিউড়িতে রয়েছে বেশ কিছু বিভিন্ন দামের
ও বিভিন্ন মানের হোটেল।
লেখকের অন্যান্য লেখা পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
লেখক পরিচিতি -
জন্ম,বেড়ে ওঠা,শিক্ষা কলকাতায়।
সুদীর্ঘ প্রায় ৩০ বছর ধরে ভ্রমণ সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু আদ্যোপ্রান্ত বোহেমিয়ান। সারা জীবন জড়িয়ে থেকেছেন 'বর্তমান পরিবারের'সঙ্গে। সাপ্তাহিক বর্তমান সহ শরীর ও স্বাস্থ্য, সুখী গৃহকোণ,আজকাল বিভিন্ন পত্রিকায় লিখেছেন। বিশেষ করে সাপ্তাহিক বর্তমানের অত্যন্ত জনপ্রিয় পুজোর ভ্রমণ বিভাগে দীর্ঘদিন ধরে লিখেছেন। এই লেখার জন্য তাঁকে ঘুরে বেড়াতে হয়েছে দেশের বিভিন্ন রাজ্যের বিভিন্ন মন্দির কেন্দ্র এবং পর্যটনকেন্দ্রগুলিতে। তারই ফলশ্রুতি এই বই। এতদিনের ভ্রমণ অভিজ্ঞ তার ফসল।
ছবি - সংশ্লিস্ট সংস্থার সৌজন্যে
.jpg)