*তিমির অবগুণ্ঠনে :
রজত কান্ত রায়ের কলমে রবীন্দ্রনাথের অন্তরলোক*
বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে আজকের দিনটি এক গভীর বিষাদের দিন। যিনি ছিলেন অন্তর্জ্ঞান ও আলোচিন্তনের নিরবধি পিপাসু, সেই রজত কান্ত রায় আজ নিঃশব্দে অন্তর্ধান করলেন। তাঁর প্রয়াণ যেন আমাদের সাহিত্যজগতে নেমে আসল এক নিঃশব্দ, অথচ গভীর, অপার তিমির। কিন্তু এই তিমিরেই তো তিনি ছিলেন অভ্যস্ত। তাঁর লেখনী যে আলো নয়, ছায়ার ভাষায় কথা বলত। বিশেষত তাঁর অমূল্য গ্রন্থ তিমির অবগুণ্ঠনে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনের অন্তরতম অন্ধকার অধ্যায়গুলিকে যেভাবে প্রকাশ করেছে, তা বাংলা সাহিত্যে এক যুগান্তকারী সংযোজন। এই বইয়ে রজত কান্ত রায় আমাদের দেখিয়েছেন এক ভগ্ন, নিঃসঙ্গ, বেদনাহত রবীন্দ্রনাথ একটি প্রহসনের নয়, একটি প্রতীক্ষার জীবন। এই গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ কেবল বিশ্বকবির ভূমিকায় নয়, বরং একজন লালনের মতো আত্মসন্ধানী, একজন রামকৃষ্ণের মতো আধ্যাত্মিক সত্যসন্ধানী, আর একজন নরমানবের মতো ক্লিষ্ট, শোকাগ্রস্ত, অন্তর্মুখী এক জীব হিসেবে উপস্থিত। আলোতে নয়, রজত কান্ত রায় তাঁকে চিনেছেন তিমিরে মোড়া এক নক্ষত্রের রূপে। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে চিরকালই আলোচনা হয়েছে তাঁর আলোকময় প্রতিভা, বর্ণময় সৃষ্টি, বিশ্বজোড়া প্রভাব, সাহিত্যের রাজপথে তাঁর বীরোচিত পদচারণা নিয়ে। কিন্তু রজত কান্ত রায় জানতেন, প্রতিটি নক্ষত্রেরই একটি ছায়া-প্রচ্ছায়া থাকে, যেখানে মিশে থাকে অজস্র পরাভব, অন্তর্জ্বালা, অপরিসীম নিঃসঙ্গতা। এই গ্রন্থে কবিগুরুর সেই অন্তর্মুখী রবীন্দ্রনাথকে দেখা যায়, যে “জীবনস্মৃতি” বা “ছেলেবেলা” তে সংক্ষেপে প্রকাশ পেলেও আসলে এক বিশাল গহন যন্ত্রণার উৎস। রজত কান্ত রায়ের ভাষায়, রবীন্দ্রনাথ ছিলেন, “এক ধ্যানমগ্ন অরণ্যের বৃক্ষ, যে নিজের দহন নিজেই জানে, কিন্তু ফলদানের দিকে তাকিয়ে থাকে না।” এই উপলব্ধি থেকেই লেখক পাঠককে রবীন্দ্রনাথের সেই অভ্যন্তরীণ অরণ্যে নিয়ে যান, যেখানে আলো কম, ছায়া বেশি। কবিগুরু নিজেই যেন ইঙ্গিত দিয়েছিলেন,
“আমি
অভিমানে তব দুঃখসঙ্গী,
ওগো নিঃসঙ্গ, আমি
তোমারে চিনি।”
রজত কান্ত রায় সেই নিঃসঙ্গ
রবীন্দ্রনাথকেই চিনিয়েছেন আমাদের। সমকালীন প্রতিচ্ছবিতে তিমির দর্শন। বুদ্ধদেব
বসু এক গভীর অন্তর্দৃষ্টি নিয়ে লিখেছিলেন,
“রবীন্দ্রনাথের
মহত্ত্ব আমাদের চোখ ঝলসে দেয়; তাই আমরা
তাঁর মানুষের দিকটা দেখতে পাই না।”
এই বইয়ে রজত কান্ত রায় যেন
সেই চোখঝলসানো দীপ্তির আড়ালে থাকা মানব রবীন্দ্রনাথকে আমাদের সামনে হাজির
করেন। যিনি দুঃখে দীর্ণ, প্রেমে
পরাভূত, শোকে ক্লান্ত, আর এক অদৃশ্য ঈশ্বরের নিকট
আত্মসমর্পণরত। তাই সমর সেন লিখেছিলেন, “রবীন্দ্রনাথ
আমাদের রক্ত নয়, রক্তপাতে লিপ্ত নয়, তিনি এক
ধ্যানমগ্ন ঈশ্বরের মত।”
রজত কান্ত রায় এই
ঈশ্বরতুল্য মূর্তিকে ভেঙে দেখান, যে ঈশ্বর
আসলে রক্তে রঞ্জিত, প্রেমে বিপন্ন, আর
অন্ধকারের স্তব্ধতায় স্থির। বিলেতের ঠান্ডা ঘরে বসে “মেঘ বলেছে যাব যাব” লেখা
কবির হৃদয়ে যে স্নায়ুবিক সংকট ও অনিচ্ছা জমে ছিল, তা তুলে
ধরা হয় এই বইয়ে এক পরিশ্রুত বেদনাবোধে। রজত কান্ত রায় অত্যন্ত সংবেদনশীল
ভঙ্গিতে তুলে ধরেছেন রবীন্দ্রনাথের পারিবারিক জীবনের বিপর্যয়গুলি। কাদম্বরী দেবীর
আত্মহনন, পত্নীর মৃত্যু, সন্তানের অকালপ্রয়াণ, পারিবারিক
দায়িত্বের নিষ্ফলা বোধ-এসবই এক অদৃশ্য ছায়া হয়ে কবির চেতনায় ছড়িয়ে পড়েছিল।
এই দুঃখগাথা যেন জীবনানন্দ দাশের কবিতায় প্রতিধ্বনিত,
“অন্ধকারে
ডুবে থাকা একখানি মুখ
যাকে আমি চিনেছি একদিন।”
রজত কান্ত রায় সেই মুখটিকে
পাঠকের সামনে এনে দাঁড় করিয়েছেন-নগ্ন, বিব্রত, বিকল।
কিন্তু ঠিক ততটাই মানবিক, ততটাই অনুধ্যানযোগ্য।
রজত কান্ত রায়ের তিমির
অবগুণ্ঠনে আত্মজৈবনিক নয়। এ যেন এক আত্মদর্শনের ভাষ্য। তিনি নিজেকে তুলে ধরার
চেষ্টা করেন এক তাত্ত্বিক ভাষ্যকার, দার্শনিক
অন্বেষক, কখনও রবীন্দ্রসত্তার এক নিঃশব্দ শিষ্য হিসেবে। তাঁর ভাষা আবেগে নয়, অন্তরঙ্গতা
ও দূরত্বের এক সুষম ভারসাম্যে গঠিত।এই প্রসঙ্গে শঙ্খ ঘোষের কথাই মনে পড়ে, “রবীন্দ্রনাথকে
বোঝা যায় না, অনুভব করা যায়। তাঁর জীবনের
ব্যাখ্যার চেয়ে জীবনের স্পন্দন বড়।” এই স্পন্দনের গভীর ছায়াপথেই রজত কান্ত রায়
পথ খুঁজেছেন। আজ যখন তিনি নিজেও চলে গেলেন, এই বইটি
যেন তাঁর জীবনের চূড়ান্ত উপাখ্যান। তাঁর লেখনী যেমন রবীন্দ্রনাথের তিমিরে প্রবেশ
করেছিল, তেমনি আজ তিনি নিজেও এক তিমিরে লীন হলেন। শক্তি চট্টোপাধ্যায় যেন এই
মূহূর্তেই বলে ওঠেন,
“যেতে নাহি
দিব হায়,
তবু যেতে দিতে হয়।”
তাঁর চলে যাওয়াটা শুধু একটি
প্রাণের প্রস্থান নয়, এক সংবেদনের বিলুপ্তি। তিমির
অবগুণ্ঠনে কেবল একটি জীবনী নয়,এ এক গোপন
নদীর মতো রচনাস্রোত, যেখানে রবীন্দ্রনাথের অজস্র
যন্ত্রণা, শোক, নিঃসঙ্গতা, ত্যাগ আর
আত্মত্যাগ মিলেমিশে এক নিঃশব্দ সমুদ্র তৈরি করেছে। রজত কান্ত রায়ের কলমে এই
সমুদ্র কখনও উত্তাল হয় না, বরং
স্নিগ্ধ, গম্ভীর, ভাবপূর্ণ হয়ে বয়ে চলে।
রবীন্দ্রনাথ নিজেই লিখেছিলেন, “মরণ রে, তুঁহু মম
শ্যামসমান।”
রজত কান্ত রায়ের চলে যাওয়া
তেমনি এক শ্যামসমান প্রস্থান। তিমিরে গৌরবময় মিলন।
লেখক পরিচিতি
সত্যের উষ্ণতা বুকে নিয়ে কবিতা লেখেন অজিত দেবনাথ। জন্ম উত্তরবঙ্গের আলিপুরদুয়ারে। উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। বর্তমানে বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরে রামানন্দ কলেজে ইতিহাস বিভাগে অধ্যাপনায় রত। ছোটবেলা থেকেই কবিতার প্রতি তীব্র অনুরাগ। শব্দের ভেতর দিয়ে পথ অতিক্রম করতে তিনি ভালবাসেন। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের নিবিড় সম্পর্ক,কথার আকাশে শব্দের অনুত্ত বিন্যাস এবং পরাবাস্তবতা তার কবিতায় বারবার ফিরে এসেছে। অসংখ্য লিটিল ম্যাগাজিনে তার কবিতা নিয়মিত প্রকাশিত হয়। নীরবে কাব্য সাধনায় এক ব্যতিক্রমী চরিত্র। প্রথম কাব্যগ্রন্থের নাম স্বপ্ন খোঁজে স্পর্শের মগ্নতা।