শরৎ আসে। কলকাতার ধুলোমাখা ছাদগুলোতে যখন পেঁজা তুলোর মেঘের ছায়া পড়ে,আর আকাশটা হয়ে ওঠে এক মায়াবী নীল ক্যানভাস,তখন অণু অনুভব করে এক চিরন্তন টান। এ টান শুধু স্মৃতির নয়,এ টান যেন আত্মার গভীরে এক অদেখা যন্ত্রণার। সে জানে,এই শহরে তার শেকড় প্রোথিত,কিন্তু সেই শেকড়ে আবার প্রবেশ করতে গেলে যে সময়ের প্রয়োজন, তার কাছে তা এক অনন্ত যাত্রার সমতুল্য।
অণু,আজ যার
বয়স পঁয়তাল্লিশ,শহরের বুকে এক স্বনামধন্য
স্থপতি। তার নকশা করা প্রতিটি স্থাপত্য
যেন এক একটি প্রতীক- আধুনিকতার প্রতীক, উচ্চাকাঙ্ক্ষার
প্রতীক এবং সেই সাথে মানুষের বিচ্ছিন্নতারও প্রতীক। সে নিজের হাতে গড়েছে কত
ইট-কাঠ-পাথরের সাম্রাজ্য, কিন্তু নিজের ভেতরের জগৎটা
যেন চিরকালই এক ভাঙা অট্টালিকার মতো। তার শৈশব কেটেছে এই শহরেরই এক পুরনো বাড়ির
চিলেকোঠায়,যেখানে সে একা বসে গুনত কত তারার জন্ম হয়, কত তারা
নিভে যায়। মা-বাবার অবিরাম ঝগড়া আর তারপর মৃত্যু। অণু বড় হয়েছিল এক নীরব শূন্যতার
মাঝে। বই আর কল্পনার জগতই ছিল তার একমাত্র আশ্রয়। সেই শূন্যতা তাকে শিখিয়েছিল
আত্মনির্ভরশীলতা,কিন্তু একই সাথে তার আত্মার
গভীরে এক অদৃশ্য কুয়াশার আস্তরণ ফেলে দিয়েছিল।
এই বছর,পুজোর ঠিক
আগে,অণুর জীবনে এক আকস্মিক পরিবর্তন
আসে। তার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু,রেণুকা,গুরুতর
অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি। রেণুকা,যে ছিল
অণুর জীবনের এক বন্ধন, যার
হাসিতে মিশে ছিল শৈশবের সহজতা আর তারুণ্যের উচ্ছ্বাস। রেণুকার অসুস্থতা অণুকে
জীবনের ক্ষণস্থায়িত্ব নিয়ে নতুন করে ভাবতে
শেখায়। সব অর্জন,সব উচ্চাশা যেন মুহূর্তের
মধ্যে অর্থহীন মনে হতে থাকে।
হাসপাতালের সাদা করিডোরে বসে
থাকতে থাকতে অণুর মনে পড়ে যায় বহু বছর আগে দেখা এক স্বপ্নের কথা। স্বপ্ন নয়,যেন
স্মৃতি। তার বাবা আর মা,পুজোর দিন,তাদের সেই
পুরনো বাড়ির উঠোনে বসে হাসছে,তাদের
মুখে শিউলি ফুলের পাপড়ির মতো নিষ্পাপ হাসি। সেই হাসি অণু আর কখনো দেখেনি। সেই
দিনগুলো যেন কুয়াশার আড়ালে ঢাকা পড়ে গেছে।
ষষ্ঠীর সকালে অণু রেণুকাকে
দেখতে যায়। রেণুকা ক্ষীণ কণ্ঠে বলে,"অণু, মনে আছে? আমরা
পুজোর সময় কিভাবে তোর ছাদ থেকে আকাশ দেখতাম? ওই আকাশে
কত গল্প লুকিয়ে থাকত।"
রেণুকার কথাগুলো অণুকে আঘাত
করে। সেই ছাদ,সেই আকাশ! সে তো বহু বছর সেই ছাদের দিকে যায়নি।
সেই বাড়ি,যা এখন অন্য কারো মালিকানায়,তা যেন এক
অচেনা বাড়ি হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিজের নকশা করা চকচকে বিল্ডিংগুলো তার কাছে এখন শুধু
নিরেট কংক্রিট মনে হচ্ছে। এই আধুনিকতা কি তার ভেতরের শূন্যতাকে আরও বাড়িয়ে দেয়নি? সে কি
নিজের হাতেই নিজের আত্মাকে পাথরচাপা দেয়নি?
হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে অণু
সটান চলে যায় তার পুরনো পাড়ায়। গলিগুলো কেমন যেন সঙ্কুচিত হয়ে এসেছে,যেন সময়ের
ভারে নুয়ে পড়েছে। তার পুরনো বাড়িটার সামনে দাঁড়িয়ে সে দেখে,গেটের
তালা ঝুলছে। বাড়িটা এখন ফাঁকা,হয়তো নতুন
মালিকরা অন্য কোথাও গেছে। মায়া আর ক্ষোভের এক মিশ্র
অনুভূতি তাকে গ্রাস করে। সে কি খুব দেরি করে ফেলেছে? তার
শৈশবের আকাশ কি চিরতরে হারিয়ে গেছে?
হঠাৎ তার চোখ যায় পাশের
বাড়ির দিকে। একজন বৃদ্ধা উঠোনে বসে শিউলি ফুল কুড়াচ্ছেন। অণু চিনতে পারে,তিনি
অপর্ণা মাসি,যিনি ঠাকুমার পরিচিত ছিলেন। অপর্ণা মাসি মায়াকে
দেখে চিনতে পারেন। "অণু! কত বড় হয়ে গেছিস! আর এই বাড়িটা,এটা তো
তালাবন্ধ। মালিকরা গ্রামের বাড়ি গেছেন।"
অণু তার পুরনো বাড়ির ছাদের দিকে
তাকায়। অপর্ণা মাসি মৃদু হেসে বলেন,"ছাদটা
দেখতে চাস বুঝি? আয়,আমার ছাদ
থেকে দেখবি। আমার ছাদটাও তো তোর ছাদই।"
অপর্ণা মাসি তাকে তাদের
বাড়ির ছাদের ওপর নিয়ে যান। অপর্ণা মাসির ছাদ থেকে দেখা যায় অণুর পুরনো বাড়ির
ছাদটা। ধুলোর আস্তরণ পড়েছে,কিছু লতা-পাতা উঠে গেছে।
কিন্তু সেই আকাশের নীচেই দাঁড়িয়ে অণু অনুভব করে এক অদ্ভুত স্বস্তি। এই আকাশটা তার,এই
বাতাসটা তার। সে বুঝতে পারে, তার শৈশবের আকাশ শুধু তার
বাড়ির ছাদেই সীমাবদ্ধ ছিল না, তা ছিল এক
অনুভব। আর সেই অনুভব ফিরে পাওয়ার জন্য ইট-কাঠের ঠিকানা প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন আত্মার
উন্মুক্ততা।
অষ্টমীর সকালে অণু রেণুকাকে
আবার দেখতে যায়। রেণুকা কিছুটা ভালো। অঞ্জলি দেবার সময় অণুর মন থেকে সব
গ্লানি কেটে যায়। সে প্রার্থনা করে
রেণুকার জন্য,নিজের জন্য এবং এই পৃথিবীর সব প্রাণের জন্য। সে
বুঝতে পারে,জীবন ক্ষণস্থায়ী,কিন্তু
সম্পর্কের বন্ধন, ভালোবাসার টান এবং
স্মৃতিগুলো চিরন্তন। তার শৈশবের শূন্যতা আজ এক অন্যরকম পূর্ণতায় ভরে উঠেছে। এই
মিলন কেবল কোনো মানুষের সাথে মানুষের মিলন নয়,এ মিলন
তার নিজের ভেতরের আত্মিক একাকীত্বের সাথে তার সত্তার গভীরতম সংযোগের।
নবমীর রাতে,শহরের আলো
ঝলমল করছে। অণু অপর্ণা মাসির সাথে ছাদে বসে আছে। দূরে ঢাকের শব্দ,প্যান্ডেলের
কোলাহল,আর আকাশে তারাদের মেলা। অণু আজ আর একা নয়। সে তার ফেলে আসা শৈশবকে ফিরে
পেয়েছে,শুধু স্মৃতির পাতায় নয়,বরং নতুন
করে হৃদয়ের গভীরে। তার নকশা করা উঁচু দালানগুলো যেন আজ তাকে উপহাস করছে না,বরং মনে
হচ্ছে, এই দালানগুলোই তাকে শিখিয়েছে মাটির গন্ধের মূল্য।
বিজয়ার দিনে অণু রেণুকাকে
দেখতে যায়। রেণুকা আরও কিছুটা সুস্থ। অণু তার হাত ধরে বলে, "অণু,আমরা আবার
নতুন করে শুরু করব। এই শহরটা শুধু ইট-কাঠের নয়,এটা
আমাদের গল্প শোনার শ্রোতা। আর ছাদের আকাশটা,ওটা এখনো
খোলা।"
রেণুকা ক্ষীণ হাসে। অণু বোঝে, জীবন এক
অনন্ত যাত্রা। আমরা সবাই পথিক,এক
কুয়াশার আড়াল থেকে আরেক কুয়াশার আড়ালে যাত্রা করি। কিন্তু এই যাত্রাপথে কিছু
প্রতীক আমাদের পথ দেখায় – যেমন এই শরৎ,এই
দেবীপক্ষ,এই ধুলোমাখা ছাদ,আর এই
মানুষের ভালোবাসা। এগুলিই আমাদের অস্তিত্বকে গভীরতা দান করে,আর চিনিয়ে
দেয় আত্মার আসল ঠিকানা।
এই দেবীপক্ষ অণুকে শুধু
পুরনো দিনের স্মৃতি ফিরিয়ে দেয়নি,দিয়েছে এক
নতুন দর্শন – যেখানে বাইরের কাঠামো নয়,ভেতরের
আশ্রয়ই আসল। যেখানে সম্পর্কগুলো শুধুই দৈহিক মিলন নয়,বরং
আত্মার অবিচ্ছেদ্য বন্ধন। আর এই শহর,যা কখনো
একাকীত্বের প্রতীক ছিল, আজ তা হয়ে উঠেছে তার নিজের
সত্তার এক বিশাল ক্যানভাস,যেখানে সে আঁকতে চলেছে নতুন
জীবনের এক গভীর চিত্র।
লেখিকার
পরিচিতি –
জন্ম শিলং- এ। নর্থ
ইস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কাজের জন্য শংসাপত্র পেয়েছেন। পেশাগতভাবে প্রথমে স্কুলে শিক্ষকতা করেন এবং পরে ২০০২ সাল থেকে বহুজাতিক লজিস্টিকে দীর্ঘদিন চাকরি করেছেন।
ছোটবেলা থেকেই
লেখালেখি শুরু। স্কুল, কলেজ এবং বর্তমানে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখালেখি করেন। প্রকাশিত বইয়ের
মধ্যে উপন্যাস 'তিন কন্যা' প্রশংসনীয়। তিনি খাদ্যরসিক এবং ক্লাউড কিচেন চালান। একজন পশুপ্রেমী,সোস্যাল ওয়ার্কার। কর্ম সুত্রে এবং
বিবাহ সুত্রে ২০০০ সাল থেকে তিনি দিল্লিবাসী।