সকালবেলার সূর্য যেন আজ একটু
বেশি মায়াময়,একটু বেশি স্পর্শকাতর । তার রোদের প্রথম ছোঁয়া
ছড়িয়ে পড়েছে পুরীর ধূলিমাখা রাজপথে। এক গলিত সোনার নদী যেন মন্দিরের চূড়া
ছুঁয়ে নামছে মাটির বুকে। বাতাসে গন্ধরাজ ফুলের গন্ধ,ভেসে আসছে
উলুধ্বনি, ঢাকের গুড়গুড় শব্দ, আর দূর
থেকে ছুটে আসা কীর্তনের সুর। সেই সুর যেন ঈশ্বরের আশীর্বাদ হয়ে ঝরে পড়ছে মানুষের
হৃদয়ে হৃদয়ে। আজ রথযাত্রা,আজ পুরী যেন শুধু ব্যস্ততম
শহর নয়। ভগবানের পবিত্র আসনে পরিণত হয়েছে।
এই আনন্দ আর উৎসবের ভিড়ের
মধ্যেই, নীরবে এগিয়ে আসছে এক মানবীর ক্ষীণ পায়ের ধ্বনি,নির্মলা।
সাদা শাড়িতে মোড়া, মুখে বিবর্ণ শান্তি, চোখে
জড়িয়ে থাকা পুরনো দিনের ধুলোমাখা শোক। তার কাঁধে ঝোলানো ব্যাগে একটিমাত্র
বস্তু—স্বামীর বহু পুরনো, ফ্যাকাসে হয়ে যাওয়া ছবি।
বছর পঁচিশ আগে যার সঙ্গে সাতপাকে বাঁধা পড়েছিল সে,তিন বছর
যেতে না যেতেই হৃদরোগে গেলেন। তার পর সমাজ যা সমাজ চিরকাল নারীর চোখে কেবলই দোষ
খোঁজে—নির্মলার সমস্ত চিহ্ন মুছে দিয়ে
তাকে ঠেলে দিয়েছিল নিঃসঙ্গতার এক অতল গহ্বরে।
“অপয়া”,“অশুভ”,“বিধবা”—এইসব
শব্দ নির্মলার পরিচয় হয়ে উঠেছিল। ঘরের আঙিনা, আত্মীয়-পরিজনের
আলাপ, আলো-আঁধারির উঠোন—সব কিছু থেকে তাকে নিঃশব্দে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। শুধু
থেকে গিয়েছিল একরাশ দ্বিধাহীন নিঃসঙ্গতা,আর সেই
ছবিখানা,যা সে প্রতিদিন বালিশের নিচে রেখে ঘুমোত।
আজ হঠাৎ এক অদ্ভুত
অভ্যন্তরীণ টানে সে এসেছে পুরী। কেউ তাকে আহ্বান করেনি, তবু মনে
হয়েছে যেন জগন্নাথ নিজেই একটি শব্দহীন পত্র পাঠিয়েছেন তাকে। সে এসেছে ঈশ্বরের
দর্শনে নয়। সে এসেছে নিজেকেই খুঁজতে,জানতে,বুঝতে,হয়তো
ক্ষমা চাইতেও ।
রথযাত্রার স্রোতে যখন সে
ভেসে চলেছে,তখন হঠাৎ ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে যায়। মানুষ,রঙ, আলোর
তোড়ে ক্লান্ত নির্মলা অবশেষে বসে পড়ে চক্রতীর্থের ধারে এক পাথরের ওপর। তার
ভেতরটা একেবারে ফাঁকা—যেন চিৎকার করে বলতে চায়, “আমি আছি”, অথচ কেউ
শুনতে পায় না।
ঠিক সেই সময় এক অলৌকিক ঘটনা
ঘটে । একটি ছোট্ট মেয়ে, হাতে লাল ফিতে বাঁধা। ধীরে
ধীরে এসে তার কোলে বসে পড়ে। শিশুটির মুখে রোদ পড়ে যেন আলোয় ঝলমল করছে তার কপাল।
নির্মলা একটু চমকে গিয়ে বলে,“তুই কে রে? তোর মা কই?”
মেয়েটি চোখ তুলে নির্মলার
দিকে তাকায়,ভয় নেই,দ্বিধা
নেই,শুধু মৃদু এক হাসি,আর কোমল কণ্ঠে বললো,“তুমি মা
নয়?”
শব্দটা এতটাই সাবলীল,এতটাই
আন্তরিক যে নির্মলার বুকের ভিতরটা কেঁপে উঠল। যে ডাক বহু বছর ধরে তার জীবনে অধরা
ছিল,আজ তা এমনভাবে ফিরে এলো! সমাজ যে তাকে কখনো মায়ের মর্যাদা দেয়নি, সেই
সমাজের বাইরে এক শিশুর মায়াবী কণ্ঠে আজ
উঠে এলো সেই শব্দ, ‘মা’।
নির্মলার চোখ থেকে জল
গড়িয়ে পড়লো। তার শূন্য বুকের ভিতর যেন এক আশ্চর্য উষ্ণতা ছুঁয়ে গেল । সে
মেয়েটিকে জড়িয়ে ধরে,বুকের ভেতরে অনুভব করে—হ্যাঁ,এই
স্পর্শের জন্যই তো অপেক্ষা করছিল সে এতদিন ধরে।
অল্প কিছু সময় পরেই ছুটে
আসে এক নারী। রাধার মা। মুখে ভয়,কপালে ঘাম,চোখে
কৃতজ্ঞতা।
“আপনার
জন্যই আমার রাধা হারিয়ে যায়নি... মা!”
‘মা’—শব্দটা
এবারও ফিরে আসে, কিন্তু এবার তা শুধু এক
মেয়ে বা তার মায়ের মুখে নয়, যেন ঈশ্বর
নিজেই সেই শব্দ উচ্চারণ করছেন। নির্মলা বুঝতে পারে, তার
জীবনের রথেরচাকা আজ নতুন করে ঘুরতে শুরু করেছে। কোনও পুরাতন শূন্যতা নয়, বরং নতুন
এক সম্ভাবনার ঠিকানা। অপার্থিব দৃশ্য।
আজ নির্মলা আর শুধুই একজন
বিধবা নয়। এক সংবেদনশীল মা,এক মানবী,এবং বুঝতে
পেরেছে,ভালোবাসা পাওয়ার জন্য শাঁখা-সিঁদুর লাগে না,দরকার
হৃদয়ের অন্তহীন ভালোবাসা।
রথের চাকা ঘুরছে রাজপথে, আর তার
সঙ্গে ঘুরছে নির্মলার খণ্ডিত পৃথিবী নৈঃশব্দ্যের মল্লিকাপথে। মন্দিরের গর্ভগৃহের বাইরেও যে ঈশ্বর বসবাস করেন, আজ তার
সাক্ষাৎ-প্রাপ্তি ঘটে গেছে চক্রতীর্থের ধারে।
রথযাত্রা শেষ হবে, মেলাও শেষ
হয়ে যাবে সময়ের ঘূর্ণি-পথে । কিন্তু নির্মলার ভেতরে যে আলোর অবিরাম বৃষ্টি ঝরছে,তা আর
কোনও নিষ্ঠুর সমান সমাজ নেভাতে পারবে না।
লেখকের অন্যান্য লেখা পড়তে এখানে ক্লিক করুন ।
লেখক পরিচিতি -
সত্যের উষ্ণতা বুকে নিয়ে কবিতা লেখেন অজিত দেবনাথ। জন্ম উত্তরবঙ্গের আলিপুরদুয়ারে। উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। বর্তমানে বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরে রামানন্দ কলেজে ইতিহাস বিভাগে অধ্যাপনায় রত। ছোটবেলা থেকেই কবিতার প্রতি তীব্র অনুরাগ। শব্দের ভেতর দিয়ে পথ অতিক্রম করতে তিনি ভালবাসেন। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের নিবিড় সম্পর্ক,কথার আকাশে শব্দের অনুত্ত বিন্যাস এবং পরাবাস্তবতা তার কবিতায় বারবার ফিরে এসেছে। অসংখ্য লিটিল ম্যাগাজিনে তার কবিতা নিয়মিত প্রকাশিত হয়। নীরবে কাব্য সাধনায় এক ব্যতিক্রমী চরিত্র। প্রথম কাব্যগ্রন্থের নাম স্বপ্ন খোঁজে স্পর্শের মগ্নতা।