পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার লাভপুর শহরের কাছে অবস্থিত এই
ফুল্লরা হিন্দুদের এক পরম পবিত্র ধর্মস্থান। বলা হয়, এখানে সতীর
ওষ্ঠ পড়েছিল। সেই কারণে অনেকেই একে একান্ন সতীপীঠের এক সতীপীঠ বলে মনে করেন।
এই মন্দিরের ইতিহাস ঘাঁটতে গেলে দেখা যায়,বহু ঐতিহাসিকই
মনে করেন,সুলতান মাহমুদ গজনবির ভারত আক্রমণে মিথিলার
ব্রাহ্মণরা মিথিলা বা কণৌজ থেকে বিতাড়িত হন। তখন তাঁরা বাংলার বর্মনরাজ হরি বর্মার
কাছে আশ্রয় ভিক্ষা করলে হরি বর্মন তাদের আশ্রয় দেন। তাঁরাই এরপর দেবী ফুল্লরাকে
উপাসনা করার জন্য সিদ্ধলগ্রাম বা শীতলগ্রামে নিয়ে আসেন। তাদের নিয়ে আসেন
বর্মনরাজের সন্ধি বিগ্রহিক ভবদেব ভট্ট। বিভিন্ন কারণে ওই পূজারিরা ফুল্লরা মন্দির
সংলগ্ন ফুলিয়ানগর,অট্টহাস,বাকুল
প্রভৃতি স্থানে বসতি তৈরি করেন। পরবর্তীকালে এই ব্রাহ্মণ বংশেরই একজন ব্রাহ্মণ
দীনমণি মিশ্র বাহাদুর বর্মন রাজা হন।
ফুল্লরা দেবীর মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন কৃষ্ণানন্দ গিরি।
শোনা যায়,একদা মন্দিরের চূড়ায় স্বর্ণকলস শোভা পেত। অন্যান্য পীঠের মতো এখানেও রয়েছে
বিশ্বেশ শিবের মন্দির। তবে বর্তমান মন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন যাদবলাল
বন্দ্যোপাধ্যায়।
লাভপুর-ফুল্লরা সম্পর্কে আর একটি প্রচলিত ধারণা আছে। বলা
হয় মহম্মদ বিন তুঘলকের রাজত্বকালে ওসমান নামের এক মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ এখানে
জনবসতি স্থাপন করেন। তারই বংশধর মহম্মদ ফাজেল এখানে যে দুর্গা তৈরি করেন,তার চিহ্ন এখনও
বর্তমান।
এই লাভপুরের অদূরেই ফুল্লরা দেবীর মন্দির। ১৩০২
বঙ্গাব্দে নির্মিত এই মন্দিরে কোনও দেবী বিগ্রহ নেই। এটি একটি মহাপীঠ বলে পরিচিত।
এখানে কচ্ছপ আকৃতিরএকটি শিলাখণ্ডই দেবী রূপে পূজিতা হচ্ছেন। শিলাখণ্ডটি সিঁদুর
লেপা,খানে দেবী মা জয়দুর্গা রূপে পুজিতা আর তাঁর ভৈরব হলেন বিশ্বেশ। মন্দিরের
সামনে নাট মন্দির।
এই মন্দির সম্পর্কে উল্লেখ পাওয়া যায় পীঠ নির্ণয়
গ্রন্থে। আবার জ্ঞানার্বব তন্ত্রেও এই পীঠের উল্লেখ আছে। বৃহন্নলী তন্ত্রে
উল্লিখিত এই মন্দিরের দেবীকে ভীমকালী বলা হয়েছে। শিবচরিতে বলা হয়েছে,অট্টহাস উপপীঠ
রূপে পরিগণিত এবং সেখানে সতীর ওষ্ঠাংশ পতিত হয়েছিল। এতেই জানা যায়,এখানে দেবীর নাম ফুল্লরা। এখানে দেবীর ভৈরবকে বিশ্বনাথ নামে উল্লেখ করা
হয়েছে। আবার প্রাণতোষণী তন্ত্রের মতানুযায়ী,দেবীর নাম
চামুণ্ডা। আবার কোনও কোনও পুঁথিতে দেবীকে মহানন্দা এবং দেবীর ভৈরবকে মহানন্দ রূপে
বলা হয়েছে।
১৩০২ বঙ্গাব্দে মন্দিরটি নির্মিত হয়েছে বলা হলেও অন্য
একটি মতে জানা যায়,১২৫৯ বঙ্গাব্দে প্রতিষ্ঠিত একটি আটচালা মন্দির রয়েছে এখানে। প্রধান
মন্দিরটি সাধারণ দালান রীতির মন্দির। তেমন কোনও বিশেষ স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত হয়।
মন্দিরের প্রবেশপথের উপর সিংহাসনে উপবিষ্ট রাম-সীতার বিগ্রহ রয়েছে। দু’পাশে কৃষ্ণলীলা ও অন্যান্য দৃশ্যাবলী দৃশ্যমান।
মন্দিরের পাশেই একটি বিরাট পুষ্করিণী রয়েছে। কিংবদন্তী
আছে এই যে শ্রীরামচন্দ্রের দুর্গাপুজোর সময় এই পুষ্করিণী থেকেই নাকি হনুমানজি
১০৮টি পদ্ম সংগ্রহ করেছিলেন।
লেখকের অন্যান্য লেখা পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
লেখক পরিচিতি -
জন্ম,বেড়ে ওঠা,শিক্ষা কলকাতায়।
সুদীর্ঘ প্রায় ৩০ বছর ধরে ভ্রমণ সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু আদ্যোপ্রান্ত বোহেমিয়ান। সারা জীবন জড়িয়ে থেকেছেন 'বর্তমান পরিবারের'সঙ্গে। সাপ্তাহিক বর্তমান সহ শরীর ও স্বাস্থ্য, সুখী গৃহকোণ,আজকাল বিভিন্ন পত্রিকায় লিখেছেন। বিশেষ করে সাপ্তাহিক বর্তমানের অত্যন্ত জনপ্রিয় পুজোর ভ্রমণ বিভাগে দীর্ঘদিন ধরে লিখেছেন। এই লেখার জন্য তাঁকে ঘুরে বেড়াতে হয়েছে দেশের বিভিন্ন রাজ্যের বিভিন্ন মন্দির কেন্দ্র এবং পর্যটনকেন্দ্রগুলিতে। তারই ফলশ্রুতি এই বই। এতদিনের ভ্রমণ অভিজ্ঞ তার ফসল।
ছবি - সংশ্লিস্ট সংস্থার সৌজন্যে