আকাশ যেন অশ্রুভেজা চোখ মেলে নেমে এসেছিল সেই বর্ষাদিনে। জুলাই মাসের এক নিরালায়, দুপুরটা তখন রণমত্ত কবিতার মতো ভিজতে ভিজতে উড়ে যাচ্ছিল। আমি তখন কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী, শহরের কোলাহল পেরিয়ে একটু নিরিবিলি লাইব্রেরির পথে হাঁটছিলাম।হাতে কেবল একটা খাতা আর কাঁধে একটা সাদামাটা ব্যাগ। হঠাৎ করেই আকাশটা অকারণে বিষণ্ণ হয়ে উঠল, যেন জীবনানন্দের সেই চিরন্তন বোধ, "আকাশ যেন কবির মতো অকারণে বিষণ্ণ..."
লাইব্রেরি থেকে ফেরার পথে
কিনে এনেছিলাম জীবনানন্দের ‘বনলতা সেন’। ভেজা পাতার গন্ধে মেশানো কাব্যিক
নিঃসঙ্গতা। ঠিক তখনই শুরু হল বৃষ্টি।প্রথমে নরম ছোঁয়া, তারপর
ধীরে ধীরে এক বুনো ঝড়ের মতো। ছাতা ছিল না, ছাউনিও
দূর, আমি দাঁড়ালাম না। হেঁটে যেতে থাকলাম, মাথায় জল, হৃদয়ে
মেঘ। আমার পাতলা সালোয়ার ভিজে গিয়ে শরীর জড়িয়ে ধরল, চুলের
ভাঁজে জমে থাকা জল গড়িয়ে পড়ছে কপালে। আমি যেন ঢুকে পড়েছি কোনও এক বৃষ্টিজড়ানো
কবিতার ছায়ায়। মনে হচ্ছিল হেমন্তর গলা ভেসে আসছে বাতাসে, "আমার এই
পথ চাওয়ার শেষ নেই, তাই তো বৃষ্টিকে আপন মনে
হয়..."
পাশ দিয়ে ছুটে গেল এক হলুদ
ট্যাক্সি। কাঁদা ছিটকে এসে লাগল পায়ে, কিন্তু
তাতে কোনও অস্বস্তি নেই, বরং যেন এক অদ্ভুত মুক্তি।
বৃষ্টি যেন ভিজিয়ে দিচ্ছে আমার সমস্ত ক্লান্তি, উদ্বেগ আর
না-বলা কথাগুলোকে। স্মৃতির গন্ধে মাখা এক রবীন্দ্র-কবিতা মনে পড়ে গেল,
"বৃষ্টি
নামে বাজে দিগন্তে তব তব করিয়া
চরণ-ধ্বনি শুনি যেন কার..."
হয়তো সেদিন প্রকৃতি নিজেই
আমার কাছে এসেছিল।অলক্ষ্যে হাত ধরেছিল কোনও পুরনো চেনা রূপে। এক ভাঙা দোকানের
ছাউনির নীচে দাঁড়ানো বৃদ্ধ কাকু বললেন, “মেয়ে, একটু
দাঁড়াও না, ভিজে যাবে।” আমি হাসলাম, “এই ভিজে
যাওয়াটাই তো জীবনের সবচেয়ে সুন্দর মুহূর্ত, কাকু।”আজ
এত বছর পর, যখন জানালায় বৃষ্টি পড়ে, আমি চোখ
বন্ধ করে অনুভব করি সেই দুপুরটিকে। তখনকার সেই আমি আর আজকের আমি—মাঝে শুধু স্মৃতির
লিমেরিক কোলাজ।হয়তো কোনও একদিন, কোনও এক
পাঠক, কোনও এক বৃষ্টির দিনে আমার এই ভেজা দুপুরকে খুঁজে নেবে কবিতার পাতায়,
"ভিজে
যাওয়া এই বৃষ্টির মাঝে
হয়তো কেউ খুঁজে নেবে আমায়—
একটি পুরনো ছায়ার মতো,
কোনও এক ধূসর
দুপুরে..."
ঝরোঝরো বৃষ্টিতে একটা বকুল গন্ধের রহস্য আছে। ওই যে মেঘ আকাশে উড়ে যায়। তারপর ঘন ঘন বিদ্যুৎ-ঝিলিক। মনে হয় পুরো আকাশটাই যেন ভেঙে পড়বে। গাছে গাছে রিমঝিম বোল। বৃষ্টি-পতনের কি শব্দ আছে? জল তো স্মৃতির চেয়েও আনমনা। বৃষ্টির টিপটিপ শব্দের মধ্যে অপরূপ আনন্দ-বোধ আছে। জলছাপের কলতানে মুখর হয়ে ওঠে স্মৃতির ছায়াবিথীতল। ওই যে মাঠে মাঠে জল জমে। কাগজের নৌকো ভেসে যায় বুনোহাঁসের আহ্বানে। পুকুরপাড়ে দাঁড়িয়ে এক-ঝাঁক চড়ুই খুঁটে খায় বিন্দু বিন্দু জল। এ যেন ঠিক বিদ্যাপতির, "এ ভরা বাদর মাহ ভাদর শূন্য মন্দির মোর।"
অনেক কাল পেরিয়ে সেই
বৃষ্টির গোপন আতশ-কাচ আজও জড়িয়ে ধরে নিবিড় ভাবে। হিপনোটাইজ করে। এই ঋতু-ভার
থেকে মুক্তি পাওয়া কি সম্ভব? অথচ ধূসর
হয়ে আসছে জীবন-চিত্র। জলকণাগুলো আজও জানালার কার্নিশে জমা হয়। মুঠোতে ধরে রাখতে
পারে না তিতলি।বৃষ্টি-ভেজা সন্ধ্যার পাতাগুলো আজও ফুলভারে অবনত হয়।বৃষ্টি-পতনের
বিপুল হিল্লোলে জেগে ওঠে মন। কিন্তু শরীর স্তম্ভিত দিঘির জলে বাঁধা। আড়চোখে
তাকিয়ে থাকে ভেজা শালিক। মনে হয় তাকিয়ে রয়েছে বহু যুগ ধরে। অনন্তকাল....
লেখক পরিচিতি
সত্যের উষ্ণতা বুকে নিয়ে কবিতা লেখেন অজিত দেবনাথ। জন্ম উত্তরবঙ্গের আলিপুরদুয়ারে। উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। বর্তমানে বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরে রামানন্দ কলেজে ইতিহাস বিভাগে অধ্যাপনায় রত। ছোটবেলা থেকেই কবিতার প্রতি তীব্র অনুরাগ। শব্দের ভেতর দিয়ে পথ অতিক্রম করতে তিনি ভালবাসেন। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের নিবিড় সম্পর্ক,কথার আকাশে শব্দের অনুত্ত বিন্যাস এবং পরাবাস্তবতা তার কবিতায় বারবার ফিরে এসেছে। অসংখ্য লিটিল ম্যাগাজিনে তার কবিতা নিয়মিত প্রকাশিত হয়। নীরবে কাব্য সাধনায় এক ব্যতিক্রমী চরিত্র। প্রথম কাব্যগ্রন্থের নাম স্বপ্ন খোঁজে স্পর্শের মগ্নতা।