পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র বাঁকুড়া
জেলার বিহারিনাথ পাহাড়। বিহারিনাথ এই জেলার উচ্চতম পাহাড়ও বটে। উচ্চতা ৪৪৮ মিটার।
চারদিকে ঘন জঙ্গলে আবৃত এই বিহারিনাথকে এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কারণে অনেকেই
পশ্চিমবঙ্গের আরাকুভ্যালি বলেও ডেকে থাকেন।
এই বিহারিনাথ পাহাড়েই রয়েছে হিন্দুদের অন্যতম পবিত্র এবং
প্রাচীন শিবমন্দির। বিহারিনাথ নামটা এসেছে এখান থেকে প্রায় দু'কিমি দূরের
বিহারি নামক গ্রাম থেকে, যেখানে এই মন্দিরের সেবায়েত বা
পূজারিদের বাস। তাঁদের পদবি দেউগাড়িয়া।
বিহারি কথার আর এক অর্থ যাঁরা বিহার করেন। অর্থাৎ
ভ্রাম্যমান। অর্থাৎ ভূত ও গণরা। এঁদের নাথ হলেন ভোলাবাবা।
প্রচলিত কাহিনি হল এই যে,কাশীপুরের
রাজাকে স্বপ্নাদেশ দিয়েছিলেন বাবা বিহারিনাথ। স্বপ্নে বাবা বিহারিনাথ রাজাকে জানান
যে,তিনি এখানে স্বয়ং প্রকট হয়েছে। কাশীপুরের রাজার অনুদান
থেকেই এই মন্দির নির্মিত হয়। এখানে একটি শিবের কুণ্ড বা শিবকুণ্ড আছে। এর জলকে
অত্যন্ত পবিত্র বলে মানা হয়। এই কুণ্ডের জল শুধুমাত্র বাবা বিহারিনাথের সেবার জন্য
ব্যবহৃত হয়। সাধারণ ভক্তরা এর জলে ডুব দিতে পারবেন কিন্তু কোনওরকম জামাকাপড় কাচা
বা বাসন ধোয়া এখানে করা যায় না।
বিহারিনাথ নিয়ে 'বাঁকুড়া জেলার পুরাকীর্তি'গ্রন্থে অত্যন্ত মূল্যবান কিছু তথ্য দেওয়া হয়েছে। সেই তথ্যগুলি বইটিতে
যেভাবে উল্লেখ করা হয়েছে তা অবিকৃত অবস্থায় পড়লে যা লেখা হয়েছে তা এইরকম। 'শালতোড়া থানার উত্তর পশ্চিম অংশে'অবস্থিত বিহারিনাথ
পাহাড়ের উত্তর সানুতে সমতল ছাদের বিহারিনাথ শিবমন্দিরটি আধুনিককালে নির্মিত হলেও,তার প্রাঙ্গণে রক্ষিত জৈন তীর্থঙ্কর পার্শ্বনাথের এক ক্ষয়িষ্ণু
প্রস্তরমূর্তি ও দ্বাদশভুজ,নাগছত্রধারী আর একটি বেশ বড়
পাথরের লোকেশ্বর বিষ্ণুমূর্তি নিঃসন্দেহে মূল্যবান পুরাবস্তু। শালতোড়ার ৪ মাইল
(৬.৪ কিমি) দুর্গম রাস্তায় ২ মাইল (৩.২ কিমি) পূবে বিহারিনাথ শিবমন্দির। প্রাচীন
পার্শ্বনাথ মূর্তিটি ও পরবর্তীকালের লোকেশ্বর বিষ্ণুমুতিটির যুগপৎ অবস্থিতি থেকে
বোঝা যায় এখানকার আদি জৈন ধর্মকেন্দ্রটি পরবর্তীকালে ব্রাহ্মণ্য হিন্দুধর্মের
প্রভাবে বিবর্তিত হয়ে প্রথমে বিষ্ণু ও অধুনা শৈব উপাসনের ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে।
সাবেক জৈন কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতারা যে অব্যবহিত পশ্চিমে মানভূম সিংভূম হাজারিবাগ
অঞ্চলে সে ধর্মের উৎপত্তিস্থান থেকে দামোদরবাহিত হয়ে এখানে এসেছিলেন তাতে সন্দেহ
নেই। পূর্ববাহিনী দামোদরের ধারা এখন বিহারিনাথ পাহাড় থেকে প্রায় দু'মাই উত্তরে হলেও দূর অতীতে হয়তো আরও অনেক কাছে ছিল। (বাঁকুড়া জেলার
পুরাকীর্তি, পূর্ত (পুরাতত্ত্ব) বিভাগ,বর্তমান-প্রত্নতত্ত্ব
ও সংগ্রহালয় অধিকার,তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগ, পশ্চিমবঙ্গ সরকার,তৃতীয় মুদ্রণ,জানুয়ারি ২০১৫)।
প্রতি বছর ৭ ফাল্গুন এই বিহারিনাথ মন্দিরে শিবরাত্রির
মেলা ও উৎসব হয়। প্রায় সাত-আটদিন ধরে এই মেলা ও উৎসব চলে। লক্ষ লক্ষ ভক্ত সমাগম হয়
সেসময়।
কলকাতা থেকে বিহারিনাথ যাওয়ার বেশ কয়েকটি পথ রয়েছে। ট্রেনে কলকাতা থেকে রানিগঞ্জ এসে সেখান থেকে বাস বা গাড়িতে যাওয়া যায় বিহারিনাথ। রানিগঞ্জ থেকে দূরত্ব মাত্র ২৪ কিমি। আবার বাঁকুড়া অবধি ট্রেনে বা বাসে এসেও যাওয়া যায় বিহারিনাথ। এই পথে দূরত্ব প্রায় ৫৭ কিমি। আবার শালতোড়া এসে সেখান থেকেও যাওয়া যায়। এই পথে বাসে সময় লাগে আধঘণ্টা থেকে ৪০ মিনিট।
যাঁরা তীর্থ করার সঙ্গে সঙ্গে অসামান্য প্রাকৃতিক
সৌন্দর্যের মধ্যে দু'টো দিন কাটাতে চান, তাঁরা ইচ্ছে
হলে বিহারিনাথ থেকে ঘুরে নিতে পারেন ২০-২৫ মিনিটের পথে পুরুলিয়া জেলার অন্যতম
সুন্দর এবং জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র বড়ন্তি থেকেও। আবার বড়ত্তিতে থেকেও ঘুরে নিতে
পারেন বিহারিনাথ। বড়ন্তি যাওয়ার জন্য কলকাতা থেকে ট্রেনে এসে নামতে হবে আসানসোল।
আসানসোল থেকে সামান্য দূরত্বের স্টেশন মুরাডি। লোকাল ট্রেন যাচ্ছে আসানসোল থেকে
মুরাডি। মুরাডি থেকে অটো, টোটো, ট্রেকারে
মাত্র মিনিট পনেরোর পথ বড়ন্তি। পাহাড়, জঙ্গল আর বিশাল সরোবর
দিয়ে
সাজানো বড়ন্তি। একদিকে যেমন প্রকৃতিপ্রেমিক হৃদয়কে
আকৃষ্ট করে,
আবার একইসঙ্গে বিহারিনাথ দর্শনের পুণ্য লাভ করতেও সাহায্য করে।
এইকসঙ্গে রথ দেখা ও কলা বেচা দুই-ই সম্ভব হয়। বিহারিনাথে থাকার জায়গা
তুলনামূলকভাবে কম। আছে বিহারিনাথ ইকো ট্যুরিজম সেন্টার (ফোন ৭৫৯৫০৭৮০২১)। আর
বড়ন্তিতে আছে একদম বড়ন্তি ড্যামের পাশেই সলিটারি ভেল রিসর্ট। এখানে খাওয়ার
ব্যবস্থা, সুইমিং পুল, শিশু উদ্যান,
মনোরঞ্জনের সমস্ত ব্যবস্থা আছে। ফোন ৯৪৩৪৩২২৫৩২,৭৫৮৪০২৪৬৬৮।
লেখকের অন্যান্য লেখা পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
লেখক পরিচিতি -
জন্ম,বেড়ে ওঠা,শিক্ষা কলকাতায়।
সুদীর্ঘ প্রায় ৩০ বছর ধরে ভ্রমণ সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু আদ্যোপ্রান্ত বোহেমিয়ান। সারা জীবন জড়িয়ে থেকেছেন 'বর্তমান পরিবারের'সঙ্গে। সাপ্তাহিক বর্তমান সহ শরীর ও স্বাস্থ্য, সুখী গৃহকোণ,আজকাল বিভিন্ন পত্রিকায় লিখেছেন। বিশেষ করে সাপ্তাহিক বর্তমানের অত্যন্ত জনপ্রিয় পুজোর ভ্রমণ বিভাগে দীর্ঘদিন ধরে লিখেছেন। এই লেখার জন্য তাঁকে ঘুরে বেড়াতে হয়েছে দেশের বিভিন্ন রাজ্যের বিভিন্ন মন্দির কেন্দ্র এবং পর্যটনকেন্দ্রগুলিতে। তারই ফলশ্রুতি এই বই। এতদিনের ভ্রমণ অভিজ্ঞ তার ফসল।
ছবি - সংশ্লিস্ট সংস্থার সৌজন্যে