তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৮-১৯৭১) একজন মানবদরদী সাহিত্যিক। সমাজ ও রাজনীতি সচেতন তারাশঙ্কর আজীবন সাহিত্য সাধনায় নিমগ্ন থেকে বাংলা সাহিত্যের ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ থেকে সমৃদ্ধতর করেছেন। বাঙালি জনমানসে তাঁর সাহিত্য সাধনার গভীর প্রভাব রয়েছে।
বীরভূম জেলার লাভপুরের এক ক্ষয়িষ্ণু জমিদার বংশে ১৮৯৮ সালের ২৩ জুলাই (৮ শ্রাবণ, ১৩০৫ বঙ্গাব্দ) তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম হরিদাস বন্দ্যোপাধ্যায় এবং মাতার নাম প্রভাবতী দেবী। তিনি পিতামাতার জ্যেষ্ঠ সন্তান। মাত্র আট বছর বয়সে তিনি তাঁর তন্ত্রসাধক পিতাকে হারান। এই সময় তিনি তাঁর মা এবং স্বামী-সন্তানহারা পিসিমা শৈলজা দেবীর তত্ত্বাবধানে মানুষ হতে থাকেন।
প্রভাবতী দেবী ছিলেন কুসংস্কারমুক্ত প্রগতিশীল মহিলা। অন্যদিকে শৈলজা দেবী ছিলেন রক্ষণশীল মহিলা। তারাশঙ্করের ব্যক্তিত্ব গঠনে এই দুই নারীই প্রভাব ফেলেছিলেন। তারাশঙ্করের পিতার মৃত্যুর পর পিসিমা চাইতেন তারাশঙ্কর জমিদার হয়ে উঠুক, কিন্তু মা চাইতেন তাঁর ছেলে জমিদারীর বাইরে বহির্বিশ্বে মুক্তি পাক। এই বিপরীতমুখী প্রভাবের আকর্ষণ-বিকর্ষণে তারাশঙ্কর বাল্য অতিক্রম করে কৈশোরে পদার্পণ করেন।
ছোটবেলা থেকেই ঘন ঘন ম্যালেরিয়ায় ভুগে তারাশঙ্করের স্বাস্থ্য ভেঙে পড়েছিল। সেকারণে তিনি প্রথমবার প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেননি। অবশ্য, দ্বিতীয়বার পরীক্ষা দিয়ে তিনি প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। প্রবেশিকা পরীক্ষায় সাফল্যের পর কলেজে ভর্তি হবার জন্যে তিনি গ্রাম ছেড়ে বহরমপুর গেলেন। কিন্তু সেখানে স্থান না পেয়ে তারাশঙ্কর জীবনে প্রথম কলকাতায় এলেন। কলকাতায় বিভিন্ন কলেজে চেষ্টা করে শেষ পর্যন্ত তিনি সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে ভর্তি হন। কিন্তু কয়েক মাসের মধ্যেই তাঁর কলেজ-অধ্যয়ন বন্ধ হয়ে যায়। কারণ এ-সময় তারাশঙ্কর বিপ্লবী দলের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেন। ফলে রাজরোষে পড়ে তিনি গৃহবন্দি হন। প্রথম মহাযুদ্ধ শেষে তাঁর বন্দিদশার অবসান হওয়ায় তিনি দ্বিতীয়বার কলেজে ভর্তি হলেন। এবার অবশ্য ভিন্ন কলেজ সাউথ সুবারবন কলেজ। কিন্তু এ-সময় তাঁকে ম্যালেরিয়ায় এমনভাবে ধরল যে, পড়াশোনা বন্ধ করে ভগ্নমনোরথ হয়ে জন্মভূমি লাভপুরে তিনি ফিরে এলেন।
যৌবনে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় স্বামী বিবেকানন্দ (১৮৬৩-১৯০২), বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৩৮-১৮৯৪) এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১) এই তিনজনের দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হলেন। তাই তো তিনি জমিদারী অত্যাচার, জাতিগত ভেদাভেদ ইত্যাদির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠেন। গ্রামের সমাজসেবক সমিতির উদ্যোগে মুষ্টিভিক্ষাসংগ্রহ ও অগ্নিনির্বাপণের কাজে নিজেকে আত্মনিয়োগ করলেন এবং সাধারণ মানুষের কাছে নিজেকে পৌঁছে দিলেন। ইতিমধ্যে তিনি হিংসাত্মক বিপ্লবীদের পথ থেকে সরে এসে গান্ধীবাদী কংগ্রেস কর্মীরূপে বীরভূমের গ্রাম-শহরে রাজনৈতিক প্রক্রিয়া শুরু করেছেন। ১৯৩০ সালে কংগ্রেসের আইন-অমান্য আন্দোলনের অংশ নেওয়ার জন্যে তারাশঙ্কর গ্রেফতার হন। ছ'মাসের জন্যে তাঁকে কারাগারে থাকতে হয়। কারাগারে বসেই তিনি নির্ধারণ করলেন তাঁর ভবিষ্যৎজীবনের গতিপথ। এই পরিপ্রেক্ষিতে তিনি অনুভব করলেন। আর রাজনীতি নয়, সাহিত্যই তাঁর স্বভূমি। কারাগার থেকে বেরিয়ে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় প্রকাশ্যে ঘোষণা করেন - সাহিত্য সেবার পথেই দেশের সেবা করবেন।
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর জন্মভূমি বীরভূমের লাভপুর এবং তৎসংলগ্ন অঞ্চলের মানুষদের মধ্যেই বিশ্ব-মানব দর্শন করেন। এখানকার অভিজ্ঞতা ও সামাজিক সমস্যাকে তিনি বিশ্বের অভিজ্ঞতা ও সামাজিক সমস্যা বলে মনে করেন। বলা যায়- তিনি বিন্দুর মধ্যে সিন্ধু দর্শন করেছেন। পর্বত-অরণ্য ঘেরা ছোট নাগপুরের মালভূমি সাঁওতাল পরগণা, অন্যদিকে শস্যশ্যামলা বঙ্গভূমি-এর মাঝে অবস্থিত রাঢ় দেশ। জঙ্গল প্রধান রাঢ়বঙ্গের ভূমি হল শাক্ত-বৈষ্ণব-আউল-বাউল-সাঁই-দরবেশ ইত্যাদির সমন্বয়ক্ষেত্র। এখানে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-বিরোধ নেই, বরং রয়েছে পারস্পরিক ভালবাসা, বিশ্বাস, সহমর্মিতা ও শ্রদ্ধাবোধ। তারাশঙ্কর এইসব মানুষদের খুব কাছ থেকে দেখেছেন এবং তাদেরকে ভালবেসেছেন। তাঁর সাহিত্যে এইসব মানুষেরই আনাগোনা। তাঁর গল্পে, উপন্যাসে বীরভূমের গেরুয়া মাটির রহস্যময় ছায়া, উঁচু-নিচু জমি, প্রকৃতির রুক্ষ ধূসর রূপ ফুটে উঠেছে। বীরভূমের গাছ-পালা, নদ-নদী, মাটি-লোকজন ইত্যাদি তাঁর সাহিত্যের আসল রসদ।
মাত্র উনিশ বছর বয়সে কাব্যগ্রন্থ 'ত্রিপত্র'-এর মাধ্যমে তারাশঙ্করের লেখালেখির জগতে প্রবেশ ঘটে। কিন্তু বাংলা সাহিত্যে তাঁর পরিচিতি কবি হিসেবে নয়, কথাসাহিত্যিক হিসেবে। লাভপুর থেকে প্রকাশিত 'পূর্ণিমা' পত্রিকায় তাঁর প্রথম দু'টি ছোটগল্প 'স্রোতের কুটো' এবং 'উল্কা' প্রকাশিত হয় ১৯২৭ সালে (যথাক্রমে আষাঢ় ও আশ্বিন, ১৩৩৪ বঙ্গাব্দ)। এর প্রায় এক বছর পরে সুবিখ্যাত পত্রিকা 'কল্লোল'-এ তাঁর একটি ছোটগল্প 'রসকলি' প্রকাশিত হয় ১৯২৮ সালে (ফাল্গুন, ১৩৩৪ বঙ্গাব্দ)। তারাশঙ্করের প্রথম উপন্যাস 'চৈতালী ঘূর্ণি' প্রকাশিত হয় ১৯৩১ সালে।
সারাজীবন ধরে প্রচুর লিখেছেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। লেখালেখির মূল ক্ষেত্র উপন্যাস ও ছোটগল্প ছাড়াও তিনি বেশ কিছু কবিতা, গান, প্রবন্ধ, স্মৃতিকথা ইত্যাদিও লিখেছেন। তাঁর রচিত প্রায় ষাটটি উপন্যাসের মধ্যে বিখ্যাত কয়েকটি হল: 'গণদেবতা' (১৯৪২), 'পঞ্চগ্রাম' (১৯৪৪), 'কবি' (১৯৪৪), 'মন্বন্তর' (১৯৪৪), 'হাঁসুলী বাঁকের উপকথা' (১৯৪৭), 'নাগিনী কন্যার কাহিনী' (১৯৫২), 'আরোগ্য নিকেতন' (১৯৫৩) 'বিচিত্র' (১৯৫৩), 'যোগভ্রষ্ট' (১৯৬০), 'ভুবনপুরের হাট' (১৯৬৪), 'গন্না বেগম' (১৯৬৫) ইত্যাদি। তারাশঙ্কর রচিত ছোটগল্পের সংখ্যা প্রায় দু'শ। উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হল। 'জলসাঘর', 'ডাকহরকরা', 'মেলা', 'নারী ও নাগিনী', 'ইমারত', 'অগ্রদানী', 'শ্রীপঞ্চমী' 'তারিণী মাঝি', 'বেদেনি', 'যাদুকরী', 'আখড়াইয়ের দিঘি' ইত্যাদি। স্মর্তব্য, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনেক গল্প, উপন্যাস চলচ্চিত্রে স্থান পেয়ে সাফল্য লাভ করেছে।
রবীন্দ্র-উত্তরকালের অন্যতম প্রধান কথাসাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। গোষ্ঠীজীবনের বিবরণে, রাজনৈতিক দ্বিধা ও সঙ্কটের রূপায়নে তারাশঙ্কর তুলনাহীন। বাংলা আঞ্চলিক উপন্যাসের শ্রেষ্ঠ শিল্পী তিনি। তারাশঙ্করের মধ্যে তাঁর পূর্ববর্তী বাংলা কথাসাহিত্যের তিন জ্যোতিষ্ক- বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৭৬-১৯৩৮) ওতোপ্রোত ভাবে মিশে রয়েছেন। 'অপরাজেয় কথাশিল্পী' শরৎচন্দ্রের পরেই তারাশঙ্করের স্থানটি স্থায়ী হয়ে রয়েছে। সাহিত্য সাধনার স্বীকৃতি স্বরূপ তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় 'শরৎচন্দ্র স্বর্ণপদক', 'রবীন্দ্র পুরস্কার', 'সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার', 'জ্ঞানপীঠ সাহিত্য পুরস্কার' ইত্যাদিতে ভূষিত হন।
১৯৩৯ সাল থেকে কলকাতায় বসবাস করলেও গ্রামের সঙ্গে তারাশঙ্করের আমৃত্যু নিবিড় যোগাযোগ ছিল। তিনি আট বছর বিধান পরিষদের এবং ছ'বছর রাজ্যসভার সদস্য ছিলেন। বাংলাদেশের প্রতি, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম (১৯৭১)-এর প্রতি তাঁর অপরিসীম দরদ ও অকুন্ঠ সমর্থন ছিল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ভিত্তি করে তিনি 'নাম ১৯৭১' শীর্ষক একটি উপন্যাসও লেখেন। ১৯৭১ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর (২৮ ভাদ্র ১৩৭৮ বঙ্গাব্দ) কলকাতায় এই মানবদরদী সাহিত্যিকের জীবনাবসান ঘটে। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'শেষ যাত্রা' আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্র সরাসরি সম্প্রচার করে।
লেখকের অন্যান্য লেখা পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
লেখক পরিচিতি –
ড.বাসুদেব রায়ের জন্ম ১৯৬২ সালে। কবিতার মাধ্যমে সাহিত্যের জগতে আত্মপ্রকাশ। প্রথম প্রকাশিত বই মানব' (কাব্যগ্রন্থ), দ্বিতীয় বই রক্তের বাঁধন (উপন্যাস)। সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় পদচারণা করলেও প্রবন্ধ সাহিত্যের দিকে তার ঝোঁক বেশি। তদুপরি গবেষণামূলক প্রবন্ধ তথা বই লিখতে তিনি অধিকতর উৎসাহী। গবেষণামূলক বইয়ের পাশাপাশি সাধু-মহাপুরুষদের জীবনী-গ্রন্থ, একাঙ্কিকা ইত্যাদি সম্পাদনাও করেছেন তিনি।
ড.বাসুদেব রায়ের বেশ কয়েকটি বই প্রকাশিত হয়েছে। হার উল্লেখযোগ্য গবেষণা গুলোর মধ্যে রয়েছে মনসামঙ্গল কাব্যে দেবদেবীর স্বরূপ', চণ্ডীমঙ্গল ও অন্নদামঙ্গল কাব্যে দেবদেবীর স্বরূপ, মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে সমাজ-চিত্র ইত্যাদি। তাঁর যৌথ রচনা ও উপেক্ষণীয় নয়।
বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় বাসুদেব রায় নিরলস ভাবে লিখে চলেছেন। এছাড়াও নতুন করে তিনি একক ও যৌথভাবে বেশ কয়েকটি গবেষণামূলক কাজে হাত দিয়েছেন। নিয়মিত বিভিন্ন e magazine-এ লেখেন।