Advt

Advt

paap-punya-story-galpo-by-kalipada-chakraborty-tatkhanik-digital-bengali-web-bangla-online-e-magazine-পাপ-পুণ্য-কালীপদ চক্রবর্ত্তী

paap-punya-story-galpo-by-kalipada-chakraborty-tatkhanik-digital-bengali-web-bangla-online-e-magazine-পাপ-পুণ্য-কালীপদ চক্রবর্ত্তী

ট্রেনটা যখনই কোন স্টেশনে থামছে, বুধন তখনই যেন কেমন একটু উদ্বিগ্ন হয়ে উঠছে। বুধন এর আগে বহুবার ট্রেনে চড়ে কলকাতা গেছে কিন্তু এমনটা হয়নি। জানালা দিয়ে এদিক ওদিক ভালকরে তাকিয়ে দেখে নিচ্ছে । মনের মধ্যে একটা ভয় কেমন যেন চাগার মারছে বারে বারে। নন্দ কি তাহলে মরে গেল। এতক্ষণে হয়তো খবরটা থানা পুলিশ হয়ে গেছে। পুলিশ তাহলে হয়তো এতক্ষণে চারিদিকে খুঁজে বেড়াচ্ছে তাকে। যে করেই হোক বহুদূরে চলে যেতে হবে তাকে। কিন্তু ও তো নন্দকে মেরে ফেলতে চায়নি। সে সময় নন্দ এসে যদি ওভাবে বুধনের জামার কলারটা ধরে গালমন্দ না করত তাহলে এসব কিছুই হত না। ট্রেনের ভেতরেও কেউ ওর দিকে তাকালে মুখটা ফিরেয়ে নিচ্ছে বুধন। কি জানি বাবা আবার কেউ চিনে ফেলছে না তো? ভাল করে ট্রেনের কম্পার্টমেন্টটা দেখে নিলো, না  চেনাশোনা কেউ নেই। একটু আশ্বস্ত হল। মনে মনে ভাবল হঠাৎ মাথাটা কেমন যেন হয়ে গেল তখন। ও তো ইচ্ছে করে নন্দকে মারতে চায়নি।

বুধন গ্রামের চাষির ছেলে। হারাণ মণ্ডলের মেয়ে শঙ্করীকে সে ভালবাসতো। শঙ্করীর রংটা ফর্সা না হলেও ওর চোখের চাহনি, পেটা শরীরটা বুধনের মন-কেড়ে নিয়েছিল। জমিদার হরকিঙ্করের ছেলে নন্দ-র কুনজর ছিল শঙ্করীর ওপর। শঙ্করীও চাইতো বুধনকে কিন্তু বাধা ছিল ওর বুড়ো বাপটা, হারান মণ্ডল। হারান মণ্ডল চাইতো জমিদারের ঘরের বৌ বানাতে নিজের মেয়েকে। বেশ কিছুদিন ধরে শঙ্করীর ঘর থেকে বাইরে বেরোনোও বন্ধ করে দিয়েছিল হারান মণ্ডল। শঙ্করীর সাথে দেখা না হওয়াতে বুধন হাঁপিয়ে উঠেছিল। তাই দুপুরে হারানের অনুপস্থিতিতে পৌঁছে গিয়েছিল ওদের বাড়ি। শঙ্করীর সাথে একান্তে কথা বলার সুযোগও পেয়ে গিয়েছিল কিন্তু বাধ সাধল নন্দর আর্বিভাব। বুধন শুনেছিল নন্দ আজকাল প্রায়ই শঙ্করীর সাথে দেখা করে ওকে বিয়ে করার মিথ্যা প্রস্তাব দিতে থাকে, ওর সাথে জোর জবরদস্তি করতে থাকে। সুযোগ পেলেই জড়িয়ে ধরতে চায়। শঙ্করী বুঝতে পেরেছিল নন্দর মতলব ভাল নয় তাই বুধনকে জোর দিত বিয়ে করতে বা ওকে নিয়ে দূরে কোথাও পালিয়ে যেতে। সেই পরামর্শ করতেই শঙ্করী আজ ডেকে পাঠিয়েছিল বুধনকে, কারণ শুনেছিল হারাণ মণ্ডল আজ পাশের গাঁয়ে যাবে জমিদারের কোন কাজে। এমন সময় হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজ হতেই দরজা খুলে বুধন দেখল, নন্দ দাঁড়িয়ে আছে ওর সামনে। ওর মাথায় কেমন যেন একটা বিদ্যুৎ খেলে গেল। তবুও রাগ চেপে রেখে বলল, নন্দ, তুই আবার এইচিস শঙ্করীর সাথে দেখা করতি। নন্দ আচমকাই বুধনের জামার কলারটা চেপে ধরে বলল – তুই আবার এখানে এইচিস চাষির পো, দ্যাখ, আমি এবার তুকে কেমন মজা চাখাই। এখুনি লেঠেলদের খবর দিচ্ছি। তোর হাড়গোড় সব গুঁইড়ে দেবে। বলেই শঙ্করীর হাতটা জোরে চেপে ধরে বলল – এই দ্যাখ, তুর সামনে শঙ্করীকে আমি লিয়ে যাচ্ছি, যা করার করি নে কেনে। তুর সামনে আজ আমি শঙ্করীর ইজ্জত নিয়ে ছাইরব। ইর পরও তুই শঙ্করীকে বিহা করবি হারামজাদা।

বুধন এক ঝটকায় নন্দর হাত থেকে কলারটা ছাড়িয়ে নিয়ে রাগের মাথায় দিগবিদিকশূন্য হয়ে দরজার কপাটের খিলটা তুলে নিয়ে নন্দ-র মাথায় বসিয়ে দিল। আর সাথে সাথেই নন্দ-র দেহটা মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। শঙ্করী বুধনকে বলল – বুধন তুই পাইলে যা। আমি সব সামলি নেব। তুকে দেখলে  উরা তুকে মেরি ফেলবে, বলতে বলতে একরকম জোর করেই বুধনকে বাইরে বের করে দিল। বুধন বাইরে বেরিয়ে ভাবল, এখানে থাকলে তো আর বাঁচা যাবে না। ওকে তো বাঁচতেই হবে শঙ্করীর জন্য। বুধন সোজা ছুটল রেল স্টেশনের দিকে। স্টেশনে গিয়ে দেখল, একটা দূরপাল্লার ট্রেন সিগনাল না পেয়ে দাঁড়িয়ে আছে স্টেশনে। বুধন কোন কিছু না বলেই চেপে বসল ট্রেনে। পরে জানতে পারল ট্রেনটা দিল্লি যাচ্ছে। ট্রেনটার নাম দিল্লি এক্সপ্রেস। কি করবে, কোথায় নামবে কিছুই ভাবতে পারছেনা। ওর তখন শুধুই একটা চিন্তা ধরা না পড়ে যায় পুলিশের হাতে। কিছুক্ষণ পর জানালার ধারের একটা সীটে কোনরকমে ভাগাভাগি করে বসে পরল। ট্রেনের জানালা দিয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে ভাবতে লাগল, এখন গ্রামে ফিরে যাওয়া কি ঠিক হবে। তবে কি আরও দূরে, অনেক দূরে চলে যাবে সে। ট্রেনটা স্টেশনে থামলেই ওর মনের মধ্যে দুরুদুরুভাব শুরু হতে লাগল। বুধন ভাবছিল এমনটাতো আগে কখনও হয়নি ওর। হঠাৎ মাথাটা কেমন ধরে গেছে, ভারী ভারী লাগছে। ও তো জেনেশুনে নন্দকে মারতে চায়নি। নন্দই চেয়েছিল ওর শঙ্করীকে জোর করে ওর থেকে কেড়ে নিতে। এসব ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল খেয়াল নেই। পেটের খিদেটা মাঝে মাঝে চাগাড় দিয়েছে কোন রকমে জল খেয়ে রাতটা কাটিয়ে দিতে পারলেই, সকালে অল্পস্বল্প কিছু কিনে খাওয়া যাবে। পকেটে হাত দিয়ে দেখল কিছু টাকা পড়ে আছে, তবে তা একদিন বা দুদিনের বেশি চলবে না। তাও ভাগ্যিস আজ ফসল বিক্রি করে টাকাটা পেয়েছিল আড়তদারের কাছ থেকে।

ট্রেনের জানালার ধারে বসে বসে বুধন স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে কোথায় যেন হারিয়ে গেল। মনে পড়ে গেল সেই চৈত্র মাসের চড়ক মেলার কথা। চড়ক মেলার দিন শঙ্করীকে নিয়ে বেড়াতে গিয়েছিল পাশের গ্রামের চরক মেলায়। কতই না ঘুরেছে মেলায়। শঙ্করীকে মালা কিনে সেদিন পরিয়ে দিয়েছিল। ফুল গুঁজে দিয়েছিল ওর মাথায়। শঙ্করীর সাথে নাগরদোলায় উঠে দোল খেয়েছে দুজনে। ফেরার পথে শকুন্তলা কালীবাড়িতে গিয়ে মালা বদল করে বিয়েও করে নিয়েছিল ওরা দু’জনে। শঙ্করীর সিঁথিতে সিঁদুর পড়িয়ে দিয়ে সেদিন প্রতিজ্ঞা করেছিল শঙ্করীকে সে কখনও ছেড়ে যাবে না। অথচ কোথা দিয়ে যে কি হয়ে গেল। হঠাৎই যেন সব ওলট পালট হয়ে গেল। কত স্বপ্ন দেখেছিল শঙ্করীকে নিয়ে ঘর বাঁধবে। কিন্তু সব বানচাল করে দিল হারামজাদা জমিদারের পো। এছাড়া ওর হাতে তো আর কোনও উপায়ই ছিল না। বুধন লাঠি চালনায় এতই পটু ছিল যে শঙ্করীও মজা করে বলতো – তূর হাত থেকে আমাকে কেউ লিয়ে যেতে পারবেক লাই। তুই আমার মরদ হচ্ছিস। সময় এলে দেখিয়ে দিস তোর লাঠির কারিগরি। বুধন মুচকি হেসে বলত – তুই ভাবিস না শঙ্করী। আমি বেঁচি থাকতি কোনও মরদ তুর দিকে তাকালে তার চোখ আমি গেলিদিবো বুঝলি। শঙ্করী ওর বুকে মাথা রেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলতো – আমি জানি রে বুধন। তাই তো তুরে আমি এত ভরসা করি। আমার ভয় ওই জমিদারের পো আমারি কোনদিন উচ্ছিষ্ট না বানাই দেয়। বড় হারামজাদা পুলাটা।  এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে নিদ্রাদেবীর কোলে মাথা রেখেছিল তা মনেই নেই।

হঠাৎ একটা বিকট আওয়াজে ঘুমটা ভেঙে যেতেই দেখল ওর অর্ধেক দেহটা গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে ঝুলছে। পায়ে একটা যন্ত্রণা অনুভব করল। চারিদিকে খালি বাঁচাও বাঁচাও আওয়াজে বুঝতে বাকি রইল না। ট্রেনটা অ্যাকসিডেন্টের শিকার হয়েছে। ভোরের আলো ফুটেছে। সেই আলোয় যতটুকু দেখা যায়, নিজেকে ধীরে ধীরে গাড়ির বাইরে বের করে নিয়ে এলো বুধন। শরীরে প্রচণ্ড যন্ত্রণা অনুভব করতে লাগল। বুঝতে অসুবিধে রইল না যে দুর্ঘটনাটা বেশ জোরালো হয়েছে। দেখল চারিদিকে খালি আর্তনাদ । শিশু এবং নর-নারীর বাঁচার জন্য আর্ত চিৎকার করে চলেছে। বুধন অনেক কষ্টে নিজেকে সোজা করে দাঁড় করাল মাটির ওপর। ঠিক মত দাঁড়ানো যাচ্ছেনা। রেললাইনের পাথরে পা পিছলে যাচ্ছে। দূরে তাকিয়ে দেখল বহুদূরে ঘরবাড়ি দেখা যাচ্ছে তবে তারা খোঁজ পেয়ে আসতে আসতে অনেকেই হয়তো প্রাণ হারাবে। বুধন আর দেরী না করেই, ট্রেনের ভেতর থেকে ক্ষত-বিক্ষত যাত্রীদের টেনে টেনে নামাতে শুরু করল। দেখল তার সাথে আরও কয়েকজন এসে যোগ দিয়েছে এই কাজে। এভাবে অনেকক্ষণ চলার পর ভোরের আলোয় দেখতে পেল দূরের গ্রাম থেকে বহু মানুষ ছুটে ছুটে এসেছে ত্রাণকার্যে সাহায্য করতে। এভাবে বেশ কয়েক ঘণ্টা কেটে যাওয়ার পর নজরে পড়ল, ইতিমধ্যে সাংবাদিক, ফটোগ্রাফার এবং পুলিশের লোকেরাও এসে উপস্থিত। সাংবাদিকেরা লোকেদের ইন্টারভিউ নিতে ব্যস্ত। হঠাৎ মনে হল, গ্রামের লোকেরা যেন কাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। বলছে, যে লোকটা এতগুলো লোকের জীবন বাঁচালো তার ইন্টারভিউ নিন। আমরা তো পরে এসেছি। কথাগুলো কানে যেতেই বুধন যেন সজাগ হয়ে গেল। ওরা কি তবে ওকেই খুঁজছে। এদিকে জল তেষ্টায় গলা শুকিয়ে এসেছে। দেখল গ্রামের লোকেরা যারা এসেছে সকলেই হিন্দি ভাষাভাষী। তাই সকলেই হিন্দিতে কথা বলছে, হিন্দিতেই মন্তব্য করছে। বুধন  একজনকে জিজ্ঞাসা করল – ভাই সাহাব, পিনে কা পানই কাহা মিলেগা? গ্রামের লোকটি তাকে দূরে একটা গাছ দেখিয়ে বলল –উধার চলে যাও, উহা এক টিউবওয়েল মিলেগা, পানি পিনেকে লিয়ে। আর কোন কথা না বলেই বুধন রেললাইন ধরে দৌড়াতে দৌড়াতে সেই টিউবওয়েলের কাছে গিয়ে দু-হাত ভরে জল নিয়ে খেতে শুরু করল। এমনিতেই গতকাল রাতে পেটে কিছু পড়েনি তার ওপর শরীরের ওপর যা অত্যাচার গেল তা ভগবানই জানেন। ভগবানের কথা মনে হতেই, বুধন দু-হাত ভরে জল নিয়ে ভগবানকে উদ্দেশে বলতে লাগলো – হে ভগবান, আমি যদি একটা পাপ করেও থাকি তবে এই এতগুলো লোকের জীবন বাঁচিয়ে যে পুণ্য করলাম তার জন্য কি তুমি আমায় ক্ষমা করবে না? বলতে বলতে তার দু-চোখ বেয়ে জলের ধারা গড়িয়ে পড়তে লাগল।

গল্পটা হয়তো এখানেই শেষ হয়ে যেত, কিন্তু তা হল না। হঠাৎ একটা হাত এসে বুধনের কাঁধে পড়তেই বুধন একেবারে চমকে উঠল। দেখল এক বয়স্ক দাড়িওয়ালা বৃদ্ধ লোক। বয়সের ভারে একটু নুয়ে পড়েছে। বৃদ্ধ লোকটি বলল – তুমকো দেখকে লাগতা হ্যাঁয় তুম বহুত ভুখে হোঙ্গে। মেরে সে ঘাবড়াও মৎ।  ম্যায় বগল মে হি রহতা হুঁ। তুহমে ট্রেন লাইনসে ভাগতে হুয়ে আতে দেখা। তুমকো দেখকে তো হামারা গাঁওকে নেহি লাগতে হো। জরুর তুম ট্রেন কে প্যাসেঞ্জার হোঙ্গে? বুধন মাথা নেড়ে সায় দিল। লোকটিকে দেখে বুধনের ভাল বলেই মনে হল। লোকটি নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন – বেটা, হামারা গাঁও কে লোগ মুঝে রহিম চাচা বোলকেই বুলাতে হ্যাঁয়। তুম মেরে সাথ আ যাও। সরমাও মৎ। থোরা বহুত খা লেনা বেটা, নেহিতো কব ট্রেন ছুটেগি কোই ভরোসা নেহি। ইস্‌ মুসিবতমে আগার ম্যায় তুমহারা কোই কাম আউ তো মেরা ভাগ হ্যাঁয় বেটা।

বুধন অবাক হয়ে শুনছিল রহিম চাচার কথা আর ভাবছিল, সত্যিই ভগবানই হয়তো এসময়ে রহিম চাচাকে পাঠিয়ে দিয়েছেন। পেটের খিদেটা বাড়ে বাড়ে চাগাড় মেরে মেরে উঠছে। বুধন চালিয়ে নেওয়ার মত একটু আধটু হিন্দি বলতে পারে। বলল – চলিয়ে জী।

রহিম চাচা বুধনকে নিয়ে গিয়ে পাশেই একটা ঘরে গিয়ে উপস্থিত হল। বলল – ইয়ে মেরা কুটিয়া হ্যাঁয় বেটা। বুধন দেখল রহিম চাচার ঘরে কেউই নেই। বুধন  জিজ্ঞাসা করল – চাচা আপকো বাংলা সমঝমে আতা হ্যাঁয়? কিউকি ম্যায় হিন্দি ঠিকঠাক বোল নেহি পাতি হুঁ।

রহিম চাচা বললেন – বেটা তুম বাংলা মে বোল সাকতে হো। ম্যায় বহুতদিন কলকাত্তামে র‍্যাহে চুকা হুঁ। ম্যায় বাংলা সমঝ যাতা হুঁ।  

বুধন যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। বলল – চাচা, তোমার কি কেউই নেই?

রহিম চাচা – এক টাইমপে সব থা, লেকিন আভি কোহি নেহি হ্যাঁয়। ওহ্‌ এক বহুত বড়া কাহানী হ্যাঁয়, বাদমে সুনায়েঙ্গে। মেরা বিবি ভি বাঙ্গালী থী।

বুধন -  থী মানে? এখন বেঁচে নেই?

রহিম চাচা – নেহি বেটা।

রহিম চাচা প্রসঙ্গ বদলে বললেন - আচ্ছা বেটা তুমহারা নাম পুছনেই তো ম্যায় ভুল হি গায়া। ক্যায়া নাম হ্যাঁয় তুমহারা।

বুধন – আমার নাম বুধন।

আল্লাকি বহুত মেহেরবানী হ্যাঁয় কি তুম বাঁচ গয়ে হো। গাঁও কে লোগ বাতা রাহে থে কি বহুত লোগো কি মউৎ  হো গয়ে। আল্লাকি লাখ লাখ সুকর হ্যাঁয় কি আপ বাঁচ গয়ে হো। 

বুধন মনে মনে ভাবলরহিম চাচা, তুমি তো আমার কোন কথাই জান না, তাই কৃপা আছে বললে কি করে। হতে পারে এর চেয়ে আরও বেশি কিছু বিপদ অপেক্ষা করে আছে আমার জন্য।

আপ পহলে খানা খা লিজিয়ে। ফির বাত করেঙ্গে। 

একথা বলেই রহিম চাচা পাঁচটা রুটি, টক আচার সঙ্গে একটু টক দই আর তরকারি দিয়ে বুধনকে খেতে দিল। বুধন তখন খিদের জ্বালায় এক নিঃশ্বাসে প্রায় সব খেয়ে নিলো। মনে মনে ভাবছিল রহিম চাচাকে হয়তো ভগবানই এসময়ে পাঠিয়েছেন, নয়তো সেইবা বেঁচে যাবে কেন আর এই অজানা জায়গায় খাবার দেবেন কেন। বুধনকে এভাবে খেতে দেখে রহিম চাচার বুঝতে অসুবিধে হল না যে বুধন খুবই ক্ষুধার্ত ।

খাওয়া শেষ হলে রহিম চাচা বলল – বুধন বেটা, থোড়া সা বইঠ যাও। আরাম কর লো। ট্রেন আভি যানেওয়ালা নেহি। কুছ ঘন্টে তো লাগেগি দুসরা ট্রেন আনে মে। থোড়া আরাম কর লো। আপ কাঁহা যা রাহে থে? আপকা ঘরমে কোন কোন হ্যায়?

আমি গ্রাম বাংলার চাষির ছেলে। বলেই গ্রামের নামটা বলতে গিয়েও কেমন যেন আটকে গেল। ভাবল এখনই এই বুড়োকে সব কথা বলা ঠিক হবে না। কিন্তু কাউকে মন খুলে সব কথা বলতে না পারলেও বুধন যেন শান্তি পাচ্ছিল না।

বুধনকে চুপ থাকতে দেখে রহিম চাচা বলে উঠলেন –

আচ্ছা বুধন, আপকো ঘরকা জরুর ইয়াদ আ রাহা হোগা!

একথা শুনেই বুধন যেন কেমন ভেঙে পড়ল। সবকথা খুলে বলবে কিনা বুধন মনে মনে ভাবছিল। এমন সময় রহিম চাচা বলে উঠল – বেটা আপ মেরে সে কুছ ছুপা রহে হো। আপ ইতমিনান সে মুঝে আপকা দুবিধা বাতা সাকতে হো। ম্যায় আপকা বাপকা উমরকা হুঁ। কোই চিন্তা নেহি। ম্যায় হোতে হুয়ে কোই তুহমে হাত নেহি লাগা সাকথা ইস গাঁও মে। আউর আপতো মেরা মেহমান হো। আপ মুঝে বিসওয়াস কর সকতে হো। আপ মেরা মেহমান হো, আপকো কুছ নেহি হোনে দুঙ্গা। ম্যায় আল্লা কি কসম খাতা হুঁ।

বুধনের মনে হল চাচা যখন আল্লার দিব্যি খেয়েছে তাহলে হয়তো সব কথা খুলে বলা যেতে পারে। তাছাড়া যে অজানা অচেনা একজনকে এত উপকার করতে পারে সে আর যাই হোক খারাপ লোক নয়। গাঁয়ের বৃন্দাবন কাকার কথা মনে হল। তিনি বলতেন প্রয়োজনে তিন মাথার থেকে বুদ্ধি নিবি। অর্থাৎ বুড়োদের থেকে বুদ্ধি নেওয়া উচিত। মনে পড়ে বুধন জিজ্ঞাসা করেছিল। তিন মাথা আবার কি গো খুড়ো। খুড়ো বলেছিল – বুড়ো হলে দুটো হাঁটু ও মাথা প্রায় একসাথে ঠেকে যায়, তাই তিন মাথা বলে। তাহলে একবার সাহস করে রহিম চাচাকে বলেই দেখা যাক। যখন আল্লার দিব্যি খেয়েছে তখন নিশ্চয়ই তেমন কিছু করবে না। তাছাড়া গ্রামের প্রায় সবাই এখন ট্রেন দুর্ঘটনাস্থলে পৌঁছে গেছে। রহিম চাচা এতই বৃদ্ধ যে তার যাওয়া উপায় নেই তাই যেতে পারেনি। দেখলে মনে হয় সারা গ্রামটা যেন খাঁ খাঁ করছে। রহিম চাচাই সেখানে একা মানুষ। গ্রামের বুড়ো, বাচ্চা সবাই ছুটেছে অ্যাকসিডেন্ট দেখতে।

বুধন ভেবে দেখল তার এখন আর কোনও উপায় নেই। স্টেশনে গেলে খবরের কাগজওয়ালারা যদি ছবি ছেপে দেয় বা পুলিশে নানা জেরা করে তা হলেও বিপদ। তাই রহিম চাচাকেই বিশ্বাস করে দেখা যাক।

বুধন ধীরে ধীরে সব কথা রহিম চাচাকে খুলে বলল। এও বলল যে সে জানে না যে জমিদারের ছেলে নন্দ বেঁচে আছে না মরে গেছে। সবকথা শুনে রহিম চাচা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল – আপ দুসরী সাইড সে ট্রেন লেকর গাঁও ওয়াপস যাও বেটে। শঙ্করী কো বহুৎ জরুরত হ্যাঁয় তুমহারা। হো সাকতা হ্যাঁয় নন্দ মরা নেহি। তুম আউর দের নেহি করনা বেটে আভি চলে যাও । যাকে দেখ উহা কি হালত, শঙ্করীকি হালত ক্যায়া হ্যাঁয়। তুমহারা একেলে আনা ঠিক নেহি হুঁয়া বেটা। তুম আমি নিকল যাও। আগলা স্টেশন সে ট্রেন চড়না। ইহা সে পাঁচ মিনিট কি রাস্তা হ্যাঁয়। ইস টাইমপে কলকাত্তা যানেকে লিয়ে ট্রেন আতি হ্যাঁয়। উসমে চড় যানা।

বুধন কি করবে ভেবে উঠতে পারছিল না। ওখান থেকে বেড়িয়ে  সোজা অন্য স্টেশনে গিয়ে একটু অপেক্ষার পর ট্রেন পেয়ে গেল। শেষ পর্যন্ত গ্রামের স্টেশনে নেমেই দৌড়ে গেল মন্টুদার চায়ের দোকানে। মন্টুদাও ওর পাশের বাড়িতেই থাকে। মন্টুদা বুধনকে দেখেই টেনে চায়ের দোকানের পেছনে নিয়ে গেল।

বলল – বুধন, তুই কোথায় ছিলি? এই একটু আগে শঙ্করীকে জমিদারের লোকেরা পাগল প্রমাণ করে মানকুণ্ডু পাগলাগারদে ভর্তি করতে নিয়ে গেল। সবাই বলছে শঙ্করী নাকি পাগল হয়ে গিয়ে নন্দকে মাথায় দরজার খিল দিয়ে মেরেছে। নন্দ এখন হাসপাতালে। বাকরূদ্ধ হয়ে গেছে। কিছুই বলতে পারছে না। শঙ্করীকে ওরা একটু আগে টানতে টানতে নিয়ে গেল। শঙ্করী চিৎকার করে বলছিল – তুই আমাকে বাঁচা বুধন। ইরা আমাকে মেরি ফেলবে। সে কি আর্তনাদ রে বুধন। আমি তোকে হন্যে হয়ে খুঁজেছি। কোথাও পাইনি।

বুধন যেন কোথায় হারিয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ চিতা বাঘের মত চিৎকার করে উঠলো। উরা আমার শঙ্করীকে লিয়ে গেছে, আমি উদের ছারবেক লাই। মন্টুদা, আমি যাচ্ছি গো, শঙ্করীকে আমার বাঁচাতিই হবে। মন্টুদা বলল – তুই যা, আমি গ্রামের মানুষগুলারে লিয়ে আসছি এর একটা বিহিত আজ করতিই হবে।

বুধন পাগলা ঘোড়ার মত শঙ্করী আমি আসছি বলতে বলতেই ছুটতে শুরু করল.................. কানে ভেসে আসতে লাগলো বুধনের গগনভেদী চিৎকার, আমি আসছি শঙ্করী...............আমি আসছি.................তুর কুনো ভয় লাই, আমি আসছি তুর কাছে...... তুকে আমি মরতি দিব না ওই পিশাচগুলার হাতে.........   আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে উঠল কালবৈশাখী ঝড়। 

লেখক পরিচিতি –

লেখকের অন্যান্য লেখা পড়তে এখানে ক্লিক করুন ।

কালীপদ চক্রবর্ত্তী  দিল্লি থেকে প্রায় ১৮ বছর ‘মাতৃমন্দির সংবাদ’ নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন এবং ‘সৃষ্টি সাহিত্য আসর’ পরিচালনা করেছেন । বর্তমানে 'কলমের সাত রঙ' এবং 'www.tatkhanik.com' পত্রিকার সম্পাদক।   

দিল্লি,কলকাতা এবং ভারতবর্ষের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখেন। কলকাতার আনন্দমেলাআনন্দবাজার পত্রিকা,সাপ্তাহিক বর্তমান,  কথা সাহিত্য, দৈনিক বর্তমাননবকল্লোল,শুকতারাশিলাদিত্য,সুখবরগৃহশোভাকিশোর ভারতীচিরসবুজ লেখা (শিশু কিশোর আকাদেমী,পশ্চিমবঙ্গ সরকার)সন্দেশপ্রসাদছোটদের প্রসাদ, কলেজস্ট্রীটউল্টোরথ,তথ্যকেন্দ্রজাগ্রত বিবেক (দক্ষিণেশ্বর কালীমন্দির থেকে প্রকাশিত) স্টেটসম্যানকিশোর বার্তা , অন্যান্য বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখা প্রকাশিত হয়। তাঁর প্রকাশিত বই-এর সংখ্যা ১০ টি এবং প্রকাশের পথে ২টি বই। 

shesh-ichha-galpo-story-by-kalipada-chakraborty-tatkhanik-digital-bengali-web-bangla-online-e-magazine-শেষ-ইচ্ছা-কালীপদ-চক্রবর্ত্তী