রসের কথা শুনলেই অনেকের জিভে জল এসে যায়। রস এমন একটি জিনিস যার জন্য লালায়িত হন অনেকেই, যারা আস্বাদন করেন তারা পরিতৃপ্ত হন, কোথাও লেগে গেলে চট চট করে আর না পেলে আক্ষেপ হয়।
স্থান কাল পাত্র ভেদে রস বিভিন্ন প্রকার, যেমন ময়রা রস বলতে যা বোঝেন, শিল্পীরা তা বোঝেন না। স্বামী, স্ত্রী-রা যা বোঝেন তা আবার খেজুরের রসওয়ালা বা সাহিত্যিকদের থেকে আলাদা। অর্থাৎ ব্যাক্তি, স্থান, কাল, পাত্র-ভেদে রসের সংজ্ঞা আলাদা। নৃত্য ও সঙ্গীত শাস্ত্রে নয় প্রকার রসের উল্লেখ আছে, যথা – হাস্য রস, ভয়ানক রস, শৃঙ্গার রস, রুদ্র রস, করুণ রস, বীর রস, অদ্ভুত রস, বীভৎস রস, শান্ত রস।
আমাদের সমাজে বহু লোকই আছেন তাঁদের মধ্যে কেউ রস ভালোবাসেন, আবার কেউ অত্যন্তই নীরস লোক। অনেকে হয়তো রামগরুড়ের ছানা কিন্তু রস আস্বাদনের সুযোগ এলে তারাও পিছিয়ে যান না। কেউ খাজুরাহোর চিত্রকলা দেখে বাহবা দেন, আবার কেউ বা বলেন অশ্লীল। নির্ভেজাল খেজুরের রস যাঁরা খেয়েছেন তাঁরা জানেন রস কত সুস্বাদু। মনে আছে গ্রামে একবার চোরের উপদ্রব থেকে বাঁচার জন্য পালাকরে রাত্রে পাহারা দিতাম। খেজুরের রসের মোহ ত্যাগ করতে না পেরে পাড়ার রবীণ দা ফুঁটো হাড়ি বা রসে উপচে পরা হাড়ির নীচে মুখ হাঁ করে দাঁড়িয়ে যেত রস আস্বাদনে। একদিন একবন্ধু ইটমেরে হাড়ি ভেঙে ফেলাতে রবীণদার রসস্নাত অভিজ্ঞতা আজও ভোলার নয়। অবশ্য একটু বেলা হলেই রস তাড়িতে পরিনত হয়ে যায় এবং খেলে নেশা হয়। যাঁরা তাড়ি খেয়েছেন, তাদের কাছে রসের থেকে তারি বেশী সুস্বাদু। আবার রস থেকেই গুড় বা চিনি তৈরি হয়। বাউল গানে দেখা যায় বাউলেরা রস সাগরে ডোবার জন্য ব্যাকুল, তবে সে শুধু মাত্র গানের মাধ্যমে নয়। যারা কেন্দুলীর বাউল মেলায় গেছেন বা শান্তিনিকেতনের পৌষমেলায় গেছেন তারা সচক্ষে দেখে থাকবেন। এ রস সে রস নয়। এ যেন রসের কড়াই-এ রসগোল্লার ডুবে যাওয়ার অনুভূতি। এককথায় রসে হাবুডুবু খাওয়া। এ মধুর অভিজ্ঞতা অনেক কবি, সাহিত্যিক ও বাউলদেরই হয়ে থাকবে।
বহুলোক আছেন যারা সারারাত রসাল গল্প বলে সময় কাটিয়ে দিতে পারেন, আবার কেউ বা গল্পের রস আস্বাদন করেই সুখলাভ করেন। আমাদের অমলদাকে দেখেছি রসালো কথা বলে সকলের মন কেড়ে নেতে পারেন। আজকাল কিছু লোক Whatsapp, SMS , Email বা Chat এর মাধ্যমেও রস গ্রহণ করে থাকেন। রস গ্রহণে যা স্বাদ তা কলিকালে বহুলোকই জানেন। রস যে আজকাল খুব প্রিয় হয়ে উঠছে তা টি. ভি. চ্যানেলের অনুষ্ঠানগুলো ও সিনেমা দেখলেই বোঝা যায়। কোথাও শ্লীল রস আবার কোথাও অশ্লীল রস দেখানো হচ্ছে।
সত্যি কথা বলতে কি আজকাল কেউই আর নীরস জিনিস ভালবাসে না। অথচ রসময় কিছু করতে গেলেই চারিদিকে অনেকেই চিৎকার তোলেন, ‘ধরণী রসাতলে গেল’। রসিয়ে রসিয়ে দু’দণ্ড প্রেমিকের সঙ্গে গল্প করলেই বর্ষীয়ান অভিভাবক বলবেন, ‘ছেলেটা রসাতলে গেল। ওকে দিয়ে আর কিছু হবে না’। অথচ একটা অদ্ভুত ব্যাপার দেখুন, আঙুর চিবিয়ে খেলে কেউ মাতাল বলে না, কিন্তু তালের রস খেলে বলে তাড়িখোর, আঙুরের রস রসিয়ে কসিয়ে বোতলজাত করে খেলে বলে মদখোর। কবিতায় কামরস ভরে পরিবেশন করলে রসজ্ঞ পণ্ডিতেরাও রসোত্তীর্ণ হয়ে বাহবা দেন, ছোটদের অনুপস্থিতিতে টি ভি তে ফ্যাশন চ্যানেল দেখেন কিন্তু বাস্তবে নারী সঙ্গ করলে কিংবা রমণী নিয়ে মত্ত হলে তাকে লম্পট বলতেও কেউ ছাড়েন না। অবশ্য আজকাল এমন আইনও নাকি পাশ হয়েছে, পরকীয়ার আনন্দ নিলেও কোনও দোষ হবে না। মধু খেতে হবে সন্তর্পণে ও সযত্নে। অনেকে বন্ধু মহলে গিয়ে পরনিন্দা, পরচর্চা করতেও পিছপা হন না। নারী সুধা পান করে কিংবা সুধাময়ীদের নিয়ে রঙ্গরসে মেতে উঠলেই পৃথিবীবাসী তেতে ওঠে।
এক কবি বলেছিলেন জীবনটা বিষবৃক্ষের মত। শুধুমাত্র দুটো কাজেই রস পাওয়া যায়। প্রথমত, কাব্যে অমৃতের রস আস্বাদন, দ্বিতীয়ত, ‘সঙ্গমে সুজনে সহ’ অর্থাৎ সুহৃদের সান্নিধ্য। মানুষ অমৃতের পুত্র। অমৃতের পুত্রেরা অমৃতের সন্ধান করবেই। অমৃত সুধার সন্ধান পেলে তারা তা আকণ্ঠ পান না করে ফেলে দেবে কেমন করে তা কি ভাবা যায়? সাগর মন্থন করে যে অমৃত উঠেছিল, অসুরের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে স্বর্গলোকের দেবতারা তা পান করার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। তাহলে মর্ত্যলোকে সুধাপান নিয়ে এত সমালোচনা কেন? কেউ বলে, জীবন ভোগ বিলাসের নয়, জীবনের মোক্ষলাভ পরিশ্রম ও ত্যাগ তিতিক্ষা ব্যতীত সম্ভব নয়। তাহলে তো কুলি মজুরদের পদাঙ্কই অনুসরণ করতে হয়। কারণ ওরাই সবচেয়ে বেশি কষ্ট করে, না খেয়ে বোঝা বহন করে সারা জীবন ত্যাগ তিতিক্ষা, বঞ্চনা ও বুভুক্ষায় থাকে। তাই অনেকেই একমত হবে যে কোনও নীরস ব্যক্তিই জীবনের মোক্ষলাভের জন্য ওই পথ নেবেন না। সে কারণেই হয়তো একজন বলেছিলেন, অতিরিক্ত ভোগেই ত্যাগ আসবে। যদিও কথাটা সত্যি কিনা পরখ করে কখনো দেখিনি।
তাহলে কি সকলেই রসাতলে যেতে চায়? রসের অতলে কি আছে? রস ছাড়া কি এই পৃথিবী মরুভূমি হয়ে যাবে? রস ছাড়া জগত সংসার অচল, সৃষ্টি অচল? উশর মরুভূমিতে শস্য ফলাতে হলে রস সিঞ্চনের প্রয়োজন। রসাল ভূমিতে হাল কর্ষণ করলেই কি তা শস্য শ্যামল হবে?
কে রসাতলে যেতে চায়? জগত সংসার রসাতলে গেল বলে কারও মাথা ব্যথা হবে কি? তাকে কি সর্বশ্রেষ্ঠ রসজ্ঞ ব্যক্তি বলা হবে নাকি তাকে নীরস ব্যক্তি বলা হবে? যুবকের বাহু বন্ধনে যুবতীকে দেখে কে আঁতকে ওঠে? অনেকেই নেশা করে আনন্দ পান। তবে সে নেশা কি ভাল না মন্দ? তবে এই মারণ নেশা যে ভাল নয় তা আমরা অনায়াসেই বলতে পারি। তবে কোনটা মরণ নেশা আর কোনটা মারণ নেশা সেটা কে বলে দেবে? আজকাল টি ভি বা খবরের কাগজ খুললেই দেখতে পাই নারী সঙ্গ লোভী কামুক, কাম চরিতার্থের জন্য জঘন্যতম অপরাধ করছে। এমনকি ধর্ষণ করে মেরে ফেলছে। কেউ বা নিজের রসের রসদ জোগানোর নেশায় কারও পেটে ছুরি ঢুকিয়ে দিচ্ছে। কেউবা রক্ত চোষার মত ব্যবসার নামে কিংবা ভিন্ন কায়দায় গরীবের রক্ত চুষে ফুলে ফেঁপে উঠছে এরাও রসের সন্ধানী। এদের রসাল জোঁক বললে ভাল শোনায় না, রক্ত চোষা জোঁক কথাটা এদের জন্য মানায় ভাল। এরা ড্রাকুলার মত ভয়ঙ্কর। এমন রসিকের সংখ্যাও দিনকে দিন বেড়ে যাচ্ছে। তবে বিজ্ঞজনেরা কিন্তু বলেন জীবন রসের কথা।
জীবন রসের সন্ধান পেয়েছেন এমন রসিক ব্যক্তি নাকি হাতে গোনা যায়। তাদের মতে চিত্ত-বিত্ত-জীবন-যৌবন সবই ক্ষণস্থায়ী। শুধু যশ গৌরব চিরজীবী। তাই তাঁরা জীবনের গৌরব ও যশের জন্য পঞ্চ ইন্দ্রিয়কে বশ করেছেন। একটা কথা মনে রাখতে হবে রসের সন্ধান করতে করতে রসের অতলে যাওয়া যাবে না। অল্প সুরায় কেউ অসুর হয় না। কিন্তু রস পান করতে গিয়ে রসের পাত্রে ডুবে গেলে সে যে রসাতলে গেল তা তো বলতেই হবে। পিঁপড়ে যেমন মধু খেতে গিয়ে মধুর পাত্রে ডুবে যায়, সেরকম সুধা পান করতে গিয়ে সুধার পাত্রে ডুবে যাওয়া চলবে না। অনেকটা ‘আমার যেমন বেণী তেমনি রবে চুল ভেজাবো না’- র মত। ডুবে ডুবে জল খাব কিন্তু জলে ডুবব না। সুরের খাদ্যে নাকি নরের ক্ষুধা মেটে না। কাজেই দেহ সুধা, রূপ সুধা, দ্রাক্ষা সুধা ইত্যাদি পানেই পরিমিতি বোধ থাকতে হবে। নয়তো অমিয় সাগরে স্নান করতে গিয়ে চোরাবালিতে ডুবে মরতে হবে। লোকেরা মুখ টিপে হাসবে আর বলবে, ‘বেচারা রসাতলে গেল’। সেখান থেকে ফেরার আর কোনও পথ থাকবেনা। আর সেই সাথে এই পৃথিবীও রসাতলে যাবে।
সমাপ্ত
লেখক পরিচিতি –
কালীপদ চক্রবর্ত্তী দিল্লি থেকে প্রায় ১৮ বছর ‘মাতৃমন্দির সংবাদ’ নামে একটি
পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন এবং ‘সৃষ্টি সাহিত্য আসর’ পরিচালনা করেছেন।
দিল্লি, কলকাতা এবং ভারতবর্ষের
বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখেন। কলকাতার আনন্দমেলা, আনন্দবাজার
পত্রিকা, সাপ্তাহিক বর্তমান, দৈনিক
বর্তমান, নবকল্লোল, শুকতারা, শিলাদিত্য, সুখবর, গৃহশোভা,
কিশোর ভারতী, চিরসবুজ লেখা (শিশু কিশোর
আকাদেমী, পশ্চিমবঙ্গ সরকার), সন্দেশ,
প্রসাদ, ছোটদের প্রসাদ, কলেজস্ট্রীট, উল্টোরথ, তথ্যকেন্দ্র, জাগ্রত বিবেক (দক্ষিণেশ্বর কালীমন্দির
থেকে প্রকাশিত) , স্টেটসম্যান , কিশোর
বার্তা অন্যান্য বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখা প্রকাশিত হয়। তাঁর প্রকাশিত বই-এর
সংখ্যা ১০ টি এবং প্রকাশের পথে ৩টি বই।
‘ভারত বাংলাদেশ সাহিত্য সংহতি সম্মান’, পূর্বোত্তর আকাদেমির পুরস্কার, ‘বরুণা অসি’-র গল্প
প্রতিযোগিতায় পুরস্কার লাভ, আরত্রিক সম্মান, তুষকুটি পত্রিকা সম্মান, কাশীরাম দাস সম্মান,
সতীনাথ ভাদুড়ী সম্মান লাভ করেন। ২০২২ সালে আন্তর্জাতিক সাহিত্য উৎসবে 'আজীবন সম্মাননা' লাভ করেন। এ ছাড়া আরও কিছু পুরস্কার লাভ করেছেন।
বর্তমানে দিল্লি থেকে প্রকাশিত 'কলমের সাত রঙ' ও www.tatkhanik.com এর সম্পাদক এবং দিল্লিতে
প্রতিমাসে একটি সাহিত্য সভা পরিচালনা করেন।