Advt

Advt

natun-bachhar-short-story-galpo-by-nandita-saha-tatkhanik-digital-bengali-web-bangla-online-e-magazine-নতুন-বছর-নন্দিতা-সাহা

natun-bachhar-short-story-galpo-by-nandita-saha-tatkhanik-digital-bengali-web-bangla-online-e-magazine-নতুন-বছর-নন্দিতা-সাহা

জানুয়ারির ১ তারিখ। নতুন বছর। এই নতুন বছরের  ঠিক আগের এক সপ্তাহ থাকতো ঘটনার ঘনঘটা।  ডিসেম্বরের কুড়ি তারিখ থেকেই বুকের ভেতর ঢিপ ঢিপ কারণ ফাইনাল পরীক্ষার রেজাল্ট।  ২১ কিংবা ২২ তারিখে বেরহতো প্রতিবছর।  আর ওই ভয়ংকর  দিনটিতেই আমাদের বাড়িতে হতো মহা ভোজ। বাবা-মার বুক ভরা বিশ্বাস ছেলে মেয়ে ভালো রেজাল্টই করবে, মাথা উঁচু করেই তারা বাড়ি আসবে,কোন সন্দেহ নেই।  তাই আগের দিন রাতেই  একে একে সব সরঞ্জাম এসে পড়তো। কাজু, গোবিন্দভোগ চাল,ঘি,কিসমিস এবং যাবতীয় সব কিছু। মেনুতে থাকত পোলাও,মাংস,বেগুনি,ভাজা মাছ ভাজা,চাটনি। ওই একটি দিনই নিয়ম করে পোলাও হত।

রেজাল্টের দিন সাত সকাল থেকেই মা শুরু করে দিত আয়োজন। আমরা ভাই-বোন মানা করতাম,আরে দাঁড়াও আগে রেজাল্টটা তো হাতে পাই।  কে শোনে কার কথা! মা হাসি হাসি মুখে তার কাজ শুরু করে দিত।

এ প্রসঙ্গে আরও একটি ঘটনা মনে পড়ে গেল। আমাদের পাড়া থেকে আমরা তিন বন্ধু একই স্কুলে একই ক্লাসে পড়তাম। কেবল আমাদের সেকশন আলাদা ছিল,আমি আর বুই ছিলাম এ সেকশনে,লিলি ছিল সি সেকশনে। রেজাল্টের দিন আমি আর বুই ঝুড়ি ঝুড়ি নম্বর নিয়ে হাসতে হাসতে ক্লাস থেকে বের হতাম। তারপর সি সেকশনের দরজার কাছে গিয়ে অপেক্ষা করতাম।  আমরা দরজায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতাম বড়দি  সবার হাতে রেজাল্ট তুলে দিচ্ছেন।

আমি বুই হা করে অপেক্ষা করতাম কখন লিলির ডাক পড়বে।  একবার হঠাৎ বুই আমায় ডেকে একটু আড়ালে নিয়ে গেল, বলল, -

"এই, শোন । লিলির  কিন্তু বছর বছর ফেল করার বদ অভ্যাস আছে,ও কিন্তু সব ক্লাসে দুবার করে থাকে। এই ক্লাসে কিন্তু এবার প্রথম। মানে ও ফেল করবেই করবে,এতে কোন সন্দেহ নেই। তখন চিল্লিয়ে চিল্লিয়ে কাঁদতে কাঁদতে আমাদের সাথে বাড়ি যাবে। সবাই ভাববে  আমরাও ফেলটু। তাছাড়া রাস্তায় অজ্ঞান-টঙ্গান হয়ে যেতে পারে,তখন বড় ফ্যাচাং।  বরং চল আমরা চলে যাই।"

 ঠিক। ঠিকই বলেছে বুই। একবার  লিলিকে ফেল করার পর টেনে  হিঁচড়ে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছিলাম। ওসব বড় ঝামেলার। চল চল  কেটে পড়ি। পড়ি কি মরি  করে আমরা দুই বন্ধুতে স্কুলের মেন গেটের বাইরে এসে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। এবার আমরা  লিলির  নাগালের বাইরে।

 

পরদিন সাত সকালেই পাড়ার খবর বাড়ি ফেরেনি  লিলি। ওর বাড়ির লোকেরা হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে । মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। লিলিটাও আত্মহত্যা করল! ছি ছি! কি করলাম  আমরা! অপেক্ষা করলে তো এমনটা হতে পারত না! চোখ দিয়ে আমার জলের ধারা। সেই সময় প্রতিবছরই  রেজাল্ট বেরনোর পর এমন একটা দুটো হত,কেউ ট্রেনে ঝাঁপ,পুকুরে ঝাঁপ, গলায় দড়ি। আমাদের লিলিও তাদের দলে নাম লেখালো!  বুইও অঝোরে  কেঁদে  যাচ্ছে। খুবই খারাপ লাগছে। আমার মা তো চুলের মুঠি ধরে এই মারে কি সেই মারে,কেন একা রেখে এলি? দেখ কি সর্বনাশ হলো। অপরাধ-বোধ দুই বন্ধুকে কুরে কুরে খাচ্ছে, কি করে মুখ দেখাবো পাড়ায়, স্কুলেই বা কি জবাব দেব!

দুইদিন পর অবশ্য হদিস পাওয়া গেল। শুনে অনেকেই বলল,যাক বাপ-মাকে মুক্তি দিল, নিজেও মুক্তি পেল। নইলে ওপরে  ওপরে  যতই দেখাক আসলে ওর সৎ মা বড্ড কথায় কথায় কষ্ট দিত। মেয়েটা বাঁচল।

ওদেরই বন্ধু জবা, লিলিদের বাড়ীর  পেছনের পুকুরে স্নান করতে গিয়েছিল, তখনই দেখেছে। 

খবর পেয়ে বুই ছুটে এল আমার বাড়ি, চল চল আজই যাব ওদের বাড়িতে। ছুটলাম দুজনেই। তখন অত কলিং বেল ছিল না,বাঁশের গেট খুলে দরজায় কড়া নাড়লাম। হাসতে হাসতে বেরোলো লিলি,কপালে এক খাবলা সিঁদুর,পরণে লাল টুকটুকে ছাপা শাড়ি। বলল, ঠিকই  ছিল রে, বাবুয়াদাকে বলাই ছিল এবার ফেল করলে ও মুখো হবো না। পড়াশোনা করে আমার  কিস্সু হবে না। বরং  সংসার করাটাই আমার  জন্য  ঠিক। সব ক্লাসে ফেল করে বয়সটাই বাড়ছে। বাবুয়াদা মন্দ কি বল, মুদিখানার দোকানে ভালো  রোজগার, ছেলেটাও ভালো। এতেই আমি খুশি,দিব্যি থাকবো। এই পরীক্ষায় কিন্তু ভালো ভাবেই  পাশ করলাম রে, একেবারে ফাস্ট,তোদের সবাইকে টপকে।

কোন কোন বছর রেজাল্ট নিয়েই মামার বাড়ি যেতাম।  দু'ঘণ্টা লোকাল ট্রেনে চেপে তারপর মামার বাড়ি। আমার মামার বাড়ি ছিল লোক থৈ থৈ। খান কতক মামা-মামী দিদি,ভাই-বোনেরা,বাড়ি একেবারে গমগম করত। পেল্লাই মামা বাড়ির পেল্লাই ছাদ।  সেই ছাদে বসে দিনের বেলায় রোদ পোহানো। এমনিতে সেই সময় নতুন বছর নিয়ে তেমন একটা মাতামাতি ছিল না। রাতে  এলাকায় চুপচাপ। তখন তো এল ই ডি,কৃত্রিম  ক্রিসমাস ট্রি, টুপি পরা পুতুল স্যান্টা মধ্যবিত্ত এলাকায় তেমন একটা  পাওয়া যেত  না, তাই আড়ম্বর ও ছিল না। কেবল বাজার ঘাটে দেখা হলে, "নতুন বছর তো এসে গেল, "ব্যাস এটুকুই।

৩১শে ডিসেম্বরও কিন্তু সারা পাড়া ডিসেম্বরের শীতের রাত দশটায় একেবারে ঘুমে কাদা। কেবল আমি আর ছোড়দি ডিম লাইট জ্বালিয়ে বসে থাকতাম। ছোড়দি  আমার থেকে দশ বছরের বড় হলেও  আমার প্রিয়, আমার বন্ধু। নতুন বছর নিয়ে ছোড়দির ছিল দারুণ উত্তেজনা, আমাকে বসিয়ে রাখতো রাত বারোটা পর্যন্ত। বলতো নতুন বছরে কত কি হবে!  আমি বলতাম কিছুই তো হয় না রে ছোড়দি,খালি পুজোয় নতুন জামা,নতুন ক্লাসে ওঠা। ছোড়দি হেসে কুটি কুটি হত। তখন নিস্তব্ধতার মধ্যেই নতুন  বছরের পদার্পণ  মনেপ্রাণে অনুভব করতাম। ছোড়দি কে বলতাম,

--কি করে বুঝবো রে নতুন বছর শুরু হল?

-- ওই যে,কান খাড়া করে থাক। জেটি থেকে সব জাহাজ একসাথে সাইরেন বাজাবে। বুঝবি নতুন বছর শুরু হল।

ঘুমে ঢুলু ঢুলু চোখে কান খাড়া করে থাকতে থাকতে সাইরেন বেজে উঠত। ছোড়দি আমাকে জড়িয়ে ধরত, বলতো ওই যে নতুন বছর।  তোর জীবনে এমন ৯২ টা নতুন বছর  আসবে রে।

--তুই কি করে জানলি?

-- জানলাম আবার কি? আমি ভগবানের কাছে চাইলাম।

--তোর জীবনে কটা আসবে রে ছোড় দি? নতুন বছর?

--আমি কি জানি, তুই বল।

ছোট হবার আহ্লাদে আমি সব  সময় বেশি টাই পেতাম। আমি যদি দুটো পেতাম ছোড়দি একটা, আমি যদি চারটে খেতাম ছোড়দি  দুটো। এই হিসাবটা আমার মাথায় পাকা হয়ে থাকতো। ছোড়দিকে কিছুতেই বেশি দিতাম না,দেব না। সেই হিসেবটা বজায় রাখতে হবে। তাই শূন্যটা বাদ দিলাম। বললাম,"নয়টা বছর, নয়টা নতুন বছর। "

ছোড়দি কিছুক্ষণ হা করে তাকিয়ে রইল। ধুস তুই একটা পাগলি, বুদ্ধিশুদ্ধি নেই,বলে জড়িয়ে  ধরে  সদ্য নতুন বছরে ঘুম লাগালো।

আমার কথা অক্ষরে অক্ষরে ফলে  গেল। বড় অকালে চলে গেল আমার ছোড়দি। আফসোস যদি আমিও বলতাম ৯০ তবে হয়তো আজও দুই বোন একসাথে নতুন একটি বছর  দেখতে পেতাম।

মামা বাড়ি থেকে ফিরে পরদিন নতুন ইউনিফর্ম পড়ে নতুন ব্যাগ বই নিয়ে নতুন ক্লাসে নতুন বছর স্কুলে  পৌঁছতাম নতুন আশা নতুন প্রত্যাশা নতুন স্বপ্ন নতুন লক্ষ্য  নিয়ে।

 লেখিকার অন্যান্য লেখা পড়তে এখানে ক্লিক করুন । 

লেখিকার পরিচিতি -

জন্ম পশ্চিমবঙ্গ-র কুচবিহার শহরে। ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর। প্রথম কবিতার বই ' সুখের ঠিকানা', গল্প সংকলন 'চিরন্তন'। ইংরেজি কবিতার বই  'Bouuet of Poems'  বিভিন্ন পত্রিকায় লেখেন। বেশকিছু কিশোর সংকলনে গল্প প্রকাশিত হয়েছে। 

স্টেটস্‌ম্যান, সুখবর, সকালবেলা ইত্যাদি খবরের কাগজে গল্প প্রকাশিত হয়েছে।  দেশ,  সানন্দা, প্রসাদ, সারথি পত্রিকায় গল্প, কবিতা ও প্রবন্ধ লেখেন। 'Times of India'-তে বেশ কয়েকবার কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। কবিতা দিয়ে সাহিত্য জীবনের শুরু।বর্তমানে কিশোর ও প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য গল্প লিখতেই বেশি ভাল বাসেন ।  বহু e magazine এ লেখেন ।  

natun-bachhar-short-story-galpo-by-nandita-saha-tatkhanik-digital-bengali-web-bangla-online-e-magazine-নতুন-বছর-নন্দিতা-সাহা