পাখি দেখা
ও পাখিদের ছবি তোলা অনেক মানুষেরই শখ। স্পেনের বাসিন্দা টম গুলিক ২০১২ সাল পর্যন্ত
একাই প্রায় সাত হাজার পাখি নথিভুক্ত করেছিলেন। জানা আমাদের এই পৃথিবীতে
দশ হাজারেরও কিছু বেশি প্রজাতির পাখি আছে বলে জানা যায়,
এবং মোট পাখির সংখ্যা প্রায় দু’শো থেকে ছ’শো বিলিয়ন
হবে। এর মধ্যে ভারতেই আছে প্রায়
এক হাজার দুশো পঞ্চাশ প্রজাতির পাখি। পশ্চিমবঙ্গে প্রায় সাতশো
প্রজাতির পাখি রয়েছে। ভারতে কাক ও বুলবুলের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি
হলেও বিশ্বের বন্য পাখিদের মধ্যে 'কুইলিয়া'-র সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। পশ্চিমবঙ্গে
জলের পাখি,মাঠের পাখি এবং বনের পাখি ছাড়াও
বেশ কিছু পরিযায়ী পাখিও দেখা যায়।
প্রথমেই তিলে ঘুঘু বা ঘুঘু পাখি নিয়ে আলোচনা করা যাক।
তিলে ঘুঘু (Spotted
Dove)
তোমরা এই তিলে ঘুঘু পাখিকে মাঠে চাষের জমিতে, এমনকী ঘরের বারান্দাতেও খাবারের
খোঁজে হেঁটে বেড়াতে দেখতে পাবে। এরা একটু ভয় পেলেই শব্দ করে ডানা ঝাপটিয়ে উড়ে যায় । এদের ওড়ার সময়
লেজের প্রান্তে সাদা মোটা দাগ দেখে খুব সহজেই এই পাখিটিকে চিনে ফেলা যায়। সাধারণত
শষ্য,বীজ খেতে পছন্দ করে,তবে প্রয়োজনে
পোকাও খেতে দেখা যায়। এদের গলার ওপর দিকে সাদা দাগযুক্ত
অর্ধেক গলাবন্ধনী থাকে,যা থকেও এই বিশেষ ঘুঘু পাখিটিকে চেনা
যেতে পারে। এদের ডানা গাঢ় ধূসর রঙের। চোখ অনেক ক্ষেত্রেই লাল,
বুকের অংশে গোলাপি আভা দেখা যায় এবং পায়ের রং গাঢ় গোলাপি। এরা সারা
বছর প্রজননে সক্ষম হলেও,গ্রীষ্মকাল এদের বিশেষ পছন্দের।
গাছের অধিক পাতাযুক্ত ডাল,ঝোপ সদৃশ্য অংশ,টেলিফোনের বা ইলেকট্রিকের স্তম্ভ,এমনকী ঘরের বিম ও
বাড়ির ফাঁটা অংশের মধ্যেও বাসা তৈরি করতে পারে। প্রায়ই দেখতে পাওয়া এই পাখিটি
কিন্তু এদের অস্তিত্ব এখন বিপদের মুখে।
অনেকে এই পাখিটিকে পোষার
জন্য বা বিক্রি করার জন্য এদের ধরে। কৃষি জমিতে খুব বেশি পরিমাণে কীটনাশক ও আগাছানাশক ব্যবহারের ফলে এদের বিপদ অনেকগুন বেড়ে গিয়েছে। কারণ,এরা খোলা জমিতে খাবার সংগ্রহ
করে। এছাড়া কিছু কিছু মানুষ এদের খাদ্য হিসেবেও ব্যবহার করে থাকে। দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলোতে এই পাখিটির আদি
বাসস্থান। তবে অস্ট্রেলিয়া,পাপুয়া নিউগিনিয়াতেও চোখে পড়ে এই
তিলে ঘুঘু।
এবার আসি অতি পরিচিত পাখি পায়রার কথায়।
তোমরা অনেকে শুনলেই অবাক হবে যে পাখিদের মধ্যে পায়রা হল সবচেয়ে বেশি বুদ্ধিমান। তারা 'আয়না
পরীক্ষা' পাস করতে পারে। 'আয়না পরীক্ষা'হল,নিজেকে চেনার পরীক্ষা। আর এই ক্ষমতা পায়রার আছে।
এছাড়াও তারা ছবি দেখে মানুষ চিনতে পারে ও ছবি দেখে সহজেই দুটো মানুষের মধ্যে
পার্থক্য বুঝতে পারে। রাস্তাঘাটের পরিচিতিও এদের মধ্যে সাংঘাতিক রকমে বর্তমান।
প্রমাণ বলে,এরা নাকি পাঁচ মাথার মোড়ে
এসেও বুঝতে পারে, কোন দিকে কোন গন্তব্য আছে। ১৩০০ মাইল দূর
থেকেও অব্যর্থভাবে বাসা খুঁজে ফিরে আসে। সম্ভবত পায়রাই সেই পাখি,যে প্রথম মানুষের পোষ্য হয়েছিল। যিশুর জন্মের বহু পূর্বেই পায়রার সঙ্গে
মানষের সহাবস্থানের ছবি পাওয়া যায়।
পায়রা ছিল
চার্লস ডারউইনের বিশেষ পছন্দের পাখি। এতটাই পছন্দের যে,তার একটি বইতে দুটো অধ্যায়ের গোটাটা পায়রা নিয়ে লেখা। যেখানে বিড়াল ও
কুকুর নিয়ে মাত্র একটি অধ্যায়। নিকোলাস টেসলা,আইনস্টাইন যাকে
মনে করতেন 'স্মার্ট, তারও বিশেষ
ভালোবাসা ছিল একটি সাদা পায়রার ওপর। এই পাখিটির গাঢ় নীল রঙের মাথা,গলা বুক ও ডানার রং হলদে, সবজে ও গোলাপি মিশিয়ে।
চোখের বর্ণ লাল এবং পায়ের রং লালচে। ঠোঁটের রং ধূসর-কালো। বছরের যে কোনও সময়
প্রজনন করতে পারে এবং দুটো সাদা রঙের ডিম পাড়ে। বর্তমানে মানুষের জীবনের সঙ্গে
মিলে যাওয়ার জন্য এরা শষ্য,বীজ ছাড়াও অন্যান্য সমস্ত খাবার
খেতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। পায়রাকে এক সময় সংবাদ বাহক হিসেবেও ব্যবহার করা হতো।
ইতিহাস থেকে জানা যায় পায়রাকে যুদ্ধ ক্ষেত্রে সংবাদ আদান-প্রদান করার জন্যও ব্যবহার
কর হয়েছিল।
তোমরা হরিয়াল-এর নাম তো শুনেছো। এরাও এক
ধরণের পায়রাই বলতে পারো।
মহারাষ্ট্রর
রাজ্য-পাখি হল এই হরিয়াল। মারাঠি ভাষায় এই পাখিটিকে হরিয়াল বলা হয়। লাল চোখ,সাদা রঙের ঠোঁট এবং মাথায় রং নীলচে বর্ণের। বুক এবং গলার অংশ হলদে রঙের। নিচের দিকটা ধূসর-সবুজ বর্ণের ও হলুদ রঙের পা।
পাখিটিকে বাংলায় সবুজ পায়রাও বলা হয়। আমাদের দেশ ছাড়াও
বাংলাদেশ,পাকিস্তান,নেপাল,ভুটান এমনকী চিনেও এই পাখি দেখতে পাওয়া যায়। এরা সাধারণত
বনাঞ্চলে থাকতে পছন্দ করলেও,বর্তমানে এদের লোকালয় সংলগ্ন
গাছেও বাসা তৈরি করতে দেখা যায়। গাছের পাকা ফল এদের খুব পছন্দের খাবার। গুচ্ছাকারে
যে সমস্ত ফল থাকে,সেই সমস্ত ফল এরা খেয়ে থাকে। গ্রীষ্মকালে
মার্চ থেকে মে মাস এদের প্রজননের সময়। গাছের ডালের মধ্যে বাসা বাঁধে এরা বিভিন্ন
উদ্ভিদজাত উপকরণ দিয়েই। এবং সাধারণত মে-জুন মাসে সেই বাসায় ২টি সাদা ডিম পাড়ে। একই
জায়গায় থাকতে পছন্দ করে। যদিও প্রজননের ঠিক পরেই এদের স্থান পরিবর্তন করা এদের
স্বভাব।
বাচ্চা পাখিরা উড়তে শেখার পরই বাসা ছেড়ে কাছের কোনও জায়গায় থাকতে শুরু করে। মিলনের পূর্বে পায়রার মতো গলায় অংশ ফুলিয়ে, ডানা নামিয়ে, মাথা ওপর-নীচ করে অল্প আওয়াজ করতে করতে
একডাল থেকে অন্য ডালে যায় এবং স্ত্রী পাখিটিকে আকর্ষণ করার চেষ্টা করে। এই পাখিটি
ভারতীয় বন্যপ্রাণ আইন (১৯৭২) অনুযায়ী 'সিডিউল চার' প্রাণী। দেখা গেছে মোটামুটি পায়রার আকারের এই
প্রাণীর ওজন ২৫০ গ্রাম হয়।
লেখকের অন্যান্য লেখা পড়তে এখানে ক্লিক করুন ।
লেখক পরিচিতি –
কালীপদ চক্রবর্ত্তী দিল্লি থেকে প্রায় ১৮ বছর ‘মাতৃমন্দির সংবাদ’ নামে একটি
পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন এবং ‘সৃষ্টি সাহিত্য আসর’ পরিচালনা করেছেন।
দিল্লি, কলকাতা এবং ভারতবর্ষের
বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখেন। কলকাতার আনন্দমেলা, আনন্দবাজার
পত্রিকা, সাপ্তাহিক বর্তমান, দৈনিক
বর্তমান, নবকল্লোল, শুকতারা, শিলাদিত্য, সুখবর, গৃহশোভা,
কিশোর ভারতী, চিরসবুজ লেখা (শিশু কিশোর
আকাদেমী, পশ্চিমবঙ্গ সরকার), সন্দেশ,
প্রসাদ, ছোটদের প্রসাদ, কলেজস্ট্রীট, উল্টোরথ, তথ্যকেন্দ্র, জাগ্রত বিবেক (দক্ষিণেশ্বর কালীমন্দির
থেকে প্রকাশিত) , স্টেটসম্যান , কিশোর
বার্তা অন্যান্য বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখা প্রকাশিত হয়। তাঁর প্রকাশিত বই-এর
সংখ্যা ১০ টি এবং প্রকাশের পথে ৩টি বই।
‘ভারত বাংলাদেশ সাহিত্য সংহতি সম্মান’, পূর্বোত্তর আকাদেমির পুরস্কার, ‘বরুণা অসি’-র গল্প
প্রতিযোগিতায় পুরস্কার লাভ, আরত্রিক সম্মান, তুষকুটি পত্রিকা সম্মান, কাশীরাম দাস সম্মান,
সতীনাথ ভাদুড়ী সম্মান লাভ করেন। ২০২২ সালে আন্তর্জাতিক সাহিত্য উৎসবে 'আজীবন সম্মাননা' লাভ করেন। এ ছাড়া আরও কিছু পুরস্কার লাভ করেছেন।
বর্তমানে দিল্লি থেকে প্রকাশিত 'কলমের সাত রঙ' ও www.tatkhanik.com এর সম্পাদক এবং দিল্লিতে
প্রতিমাসে একটি সাহিত্য সভা পরিচালনা করেন।