অন্নদাশঙ্কর রায় চতুর্মাত্রিক প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। তিনি একদিকে যেমন কবি, কথাসাহিত্যিক,ভ্রমণ লেখক ও প্রাবন্ধিক তেমনি সর্বোপরি একজন সচেতন ও বিবেকবান চিন্তাবিদ। তিনি ১৫ই মে ১৯০৪ সালে ঢেঙ্কাকানলে,ওড়িশার একটি প্রবাসী বাঙালি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা নিমাই রায় ছিলেন ঢেঙ্কাকানলেরই একজন রাজকর্মচারী। ১৯২৫ সালে তিনি ইংরেজি সাহিত্যে এম. এ অনার্সে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হন। ১৯২৬ সালের আইসিএস পরীক্ষায় রেকর্ড নম্বর নিয়ে প্রথম হন এবং প্রশিক্ষণের জন্য বিলেতে যান। ১৯২৭ সাল থেকে ১৯২৯ সাল পর্যন্ত তিনি লন্ডনের বিভিন্ন কলেজে পড়াশোনা করেছেন।
১৯৩৬ সালে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হন। তিনি ১৯৪০ সালে বিচারক পদ থেকে এবং ১৯৫০ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিচার বিভাগের সচিব পদ থেকে সেচ্ছা অবসর নেন।
তিনি
ছিলেন একজন পূর্ণকালীন লেখক হওয়ার উচ্চাকাঙ্ক্ষী,তাই কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনে সাহিত্য সাধনায় নিয়োজিত করেন
এবং পরে কলকাতায় চলে আসেন।
চাকরি সূত্রে ফরিদপুর,কুষ্টিয়া,ময়মনসিংহ,রাজশাহীসহ বাংলাদেশের অনেক অঞ্চল দেখেছেন
তিনি। অন্নদাশঙ্কর রায় আজীবন স্বাধীনতা চিন্তার পক্ষে ছিলেন। তিনি মুক্তচিন্তার
পক্ষে অনেক তথ্য,তত্ত্ব ও যুক্তি দিয়ে অনেক প্রবন্ধ ও নিবন্ধ লিখেছেন। মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে বহু রচনা লিখেছেন। বাঙালি
অন্নদাশঙ্কর রায়ের প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা প্রায় দুইশত। তার মধ্যে মূল্যবান
প্রবন্ধের বইটির সংখ্যা প্রায় পঞ্চাশটি।
তাঁর প্রবন্ধগুলো একইসাথে সাহিত্য,সামাজিক,সমসাময়িক ও সময়োপযোগী ছিল। তার লেখার বিষয় ছিল অত্যন্ত সাহসী এবং মরমী। তার লেখায় বিভিন্ন বিষয়
নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তিনি হলেন শ্রেষ্ঠ প্রাবন্ধিকদের একজন।
তিনি মধ্যযুগ,আধুনিক যুগ,জনসংখ্যা এবং
হিন্দু ও মুসলমানদের কথাও লিখেছেন। রবীন্দ্রনাথ,বঙ্কিম,শরৎচন্দ্র,গ্যেটে, টলস্টয়, রমা রামলান,প্রমথ চৌধুরী, গান্ধী, কাজী
ওদুদ এবং আরও অনেকের কথা তাঁর লেখায় উল্লেখ করা হয়েছে। একদিকে প্রবন্ধ লিখেছেন,অন্যদিকে লিখেছেন অনেক উপন্যাস,গল্প,কবিতা ও ছড়া।
অন্নদাশঙ্কর রায় ১৯৮৯ সালে ভারতীয় সাহিত্য আকাদেমি থেকে সর্বোচ্চ সম্মানীয় ফেলোশিপ পেয়েছিলেন। রবীন্দ্র ভারতী এবং বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডি.লিট. পেয়েছেন। এছাড়াও তিনি দুইবার আনন্দ পুরস্কার,একবার বিদ্যাসাগর পুরস্কার পান। ভারত সরকারের কাছ থেকে পেয়েছেন পদ্মভূষণ উপাধি। তাঁর একটি লেখা থেকে জানা যায় যে টলস্টয়,গান্ধী, রবীন্দ্রনাথ,রোমারোলাঁ,প্রমথ চৌধুরী ছিলেন তাঁর সাহিত্য ও রাজনৈতিক গুরু। গান্ধীর সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। তারা কেউই সংকীর্ণ মনের মানুষ ছিলেন না। সবাই ছিল উদার ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার অধিকারী ব্যক্তিত্ব। নিছক শ্রম ও পরিশ্রম দিয়ে প্রতিভা অর্জন করা যায় না। কিন্তু জন্মগত বা সহজাত প্রতিভার আভাস যেহেতু পূর্ব-আনুমানিক এবং পরিচিত,তাই কঠোর পরিশ্রম ও প্রচেষ্টার মাধ্যমে প্রতিভাকে উপলব্ধি করতে হয়। এটি ব্যবহার করতে হবে। প্রকাশ করা অন্যথায় প্রতিভা অনুপলব্ধ এবং অপ্রকাশিত থেকে যায় এবং অপমৃত্যু হয়। তার স্ত্রী জার্মান হওয়া সত্ত্বেও তিনি প্রকৃত বাঙালি হিসেবে গড়ে উঠতে পেরেছিলেন।
সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন সমাজকল্যাণমূলক কাজে আত্মনিয়োগ করেন। দুজনেই ব্যক্তিগত জীবনে ধর্মনিরপেক্ষ ছিলেন। অন্নদাশঙ্কর রায়ের বাড়িতে হিন্দু,মুসলমান,খ্রিস্টান, বৌদ্ধদের আলাদা মর্যাদা ছিলনা। সাহিত্য সৃষ্টির প্রথম পর্বে অন্নদাশঙ্কর রায় ছিলেন একজন বুদ্ধিজীবী ও মননশীল লেখক। দ্বিতীয় পর্যায়ে প্রবন্ধ লেখক,হাস্যরস লেখক। এমনকি তৃতীয় পর্যায়ে এসেও,অন্নদাশঙ্কর শেষ পর্যন্ত একজন বুদ্ধিজীবী হলেও তার চেয়ে বেশি ছিলেন একজন হৃদয়বান মানুষ। অন্নদাশঙ্কর রায়ের সাহিত্য এই অর্থে বন্ধুসুলভ সমাজের রচনা। তিনি সত্যিকার অর্থে মুক্তি প্রজ্ঞার ধারক বাহক। তিনি আধুনিক বাংলা সাহিত্যের পাশাপাশি দক্ষিণ এশিয়ার সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটকে সমৃদ্ধ করেছেন। তাই প্রবোধ সেনের ভাষায়, অন্নদাশঙ্কর রায়ের প্রবন্ধ সংকলন বাংলা সাহিত্যের এক মূল্যবান সম্পদ। তাই আজও আমরা প্রগতিশীল চিন্তাবিদ হিসেবে অন্নদাশঙ্কর রায়কে আমাদের হৃদয়ের মণিকোঠায় রাখি।
২৮শে
অক্টোবর,২০০২ সালে চতুর্মাতিক প্রতিভার অধিকারী অন্নদাশঙ্কর রায়, কলকাতায় পরলোক গমন করেন।
লেখকের অন্যান্য লেখা পড়তে এখানে ক্লিক করুন
লেখক পরিচিতি –
কালীপদ চক্রবর্ত্তী দিল্লি থেকে প্রায় ১৮ বছর ‘মাতৃমন্দির সংবাদ’ নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন এবং ‘সৃষ্টি সাহিত্য আসর’ পরিচালনা করেছেন।
দিল্লি, কলকাতা এবং ভারতবর্ষের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখেন। কলকাতার আনন্দমেলা, আনন্দবাজার পত্রিকা, সাপ্তাহিক বর্তমান, দৈনিক বর্তমান, নবকল্লোল, শুকতারা, শিলাদিত্য, সুখবর, গৃহশোভা, কিশোর ভারতী, চিরসবুজ লেখা (শিশু কিশোর আকাদেমী, পশ্চিমবঙ্গ সরকার), সন্দেশ, প্রসাদ, ছোটদের প্রসাদ, কলেজস্ট্রীট, উল্টোরথ, তথ্যকেন্দ্র, জাগ্রত বিবেক (দক্ষিণেশ্বর কালীমন্দির থেকে প্রকাশিত) , স্টেটসম্যান , কিশোর বার্তা অন্যান্য বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখা প্রকাশিত হয়। তাঁর প্রকাশিত বই-এর সংখ্যা ৬ টি এবং প্রকাশের পথে ২টি বই।
‘ভারত বাংলাদেশ সাহিত্য সংহতি সম্মান’, পূর্বোত্তর আকাদেমির পুরস্কার, ‘বরুণা অসি’-র গল্প প্রতিযোগিতায় পুরস্কার লাভ, আরত্রিক সম্মান, তুষকুটি পত্রিকা সম্মান, কাশীরাম দাস সম্মান, সতীনাথ ভাদুড়ী সম্মান লাভ করেন। ২০২২ সালে আন্তর্জাতিক সাহিত্য উৎসবে 'আজীবন সম্মাননা' লাভ করেন। এ ছাড়া আরও কিছু পুরস্কার লাভ করেছেন।
বর্তমানে দিল্লি থেকে প্রকাশিত 'কলমের সাত রঙ' ও www.tatkhanik.com এর সম্পাদক এবং দিল্লিতে প্রতিমাসে একটি সাহিত্য সভা পরিচালনা করেন।