সূর্যের আলো নিভে গেছে। আমি দোতলা ঘরের গ্রিল বারান্দায় একটি বেতের চেয়ারে বসে আছি। দূর আকাশে স্থির দৃষ্টি। অস্পষ্ট কয়েকটি তারা দেখা যাচ্ছে। কেমন যেন নিষ্প্রভ ম্রিয়মান। ঘোর সন্ধ্যা। অন্ধকার আকাশ।
এখন অন্ধকারই প্রিয়
হয়ে উঠেছে। নিজেকে নিয়ে যত কম ভাবা যায় ততই মঙ্গল।একটা- দু'টো বাড়ি থেকে
শঙ্খধ্বনির আওয়াজ আসছে। তাতেই আন্দাজ করছি সবে সন্ধ্যে হল। সময়জ্ঞানও লোপ পেতে
চলেছে।আমি যে কী ভাবছি নিজের কাছেই স্পষ্ট নয়। এতবড় দোতলা বাড়িটাতে আমি একা। একাই
যাপন করছি মাসাধিক কাল। খাওয়া-দাওয়ার
সময়ের কোনও ঠিক ঠিকানা নেই। এক-একদিন স্নান-খাওয়া না করেই অফিস ছুটছি।
অফিসে সময়টা এক প্রকার যায়। যন্ত্রের মতো কাজ করি। তারপরেই মাথাটা কেমন হয়ে যায়।
রাস্তায় পা দিতেই যেন অজানা গহবরে ঢুকে গেছি। নতুন আস্তানা খুঁজি। যাবো
কোথায়? এতদিন যেখানে ছিলাম সেই বাড়িটার
প্রাণ নেই যে। হঠাৎ অপমৃত্যু ঘটে গেছে। গিয়ে কি লাভ ! মৃত বাড়ির সঙ্গে কতদিন সহবাস করা যায়? দেড় মাস
আগেও বাড়িটা কেমন গমগম করত। প্রাণ
প্রাচুর্যে ভরপুর ছিল। তখন ফেরার একটা তাগিদ ছিল। চুম্বকের মতো আকর্ষণ ছিল। কত
তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরবো।
বাবা
দু'বছর আগে চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন। সকাল বিকেল নিয়ম করে হাঁটতে বের হন। সন্ধেতে
ফিরে ফ্রেস হয়ে বসে থাকেন। সমু ফিরুক। একসঙ্গে
টিফিন করবো। অর্থাৎ আমার ফেরার অপেক্ষায় বসে থাকবেন। আদরের বোন ঈশিতা। সবে
এম.এস.সিতে ফার্স্ট ক্লাস পেয়ে পাশ করেছে। পিএইচডি করবে। সেও বলবে, দাদা ফিরুক না।
একসঙ্গে গল্প করতে করতে চা খাবো। ফলে
আমারও একটা নেশা ধরে গিয়েছিল। কখন এক সঙ্গে হবো। বাবা মা বোন পুরো পরিবারের সঙ্গে
এক টেবিলে বসে টিফিন করার আলাদা তৃপ্তি। শত কাজ থাকলেও অফিস ছুটির পর অন্য কোথাও
যাওয়ার কথা ভাবি না। আমার কাছে এই সময়টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। হঠাৎ যদি সেই
মানুষগুলো নেই হয়ে যায় তখন তার অবস্থা কেমন হতে পারে।
মাস
দেড়েক আগের ঘটনা। বোন বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটিতে হস্টেলে থেকে পিএইচডি করবে।
কনফার্মেশন লেটার পেয়ে গেছে। তাই বোনের ইচ্ছে যাওয়ার আগে সবাই মিলে কোথাও একটু
ঘুরে আসবে। ইয়ার এন্ডিং বলে অফিসে ভীষণ চাপ। ছুটি ম্যানেজ করা অসম্ভব। অগত্যা
আমাকে ছাড়াই দিঘা যাওয়া স্থির করল। বাবা,মা,বোন
বাড়ির গাড়ি নিয়েই গেল।
ঈশ্বর
বোধহয় বিরূপ ছিলেন। তিনি সম্ভবত চান নি, তড়িঘড়ি হুট করে বেরিয়ে পড়া। না হলে এমনটা
হবে কেন? যাওয়ার পথেই দুর্ঘটনা। এক লরির
সঙ্গে ধাক্কা লেগে সব শেষ। খবর পেয়ে স্পটে গিয়ে যা দেখলাম, বীভৎস ছবি। গাড়িটা দুমড়ে মুচড়ে তালগোল পাকিয়ে গেছে। মানুষগুলোকে চেনার
উপায় নেই। কী করে হয় আজও ভেবে কোনো কিনারা পাচ্ছি না। স্পটেই জ্ঞান হারাই। অফিস
কলিগ দু'জন ছিলেন। তারাই আমাকে হসপিটালে
ভর্তি করে দিল। জ্ঞান আসার পর থেকে সাতদিন নাকি শুধু প্রলাপ বকেছি। আমি নিজের
মধ্যেই ছিলাম না। থাকলে মনে করতে পারছি না কেন? শুধু কুন্ডলি পাকানো দেহগুলো চোখে
ভাসছে। শুনেছি বড় পাঞ্জাব লরি। কিন্তু কত স্পিডে চলছিল। এমনটা হয় কী করে ! সবটাই ধোঁয়াশা। পনেরদিন পর সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরলাম। বন্ধুরা জোর করে অফিস
নিয়ে যেতে লাগল। আমি সুস্থ না অসুস্থ বোধজ্ঞান নেই। এ'ভাবে বেঁচে থাকার অর্থ কী!
এক-একসময় মনে হয় বাবা-মায়ের কাছে ফিরে গেলেই বোধহয় শান্তি পাবো।
আজ
একটা কান্ড করে ফেলেছি। বিকৃত মস্তিস্ক হলে যা হয়। অফিস ফিরে পাড়াতে ঢুকতেই নীলার
সঙ্গে দেখা। নীলা বোনের বন্ধু। প্রায়ই আসতো আমাদের বাড়িতে। বোনের কাছে শুনেছি আমার
প্রতি নাকি নীলার দুর্বলতা আছে। বাবা-মায়েরও খুব পছন্দ। প্রস্তাব না দিলেও তড়িঘড়ি
বাবা বাড়িটাকে দোতলা বানিয়ে ফেললেন। আমার বিয়েটা সেরে ফেলতে চান। বড় বড় তিনটে
বেডরুম। লাগবে তো। মেয়ে-জামাইয়ের জন্য একটি ঘর করে রাখতে হবে তো। মেঝেতে মার্বেল
পাথর বসিয়ে রঙ-টং কমপ্লিট। বাবা-মা নীলাদের বাড়ি যাওয়ার কথাও আলোচনা করছিল। সব
তছনছ হয়ে গেল।
নীলাকে
অনেকদিন পর দেখে একটু ভরসা পেয়েছিলাম। ও পাশে থাকলে বেঁচে থাকার স্বার্থকতা খুঁজে
পাব। আগুপিছু না ভেবে হঠাৎ নীলার হাতটা চেপে ধরলাম। বললাম, নীলা আমি তোমাকে বিয়ে
করতে চাই। তোমাকে নিয়ে নতুন ভাবে বাঁচতে চাই। তুমি না করো না নীলা।
এরপর
নীলা যা করল আমার আর বেঁচে থাকার মানে হয় না। সত্যিই তো, বলা নেই কওয়া নেই এ'ভাবে
কেউ হাত চেপে ধরে ! উন্মাদ ছাড়া কি! নীলা বলল, একী করছেন সুমন দা? আপনি কি সত্যি
সত্যি পাগল হয়ে গেলেন? রাস্তায় দাঁড়িয়ে আপনি বিয়ের প্রস্তাব দিচ্ছেন?
বাবা-মা-বোনকে হারিয়ে খুব ফুর্তিতে আছেন মনে হচ্ছে। শোকতাপ এত তাড়াতাড়ি ভুলে
গেলেন? ছিছি আমি ভাবতেও পারছি না।"
আমি আর
এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থাকতে পারিনি। মাথা নিচু করে কোনোরকমে পালিয়ে বেঁচেছি। কিন্তু
এরপর মুখ দেখাবো কি করে? আমার কী করণীয়? সত্যিই তো বাবা-মা-বোনের এমন ভয়াবহ
মৃত্যুর পর পাগল না হলে কেউ কি এমন প্রস্তাব দেয় ! সুস্থ মানুষ কী বিয়ের কথা ভাবতে
পারে? ঠিকই বলেছে নীলা, আমি পাগল হয়ে গেছি।
দোতলা
থেকে নিচে নেমে এলাম। অন্ধকারের মধ্যেই বাবা-মায়ের ঘরে ঢুকলাম।
এই ঘর আমার জন্ম থেকেই চেনা। পা টিপে টিপে খাটে এসে বসলাম।
কেন বসলাম মনে করতে পারছি না। কেনই বা এলাম। এই ঘরে বাবা থাকেন, মা থাকেন। দু'দণ্ড বসলেও শান্তি। মায়ের স্পর্শ যেন টের পাচ্ছি। মা বেঁচে
থাকলে বোধহয় আমি পাগল হতাম না। পৃথিবীতে
মা-ই ছিল আমার শক্ত পিলার। যাকে আঁকড়ে সারা জীবন কাটিয়ে
দেওয়া যায়। হ্যাঁ মনে পড়েছে। ঘুমের ট্যাবলেট নিতেই আসা। এক সঙ্গে পঁচিশ-ত্রিশটা
ট্যাবলেট যদি খেয়ে নিই তবেই তো কেল্লা ফতে। গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়ার থেকে কষ্ট কম
হবে। সিদ্ধান্ত যখন নিয়ে ফেলেছি নড়চড় হবে না কিছুতেই। মানুষ যদি সুস্থ শরীরে
সম্মান নিয়ে থাকতে না পারে তার বেঁচে থাকার কোনও মানে নেই। সেতো মরে বেঁচে থাকা।
তার থেকে একেবারেই চলে যাওয়া সঙ্গত। বাবা নিয়মিত ঘুমের ট্যাবলেট খেতেন । সারা
মাসের এক সঙ্গেই আনা থাকে। সন্তর্পণে ওঠে গিয়ে দেওয়াল হাতড়াতে হাতড়াতে সুইচ বোর্ডে
হাত রাখলাম। লাইট অন করতেই উজ্জ্বল আলো
সারা ঘরময়। চোখ দুটো জ্বালা করছে। আলো কেন
সহ্য হয় না বুঝতে পারি না। অন্ধকারের জীব হয়ে যাচ্ছি কী ! জানি না পূর্ব জন্মের
পাপের ফল কিনা।
ড্রেসিং
টেবিলের একটি ড্রয়ারে বাবার ঔষধগুলো থাকে। একী ! মাত্র তিনটে ট্যাবলেট ! তাহলে কি
সঙ্গে করে নিয়ে গেছেন? আজ কত তারিখ। তবে কী শেষ হয়ে গিয়েছিল ? না না, তিনটে
ট্যাবলেট খেলে মানুষ মরবে না। বিকল্প ভাবতে হবে। খেয়ে না মরে অসুস্থ হলে মানুষকে
শুধু শুধু বিড়ম্বনায় ফেলা। সেটা আমি চাই না। অক্কা গেলে একবার ঝামেলা পোহাতে হত।
ল্যাটা চুকে যেত। বারবার মানুষকে বিরক্ত করা কে সহ্য করবে? কার অত সময় আছে !তাহলে?
যা চাইছিলাম না, সেটাই করতে হবে। উপায় কী! সিঁড়ির ঘরের নীচে কতগুলো নারকেলের দড়ি
রাখা থাকে জানি। আর সময় নষ্ট করতে চাই না। দ্রুত গেলাম। বাঃ অনেক দড়ি। লম্বা দেখে
একটি নিয়ে চলে এলাম। ডাইনিংয়ের সিলিংয়ে একটাতে ফ্যান আছে, আরেকটা হুক ফাঁকা।
এখানটাতেই মোক্ষম হবে। তার আগে ট্যাবলেট তিনটে জল নিয়ে খেয়ে নিলাম। ঘুমের ঘোর
থাকলে যন্ত্রণা একটু কম হতে পারে। খালি পেটেই খেলাম। ঔষধের দ্রুত কাজ হবে। অফিস
ক্যান্টিং থেকে রুটি তড়কা নিয়ে এসেছিলাম। খেলাম না। কি হবে আর খেয়ে। পরপারে গিয়ে
দেখা যাবে। একটু শান্ত হয়ে বসলাম। ভাবছি। কিছু কাজ বাকি রয়ে গেল কি? পৃথিবী থেকে
বিদায় নেওয়ার আগে কি কি ফর্মালিটি থাকে? মনে করতে পারছি না। এদিকে ঘুমে চোখ ছোট
হয়ে আসছে। দূর ! অত ভাবাভাবির কি আছে? আগে যাই তো, তারপর দেখা যাবে।
ডাইনিং
টেবিলটাকে একটু এগিয়ে এনে হুকের সঙ্গে শক্ত করে বেঁধে গলায় পেঁচিয়ে টেবিলটাকে
গায়ের জোরে পায়ে ঠেলে সরিয়ে ঝুলে পড়লাম। তারপর আর কিছু মনে নেই।
পরদিন
সকাল দশটা। দূর থেকে একটা ক্ষীণ আওয়াজ ভেসে আসছে। মৃত্যুর পরের, না আগের ঘটনা ঠিক
বোধগম্য হচ্ছে না। আওয়াজটা ক্রমশ জোরালো হচ্ছে। বুঝতে পারলাম আমার বাড়ির কলিং বেল
বেজে চলেছে। ঘন ঘন বাজছে। কে এমন করছে। কেউ তো আসার কথা নয়। প্রথমদিকে সপ্তাহ
খানেক অফিসের এক কলিগ নিয়ে যেত। আর তো আসার কথা নয়। গতকালের ঘটনাটা অনুধাবন করলাম।
নারকেলের দড়ি গলায় ঠিকঠাক লাগানো হয় নি। ফলে ধপাস করে মেঝেতে পড়েছি। হাতে কোমরে
অসম্ভব যন্ত্রণা। অর্থাৎ সম্পূর্ণ ব্যর্থ। গলায়ও অল্প অল্প ব্যথা আছে কি !কিন্তু
এই সময়ে কে এল! শরীরের যন্ত্রণা নিয়েই ডাইনিং টেবিলে ওঠে হুক থেকে দড়িটা দ্রুত
খুলে সরিয়ে ফেললাম। টেবিল ইত্যাদি ঠিকঠাক করে দরজার সম্মুখে এসে দাঁড়ালাম। কে হতে
পারে। পাড়ার কেউ কি? প্রথম প্রথম আশেপাশের মানুষজন খবর নিতে আসতো। সহানুভূতি
দেখাতো। তাদেরও কেউ হতে পারে।
দরজা
খুলতেই আমার চক্ষু চড়কগাছ। নীলা এবং ওর মা সম্মুখে দাঁড়িয়ে। আমি নির্বাক ! পা
দুটিতে মৃদু কম্পন টের পাচ্ছি। ওরা কি বদ্ধ উন্মাদকে আবার দেখতে এসেছে ! নাকি
অপমান করতে এসেছে!
নীলার
মা বলল, অফিস যাবে না বাবা?
বললাম,
যাবো। একটু দেরি করে যাবো। আসুন।
ওরা
সরাসরি ঢুকে ডাইনিং টেবিলের চেয়ারে বসল। বলল, আমরা তোমার কাছে ক্ষমা চাইতে এসেছি
বাবা। নীলা গতকাল খুব অন্যায় করেছে। ওর বোঝা উচিত ছিল তোমার মানসিক অবস্থা। এই
বিপদের সময় মানুষ আপনজনকেই কাছে পেতে চায়। তোমার কোনও ভুল ছিল না। তুমি ওর কথায়
কিছু মনে করো না বাবা। তোমার মায়ের সঙ্গে আমার আগেই কথা হয়েছিল। সে এখন থাক। তোমার
বোধহয় দেরি হয়ে যাচ্ছে। তবে একটা কথা বলি বাবা, তোমার এই বাড়িতে কিছুদিন না থাকাই
ভালো। স্মৃতিগুলো মনে কষ্ট দেবে বেশি। আমাদের দোতলার ঘরগুলো তো ফাঁকাই পড়ে আছে।
অফিস থেকে ফিরে আমাদের বাড়ি চলে এস। কেমন? কয়েকটা মাস অন্তত থাকো। কোনও অসুবিধা
হবে না। এখন আমরা চলি। বলেই বেরিয়ে গেল।
আমি কোনও কথা বলতে পারিনি। আহাম্মকের মত অপলক তাকিয়ে রইলাম। ওদের চলে যাওয়া দেখছিলাম। মনে মনে ভাবছি, তাহলে কি আমি সত্যি সত্যি পাগল হই নি !
লেখক পরিচিতি -
নিত্যরঞ্জন দেবনাথ পূর্ব বর্ধমান জেলার কাটোয়ার পানুহাটে ১৯৫৬ সালে জন্মগ্রহণ করেন।কাটোয়া কলেজ থেকে বাণিজ্যে স্নাতক। বর্তমানে থাকেন হুগলির চুঁচুড়ায়। পেশায় কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মী ছিলেন।অ্যাকাউন্টেন্ট জেনারেল-এর অধীন ডিভিশনাল অ্যাকাউন্টস অফিসার পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন। তাঁর প্রথম গল্প " চেতনা " ছোটদের পত্রিকা শুকতারায় ১৯৯৬ - এর এপ্রিলে প্রকাশিত হয়। এরপর দেশ, শিলাদিত্য, কালি ও কলম,মাতৃশক্তি, তথ্যকেন্দ্র, কলেজস্ট্রিট, কথাসাহিত্য, দৈনিক স্টেটসম্যান, যুগশঙ্খ, একদিন,,সুখবর ইত্যাদি এবং বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনে নিয়মিত তাঁর সাহিত্যকীর্তি অব্যাহত। ইতিমধ্যে পাঁচটি গল্প সংকলন ও চারটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক "শতানীক " পত্রিকাটি দীর্ঘদিন ধরে সম্পাদনা করে আসছেন।