Advt

Advt

bharatiya-darshan-part-3-bharatiya-darshaner-swarup-tatkhanik-digital-bengali-web-bangla-online-e-magazine-ভারতীয়-দর্শনের স্বরূপ-৩য়-পর্ব


bharatiya-darshan-part-3-bharatiya-darshaner-swarup-tatkhanik-digital-bengali-web-bangla-online-e-magazine-ভারতীয়-দর্শনের স্বরূপ-৩য়-পর্ব

৩য় পর্ব শুরু -----

ভারতীয় দর্শনের আস্তিক ও নাস্তিক সম্প্রদায়গুলির মধ্যে পার্থক্য আছে -

ভারতীয় দর্শনের বিভিন্ন শাখা বা সম্প্রদায় আছে। সম্প্রদায়গুলিকে প্রধানত দুটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়—একটি আস্তিক সম্প্রদায় অপরটি নাস্তিক সম্প্রদায়। সাধারণত যারা ঈশ্বরে বিশ্বাসী তাদের আস্তিক এবং ঈশ্বরে অবিশ্বাসীদের নাস্তিক বলা হয়। কিন্তু ভারতীয় দর্শনের সম্প্রদায়গুলিকে বেদের প্রামাণ্য স্বীকার বা অস্বীকারের ভিত্তিতে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে ; ঈশ্বরে বিশ্বাস বা অবিশ্বাসের ভিত্তিতে এই বিভাগ করা হয়নি। বেদ এই বিভাগের ভিত্তি। ভারতীয় দর্শনে বেদবিরোধীদের নাস্তিক (Heterodox) বলা হয়েছে। যে সব সম্প্রদায় বেদের প্রামাণ্য স্বীকার করে না, বেদকে অপৌরুষেয় বলে মনে করে না, তাদের নাস্তিক বলা হয়েছে। চার্বাক, জৈন ও বৌদ্ধ দর্শন নাস্তিক সম্প্রদায়ভুক্ত। এই তিনটি নাস্তিক দর্শনকে অ-বৈদিক নাস্তিক দর্শনও বলা যায়।

অপরদিকে যে সব সম্প্রদায় বেদের প্রামাণ্য স্বীকার করে, বেদকে অপৌরুষেয় ও অভ্রান্ত মনে করে তাদের আস্তিক (Orthodox) সম্প্রদায় বলা হয়। আস্তিক সম্প্রদায় বেদকে আশ্রয়

করে তাদের দার্শনিক মতবাদ গড়ে তুলেছে। ন্যায় বৈশেষিক, সাংখ্য-যোগ, মীমাংসা-বেদান্ত এই ষড়দর্শন হল আস্তিক সম্প্রদায়ভুক্ত। আস্তিক সম্প্রদায়কে আবার দুটি ভাগে ভাগ করা হয়। একদল বেদানুগত, অপরদল বেদস্বতন্ত্র। মীমাংসা ও বেদান্ত দর্শন আস্তিক ও বেদানুগত ন্যায়-বৈশেষিক, সাংখ্য-যোগ আস্তিক কিন্তু বেদস্বতন্ত্র। সুতরাং আস্তিক দর্শন ছয়টি। নাস্তিক দর্শন তিনটি। তবে চার্বাক, জৈন ও বৌদ্ধ—এই তিনটি নাস্তিক দর্শন হলেও জৈন ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের সঙ্গে নাস্তিক চার্বাক দর্শনের পার্থক্য আছে। চার্বাক দর্শন বেদবিরোধী দর্শন। এই দর্শনে বেদের বিরোধিতা যেভাবে করা হয়েছে, বৌদ্ধ ও জৈন দর্শনে সেভাবে করা হয়নি। তাছাড়া চার্বাক জড়বাদী, কিন্তু বৌদ্ধ ও জৈন সম্প্রদায় নাস্তিক হলেও জড়বাদী নয়। আবার চার্বাকগণ কর্মবাদে বিশ্বাসী নন। কিন্তু বৌদ্ধ ও জৈনগণ কর্মবাদে বিশ্বাসী। চার্বাকগণ জড়ের অতিরিক্ত চেতন সভায় অবিশ্বাসী। কিন্তু বৌদ্ধগণ ও জৈন দর্শন চেতন সত্তা বা আত্মার অস্তিত্ব স্বীকার করেন। এই আলোচনা থেকে বলা যায় যে ভারতীয় দর্শনে 'আস্তিক' 'নাস্তিক' শব্দ দুটিকে একটি বিশেষ অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। সাধারণত নাস্তিক বলতে জড়বাদী ও ঈশ্বরে অবিশ্বাসীদের বোঝায়। কিন্তু জৈন ও বৌদ্ধ দর্শন জড়বাদী হলেও ঈশ্বরের অস্তিত্ব খণ্ডন করা এদের প্রধান কাজ নয়। আবার কোন দর্শন যদি ঈশ্বর স্বীকার না করেও বেদের প্রামাণ্য স্বীকার করে তবে সেই দর্শনকে আস্তিক বলা হয়। যেমন সাংখ্য ও মীমাংসা দর্শনে ঈশ্বর স্বীকার করা হয়নি। কিন্তু এই দুটি দর্শন বেদের প্রামাণ্য স্বীকার করেছে বলে এদের আস্তিক বলা হয়।

চার্বাক দর্শনের সঙ্গে অন্য দুটি নাস্তিক দর্শনের পার্থক্য দেখা যায় -

চার্বাক,বৌদ্ধ ও জৈন দর্শন, এই তিনটি নাস্তিক দর্শন। তিনটি সম্প্রদায়ই বেদকে প্রমাণ বলে স্বীকার করে না। তাই এরা অবৈদিক বা নাস্তিক সম্প্রদায় বলে অভিহিত। কিন্তু এই তিনটি দর্শন নাস্তিক দর্শন হলেও চার্বাক দর্শনের সঙ্গে জৈন ও বৌদ্ধ দর্শনের পার্থক্য আছে। চার্বাক দর্শন সাক্ষাৎভাবে বেদ-বিরোধী দর্শন। বেদের বিরোধিতা করা এই দর্শনের উল্লেখযোগ্য দিক। চার্বাকগণ বলেন, বেদ অভ্রান্ত নয়, অপৌরুষেয় নয়, বেন ভগ্ন পুরোহিত সম্প্রদায়ের সৃষ্টি। অপরদিকে জৈন ও বৌদ্ধ সম্প্রদায় বেদের প্রামাণ্যে বিশ্বাস না করলেও, এরা বেদ বিরোধী নয়। এরা বেদকে হেয় প্রতিপন্ন করা থেকে বিরত আছে। এরা বেদকে বিদ্রূপ করে না, বেদবিরোধী মন্তব্য করে না।

এছাড়াও চার্বাক দর্শনের সঙ্গে বৌদ্ধ ও জৈন দর্শনের উল্লেখযোগ্য পার্থক্য আছে। চার্বাক দর্শন নাস্তিক জড়বাদী দর্শন। জড়ের অতিরিক্ত কোন আধ্যাত্মিক সত্তা এই দর্শনে স্বীকার করা হয়নি। চেতনাকে জড়ের বিকার বা উপজাতবস্তু বলা হয়েছে। এই মতে আত্মা নেই, ঈশ্বর নেই, বেদ মিথ্যা, পুনর্জন্ম নেই। অপরদিকে জৈন ও বৌদ্ধ দর্শন ঈশ্বর স্বীকার না করলেও জড়বাদী নয়। এই দুটি দর্শনে চেতনাকে জড়ের বিকার বলা হয়নি। জৈন দর্শনে আত্মাকে দেহের অতিরিক্ত চেতন দ্রব্য বলা হয়েছে। বৌদ্ধ দর্শনের যোগাচার সম্প্রদায় চেতনাকে

একমাত্র সত্তা বলেছে। নৈতিকতার ক্ষেত্রেও চার্বাক দর্শনের সঙ্গে জৈন ও বৌদ্ধ দর্শনের পার্থক্য আছে। চার্বাক দর্শন ল সুখবাদী। এই দর্শনে ইন্দ্রিয়সুখকে পরম পুরুষাধ হয়েছে। অপরদিকে জৈন ও বৌদ্ধ দর্শনে মোক্ষকে পরম পুরুষার্থ বলা হয়েছে।

অনেকেই জানতে চান তাহলে ভারতীয় দর্শন কি কর্মবাদে বিশ্বাসী নয়? এর উত্তরে বলা যায় যে নাস্তিক চার্বাক ছাড়া ভারতীয় দর্শনের সকল সম্প্রদায় কর্মবাদে বিশ্বাসী। কর্মবাদরে নৈতিক কার্য-কারণবাদও বলা হয়। কর্মবাদ অনুসারে মানুষ যেমন কর্ম করবে, তাকে সেই। রকম ফলভোগ করতে হবে। সৎ কর্মের ফল পুণ্য, অসৎ কর্মের ফল পাপ বা দুঃখ। জৈন ন্যায়-বৈশেষিক ও মীমাংসকদের মতে সৎ কাজ ও অসৎ কাজ এক অদৃষ্ট শক্তি (unseen potency) উৎপন্ন করে। ঐ শক্তির জন্য ব্যক্তি তার কর্ম অনুযায়ী ফল পায়। কর্ম ও কর্মফল ভোগের মধ্যে কার্য-করণ সম্পর্ক আছে।

কর্মবাদের ফলশ্রুতি হল জন্মান্তরবাদ। জীবকে কর্মফল ভোগ করতেই হবে। কর্মফল কখনও বিনষ্ট হয় না। কর্মফল ভোগ বর্তমান জীবনে শেষ না হলে জীবকে মৃত্যুর পর আবার জন্মগ্রহণ করতে হয়। ভাবী জীবনের শুভ-অশুভ, পাপ-পুণ্য—সব নৈতিক মূল্যই কর্মফলের মাধ্যমে সংরক্ষিত হয়। একে বলে নৈতিক মূল্যের সংরক্ষণ (conservation of moral value)

নাস্তিক চার্বাক সম্প্রদায় ছাড়া সব সম্প্রদায় এক সর্বকালব্যাপী নৈতিক নিয়ম-শৃঙ্খলায় বিশ্বাসী। এই চিরন্তন জাগতিক শৃঙ্খলাকে ঋগ্বেদে 'ক্ষত' বলা হয়েছে। তাঁরা বলেন, এই সনাতন নৈতিক শৃঙ্খলা আছে বলেই সৎ কাজ করার ফল পুণ্য এবং অসৎ কাজ করার ফলে দুঃখ উৎপন্ন হয়। জীব নিজের কর্ম অনুযায়ী নিজের ভাগ্যকে গঠন করে। কর্ম দুই প্রকার—নিষ্কাম ও সকাম কর্ম। নিষ্কাম কর্মের জন্য মানুষকে ফলভোগ করতে হয় না। জীব কেবল সকাম কর্মের জন্য ফলভোগ করে। কর্মবাদীগণ পরমার্থ লাভের জন্য নিষ্কাম কর্ম সম্পাদনের কথা বলেন। ভারতীয় দর্শানে কর্মবাদ অদৃষ্টবাদের নামান্তর নয়। কারণ মানুষ তার স্বাধীন পুরুষাকারের দ্বারা নিজেকে মহৎ করে তুলতে পারে।

 

ভারতীয় দর্শনের বিভাগ

ভারতীয় দর্শনের প্রধান দু’টি বিভাগ – বৈদিক (আস্তিক) এবং অ-বৈদিক (নাস্তিক)

 

বৈদিকদের মধ্যে দু’টি বিভাগ – বেদানুগত এবং বেদস্বতন্ত্র

বেদানুগতদের মধ্যে দু’টি বিভাগ – বেদান্ত এবং মীমাংসা

বেদস্বতন্ত্রদের মধ্যে চারটি বিভাগ – ন্যায়, বৈশেষিক, সাংখ্য এবং যোগ

 

অ-বৈদিকদের (নাস্তিক)মধ্যে দু’টি বিভাগ – চরমপন্থী এবং নরমপন্থী

চরমপন্থীদের মধ্যে একটি বিভাগ – চার্বাক

নরমপন্থীদের মধ্যে দুটি বিভাগ – বৌদ্ধ এবং জৈন

 

ভারতীয় দর্শনে স্বীকৃত প্রমাণ :

 

চার্বাক- প্রত্যক্ষ।

বৌদ্ধ—      প্রত্যক্ষ, অনুমান।

জৈন  - প্রত্যক্ষ, অনুমান, শব্দ।

ন্যায়—   প্রত্যক্ষ, অনুমান, উপমান, শব্দ।

বৈশেষিক— প্রত্যক্ষ, অনুমান।

সাংখ্য—   প্রত্যক্ষ, অনুমান, শব্দ।

বেদান্ত——  প্রত্যক্ষ, অনুমান, উপমান, অর্থাপত্তি, শব্দ ও অনুপলব্ধি।

মীমাংসা — প্রত্যক্ষ, অনুমান, উপমান, শব্দ, অর্থাপত্তি

(এছাড়াও ভাট্টগণ অনুপলব্ধি স্বীকার করেন)

 

প্রমাণ : যার দ্বারা প্রমা, অর্থাৎ যথার্থ জ্ঞান উৎপন্ন হয় তাকে প্রমাণ বলে। সুতরাং প্রমার করণ হল প্রমাণ।

 

প্রমা : প্রমা শব্দের অর্থ যথার্থ অনুভব। অনুভব দুই প্রকার, যথার্থ অনুভব ও অযথার্থ অনুভব। কেবলমাত্র যথার্থ অনুভবই প্রমা। যথার্থ অনুভব বা প্রমা সফল প্রবৃত্তির জনক হয়। তদ্‌বতি তৎপ্রকারকঃ অনুভবঃ যথার্থঃ। বিষয়টি যেমন সেইরূপ যে উপলব্ধি, তাকে যথার্থ অনুভব বলে।

ভাষ্য : মূল গ্রন্থের ব্যাখ্যা (সূত্রগ্রন্থের ব্যাখ্যা) যে গ্রন্থে দেওয়া হয় তাকে ভাষ্য বা ভাষ্য

গ্রন্থ বলা হয়। যেমন—'ন্যায় ভাষা', 'সাংখ্য কারিকা' ইত্যাদি।

টীকা : টীকা হল ভাষ্যের ব্যাখ্যা বা ভাষ্যের ভাষ্য।

ভারতীয় দর্শনে প্রমাণ

ভারতীয় দর্শনের বিভিন্ন সম্প্রদায় বিভিন্ন প্রকার প্রমাণ স্বীকার করেছেন। কোন্ সম্প্রদায়

কী কী প্রমাণ স্বীকার করেছেন তা নিম্নে উল্লেখ করা হল :

 

সম্প্রদায়

প্রমাণ

চার্বাক

প্রত্যক্ষ

বৌদ্ধ

প্রত্যক্ষ, অনুমান ,

জৈন

প্রত্যক্ষ, অনুমান, শব্দ

সাংখ্য

প্রত্যক্ষ, অনুমান, শব্দ

ন্যায়

প্রত্যক্ষ, অনুমান,উপমান, শব্দ

বৈশেষিক

প্রত্যক্ষ, অনুমান,

মীমাংসা

প্রত্যক্ষ, অনুমান,উপমান, অর্থাপত্তি (ভাট্ট-অনুপলব্ধি)

বেদান্ত

প্রত্যক্ষ, অনুমান, উপমান, শব্দ, অর্থাপত্তি অনুপলব্ধি