একজন চৌকস
ফেরিওয়ালা ট্রেনের কামরায় মাতনের ঘুম ভাঙ্গিয়ে তার ডান হাতের কব্জিতে সেন্ট ঘষে
দিয়ে বলল, গন্ধটা কমসেকম ছ'থেকে আট ঘণ্টা থাকবে।
তখন শিশুকোলে
একজন ভিখারিনী গান গাইছে – এ মায়া প্রপঞ্চময়, এ মায়া প্রপঞ্চময়।
খাকি রংয়ের উর্দি-গায়ে
একজন পটু স্বাস্থ্যের সেপাই, অপটু চেহারার একজন চালউলির সঙ্গে অশ্লীল প্রেমালাপ করছে।
সময়টা আশ্বিনের শুরু বলে, বাতাসে আমেজী ঠাণ্ডাভাব এবং হিম পড়ছে। রেললাইনের দুপাশের
জনপদ বনস্থলীর ওপর। চাল ধোওয়া জলের মতো তার রং। আবছা, ফ্যাকাসে।
আর এ সবের দৌলতে, আচমকা কব্জিতে সেন্ট ঘষে দেওয়ার ব্যাপারটা, মাতনের
জীবনে একটা হৈ-চৈ-এ ব্যাপার হয়ে গেল।
এখন দেখার
এরপর মাতন সত্যি সত্যি কী করল, কী করবে ভেবেও ঠিক করতে পারল না, আর
কিছু করতে তার ইচ্ছেই করল না।
মাতন লেটুসের
ধেনো মদের ঠেকের সামনে দিয়েই এলো। কিন্তু তার মদ খেতে ইচ্ছেই করল না। ঠেকের দু-চার
বন্ধুবান্ধব 'এই মাতন' – 'এই মাতন' করে
হাঁক পাড়ল। মাতন ফিরেও তাকাল না। তখন তারা বলাবলি করতে লাগল, মাতনটা
শালা ইয়ে হয়ে গেছে। নেমকহারাম।
আর বলল, শালা
নকশা মারছে। ক্যাদরানি দেখাচ্ছে।
মাতন এসব
শুনতেও পেল না। সে গটমট করে ঠেক পিছনে ফেলে রেখে সামনে এগিয়ে গেল।
মাতনের বউ
মিলি বাড়িতে একা আছে। প্রতিদিন যেমন সে থাকে। মাতনের বাড়ি ফেরার অপেক্ষায় উদগ্রীব
হয়ে আছে। টিনের সদর দরজার ঢকঢক আওয়াজ শোনার জন্য দুকান খাড়া করে আছে। মাতন জানে, কোন
কোন দিন আবার ঘরের জানলার পাল্লা খুলে মিলি নিশ্চুপ ছায়ামূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে
বাইরের দিকে চেয়ে।
মাতনের ভারি
শখ হল, আজ মিলিকে একটু চমকে দিতে হবে। বাড়ি ঢুকবে কী ভাবে, সে
ব্যাপারে অন্যরকম কিছু ভাবতে হবে। সদর দরজা দিয়ে না ঢুকে, পাঁচিল
টপকে ভেতরে ঢুকলে কেমন হয়! চোখ বুজে ছবিটা ভাবতে গিয়ে মাতন ফিক করে হেসে ফেলল।
ব্যাপারটা বেশ লাগসই হবে। তার বাড়ির পিছনে একটা ছোট ডোবা আছে। ডোবাটার চারপাশ ঘিরে
ঝোপঝাড় আছে। তার মধ্যে মেটে রংয়ের বড় বড় ইঁদুর আছে। ঢ্যামনা সাপ আছে। আর ফাঁদালো
সাপের গর্ত আছে মাটিতে। লোকে বলে গর্তগুলো শেয়ালের আঁতুড়ঘর। কালেভদ্রে দু'একজন এই
ঝোপঝাড়ের মধ্যে ঢোকে। বুনো কাঁকরোল, বাসক পাতা, এই
সবের খোঁজে।
গোল থালার মতো
চাঁদ আকাশের মাঝ বরাবর। সাদা আলোয় চারপাশ ভেসে যাচ্ছে। অনেক দূরের জিনিসও আজ
স্পষ্ট করে দেখতে পাচ্ছে মাতন। নিজের মনেই মাথা দোলাল মাতন, আকাশে
চাঁদ থাকলে বোধহয় এমনটাই হয়। অন্যদিন নেশার চোখে ধরা পরে না। আজকের দিনটা তো আলাদা
রকম। সাদা চোখে কতদূর দেখা যায় ! বাপরে বাপ! মাতনের এতটাই অবাক লাগল যে আপনা আপনি
একটা লম্বা শ্বাস বেরিয়ে এলো। দূরে মিত্তিরদের ভাঙ্গাচোরা বিশাল বাড়িটা। এতদূর
থেকেও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। চলতে চলতে মাতন হঠাৎ চুপ করে দাঁড়িয়ে পড়ল। আর সোজা চোখে
পুরনো বাড়িটার দিকে চেয়ে রইল। তার একটুও ভয় করল না। গা ছমছম করল না। সে জানে, ছোটবেলা
থেকে শুনছে, লোকে বলাবলি করে, রাতের অন্ধকারে এই
জরাজীর্ণ বাড়িটায় কারা যেন সব ঘোরাফেরা করে। কখনও কখনও তীক্ষ্ণ গলায় কে যেন কেঁদে
ওঠে। আবার কখনও নাকি এমনটাও হয়, বাতাস বইছে না, গাছের পাতাটিও নড়ছে না, তার
পরেও পুরনো বাড়িটার ভাঙ্গাচোরা জানলা দরজাগুলো দেওয়ালে মাথা ঠোকাঠুকি করে। বেশ
শব্দও হয় তাতে।
এমনি সব শোনা
গল্প মাতন রাতে বিছানায় শুয়ে মিলিকে বলেছে, মিলি ভয়ে কুঁকড়ে এতটুকু
হয়ে মাতনকে জড়িয়ে ধরেছে। তার রোমশ বুকে মুখ গুঁজরে নিজেকে লুকিয়েছে। যেন ভয় তাকে তাড়া
করেছে। মিলিকে সাহস দিতে গিয়ে মাতনের নিজে হাত-পা'ও শিথিল হয়ে গেছে। মনে
হয়েছে এমনটা যদি সত্যি হয়! যদি তার চোখে কোনদিন এমন কিছু পড়ে! বা কানে তীক্ষ্ণ
কান্নার শব্দ ভেসে আসে!
আশ্চর্য, আজ
মাতনের একটুও ভয় করছে না। বরং তার মনে হচ্ছে, এখন এই সময়ে মিলি তার পাশে
থাকলে, সে মিলির হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে, গটগট
করে দুজনে ঢুকে যেত প্রায় ভেঙ্গে পড়া বাড়িটার বুকের ভিতরে। তারপর একতলা দোতলা
চিলেকোঠা, আনাচে কানাচে সব জায়গায় উঁকি মেরে দেখত। ভয়, 'কী হয়', 'কী হয়' এসব
ভাব আজ উধাও হয়ে গেছে মাতনের মন থেকে। আজ 'ফুর্তির প্রাণ গড়ের মাঠ' এমনি
মেজাজে ভাসছে।
হাত চুইয়ে
এসেন্সের সুগন্ধ মিশে গেছে রক্তের ভিতরে। দুচোখে মাখ-মাখ ভাব। সাজানো গোছানো নয়, এলোমেলো
কথা, বেসুরো গানের কলি ঘাই মারছে বুকের মধ্যে।
গন্ধটা বড়ই
এলেমদার।
মাতনের খুব
সাধ হয়েছিল, মিলির জন্য সেন্টের ছোট একটা শিশি কেনে, কিন্তু
পকেটে হাত ঢুকিয়ে দেখে ঠনঠন করছে। তো কী আর করা ! কব্জিতে গন্ধ বয়ে আনা।
মাতন শূন্যে
তার গন্ধ-সমেত হাতখানাকে ঘোরাল। ভাবখানা এইরকম, সে একা কেন ! গাছপালা, পশুপক্ষী, আকাশের
গায়ে লেপটে থাকা থালার মতো চাঁদ, গন্ধে সবাই মাতোয়ারা হোক।
দুহাতে ঝোপঝাড়
ঠেলতে ঠেলতে চলেছে মাতন। আশপাশ দিয়ে সরসর খসখস আওয়াজ তুলে কী যেন সব ছুটে যাচ্ছে।
পিটুলি গাছের ডালে বসে পাঁশুটে রংয়ের যে পেঁচাটি 'দুরগুম-দুরগুম' করে
ডাকছে, যেন অব্যর্থ মাতনকেই ডাকছে 'কাছে আয়, কাছে
আয়' বলে।
মাতনের কোন
ভয়ডর নেই। সে তো চলেছে রহস্য সৃষ্টি করতে। ঘরের দরজা খুলে যখন তার বউ দেখবে, উঠোনে
দাঁড়িয়ে মাতন তার বউয়ের নাম ধরে ডাকছে আর মিটমিট করে হাসছে, অথচ
সদরের খিলটি আঁটা, বউটার যা ছেঁদো বুদ্ধি, হয়ত হাউমাউ করে চিৎকার করে
উঠবে। আশপাশ থেকে দু-চারজন ছুটেও আসতে পারে। আর তাতে ব্যাপারটা খোলতাই হবে। রঙ্গ
তামাশা আরও কত রকমভাবে করা যায়। পরের বউ তো আর নয়। মাতন এইভাবে নিজেকে বোঝায়।
ভাঙ্গা
পাঁচিলের ফোঁকর দিয়ে উঠোনের দিকে তাকিয়ে মাতনের চক্ষু চড়কগাছ। হাঁসের ঘরের দরজাটা
খুলে ভেতর দিকে চেয়ে উবু হয়ে বসে, ও কে? লোকটি শীর্ণকায়। উঠোনে তার শরীরের ছায়া পড়েছে। সরু একফালি
ছায়া। লোকটির যেন কোনদিকে হুঁশ নেই।
মাতন চুপিসারে
পাঁচিল টপকে উঠোনে নেমেই বাজখাই গলায় হুংকার ছাড়ল, অ্যাই, কোন
শালারে ?
লোকটি চকিতে
ঘাড় ঘুরিয়ে মাতনকে দেখে খুব অবাক হয়ে গেল, মাতনদা? তুমি
এইলে কোন দিক থিকে ?
মাতনকে কেউ 'দাদা' বলে
ডাকলে সে খুশি হয়। কিন্তু চোর যদি গেরস্তর থেকে জবাবদিহি চায়, ব্যাপারটা
অসহ্যের পর্যায়ে চলে যায়।
মাতন মুখ
ভেংচে বলল, এ্যাই বান…, আমাকে জিগোচ্ছিস?
- হুঁ। লোকটি ঘাড় ঘুরিয়ে চারপাশে তাকাল, সবি কবাট বন্দ দেকচি।
এবার মাতন
সত্যি সত্যি রেগে গেল। লোকটির দিকে তেড়ে গেল। লোকটি সরে দাঁড়াবার চেষ্টা করতেই সে
কাঁধ সমেত তার জামাটা খামচে ধরল। কাছে টেনে আনতেই চিনতে পারল, পেল্লাই।
ছিঁচকে চোর হিসেবে নামডাক করেছে। এখনে ওখানে ধরাও পড়েছে। আর তাই মুখখানা ঠিক মুখের
মতো নেই।
পেল্লাই কুঁই
কুঁই করে বলল, হাঁস-গুলোন সব ভেতরে সিঁধইছে। বারি আনতি তো সময় লাগে।
- শালা ঢ্যামনার পো, ওগুলোন কি তোর বাপের সম্পত্তি? মাতন
এইটুকু মুখে বলল। আর বাকিটুকু হাতে দেখাবে বলে বিশাল একখানা থাপ্পড় তুলল
পেল্লাইয়ের মাথা কিম্বা গাল লক্ষ্য করে। বাতাসে সাঁ করে আওয়াজ হল। মুহূর্তে
পেল্লাই ছিটকে সরে গেল। আর সরে গিয়েই এদিক ওদিক মাথা ঘুরিয়ে ফোঁ ফোঁ করে নাক টানতে
লাগল,
- কি সোন্দর বাস গ!
- মাতন চমকে উঠে বলল, বাস ?
- হঁ। চন্ননের বাস। তুমি পাচ্ছনি?
- সোন্দর? মাতন যাচাই করতে চাইল, সত্যি?
- হঁ গ। চতুরপাশ ম ম করছে।
এরপর চোর আর
গেরস্ত মিলে, উঠোন পেরিয়ে ঘরের দাওয়ায় এসে মুখোমুখি বসল। দুজনে ঘরের
গল্প পরের গল্প করতে লাগল।
এমন ছবি
কদাচিৎ দেখা যায়। পৃথিবীতে এমন কথাবার্তাই বা শুনেছে ক'জন?
একসময় পেল্লাই
না বললেও, মাতন তার হাতে নিজের হাতটা ঘষে দিল, গন্ধটুকুন
তুই-ও বাড়ি নে যা।
এরপর নিশুতি
রাতে ফটফটে চাঁদের আলোয়, একা মাতন, উঠোনময় ঘুরতে লাগল। আর নাক
টেনে টেনে গন্ধ শুঁকতে লাগল। পেল্লাই ঠিকই বলেছে। চন্দনের গন্ধ। চারপাশ জুড়ে।
উঠোনের জবাগাছ, দড়িতে মেলা মিলির শাড়ি, সবেতে ভুরভুর করছে চন্দনের
গন্ধ। গন্ধে নেশা ধরে যাওয়ার মতো ঘোর ঘোর ভাব। দুচোখ যেন বুজে আসতে চাইছে। হঠাৎ
মিলির গলার আওয়াজে সম্বিত ফিরে পেল।
মিলি – কি
ব্যাপার বলতো তখন থেকে জানালা দিয়ে দেখছিলুম তুমি কার সাথে কথা বলছ! সদর দরজা তো
বন্ধ। এলে কোথা থেকে?
মাতন বুঝতে
পারলো তার সারপ্রাইজ দেওয়াটা মাটি হয়ে গেল। বললো – চল, বউ, ভেতরে
চল, আমি এটাকে বাড়ির বাইরে করে আসছি।
মাতন, পেল্লাইকে
বাইরে ছেড়ে দিয়ে এসে ঘরে ফিরলো। বিশ্রামের পর খেয়ে-দেয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো।
রাতে বিছানায়
মিলি গোঁসা করে বালিশে মুখ গুঁজরে শুয়ে রইল। তার জন্য সেন্টের শিশি কিনে আনা হয়নি
কেন, এই অভিমানে।
মাতন খুব
সন্তর্পণে কুপির পলতে উসকে দিয়ে, হঠাৎ করেই মিলির মুখখানা নিজের দিকে ঘুরিয়ে ধরল।
অপলক মিলির
মুখের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে আজই মাতনের চোখে প্রথম ধরা পড়ল, রোগা
হিলহিলে চেহারার মেয়েটা, যেন রাতারাতি আকাশের চাঁদের মতো ভরাট, ডাগর
হয়ে উঠেছে। সারা শরীরে তার আলো পিছলে যাচ্ছে।
লেখক পরিচিতি –
লেখালেখির শুরু নব্বই দশকে। বর্তমানে
সাতটি গল্প সংকলন এবং তিনটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে। রাজ্য সরকারের উচ্চপদস্থ আধিকারিক
হিসেবে সম্প্রতি অবসর গ্রহণ করেছেন।

