ধারাবাহিক উপন্যাস – প্রতি বৃহস্পতিবার
২৪তম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন ।
লেখিকার অন্যান্য লেখা পড়তে এখানে ক্লিক করুন ।
২৫তম পর্ব শুরু ……
চলে গেলেন বাবা
তিরিশে নভেম্বর। সকাল থেকে মনটা বেশ চনমনে। অন্যান্য সাধারণ দিনের তুলনায় এই দিনটি আমার কাছে একটু অন্য রকম। এটি আমার কাছে একটা বিশেষ দিন। যারপরনাই আনন্দের দিন। এই দিনেই আমি প্রথম মা হয়েছিলাম। আমার পৃথিবী আলোকোজ্জ্বল করে আমার কোলজুড়ে নেমে এসেছিল আমার কন্যারত্ন।
সকাল থেকে যে খুশির হাওয়াটুকু বইছিল হঠাৎ কালবৈশাখীর একটা ঝোঁকা এসে তছনছ করে দিয়ে গেল সবকিছু। এলোমেলো করে দিল সুখবাসা। আকাশ থেকে ধড়াম করে পড়লাম জমিতে। উঠে দাঁড়ানোর ক্ষমতা হারিয়ে ফেললাম।
মনের মধ্যে সবসময় একটা ভয় কাজ করত। বাবা আমাকে না বলে চলে যাবেন না তো? ঠিক সেটাই হলো। বলা নেই কওয়া নেই হুট করে চলে গেলেন বাবা। একবার কি ভেবেছিলেন আমার মেয়েটা ওখানে এই খবর শুনে কতটা কষ্ট পাবে? একা একা সে কেমন পাগল পাগল করবে? কতোটা অন্ধকার হবে তার পিতৃহীন পৃথিবী? কেমন টলমল করবে তার দুটো পা? হয়তো ভেবেছিলেন। বাবারা ভাবেন। কিন্তু ইচ্ছে থাকলেও কখনও কখনও বলা হয়ে ওঠেনা। হয়তো দু'চোখ জুড়ে আমারই ছবি আঁকা ছিল তখন। আমার অতো শক্তিশালী বাবা রাস্তায় পড়ে গেলেন। অন্তিম লগ্নে তিনটি ছেলেমেয়ের একটিরও মুখ দেখতে পেলেন না? কী ভাবছিলেন তিনি তখন? কাকে দেখতে ইচ্ছে করেছিল? কিছু কি বলতে চেয়েছিলেন? আমার মায়ের জন্য কি চিন্তা হচ্ছিল? কিচ্ছু জানিনা। মুখফুটে কিচ্ছু বলতে পারেননি তিনি। শুধু একবার শূন্য দৃষ্টি নিক্ষেপ করেছিলেন আকাশের দিকে শেষ বারের মতো। আমার পাশের বাড়ির দাদা বৌদি রাস্তার থেকে তুলে নিয়ে মুখে জল দিয়েছিলেন কানে দিয়েছিলেন হরিনাম। ৩০ শে নভেম্বর আমার আনন্দতম দিন চরমতম দুঃখের দিনে পরিনত হল। আপন তালে আপন মনে চলতে চলতে মাঝ দরিয়ায় থমকে দাঁড়াল পাল তোলা নৌকাটি। চারিদিকে এলোমেলো হাওয়া। উত্তাল ঢেউ। হে ঈশ্বর এ তোমার কেমন বিচার?
কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না যে বাবাকে আর কোনোদিনও দেখতে পাব না। গরমে হাইফাই করলে বাবা আর কোনোদিনও হাত পাখা নিয়ে হাওয়া করবেন না। বাবা মায়ের মাঝখানে শুয়ে কোনোদিনও আর বাবার সঙ্গে গল্প করা হয়ে উঠবে না। জ্বর হলে কলার পাতা মাথার নিচে দিয়ে বাবা আর জল ঢালবে না আমার মাথায়। আমার বাবা, আমার প্রিয়তম মানুষ, আমার সঙ্গে পথ চলবে না আর কোনদিনও। সোনালী ধানের সোনা রং দেখতে বাবার সঙ্গে আর যাওয়া হয়ে উঠবে না। জমিতে ফসল হবে এখনও। সর্ষে ফুলে রঙিন হবে ত্রিভূন। সেই রং গায়ে মাখতে আমি যাব তবে বাবা হীন ধূসর আমার পৃথিবী।
কতো কথা বাকি রয়ে গেল বাবা! বড় অসময়ে চলে গেলে তুমি! আরও অনেক কিছু জানার ছিল অনেক কিছু শেখার ছিল গো।
ছুটে গেল হাত
"পিতা স্বর্গ পিতা ধর্ম পিতাহি পরমং তপ, পিতরি প্রিতীমাপন্নে প্রিয়ন্তে সর্ব দেবতা!"
কেন এমন করলে বাবা?
তোমার আঙুল ছেড়ে আমি তো চলতে
শিখিনি।
পিছনে খাই, সামনে
সমুদ্র, আতঙ্কে আড়ষ্ট আমি...
তোমাকে ছাড়া আমি যে অচল
ডুবে যাচ্ছি ক্রমাগত
আর কি ধরবে না হাত বল?
তুমি এমন করতে পারনা বাবা
আমার মাথা থেকে সরাতে পারনা অশত্থের ছায়াটুকু
এই বিপুল পৃথিবীতে ঝড়ঝাপটা সাইক্লোনের বিভীষিকা
চৌদিকে
এর মধ্যে ছাতা বিহীন কেমন করে বাঁচি?
ফিরে এসো বাবা
তোমার অভয় স্পর্শ পেলে আমি তোলপাড় করে দিতে পারি
জীবনের এমাথা থেকে ও মাথা।
মসৃণ করে দিতে পারি সমস্ত এবড়ো খেবড়ো পথ
ভেঙে চুরে গড়ে নিতে পারি প্রশস্ত ললাট!
তোমার আশীর্বাদে ভালো থাকব আমরা
ঐ দুনিয়ায় ভালো থেকো তুমিও
চিন্তা করোনা কারো জন্য
নিশ্চয়ই দেখা হবে আবার !
যদি পারো পরের জন্মে বাবা হয়ে নয়, ছেলে
হয়ে এসো
আমার আগে যেতে পারবেনা তখন।
যা দিতে পারনি তার জন্য ক্ষোভ নেই কোনো
যেটুকু দিয়েছ তার জন্য চিরকৃতজ্ঞ রইলাম
জ্ঞানে অজ্ঞানে ব্যথা যদি দিয়ে থাকি মনে ক্ষমা করে
দিও
তুমি আমার প্রণাম নিও বাবা
শত শত প্রণাম নিও।
ক্রমশঃ ………
২৬তম পর্ব পড়ুন
আগামী বৃহস্পতিবার
লেখিকার পরিচিতি –
মনীষা কর বাগচী বিয়ের পর দিল্লিতে আসেন। শৈশব এবং কৈশোর কেটেছে সবুজে শ্যামলে ঘেরা নদীয়া জেলার মাঝেরগ্রাম নামক একটি গ্রামে।
স্কুল থেকেই লেখা লিখি শুরু । নিজের মনেই লিখে যেতেন কত কিছু। আজ সে সব লেখাগুলোও হারিয়ে গেছে। লেখার অনুপ্রেরণা জোগান সেজোকাকা কবি নিশিকান্ত বাগচী।
দেশে এবং বিদেশে অসংখ্য লিটিল ম্যাগাজিনে লেখা প্রকাশিত হয়। প্রতিদিন কিছু না কিছু লেখেন। শ্রদ্ধেয় কাকু বিরাট বৈরাগ্যের সহায়তায় হরিচাঁদ ঠাকুরের গান লিখেছেন।
এ পর্যন্ত লেখিকার নিচের আটটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।
১ নীল দিগন্ত
২ চোখের কোণে জল
৩ নূতন ভোর
৪ বসন্তরেণু
৫ শিউলি বেলার সুর
৬ বিবর্ণ বনলতা
৭ তপন বাগচী গভীর অনুধ্যান
৮ স্বপ্ন সফর (গল্প বই)
দু’টি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের পথে।
১ শিমুলরঙা সূর্য