ধারাবাহিক উপন্যাস – প্রতি বৃহস্পতিবার
১৭তম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
লেখিকার অন্যান্য লেখা পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
১৮তম পর্ব শুরু ……………………
বিদায়
সময়ের সাথে এগিয়ে চলতে থাকি আমরা সবাই। দিন যায় দিন আসে আমাদের প্রেম গভীর থেকে গভীরতর হয়। মনে মনে দুজনে সাজিয়ে ফেলি স্বপ্নের রাজমহল। একে অপরকে না দেখে থাকতে পারিনা। একে অপরের কষ্টে ব্যথিত হই। যতক্ষণ কাছে থাকি একান্ত গোপনে দুজন দুজনের হৃদয়কে ছুঁয়ে থাকি। যতক্ষণ দূরে থাকি একে অপরের সবটুকু জুড়ে থাকি। কতবার ভেবেছি আজ হয়তো তুমি কিছু বলবে। আজ হয়তো তুমি কিছু বলবে। কিন্তু বললে না কিছুই। আমার বদ্ধমূল ধারণা ছিল এসব কথা মেয়েরা বলে না ছেলেরাই বলে। অপক্ষা আর অপেক্ষা। ভীষণ ভয় লাগত আমার। তোমাকে হারানোর ভয়। একটা মেয়ে তার জীবন সঙ্গীর মধ্যে যে যে গুণ গুলো দেখতে চায় সবই তোমার মধ্যে ছিল। মধুমিতাদি তোমাকে পছন্দ করত। বারবার তোমার কাছে আসার চেষ্টা করেছে। তুমি তেমন পাত্তা দিতে না। সে আমাকে সন্দেহ করত । বারবার আমাকে জিজ্ঞেস করত , "অনিকেতের সঙ্গে তোর কি অন্য কোনো সম্পর্ক আছে? " আমি কি উত্তর দিই বুঝে উঠতে পারতাম না। আমি জানতাম ও তোমাকে চায়। না বললে, ও তোমার দিকে আরও এগোবে। হ্যাঁ বললে পুরো পাড়াময় ঢিন্ডোরা পিটিয়ে বেড়াবে। হ্যাঁ বলবই বা কোন সাহসে? তুমি তো আমাকে তেমন কিছু বলই নি। বাধ্য হয়ে আমাকে বলতে হয়েছিল একদিন, "না দি তেমন কিছু নয়। ওনাকে শ্রদ্ধা করি। উনি আমাকে ভালবাসেন যেমন তোমাকেও বাসেন।"
সেদিন ঘরে এসে খুব কেঁদেছিলাম।
তোমার উপর রাগ নয় বড় অভিমান হয়েছিল। আমি তোমাকে হারানোর ভয়ে কেঁদেছিলাম।
মধুমিতাদি আমার চোখের সামনে দিয়ে তোমাকে আকৃষ্ট করার নানা রকম ছলা-কলা
শুরু করে দিল। আমাকে এসে কত কথা বলত তোমাকে নিয়ে। তুমি তাকে অনেক অনেক গুরুত্ব
দাও। সে যা বলে তুমি তাই শোনো। সে আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছিল তুমি তাকে ভালোবাস।
একদিন আমি দাঁড়িয়ে আছি তুমি আমাকে দেখতেই পেলে না। তার সঙ্গে তাদের ঘরে ঢুকলে।
আমি বাইরে দাঁড়িয়ে রইলাম অনেকক্ষণ। কেননা আমি তো সব শক্তি হারিয়ে ফেলেছি তখন।
রাগে দুঃখে বেদনায় আমি তখন নীলকন্ঠ। শুধু আঘাত পাওয়ার জন্যই কি আমার জন্ম হয়েছে? চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে এলো।
বুঝতে পারলাম ফাটল ধরেছে। সব শেষ । আমার রাজমহলে ঘুন ধরেছে।
পরের দিন তুমি এলে আমি কথা বলতে
পারিনি। তুমি ডেকেছ কাছে আসিনি। মা ডাকলে এলাম। পড়াশোনার কথা বলছিলে। তাকাতে
পারছিনা তোমার দিকে। তুমি আমার চিবুকে হাত দিয়ে মুখ তুলে ধরলে। দেখলে কাঁদছি।
--- কি হয়েছে বলবে তো? পাগল। এমন করে বিনা কারণে কেউ কাঁদে নাকি?
--- না কোনো কারণ নেই। এমনিতেই কাঁদছি।
--- আবার মিথ্যা কথা বলছ। বল না কী
হয়েছে? এভাবে তুমি কাঁদলে আমার কি ভাল লাগে?
---জানিনা।
--- কি জাননা? তুমি
সব জান। সময় হলে আরও জানবে। কান্নাকাটি না করে পড়াশোনায় মন দাও। একদম মন খারাপ
করবে না। সামনে এইচ এস পরীক্ষা খুব ভালো রেজাল্ট দেখতে চাই।
আমি কিছুই বলতে পারলাম না সেদিনও।
শুধু নিজেকে গুটিয়ে নিলাম।
খরস্রোতা নদী
অখিলেশ একটা কথা তোমাকে জানানো হয়নি। আমি তোমাকে স্বমূলে উৎখাত করেছি আমার স্থাবর অস্থাবর সমস্ত অস্তিত্ব থেকে। নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্য তোমার অক্সিজেন চাইনা আর।
আমার ময়ূরপঙ্খী স্থির, অচল
এখন। ভেঙে গেছে গলুই, ছিঁড়ে গেছে পাল। তবু একাই বাইব। হাত
বাড়াব না তোমার দিকে।
যেদিন মধুমিতাদের উঠোন জুড়ে ছড়িয়েছিলে আমার শত সহস্র বিশ্বাসের টুকরো। রক্তে ভেসে গেছিল একটি ফুটন্ত গোলাপ। আমার মৃতদেহের উপর পা রেখে রেখে ঢুকলে তার ঘরে। সেদিন থেকে আমি নদী। খরস্রোতা নদী।
অসংখ্য লাল পিঁপড়েরা কুরে কুরে খায় পাঁজর ঘরের লাল পুটলীটাকে। আমি উফফফ্ করিনা।
তোমাকে ছাড়া এক একটি দিন এক একটি রাত এক একটি জ্বলন্ত অগ্নিপিন্ড। পুড়ছি। পুড়েই চলেছি। রোজ একবার ছাই হই।
চিতায় ওঠার প্রয়োজন পিছে ছুটে
গেছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলারও সুযোগ দেবে না তোমাকে নদী নামের মেয়েটি।
সকাল সন্ধ্যা রাত পৌষের
হাড়কাঁপানো শীত, কালবৈশাখীর উত্তাল সংঘর্ষ, সুনামীর উলঙ্গ নৃত্য। তবুও নদী মাথা আঁচড়ায়, চুল
বাঁধে, টিপ পরে। সংসারের দায়বদ্ধতা খর্গ ধরে আছে। পুতুল নাচে
বিশ্বজয়ী তাই...
তার মতো ভালো তোমাকে কেউ
বাসেনি। বুঝতে বুঝতে পেরিয়ে গেল অনন্ত সময়। ছুঁতে পারলে না উন্মত্ত পাগল নদীর
ঢেউ। সেটাই তোমার শাস্তি , সেটাই শাস্তি তোমার।।
তাকে দেখেছি তোমাকে যত্ন করতে।
তোমাকে গিফ্ট দিতে। তোমাকে নানা রকম রান্না করে খাওয়াতে। যত দেখেছি ততই
কেঁদেছি। কত রাত শুধু কেঁদেই কাটিয়েছি তার ইয়ত্তা নেই। সাক্ষী আছে আকাশের অসংখ্য
তারা।
চোখ লাল দেখলে তুমি বুঝতে পারতে
আমি কষ্টে আছি। কষ্টের কারণ তোমাকে বুঝতে দিইনি। তুমি চাকরি পেয়ে চলে গেলে। আমি
একা হলাম। জন্মের মতো একা হলাম। মনে হতো মহাশূন্যে হারিয়ে গেছি কোথাও। কেউ কোথাও
নেই। কত চিৎকার করছি কিন্তু আমার হাতটি কেউ টেনে ধরছে না।
ধীরে ধীরে বড় থেকে বড় ব্যথাও
উপশম হয়ে যায়। পাশ করলাম। কলেজে ভর্তি হলাম। তুমি এলে। কিছু বললে না। বাবা ছেলে
দেখল। কিছু বলতে পারলাম না। বললাম পড়াশোনা করতে চাই। শ্বশুর বাড়ির লোকজন বললেন
আমরা পড়াব যতটা পড়তে চাও। সবাই বলল এত আগ্রহ করে নিতে চাইছে দিয়ে দাও। সাধা
লক্ষ্মী পায়ে ঠেলতে নেই। বান্ধবী বলল, "বোকা
দেখছিস না মেয়েদের বিয়ে হচ্ছে না? কত মেয়ে পড়ে আছে দেখ ।
ওদের এতো বয়স হয়ে গেছে আর হয়ত বিয়েই হবে না। বিয়ে করে নে।"
বুকের মধ্যে আমার তখন সুনামি।
পাঁজরের হাড়গুলো ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। কিছুতেই বলতে পারছিনা যে আমি কাউকে ভালোবাসি
! সে-ই আমার জীবন আমার মরণ। তাকে ছাড়া আমার চারিদিকে আলো জ্বলবে না কোনো দিন। তার
চোখে আমি ভূবন দেখি। সে ছাড়া আমি যে অন্ধ। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে খুব কেঁদেছি। আমার
কান্না কেউ শুনতে পায়নি। কেউ দেখতে পায়নি। তুমি কি বলতে চেয়েছিলে সেটা বলার আর
সময় দিতে পারলাম না। তোমার বলারও সময় হলো না। আমার শোনারও হলোনা সময়।
একদিন আমাদের উঠোন জুড়ে
প্যান্ডেল হলো। আকাশ বাতাস ছাপিয়ে সানাইয়ের সুর উঠলো কেঁদে।
সেদিন সানাইও হেরে গিয়েছিল আমার হৃদয়ের কাছে। জানি না সে সুর তোমার হৃদয়
পর্যন্ত পৌঁছেছিল কিনা।
জীবনের সমস্ত সুখ, সমস্ত
সুর, সমস্ত কবিতাকে বিদায় দিয়ে চললাম অনিশ্চয়তার হাত ধরে।
দিশাহীন পথে।
ক্রমশ ………………
১৯তম পর্ব পড়ুন আগামী বৃহস্পতিবার ।
লেখিকার পরিচিতি –
মনীষা কর বাগচী বিয়ের পর দিল্লিতে আসেন। শৈশব এবং কৈশোর কেটেছে সবুজে শ্যামলে ঘেরা নদীয়া জেলার মাঝেরগ্রাম নামক একটি গ্রামে।
স্কুল থেকেই লেখা লিখি শুরু । নিজের মনেই লিখে যেতেন কত কিছু। আজ সে সব লেখাগুলোও হারিয়ে গেছে। লেখার অনুপ্রেরণা জোগান সেজোকাকা কবি নিশিকান্ত বাগচী।
দেশে এবং বিদেশে অসংখ্য লিটিল ম্যাগাজিনে লেখা প্রকাশিত হয়। প্রতিদিন কিছু না কিছু লেখেন। শ্রদ্ধেয় কাকু বিরাট বৈরাগ্যের সহায়তায় হরিচাঁদ ঠাকুরের গান লিখেছেন।
এ পর্যন্ত লেখিকার নিচের আটটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।
১ নীল দিগন্ত
২ চোখের কোণে জল
৩ নূতন ভোর
৪ বসন্তরেণু
৫ শিউলি বেলার সুর
৬ বিবর্ণ বনলতা
৭ তপন বাগচী গভীর অনুধ্যান
৮ স্বপ্ন সফর (গল্প বই)
দু’টি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের পথে।
১ শিমুলরঙা সূর্য
২ দেখা হত যদি