ধারাবাহিক উপন্যাস - প্রতি সোম, বুধ এবং শুক্রবার।
৫ম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
৬ষ্ঠ পর্ব শুরু …………………
৬
গঙ্গায় অবগাহন করে ফিরে এসে ব্রজগোপাল বালিশের তলা থেকে
কলমটা বার করে চেয়ারে বসল। টেবিলটা মোটামুটি পরিচ্ছন্ন। টেবিলের ওপর ফুটবল ছাড়া রয়েছে কয়েকটা খেলার ম্যাগাজিন।
চেয়ারে বসে বুল্টির দেওয়া খাতাটা খুলে বসলো সে। সকালবেলা একবার সোনার কলমের
কেরামতি পরীক্ষা করা দরকার। কলমটা খাতার উপর রেখে তিনবার হাততালি দিল। তারপর মনে
মনে প্রতীক্ষা করতে লাগলো। ঠিক ত্রিশ সেকেন্ডের মাথায় পেনের মধ্যে জ্বল উঠলো সেই
মোহময় আলো। সূর্যদেব এখনও আকাশে মাথা তোলেন নি। চরাচর
জুড়ে ছড়িয়ে পড়েনি তার আলো। ঘরের মধ্যে আবছা অন্ধকার। তবু ঘরের ভেতরের সেই মোহময়
আলোয় ব্রজগোপাল দেখলো খাতার পাতায় মুক্তো মতো হস্তাক্ষরে লেখা আছে, জ্বলবে
মজার আলো, কলমচির হবে ভালো/ কলম ধরলে হাতে লেখা হবে সাথে সাথে।
কি লিখবে? খানিকক্ষণ ভাবলো ব্রজগোপাল। তারপর কলম তুলে
নিয়ে খাতার পাতায় হেডিং লিখলো, একটা ফুটবল ম্যাচের ধারাভাষ্য। তারপর আধঘন্টা ধরে
ব্রজগোপালের খাতার উপর কলম চললো ঝড়ের গতিতে। আধঘন্টা পরে লেখাটা যখন শেষ হল তখন
সেটার দিকে অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে রইলো সে। হেডিং এর তলায় লেখকের নাম লেখা
ব্রজগোপাল পাকড়াশি। তারপর টানা ছ’পাতা লেখা। লেখা পাতাগুলো খাতা থেকে ছিঁড়ে পিন
আপ করে ভাঁজ করে একটা খামে ঢুকিয়ে
টেবিলের ওপর রেখে কলমটা বালিশের তলায় নিয়ে শুয়ে পড়ল। খানিকক্ষণের
মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ল সে।
এ বাড়িতে দিন শুরু হয় একটু বেলা করেই। ব্রজগোপালের বাবা
হরিশঙ্করবাবু কাজ করেন খবরের কাগজের অফিসে।
অফিসে বেরোন তিনটে সাড়ে তিনটে নাগাদ। বাড়ি ফিরতে ফিরতে একটা-দেড়টা। বুল্টি, যার পোষাকি নাম মঞ্জুলেখা
- পড়ে রবীন্দ্রভারতীতে। বারোটার পর সে ইউনিভার্সিটি যায়। আর ব্রজগোপালের অফিস
গেলেও হয়, না গেলেও হয়। তবু প্রত্যেকদিন সে এগারোটা-সাড়ে এগারোটা নাগাদ অফিস
যায়। দুপুরে ঘরে বসে থাকা তার পোষায় না। কোনো দিন কাজ থাকলে দু’তিন ঘন্টা করে।
তারপর মাঠে যায় টিম নিয়ে। বড়বাবু তাকে স্নেহের চোখে দেখেন। ছেলেটা খেলে ভালো।
আজকালকার ছেলেদের মতো নেশা ভাঙ করে না। তারপর পালটি ঘর। সরকারি চাকরি। তার মেয়েটা
এবার থার্ড ইয়ারে উঠলো। বিয়ে তো দিতে হবে। হাতের কাছে যদি একটা ভালো ছেলে পাওয়া
যায়। একবার কথা বলে দেখতে তো ক্ষতি নেই। ব্রজর বাবা হরিশঙ্করবাবু মানুষ ভালো।
অন্তত চামার নয়। ব্রজর সঙ্গে মেয়েটার একবার পরিচয় করিয়ে দিলে হয়। দু’জনের যদি
পছন্দ হয়ে যায়। তারপর প্রজাপতির ইচ্ছা। ব্রজকে একবার তিনি বাড়িতে নিয়ে যাবেন।
অফিসে ব্রজগোপালের সাত খুন মাপ। তারপর ছেলেটা চাকরিতে
ঢোকার পর ইস্টার্ন রেলের ঘরে মেডেল, কাপ, শিল্ড এসেছে বিস্তর। তাই ব্রজকে ছাড়
দেওয়া যেতে পারে। স্বয়ং জি.এম সাহেব ব্রজকে পছন্দ করেন। ফলে চাকরি-জীবনে ব্রজ আরও
উন্নতি করবে। অফিসে কলম পেষার লোক আছে অনেক। কিন্তু কাপ, ট্রফি আনার লোক ঐ একজনই। অফিসশুদ্ধ লোক তাই ব্রজকে পছন্দ করে।
ব্রজর ব্যবহারটা বড় মধুর। লেখাপড়ায়
একটু কমজোরি। তা তাতে কিছু এসে যায় না।
সকাল নটা নাগাদ চায়র টেবিলে বসে হরিশঙ্করবাবু বললেন, খোকন
(ব্রজকে বাড়ির সবাই খোকন নামেই ডাকে) এন.এফ রেলের সঙ্গে তোমাদের ওই খেলাটার
কয়েকটা পয়েন্ট আমাকে লিখে দিও তো। একটা স্টোরি বানাতে হবে। ইস্টার্ন রেল থেকে
বারবার ফোন করছে। বিজ্ঞাপনও ওরা দিয়েছে ভালো টাকার। পয়েন্টগুলো স্পোর্টস রিপোর্টার নব্যেন্দুকে
দিলে ও একটা ভালো স্টোরি নামিয়ে দিতে পারবে। ছেলেটার ইমাজিনেশন খুব ভালো। লেখার
হাতটাও চমৎকার। আজকেই দিও। বুল্টিকে বোলো লিখে দেবেখন। ও তো বারোটার আগে বেরোবে
না।
-
ওটা আমি লিখে রেখেছি বাবা।
-
তুমি লিখেছ?
-
বলতে পারো ওরকমই।
-
কৈ, আমাকে বলোনি তো।
-
আমি তো তেমন গুছিয়ে লিখতে পারি না
তো তাই-
-
পয়েন্টগুলো সব আছে তো?
-
আছে।
-
তোমার হ্যাট্রিক?
-
তাও আছে।
-
কোথায় সে লেখা?
-
আমার ঘরে আছে। একটু বোসো, এনে
দিচ্ছি।
উঠে গেল ব্রজগোপাল। খাতাটা আর পেনটা তোষকের তলায় রেখে
খামে ভরা লেখার পাতাগুলো এনে দিল হরিশঙ্করবাবুর হাতে। খাতাটা হাতে নিয়ে আর একবার
চমক খেয়েছিল ব্রজগোপাল। একেবারে সাদা খাতা। সামনের
পাতার ছড়া উধাও। অথচ আজ সকালেই সে ছড়াটা দেখেছে। একি ভুতুড়ে ব্যাপার নাকি! অবশ্য অতসব ভাবার এখন সময় নেই।
বাবা অপেক্ষা করছে।
লেখার পাতাভরা খামটা এনে সে বাবার হাতে দিল। হরিশঙ্করবাবু
খামটা রেখে দিলেন তার অফিস ব্যাগে। এখন দেখার সময় নেই। বাজার যেতে হবে। অফিসে গিয়ে
খামটা ধরিয়ে দেবেন নব্যেন্দুর হাতে। স্টোরিটা যদি আজকেই নামাতে পারে! বাজারের ব্যাগ
নিয়ে বার হলেন হরিশঙ্করবাবু।
অফিসে এসে নব্যেন্দুর হাতে ব্রজর দেওয়া খামটা ধরিয়ে দিয়ে
বললেন, এর মধ্যে এন.এফ.রেলের সঙ্গে খেলার পয়েন্টগুলো সব আছে। বিকেলের মধ্যে
লেখাটা নামিয়ে ফেল। কালকের কাগজেই কিন্তু
লেখাটা যাবে। এরপর তিনি ডুবে গেলেন নিজের কাজে। চিফ সাব এডিটরের অনেক কাজ।
আধঘন্টা পরে নিউজ এডিটর হরিশঙ্করবাবুকে ডেকে পাঠালেন নিজের
ঘরে। বললেন, কনগ্রাচুলেশনস। বেয়ারাকে ডেকে বললেন, দু’কাপ কফি দিতে। বেয়ারা কফি
দিয়ে গেলে কফিতে চুমুক দিয়ে বললেন, নিন, কফি খান।
ব্যাপারটা ঠিক কোন দিকে যাচ্ছে ধরতে পারলেন না
হরিশঙ্করবাবু। নিউজ এডিটর চেম্বারে ডেকে কফি খাওয়াচ্ছেন। আবার কনগ্রাচুলেশন! এতো বছর
এই অফিসে কাজ করছেন। সাব-এডিটর থেকে চিফ সাব
এডিটর হয়েছেন। এমন তো কখনও হয়নি।
নিউজ এডিটর বললেন, আপনি যে এতো ভালো লেখেন বলেন নি তো
কখনো। টেলপ্রিন্টার ঘেঁটে, পিটিআই, রয়টার
ঘেঁটে আর পোকা বেছে জীবনটা কাটিয়ে দিলেন।
অথচ এতো শক্তিশালী কলম আপনার। এমন সুললিত সাবলীল গদ্য অনেকদিন পড়িনি। পাঠক
এ লেখা শুধু পড়বে না, গোগ্রাসে গিলবে। আপনি এখন থেকে সপ্তাহে দু’তিনটে করে লেখা
লিখুন। চল্লিশ বছর এ লাইনে হয়ে গেল। আমি লেখা বুঝি মশাই।
-
আপনি কোন লেখার কথা বলছেন বলুন
তো?
-
যেটা আপনি একটু আগে নব্যেন্দুকে
এডিট করতে দিয়েছিলেন।
-
সেটা তো আমার ছেলে ব্রজ, মানে যে
ফুটবল খেলে, সে পয়েন্টগুলো লিখে দিয়েছিল।
-
শুধু পয়েন্ট লেখেনি হরিশঙ্করবাবু। পুরো লেখাটাই লিখেছে।
অ্যান্ড এ ভেরি গুড পিস অফ রাইটিং।
-
নব্যেন্দু এডিট করে লেখেনি?
-
এডিট করবে কি – কলম ছোঁয়াতে
পারেনি। এনেছিল আমার কাছে। লেখকের
লেখা কেটে ছেঁটে উড়িয়ে দিই বলে বাজারে আমার বদনাম আছে। কিন্তু আমিও দাঁত ফোটাতে
পারিনি। প্রত্যেকটা সেন্টেন্স যেন পেলের দুরন্ত শট। ওই লেখাটা আপনি লেখেন নি?
-
না। খেলার লেখা আমার ঠিক আসে না।
ছেলেকে বলেছিলাম পয়েন্টগুলো লিখে দিতে। নব্যেন্দু স্টোরিটা নামিয়ে দেবে।
-
আপনার ছেলে কি লেখালিখি করে?
-
কখনো তো দেখিনি। লেখাপড়ার সঙ্গে
সে বাবুর তেমন কোন সম্পর্ক নেই বলেই জানি। ফুটবল ছাড়া পৃথিবীতে আর কোনো বস্তু
আছে বলে সে জানে না। মেয়ে বরং লেখালিখির চেষ্টা করে। আমাদের সংস্থার ম্যাগাজিনে
তার দু’চারটে কবিতা বেরিয়েছে।
-
আপনি লেখাটা দেখেন নি?
-
না, খেলাটা আমি তেমন বুঝি না।
তাছাড়া বাজার করার তাড়া ছিল। তাই লেখাশুদ্ধ খামটা সোজা ব্যাগে নিয়ে নিয়েছিলাম।
অফিসে এসে নব্যেন্দুকে দিই এডিট করার জন্য।
-
আপনার মেয়ে লেখেনি তো?
-
বোধহয় না। লিখলে আমাকে বলতো।
-
তা হলে আপনার ছেলেই লিখেছে। ফুটবল
গুলে না খেলে ফুটবলের এমন সমস্ত টার্ম লেখা যায় না। আসলে হরিশঙ্করবাবু আমাদের
ছেলেমেয়েদের আমরা কতটুকুই বা চিনি!
-
তা অবশ্য বটে।
-
যা হোক, লেখাটা কালকে আমারা পেজ ওয়ানে অ্যাঙ্কার স্টোরি করবো। পাঁচ
কলমে। তিন কলমের সোলাস বিজ্ঞাপন আছে। আপনার ছেলের নামেই লেখাটা বেরোবে। সঙ্গে
আপনার ছেলের ছবি। ছেলেকে বলুন একটা ছবি দিয়ে যেতে।
-
ছেলেকে এখন কোথায় পাবো। সে তো
মোহনবাগান মাঠে। আজ রেলের সঙ্গে ওয়াড়ির খেলা আছে।
-
বাড়িতে আর কেউ নেই যে ছবি দিতে
যেতে পারে? বা গাড়ি পাঠালে ছবি দিতে পারবে?
-
আচ্ছা দেখছি। বাড়িতে বোধহয় মেয়ে
আছে।
-
বাড়িতে ফোন করুন। এখান থেকেই
করুন।
-
হ্যাঁ, তাই করছি।
-
মেয়েকে জিজ্ঞেস করে নেবেন লেখাটা
সে লিখেছে কি না। মেয়ে লিখলে মেয়ের নামেই বেরোবে।
বাড়ির লাইন ধরলেন হরিশঙ্করবাবু।
-
বুল্টি।
-
বাবা। হঠাৎ এ সময়! বুল্টি যেন একটু
উৎকন্ঠিত। কোনো অসুবিধা হয়েছে? শরীর খারাপ।
-
না, না। সেসব কিছু নয়। তোর দাদা
আছে বাড়িতে?
-
দাদার তো আজ খেলা আছে। তোমাকে
বললো তো সকালে।
-
আচ্ছা তুই কি দু’চারদিনের মধ্যে
দাদাকে কোনও লেখা লিখে দিয়েছিস?
-
লেখা! আমি! কই না তো। কিসের লেখা?
-
খেলার।
-
খেলার কিছু আমি বুঝি নাকি! তবে-
-
তবে?
-
দাদা কাল রাতে আমার কাছ থেকে একটা
খাতা চেয়ে নিয়েছিল।
-
খাতা!
-
হ্যাঁ। আমি বললাম তুই খাতা কি
করবি? বললো ফুটবলের ছবি আঁকবো। কেন কি হয়েছে বাবা?
-
তেমন কিছু নয়। হ্যাঁরে, খোকনের
কোনো ছবি আছে ঘরে?
-
কেমন ছবি?
-
পাসপোর্ট।
-
আমার কাছেই আছে।
-
শোন, আমাদের অফিস থেকে লোক
যাচ্ছে। তার কাছে খোকনের একটা পাসপোর্ট সাইজের ছবি দিয়ে দিস।
-
বলো না বাবা কি হয়েছে?
-
কাল সকালে জানতে পারবি। ভালো একটা
ছবি বেছে রাখ।
ফোন নামিয়ে রেখে হরিশঙ্করবাবু বললেন, না মেয়ে লেখেনি। তবে
ছেলেটা কাল রাতে মেয়ের কাছ থেকে একটা খাতা চেয়ে নিয়েছিল ফুটবলের ছবি আঁকবে বলে।
-
ফুটবলের ছবিই এঁকেছে। লেখাটা নিয়ে
যান। কম্পোজে পাঠান। দেখবেন প্রুফটা যেন নির্ভুল হয়।
ক্রমশ …………………
৭ম পর্ব পড়ুন আগামী শুক্রবার।
লেখক পরিচিতিঃ
উৎপল মৈত্রের শৈশব কেটেছে সুন্দরবনে। পরবর্তীতে
লেখাপড়া কলকাতায়। একদা দৈনিক বসু্মতীর সাংবাদিক ছিলেন। উত্তরবঙ্গে কাটিয়েছেন
দীর্ঘকাল। বর্তমানে বইওয়ালা নামে একটি প্রকাশনা সংস্থার সঙ্গে যুক্ত। স্থায়ী নিবাস
কলকাতায়। ছদ্মনাম ভীষ্মলোচন শর্মা।