বাংলা ভাষা ইন্দো - ইউরোপীয় মূল ভাষাগোষ্ঠীর
অন্তর্গত । বাংলা ভাষা মোটামুটি ভাবে অবয়ব নিয়েছিল খ্রিস্টীয় দশ শতকের দিকে ।
এর পূর্ববর্তী স্তর হল মাগধী অপভ্রংশ - অবহট্ বা মাগধী প্রাকৃত । বাংলা ভাষায়
বাংলা সাহিত্য সৃষ্টির পূর্বে বাঙালিরা সংস্কৃত , প্রাকৃত ও অপভ্রংশ ভাষায় সাহিত্য রচনা করেছে
।
বাংলা সাহিত্যের বর্তমান বয়সকাল কমপক্ষে এক
হাজার বছর । এই সুদীর্ঘ হাজার বছরের ইতিহাসে বাংলা সাহিত্যের গতি প্রকৃতির নানাবিধ
পরিবর্তনও ঘটেছে । বিভিন্ন রাষ্ট্রনৈতিক বিপর্যয় তথা পরিবর্তনও ঘটেছে এই সময়ে ।
সেসব দিকে লক্ষ্য রেখে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসকে কয়েকটি ভাগে ( সময় কালের দিক
দিয়ে ) বিন্যস্ত করা যায় । যেমন- ১ ) প্রাচীন বা আদিযুগ ( আনুমানিক ৯৫০-১২০০
খ্রিঃ, ২ ) অন্ধকার যুগ বা যুগ সন্ধিকাল ( আনুমানিক
১২০১-১৩৫০ খ্রিঃ ) , ৩ ) মধ্যযুগ ( ১৩৫১-১৮০০ খ্রিঃ ) এবং
৪ ) আধুনিক যুগ ( ১৮০১ খ্রিঃ থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত ) ।
বাংলা সাহিত্যের আদিযুগের একমাত্র নিদর্শন ' চর্যাপদ ' বা ' চর্যাচর্যবিনিশ্চয়
' নামক কাব্যগ্রন্থ । আবার মহাযুগের প্রথম গ্রন্থ তথা
নিদর্শন ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন '। প্রাচীন
বাংলা সাহিত্যের জহুরি বসন্তরঞ্জন রায় বিদ্বদ্বল্লভ ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে ( ১৩১৬
বঙ্গাব্দে ) বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুরের কাছাকাছি কাঁকিল্যা গ্রাম নিবাসী
শ্রীনিবাস আচার্যের দৌহিত্র বংশজাত দেবেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের গোয়াল ঘরের খাঁচা
থেকে শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের পুঁথি আবিষ্কার করেন । ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে ( ১৩২৩ বঙ্গাব্দে
) আবিষ্কর্তা বসন্তরঞ্জন রায়ের সম্পাদনায় বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে উক্ত পুঁথিটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় । ২০১৬ খ্রিস্টাব্দ / ১৪২৩ বঙ্গাব্দ বড়ু চণ্ডীদাস রচিত ' শ্রীকৃষ্ণকীর্তন
' কাব্যগ্রন্থের প্রকাশনার শতবর্ষ ছিল।
'শ্রীকৃষ্ণকীর্তন ' - এর রচনাকাল নিয়ে গবেষকদের মধ্যে মতভেদ থাকলেও মোটামুটি ভাবে
খ্রিস্টীয় পনেরো শতকের প্রথম ভাগেই কাব্যটি রচিত হয়েছিল বলে ধরে নেওয়া হয় ।
বড়ুচণ্ডীদাসের ' 'শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ -এর কাহিনী অংশ
সংগৃহীত হয়েছে লোক - প্রচলিত রাধাকৃষ্ণকথা এবং ভাগবত , বিষ্ণুপুরাণ
, হরিবংশ , ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ
ইত্যাদি থেকে । তেরো খণ্ডে বা অধ্যায়ে ( জন্মখণ্ড
তাম্বুলখও দানখণ্ড, নৌকাখণ্ড, ভাবখণ্ড, ছত্র খণ্ড,
বৃন্দাবন খণ্ড, কালিয়দমন খণ্ড , যমুনাখণ্ড , হারখণ্ড, বাণখণ্ড,বংশীখণ্ড এবং রাধাবিরহ ) বিভক্ত উক্ত
গ্রন্থটিতে পদসংখ্যা চার শতাধিক । ' শ্রীকৃষ্ণকীর্তন '
- এ জয়দেবের সংস্কৃতকাব্য ' গীতগোবিন্দম্
' - এর সুস্পষ্ট প্রভাব রয়েছে । কেননা , শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের শ্রেষ্ঠ গীতাংশ গীতগোবিন্দের প্রায় আক্ষরিক অনুবাদ
। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যে দেখানো হয়েছে ভূভার হরণের জন্যে বৈকুণ্ঠের নারায়ণ
মর্ত্যধাম তথা পৃথিবীতে জন্মেছেন কৃষ্ণ হয়ে এবং লক্ষ্মীদেবী জন্মেছেন রাধা হয়ে । তাঁর সঙ্গে বিবাহ হয় সম্পর্কে কৃষ্ণের মামা আইহনের । কৃষ্ণ রাধাকে দেখে নানা ভাবে তাঁর স্বরূপ বোঝাবার চেষ্টা করেন ।
শেষে রাধা - কৃষ্ণের মিলন হয় বৃদ্ধা বড়াই ( রাধার একমাত্র সহচরী ) -এর চেষ্টায়
। কিন্তু কৃষ্ণ কংসবধের জন্যে মথুরায় চলে গেলে রাধাবিরহে কাহিনীর সমাপ্তি ঘটেছে ।
বসন্তরঞ্জন রায় কর্তৃক শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের যে
পুথিটি আবিষ্কৃত হয়েছিল সেটিই এই কাব্যের আবিষ্কৃত একমাত্র পুঁথি । পুথিটি
প্রাচীন বাংলার তুলোট কাগজে লিখিত । এর প্রথম , মধ্য ও অভ্যভাগের কয়েকটি পৃষ্ঠা পাওয়া না যাওয়ার কাব্যের নাম ,
রচনাকাল , পুঁথি নকলের সন তারিখ ,
কবির বিস্তৃত পরিচয় ইত্যাদি কিছুই জানা যায়নি । আলোচ্য পুঁথির মধ্যে যে চিরকুটটি পাওয়া যায় তাতে বোঝা যায় পুথিটি ১৬৮২
খ্রিস্টাব্দে বাঁকুড়ার বনবিষ্ণুপুরের রাজগ্রন্থাগারে রক্ষিত ছিল । চিরকুটটিতে '
শ্রীকৃষ্ণসন্দর্ভ ' (শ্রীকৃষ্ণসন্দর্ব ) লেখা ছিল । তারই সূত্র ধরে গ্রন্থআবিষ্কারক গ্রন্থ তথা কাব্যটির নাম
দেন 'শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'। গ্রন্থমধ্যে
গ্রন্থরচয়িতা বড়ু চণ্ডীদাসের ভণিতা আছে তেতাল্লিশ বার ।
ভণিতাগুলোতে বিভিন্ন নাম পাওয়া যায় - বড়ু চণ্ডীদাস , চণ্ডীদাস
, অনন্ত বড়ু চণ্ডীদাস ইত্যাদি । এর ফলেই সৃষ্টি হয়েছে
চণ্ডীদাস সমস্যা ।
কোন কোন গবেষক মনে করেন কবির নাম ' অনন্ত ’ , ‘ চণ্ডীদাস ' তাঁর উপাধি । কিন্তু চণ্ডীদাস ভণিতায় শুধু ‘ অনন্ত ’ কোথাও ব্যবহার
করেননি । তাই অনেক গবেষক আবার মত দিয়েছেন- ' অনন্ত 'তাঁর নাম নয় , এই নাম তাঁর অপ্রচলিত নাম হতে
পারে কিংবা গায়েনের দেওয়া নাম হতে পারে । তাই তাঁর আসল নাম ‘ বড়ু চণ্ডীদাস '। ' বড়ু ' শব্দটি '
বটু ' শব্দ থেকে এসেছে । 'বঁটু ’ শব্দের অর্থব্রাহ্মণ সন্তান । সেজন্যে বড়ু চণ্ডীদাস ব্রাহ্মণ
সন্তান ছিলেন বলে অনেক গবেষক অনুমান করেন । এই মতের স্বপক্ষে তাঁদের যুক্তি হল –
বড়ু চণ্ডীদাস নিজে ভণিতায় নিজেকে বাসুলীর সেবক বলে
উল্লেখ করেছেন । এতেও চণ্ডীদাস সমস্যার সমাধান হয়নি । কারণ বড়ু চণ্ডীদাস ও
পদাবলীকার চণ্ডীদাসকে ঘিরে সমস্যা ঘনীভূত হয়েছে । স্মর্তব্য , শ্রীচৈতন্যদেব ( ১৪৮৬-১৫৩৪ খিঃ ) চণ্ডীদাসের পদ আস্বাদন করতেন ।
সেজন্যে চণ্ডীদাস সমস্যা সমস্যাই থেকে গেছে , সর্বসম্মত
সমাধান আজও হয়নি । চৈতন্য - পূর্ব যুগে আবির্ভূত বড়ু চণ্ডীদাসের অবির্ভাব স্থান
নিয়েও বিরোধ রয়েছে । কেউ তাঁকে বলেছেন বীরভূমের নান্নুরের কবি , আবার কেউ বলেছেন তিনি বাঁকুড়ার ছাতনার । বাঁকুড়ার বনবিষ্ণুপুর থেকে
শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যগ্রন্থটি আবিষ্কৃত হওয়ায় এবং সেখানে বাসুলীদেবীর মন্দির
থাকায় কবির অবির্ভাব - স্থান হিসেবে বাঁকুড়ার ছাতনার দাবিটা অধিকতর জোরালো
হয়েছে ।
শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের মূল বিষয় রাধা -
কৃষ্ণের প্রণয়লীলা বৈষ্ণব পদাবলীর মতো নয় । কেননা , রাধা এখানে প্রথমাবধি কৃষ্ণগতপ্রাণা ও কৃষ্ণ অনুরক্তা নন । আবার ,
তাঁকে বিদ্যাপতির রাধার মতো ছলাকলায় পারদর্শী প্রগলভা ও শ্যাম -
মুগ্ধা নায়িকা বলেও মনে হয় না । পাশাপাশি , জয়দেবের
রাধার সঙ্গেও তাঁর তুলনা চলে না । বড়ু চণ্ডীদাসের রাধা মানবী , তিনি মহাভাব স্বরূপিণী নন । কবি তাঁকে আত্মস্বরূপ বিস্মৃতারূপে চিহ্নিত
করার ফলে মানবীরূপেই তাঁর চরিত্র উদ্ভাসিত । দেহ - চেতনার পথ ধরে প্রেম - চেতনা
জাগ্রত হওয়ার ফলে ' শ্রীকৃষ্ণকীর্তন ' - এর রাধা পার্থিব চাওয়া - পাওয়ার উর্ধ্বে পৌঁছতে পারেন না । 'বংশীখণ্ড ’ ও ‘ রাধাবিরহ ' - এ তাঁর যে
আত্মনিবেদন তা দেহসংরাগশূন্য নয় । বিরহানলে দগ্ধ হয়ে প্রেম সোনায় পরিণত হলেও
শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের রাধা পদাবলী সাহিত্যের রাধার মতো শুধু স্বপ্ন - দর্শনে কৃষ্ণকে
লাভ করে তৃপ্ত হননি । তাইতো শ্রীকৃষ্ণকীর্তন বৈষ্ণব পদাবলী থেকে আখ্যান ও চরিত্র
পরিকল্পনার দিক থেকে আলাদা ।
বাংলা ভাষায় রচিত প্রাচীনতম কাহিনীকাব্য হচ্ছে
শ্রীকৃষ্ণকীর্তন '। বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন '
চর্যাপদ ' রচিত হওয়ার পর বাংলা
সাহিত্যের ইতিহাসে অন্ধকার তথা বন্ধ্যা যুগের সৃষ্টি হয়েছিল অনিবার্য কারণে । '
শ্রীকৃষ্ণকীর্তন ' কাব্য রচিত হওয়ার
সঙ্গে সঙ্গে সে বন্ধ্যাত্ব ঘুচে যায় । মধ্যযুগের আদিগ্রন্থ ' শ্রীকৃষ্ণকীর্তন ' - এর গুরুত্ব সেজন্যে বাংলা
ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাসে অবশ্যস্বীকার্য । শ্রীকৃষ্ণকীর্তন প্রকাশনার শতবর্ষে বিষয়টা
উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়েছিল তা নির্দ্বিধায় বলা যায়
।
লেখক পরিচিতি –
ড.বাসুদেব রায়ের জন্ম ১৯৬২ সালে। কবিতার মাধ্যমে সাহিত্যের জগতে আত্মপ্রকাশ। প্রথম প্রকাশিত বই মানব' (কাব্যগ্রন্থ), দ্বিতীয় বই রক্তের বাঁধন (উপন্যাস)। সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় পদচারণা করলেও প্রবন্ধ সাহিত্যের দিকে তার ঝোঁক বেশি। তদুপরি গবেষণামূলক প্রবন্ধ তথা বই লিখতে তিনি অধিকতর উৎসাহী। গবেষণামূলক বইয়ের পাশাপাশি সাধু-মহাপুরুষদের জীবনী-গ্রন্থ, একাঙ্কিকা ইত্যাদি সম্পাদনাও করেছেন তিনি।
ড.বাসুদেব রায়ের বেশ কয়েকটি বই প্রকাশিত হয়েছে। হার উল্লেখযোগ্য গবেষণা গুলোর মধ্যে রয়েছে মনসামঙ্গল কাব্যে দেবদেবীর স্বরূপ', চণ্ডীমঙ্গল ও অন্নদামঙ্গল কাব্যে দেবদেবীর স্বরূপ, মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে সমাজ-চিত্র ইত্যাদি। তাঁর যৌথ রচনা ও উপেক্ষণীয় নয়।
বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় বাসুদেব রায় নিরলস ভাবে লিখে চলেছেন। এছাড়াও নতুন করে তিনি একক ও যৌথভাবে বেশ কয়েকটি গবেষণামূলক কাজে হাত দিয়েছেন। নিয়মিত বিভিন্ন e magazine-এ লেখেন।
