অফিসের কাজে দক্ষিণ আফ্রিকায় গিয়েছিলাম
একমাসের জন্য। কাজের মাঝেই ঠিক করা হ’ল কদিন ‘ব্রেক’ দিয়ে একটু ‘সাফারি পার্কে’ ঘুরে আসার। শুনলাম ওই সময়টাতেই জন্তু-জানোয়াররা খুব
হাট্টা-কাট্টা আর ‘তাজা’ থাকে। জুন মাসের শেষ,দেশে
পিচ-গলা গরম,কিন্তু
দক্ষিণ আফ্রিকাতে তখন কনকনে শীত। তাই এই সময়টাতে টুরিস্ট এর ভিড়ও বেশি।
যাবো যাবো করেও বার বার কাজের চাপে হয়ে
উঠছিল না। শেষে এক সপ্তাহান্তে প্রায় হঠাত্ই
বেরিয়ে পড়লাম-এক সহকর্মী আর একজন স্থানীয় অফিসার,মিঃ
এন্ডুজ এর সঙ্গে; নিজের
দামী গাড়ি নিয়েই বেরিয়ে পড়েছিল এন্ড্রুজ।
পথে জঙ্গলের পরিবেশে গাড়িতে চড়ে ভীষণ ভালো
লাগছিল। রাস্তার মসৃণতা আর প্রশস্ততা বাদ দিলে এ যেন আমাদের দেশের কোন গ্রামের
রাস্তা। দুদিকে সবুজের ছড়াছড়ি। একনাগাড়ে দু’সপ্তাহ কাজ করার ক্লান্তি যেন হঠাত্ই, দূর হয়ে গেল।
সন্ধের বেশ
আগেই ‘সাফারি পার্কে’ পৌঁছাতে পারায় সময় নষ্ট না করে একটু
চা খেয়েই বেরিয়ে পড়া গেল। রাতে জঙ্গলে যাওয়া বারণ তাই সূর্য ডোবার আগে যতটুকু সময়
ছিল ততক্ষণ জঙ্গলের বাইরের দিকটা চক্কর দিয়ে কিছু হাতি, গণ্ডার,জল-হস্তি
ইত্যাদি দেখেই ফিরে আসা ঠিক হ’ল। তাছাড়া আকাশে একখণ্ড গর্ভবতী মেঘও দেখা দিয়েছিল। এখানে
নাকি এই সময় হঠৎ হঠাৎ বৃষ্টি হয়ে যায়।
জঙ্গলের এক প্রান্তেই থাকা,খাওয়া,রেস্টুরেন্ট
ইত্যাদির ব্যবস্থা ছিল। আগে থেকে ‘বুক’ না করা আর অত্যধিক ভিড়ের জন্য ভাল ‘লজ’
পেলাম না,অথচ
আমি ওদের সম্মানিত অতিথি বলে আমাকে ডর্মেটরিতে থাকতে দেওয়াও ওরা উচিত মনে করলো না।
তাই, সাফারি পার্কেরই খুব কাছে একটি ‘কটেজে’ আমার থাকার ব্যবস্থা করা হ’ল।
সারাদিনের সফরের ক্লান্তি বুঝতে পারলাম সন্ধ্যার পরে। তাই সাফারি থেকে ফেরার পথে সামান্য চা-টা খেয়ে কটেজে চলে এলাম। ঠিক হ’ল রাতে
ক্যাফেটেরিয়ার কোন কর্মচারী আমার জন্য গরম গরম ‘ডিনার’ কটেজেই নিয়ে আসবে,আর আমার
খাওয়া শেষ হলে সে বাসন-পত্র নিয়ে চলে যাবে।
এই ব্যবস্থায় আমিও খুশি হলাম শীতের রাতে
আবার ‘ধরা-চূড়া’ পরে বেরুতে হবে না। জঙ্গলের মাঝে ‘এয়ার কন্ডিশন’ কুটিরে থাকা বেশ
রোমাঞ্চকর আর উত্তেজক অভিজ্ঞতা মনে হ’চ্ছিলো,যদিও ঘন ঘন পশুরাজ আর তার
প্রজাদের হুঙ্কারে গায়ে কাঁটা দিয়েও উঠছিল। বিশেষ করে এই কটেজ গুলি বাইরে থেকে খড়-বিচালি আর লতা-পাতায় মুড়ে একেবারে এক একটি কুটিরের আকার দেওয়া থাকে। কংক্রিটের
ছাদের বদলে ছিল খড়-বিচালি মোড়া পর্ণ-কুটির। দিনের শেষ আলোতে এই ‘অভিজাত’
কুটিরগুলোতে থাকা অনেকটা ‘অভিযান’ অভিযান’ মনে হচ্ছিলো।
যা হোক, জামা-কাপড়
বদলে আরাম করে সোফায় বসে বড় মাপের টি ভি টা খুলে দেখতে শুরু করলাম। ওদিকে,শহরের যে
কোন ভাল হোটেলের ঘরের মত ‘কুটিরের’ এক কোনে একটি মিনি-ফ্রিজও দেখতে পেলাম। ভাবলাম
ডিনার এলে বিখ্যাত সাউথ-আফ্রিকান ‘ওয়াইন’ ও চেখে দেখা যাবে। তাতে এতটা ভ্রমণের
ক্লান্তিও দূর হয়ে রাতভর টানা ঘুম মারতে পারা যাবে।
টি ভি তে এটা-ওটা খবর আসছিল আর বেশি আসছিল
বিজ্ঞাপন। বিরক্ত হয়ে ওটাকে বন্ধই করে দিলাম। ওদিকে বাইরে থেকে জঙ্গলের বিভিন্ন
রকম শব্দ আসছিল-এর মধ্যে সিংহ, হাতি
আর বাঘের গর্জনই শোনা যাচ্ছিলো বেশি। মাঝে মধ্যে অবশ্য,শেয়াল আর
বুনো কুকুরের রেষারেষির ডাকও শোনা যাচ্ছিল-মনে হচ্ছিলো যেন আমার কটেজের পাশেই।
এদিকে চন চন করে খিদেও লাগছিল-চার ঘণ্টা
গাড়িতে আর তারপর এখানে পৌঁছে এক-কাপ চা আর এক টুকরো কেক ছাড়া কিছুই পেটে যায়নি। ভাবছিলাম
কখন ক্যাফেটেরিয়ার বেয়ারা খাবার নিয়ে আসবে-গরম গরম সুপ আর ধোঁয়া-ওঠা সুগন্ধি
খাবার। ভাবতেই মুখে জল এলো আর খিদেটা আরও চাগিয়ে উঠলো। টিভির টেবিলে রাখা ছোট
ঘড়িটাতে সময় দেখলাম রাত ন’টা বাজতে চলেছে। এত দেরি করে তো বিদেশীরা ডিনার করেনা,ভাবলাম। কিছু একটা গণ্ডগোল
হয়েছে কোথাও,এই
ভেবে বিছানার পাশে রাখা টেলিফোনটির দিকে তাকালাম-ফোন করে দেখা দরকার কি ব্যাপার।
এন্ড্রুজ এর নম্বর আছে আমার কাছে। তাছাড়া রেস্টুরেন্টের ম্যানেজার এর নম্বরও রয়েছে
টেলিফোনের বইটাতে।
ঠিক এই সময়ে আমার কটেজের কাঠের দরজায়
আস্তে করে টোকা পড়ল।
“এসে
গেছে”,ভাবলাম।
জামা-কাপড় একটু ঠিক-ঠাক করে নিয়ে উঠে গিয়ে
দরজা খুলে দিলাম।
সাড়ে ছ’ফুটের উপর লম্বা রোগা-ডিগডিগে আর
মিশমিশে কালো হোটেলের উর্দি পরিহিত একটি লোক ধপধপে সাদা কাপড়-ঢাকা একটি ট্রে হাতে
ঘরে ঢুকেই বাঁহাতে ভারী ট্রেটা ধরে ডান হাত দিয়ে এক বিশাল স্যালুট মারল আর আমার
অজানা কোন ভাষায় কিছু বলল। কিন্তু নামী হোটেলের দামী খাবারের গন্ধের বদলে জংলী
জানোয়ারের বিশেষ করে বাঘ-সিংহের গায়ের বোটকা গন্ধ নাকে এলো। ভাবলাম এত বড় সাফারি পার্কের সংলগ্ন কটেজে রয়েছি,জন্তু-জানোয়ারের
গায়ের গন্ধ আসা তো স্বাভাবিক। তবু লোকটাকে ইশারায় দরজাটা
দেখিয়ে ইংরাজিতে বললাম,“প্লিজ,দরজাটা
ভাল করে বন্ধ করে দাও”।
বেয়ারা মাথা নেড়ে জানালো,“ওকে”; খাবার
ট্রেটা গোল টেবিলটার উপর রেখে দরজাটা বন্ধ করে এসে টেবিলটা গোছগাছ করতে লাগলো, টেবিলের
উপর রাখা কাগজে মোড়া জলের গ্লাসটা বের করে মিনারেল ওয়াটারের বোতল খুলে জল ঢেলে
দিল। বোটকা গন্ধটা আরও তীব্র হয়ে যেন ছ্যাঁক করে নাকে লাগলো;আমার বমি
বমি ভাব হতে লাগল। লোকটার সামনে বমি করলে একটা বিশ্রী ব্যাপার হবে আর সারা হোটেলে
খবরটা চাউর হয়ে যাবে এই ভেবে আমি খুব বিনীতভাবে বললাম,“ ঠিক
আছে,আপনি
বাইরে অপেক্ষা করুন,আমি খেয়ে নিয়ে আপনাকে ডাকবো”। লোকোটি মাথা
হেলিয়ে ‘নড’ করে বেরিয়ে গেল।
আমি নাকে হাত রেখে বাথরুমে গিয়ে ভাল করে
মুখে-চোখ ধুয়ে ফিরে এলাম; আশ্চর্য, এবার
আর বোটকা গন্ধটা পাচ্ছিলাম না।
যাহোক, বমি
হবার ভয়েই বুঝি খিদেও কোথায় উধাও হয়ে গিয়েছিল; ভাবলাম
একটু পরে খাবো।
ঠিক এই সময় আবার দরজায় টোকা পড়ল।
বিরক্তি বোধ করলাম- ভারী অভদ্র তো, লোকটার
এত তাড়া কিসের?
ভাবলাম,ম্যানেজারের কাছে কমপ্লেইন করতে হবে কাল।
এমন সময় আবার দরজার টোকা পড়ল।
এবার আমি সত্যি অসন্তুষ্ট বোধ করলাম।
বিরস মুখে দরজাটা অর্ধেক খুলেই
ধমক লাগালাম,“এটা
কি হচ্ছে এ্যাঁ ক্যান্ট ইউ ওয়েট?” কিন্তু
অবাক হয়ে গেলাম,সামনে
দাঁড়িয়ে এন্ড্রুজ,খুব
বিনয়ের সংগে বলে উঠলো,“হেই,স্যার,একটা ভীষণ
ভীষণ অন্যায় হয়ে গেছে,এ টেরিবেল মিস্টেক”।
অবাক হয়ে ওকে ঘরে ঢুকতে আহবান করে
জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম।
অত্যন্ত দুঃখিত হয়ে এন্ড্রুজ যা বলল তার
মর্মার্থ হল আমার কুটিরে খাবার নিয়ে আসতে হবে এই অনুরোধটা ম্যানেজার কাজের চাপে
ভুলে মেরে দিয়েছিল। “হি ইজ ভেরী ভেরী সরি স্যার”। পিছনে দেখলাম বেচারা ম্যানেজার
কাঁচু-মাচু মুখ করে হাত-জোড় করে দাঁড়িয়ে আছে আর তার পিছনে ‘সাহেব বেয়ারা’ আমার
খাবার নিয়ে মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে।
অবাকের ঘোর সামান্য কাটলে আমি জিজ্ঞেস
করলাম,“তাহলে
ও কে ছিল? আর
টেবিলের উপর ওই খাবারটাই বা কোথা থেকে এলো?”
“খাবার?” এন্ড্রুজ
আর ম্যানেজার দুজনই অবাক হয়ে টেবিলের উপর রাখা কাপড়-ঢাকা ট্রেটার দিকে দৌড়ে গেল।
ম্যানেজার এগিয়ে এসে সাদা কাপড়টা তুলতেই
আবার সেই বোটকা গন্ধটা ফিরে এলো আর ম্যানেজারের হাত থেকে কাপড়টা মেঝেতে পড়ে গেল।
এন্ড্রুজ কটেজের জোরালো আলোটা জ্বালাতেই
যা দেখা গেল তাতে এন্ড্রুজ আর ম্যানেজার নাকে হাত দিয়ে তিন হাত পিছিয়ে এলো, “ও
মাই গড”!
“এ
যে পচা লায়ন ফিড”, সিংহের
খাবার,“কাঁচা
মাংস”, চেঁচিয়ে
উঠলো ম্যানেজার।
আমার চোখ তখন চড়ক গাছেরও উপরে; মাথা
ঘুরে মাটিতে পড়ে যাবার আগে এন্ড্রুজ এসে ধরে ফেলল আমাকে।
আমাকে সোফায় বসিয়ে দিয়ে ম্যানেজার প্রায়
ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করলো,“আচ্ছা,যে লোকটা
ওই ট্রেটা এনেছিল সেকি প্রায় সাত ফুট লম্বা ছিল?”
আমি অবাক হয়ে ঘাড় নেড়ে সায় জানালাম,“ইয়েস”।
“ও
মাই গড”। আবার বলে উঠলো ম্যানেজার।
আমি আর এন্ড্রুজ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ওর
পানে তাকিয়ে রইলাম।
ম্যানেজার ধীরে ধীরে বলতে লাগল,“গার্ডেনের
বদনামের ভয়ে খবরটা বাইরে জানতে দেওয়া হয়নি। কাল রাতে গার্ডেনে একটা ভয়ানক ‘অ্যাক্সিডেন্ট’
হয়ে গেছে। রাতে, কি
কারণে জেমস মানে ওই লম্বা বেয়ারাটা ঘর থেকে বেরিয়ে জঙ্গলের দিকে গিয়েছিল। আর
ফেরেনি। সকালে,ওর
আধ-খাওয়া দেহটা পাওয়া গিয়েছিল জঙ্গলের পাড়ে-সিংহদের আড্ডায়”।
এন্ড্রুজ আর আমি দুজনেই একসঙ্গে বলে উঠলাম,“ও মাই গড”,”ওহ, মাই
গড”।
লেখক পরিচিতি –
শোভনলাল আধারকার-এর স্কুলে থাকতেই শুরু হয়েছিল গল্প আর মহাকাশের উপর প্রবন্ধ লেখা। ওই সময়েই “শুকতারা”তে “অসীমের অন্বেষণে” প্রকাশিত হয়েছিল। সীমাহীন বলেই বুঝি মহাকাশের আকর্ষণ ছিল অসীম। জ্যোতিঃশাস্ত্রের ছোটখাটো বই পড়ে কম দামী বাইনোকুলার চোখে লাগিয়ে চলতে লাগল নক্ষত্রদের সংগে নীরব বার্তালাপ। ইচ্ছা ছিল জ্যোতিঃশাস্ত্র নিয়ে পড়াশুনা করা। কিন্তু “Need to have and Nice to have” এর কলহে সেটা হতে পারেনি। কিন্তু নেশা আর পেশায় দ্বন্দ্ব কখনও হয়নি। তাই এখন এই পরিণত বয়সেও মহাকাশের আর বিজ্ঞানের অনন্ত রহস্য নতুন করে জেনে ও জানিয়ে সহজ সরল ভাষায় পরিবেষণ করে আনন্দ পান।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় আর আই. আই. টি, দিল্লি থেকে পড়াশুনা ও গবেষণা,কিছুদিন অধ্যাপনা,তারপর সরকারী বৈজ্ঞানিক দপ্তরে কার্যকালে পৃথিবীর কয়েকটি দেশেও কাজ করার সৌভাগ্য হয়েছে।
পঞ্চাশটিরও বেশি প্রবন্ধ নামী বৈজ্ঞানিক পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসে (ইন্দোর) আমন্ত্রিত প্রবন্ধ পাঠ করার গৌরবও ভাগ্যে ঘটেছে। বিগত দেড় বছর করোনার প্রকোপে ছাপাখানা বন্ধ থাকার কারণে অনেক ই-ম্যাগাজিনে বিজ্ঞান বিষয়ক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে ও হচ্ছে।
দিল্লি থেকে প্রকাশিত বহুল জনপ্রিয় ই-ম্যাগাজিন, “তাৎক্ষণিক”এর ‘জানা-অজানা’ কলমে এখন পর্যন্ত প্রায় ৩০ টি জনপ্রিয়-বিজ্ঞান বিষয়ক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। সম্প্রতি “দেশ” ওয়েব-সাইটে একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে এবং বিশেষ প্রশংসিত হয়েছে।