কোভিড-১৯ এর মরশুমের দ্বিতীয় বছর চলছিল। হাওয়াই জাহাজে যাতায়াতে ভীষণ কড়াকড়ি-হাতে প্লাস্টিকের দস্তানা,মুখে
‘ডবল’ মুখোস, মাঝখানের
যাত্রীর আবার সর্বাঙ্গ ঢাকা প্লাস্টিকের ওভারল। তবুও ভাগ্যক্রমে সামনের গেটের
দ্বিতীয় রো’তেই জায়গা পেয়ে বর্তে গেলাম। স্ত্রীকে জানালার সিটে বসিয়ে আমার ভাগ্যে
জুটল আপাদ-মস্তক প্লাস্টিকে মোড়া যাত্রী হিসাবে একজন। ফটো
দেখলে নিজেই নিজেকে চিনতে পারা কষ্টকর হ’ত। অনেকক্ষণ ধরে বসে আছি আর করুণাময়ের
কাছে প্রার্থনা করছি-যদি ‘আইল’ (Aisl) এর সিটের যাত্রী না আসে
তাহলে আমি সেই জায়গাটি অধিকার করে গা থেকে প্লাস্টিকের ‘খোলস’ ছাড়িয়ে আরাম করে
বসতে পারব। কিন্তু ‘বিড়ালে’র ভাগ্যে সে সিকে কি ছিঁড়বে? ভাবছিলাম
‘ছিঁড়তেও পারে - একবার পাঁচ টাকার লটারির টিকিট কিনে
দেড়’শ টাকার লটারি পেয়েছিলাম না? দেড়’শ
টাকা হ’লে কি হবে-লটারি তো? আশায়
ভর দিয়ে আঙুল কামড়ে বসে রইলাম।
কিন্তু
বিড়ালের ভাগ্যে শিকে ছিঁড়ল না। শেষ মুহূর্তে প্লেনের দরজা বন্ধ হওয়ার ঠিক আধ-মিনিট
আগে এসে হাজির হলেন তিনি,এক সাদা-কালো
দাঁড়ি-গোঁফ আর ঘাড় পর্যন্ত লম্বা চুল ওয়ালা এক সাধু বাবা। চোখে পুরু কাঁচের চশমার
পিছনে দেখতে পাচ্ছিলাম একজোড়া অতি উজ্জ্বল চোখ। চোখ আর চেহারা এত সম্ভ্রম জাগানো
হলেও আমার মনটা খুশি হতে পারলনা - কারণ লোভী ছোট ছেলেটির মত একরাশ আশা নিয়ে লোভীর
মত বসে ছিলাম ওই সিটটাতে কেউ না থাকলে আমি নিজেকে প্লাস্টিকে
মোড়া ‘ওভারল’ থেকে মুক্ত করতে পারতাম। কি আর করা যাবে সহ্য করতে হবে
অবস্থাটা প্রায় দু’টি ঘণ্টা। আমার ডানদিকে বসা গেরুয়া-ধারী ভদ্রলোক চোখ বুজে যেন
ধ্যানস্থ হয়ে বসেই আসেন পাথর প্রতিমার মত। ওঁর শরীরের গন্ধের বদলে সুভাষিত চন্দনের
সুভাস ভেসে আসছিল। তবুও যতটা সম্ভব সরে বসলাম।
আমার অসন্তোষের আভাস পেয়েই বোধহয় বাঁদিকে
বসা গৃহিনী সামনের সিটের পিছনের পকেট থেকে একটি হাওয়াই কোম্পানির সুদৃশ্য সাময়িক
পত্রের পাতা ওলটাতে ওলটাতে এক পাতায় এসে হাত থেমে গেল। আমিও চোখের কোন দিয়ে এক ঝলক
নজর মারলাম-ছোট্ট করে ছাপা লেখকের ফটোটা। একটু যেন পরিচিত মনে হচ্ছিল,কিন্তু
কার সেটা ঠিক মনে আসছিলনা। কিন্তু মুখটা যেন খুব চেনে চেনা লাগছিল। মনের মধ্যে যখন
এ-নিয়ে তোলপাড় চলছিল তখনই গিন্নি ফিসিফিসিয়ে বলে উঠলেন-ঠিক তোমাদের ‘মিশ্র’দা’-র মত দেখতে না?
আমার মনের পর্দায় ভেসে এলো প্রায় দশ বছরের
পুরানো স্মৃতি:
মিশ্র-দা ওরফে মনমোহন মিশ্র। আমরা দু’জনই
কিছুদিন একসঙ্গে পাশাপাশি বসে কাজ করেছিলাম-আমি এক্সটেনশনে আর উনি অন্য অফিস থেকে
একবছর আগে অবসর নিয়ে বিশেষজ্ঞ হিসাবে এসেছিলেন আমাদের অফিসে। বয়সে আমরা সমান সমান
হলেও অন্যান্য সবার মত আমিও ওঁকে ‘মিশ্রদা’ বলেই ডাকতাম। খুব জ্ঞানী মানুষ ছিলেন
‘মিশ্র-দা’। কিন্তু কাজের ব্যাপারে কোন ‘কম্প্রোমাইজ’ করার ছিলেন ঘোর বিরোধী। একটা
বিশেষ ‘টাইম-বাউণ্ড’ প্রকল্পের জন্য আমারই অফিসে একটি নতুন শাখা খোলা হয়েছিল,আর তারই
কাজের দায়িত্ব ছিল আমাদের উপর। কাজের ভিড়ে কতদিন মধ্যরাত হয়ে গিয়েছিল কারও খেয়াল
থাকত না। কত দিন সেই মধ্যরাতে ওঁকে বাড়ি পৌঁছে দিতে গেছি আমাদের ‘চাটার্ড’
ট্যাক্সিতে। পথে কত কাহিনী,কত গল্প হতো। যৌবনে মিশ্র-দা একবার পূর্ব
ইয়োরোপের কয়েকটি দেশেও কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলেন- কখনও সখনও সেখানকার জীবনযাপনের গল্প সবিস্তারে কিছু ঝাল-মিষ্টি মশলা মিশিয়ে
বলতেন উনি। স্পেন দেশ থাকে আসা মার্থা নামের একটি মেয়ের সঙ্গে বিশেষ ঘনিষ্ঠ ভাবেও
মিশেছিলেন,সে সব সরেস গল্প বলতেন মিশ্র-দা-অবশ্য আমারই
পীড়াপীড়িতে। অনেক রাতে বাড়িতে ফিরে সেসব গল্প কিছু কিছু গৃহিণীর কাছেও বলতে হতো,আমার
দীর্ঘ কাজের-দিনের হিসাব দিতে গেলে এসব তো করতেই
হ’ত। এক রাতে কাজ করতে করতে অনেক দেরি হয়ে যাওয়াতে গাড়ি করে ওকে পৌঁছে দিতে হয়েছিল;
হঠাৎ মাঝ রাস্তায় গাড়ি গেল বিগড়ে। সর্দারজী ড্রাইভার বলল,“থোড়া টাইম
লাগেগা স্যার”,বলে গাড়ির নিচে ঢুকে পড়লো। যতক্ষণ
ড্রাইভার গাড়ি ঠিক করতে লেগেছিল ততক্ষণ আমরা দু’জন গাড়ি থেকে সামান্য দূরে
বসেছিলাম একটা ভাঙা গাছের গুঁড়ির উপর-আমার হাতে সিগারেট আর মিশ্রদা’র হাতে সুগন্ধী
দামী সিগার।
আমার পীড়াপীড়িতেই মিশ্র-দা সেইরাতে তাঁর
জীবনের এক অজানা অধ্যায় উন্মোচিত করেছিলেন আমার কাছে।
মার্থা
এসেছিল ভূমধ্যসাগরের গা-ঘেঁষা দেশ স্পেন থেকে। মার্থার গভীর নীল চোখ দুটি ছিল
ভূমধ্যসাগরের মত উজ্জ্বল নীল; কিন্তু
ও অন্যান্য ইয়োরোপিয়ান মেয়েদের মত উচ্ছল ছিল না-ছিল ভূমধ্যসাগরের মত গভীর
অন্তর্মুখী স্বভাবের। এসেছিল মিশ্র-দারই মত সুপার-কম্প্যুটারের তালিম নিতে। দেখা হ’ত প্রতিদিনই সকাল-বিকালের ‘কফি-ব্রেকে’। ঘন কালো
একজোড়া ভ্রুর আড়ালে অমন উজ্জ্বল নীল চোখ নাকি মিশ্র-দা কোনদিন দেখেননি। আলাপের
ক’দিন পরেই মার্থাকে সে কথা বলেছিলেন মিশ্র-দা। খিলখিলিয়ে অনেকক্ষণ ধরে হেসে
মার্থা বলেছিল, অমন
চোখ নাকি স্পেনের রাস্তা-ঘাটে সর্বত্র দেখা যায়। মিশ্র-দা মানতে চাননি, বলেছিলেন,“হতে
পারেনা,অমন
চোখ শুধু তোমার মুখেই মানায়”।
মার্থা আর এক প্রস্থ হেসে বলেছিল,“সেটা যে
দুটো চোখ দিয়ে তা দেখছে এটা তারই গুন”।
তবুও মানেননি মিশ্র-দা। তবে আর তর্কের বিষয় খুঁজে না পেয়ে চুপ করে হেসেছিলেন। কথায়
কথায় মার্থা জানিয়েছিল ওদের গ্রামটা একেবারে ভূমধ্যসাগরের গা-ঘেঁসে একটা পাহাড়ের
ঢালে। সেখানে সূর্যোদয় আর সূর্যাস্ত দুই দেখা যায়
সকাল-বিকালে। আপন কল্পনায় ছবির মত সেই ছোট্ট গ্রামটিকে দেখার ভীষণ লোভ হয়েছিল
মিশ্র-দার। অমন সুন্দর একটা জায়গা না দেখে চলে গেলে সারা জীবন পস্তাতে হবে। কথাটা মার্থাকেও জানাতে ভুল হয়নি। মার্থা নাকি
খিলখিলিয়ে হেসে বলেছিল,“একবার ও গ্রামের জামাই হলে যখন ইচ্ছে যেতে
পারবে সেখানে। সবুরে ম্যাওয়া ফলে মশাই”।
ভূমধ্যসাগরের জলের মত নীল চোখ দুটি সুন্দর
করে নাচিয়ে সেই ভুবন-ভোলান হাসি হেসেছিল মার্থা আর লুব্ধ-চোখে তাকিয়ে ছিল
মিশ্র-দা।
ওদের ট্রেনিং ছিল তিন মাসের;মাঝে
অবশ্য ছিল এক-সপ্তাহের ‘খ্রিসমাস-ব্রেক’। মার্থা গেল স্পেনে নিজের মা-বাবা-ভাই-বোন
দের সঙ্গে উৎসবের ছুটি কাটাতে। মিশ্র-দা আর এক ভারতীয় বন্ধুর সঙ্গে বেরিয়ে পড়েছিল
স্পেনের সমুদ্র উপকূলবর্তী শহরগুলি ঘুরে দেখতে,যদিও খুব
ইচ্ছে ছিল মার্থার সঙ্গেই ওদের অতি সুন্দর গ্রামে ছুটি কাটিয়ে আসার,কিন্তু
সেটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে ভেবে দুজনেই সেই প্ল্যান বাতিল করে দিয়ে ঠিক করেছিল
ট্রেনিং শেষ করেই মিশ্র-দাকে নিয়ে হাজির করবে মার্থার বাপ-মা’র সামনে। খ্রিসমাসের
ছুটিটা মার্থা ওর ’কিছুটা-রক্ষণশীল’ পরিবারের সমর্থন জোগাড় করার জন্যই কাজে লাগাবে
ঠিক করল। প্ল্যানটা মিশ্র-দারও ঠিক মনে হয়েছিল।
ক্রমশ ………………
২য় পর্ব পড়ুন আগামীকাল ।
লেখক পরিচিতি –
শোভনলাল আধারকার-এর স্কুলে থাকতেই শুরু হয়েছিল গল্প আর মহাকাশের উপর প্রবন্ধ লেখা। ওই সময়েই “শুকতারা”তে “অসীমের অন্বেষণে” প্রকাশিত হয়েছিল। সীমাহীন বলেই বুঝি মহাকাশের আকর্ষণ ছিল অসীম। জ্যোতিঃশাস্ত্রের ছোটখাটো বই পড়ে কম দামী বাইনোকুলার চোখে লাগিয়ে চলতে লাগল নক্ষত্রদের সংগে নীরব বার্তালাপ। ইচ্ছা ছিল জ্যোতিঃশাস্ত্র নিয়ে পড়াশুনা করা। কিন্তু “Need to have and Nice to have” এর কলহে সেটা হতে পারেনি। কিন্তু নেশা আর পেশায় দ্বন্দ্ব কখনও হয়নি। তাই এখন এই পরিণত বয়সেও মহাকাশের আর বিজ্ঞানের অনন্ত রহস্য নতুন করে জেনে ও জানিয়ে সহজ সরল ভাষায় পরিবেষণ করে আনন্দ পান।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় আর আই. আই. টি, দিল্লি থেকে পড়াশুনা ও গবেষণা,কিছুদিন অধ্যাপনা,তারপর সরকারী বৈজ্ঞানিক দপ্তরে কার্যকালে পৃথিবীর কয়েকটি দেশেও কাজ করার সৌভাগ্য হয়েছে।
পঞ্চাশটিরও বেশি প্রবন্ধ নামী বৈজ্ঞানিক পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসে (ইন্দোর) আমন্ত্রিত প্রবন্ধ পাঠ করার গৌরবও ভাগ্যে ঘটেছে। বিগত দেড় বছর করোনার প্রকোপে ছাপাখানা বন্ধ থাকার কারণে অনেক ই-ম্যাগাজিনে বিজ্ঞান বিষয়ক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে ও হচ্ছে।
দিল্লি থেকে প্রকাশিত বহুল জনপ্রিয় ই-ম্যাগাজিন, “তাৎক্ষণিক”এর ‘জানা-অজানা’ কলমে এখন পর্যন্ত প্রায় ৩০ টি জনপ্রিয়-বিজ্ঞান বিষয়ক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। সম্প্রতি “দেশ” ওয়েব-সাইটে একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে এবং বিশেষ প্রশংসিত হয়েছে।