পাশাপাশি
হাঁটছিলাম দুজনে-মন্দিরা আর আমি। একই কলেজে একসঙ্গে কাজ করি। মন্দিরার গায়ের হালকা
মিষ্টি গন্ধ
লাগছিল নাকে - কোন এক নাম-না-জানা ফুলের হাল্কা মিষ্টি গন্ধ,নাকি কোন এক নামী কোম্পানির সুরভি-সারের পরিচিত গন্ধ। গন্ধটা খুব মিষ্টি আর
চেনা চেনা। ভীষণ ভালো লাগে আমার এই গন্ধটা-আগেও বলেছি ওকে। ও হেসে বলেছিল “বডি-স্প্রে’ কোম্পানিকে বলবো পুরো এক কেস
পাঠিয়ে দিতে তোমার জন্যে”। আমি দুষ্টুমি করে হেসে উত্তর
দিয়েছিলাম “তার চেয়ে ভালো হয় যদি যে এই স্প্রে ব্যবহার
করে সে নিজেই এসে কাছে থাকে”। মন্দিরা চোখ বড় করে শাসিয়ে
ছিল, “এই, ইউ নটি”।
মন্দিরা ওর
আসল নাম নয়,আমিই আদর করে নামটা দিয়েছিলাম,কেননা ওর মনটা ছিল মন্দিরের মত পবিত্র। আর ওরও ভীষণ পছন্দ হয়েছিল নামটা। প্রথমে
উচ্চারণটা ঠিক আসত না, পরে ক্রমাগত ব্যবহারের ফলে নিজেই ফোনে পরিষ্কার উত্তর দিত, ‘মন্দিরা’ হিয়ার’। আসলে ও ‘ম্যান্ডারিন জোনস’-ক্যানাডার উপকূলের আমেরিকান।
আমরা খুব
কাছাকাছি ঘনিষ্ঠ হয়ে হাঁটছিলাম আর ওর শুভ্র স্বচ্ছ শরীর আমার শরীর স্পর্শ করছিল বার বার আর ও আদর করে
আমার কোমরে হাত দিয়ে আমাকে আলতো করে কাছে টানছিল।
অন্ধকার হয়েছে
অনেকক্ষণ,কিন্তু স্বল্প
আলোকিত নদীর ধার আলো আধারিতে মোহময় স্বপ্নলোক তৈরি হয়েছিল। সপ্তাহান্তে এখানে
প্রচুর ভিড় হয়-কোন বেঞ্চই খালি পাওয়ার জো থাকেনা। আজ ‘উইক-এন্ড’ নয় তাই ভিড় তেমন ঘন নয়। সুন্দর কুল
কুল করে বয়ে যাওয়া ছোট নদীটি। নামটিও খুব সুন্দর-‘পিস্কাটাকুয়া’। প্রথমে নামটা উচ্চারণে আমারও খটমট লাগতো।আমার
সুবিধার জন্যে আমেরিকান বন্ধুরা সিলেবেল ভেঙে বলতেন-“পিস-কাটা-কুয়া”,
মানে টুকরো টুকরো করে কাটা কুয়া। এখন আর অসুবিধা হয়না।
এই নদীটির
পাড়েই গড়ে উঠেছে সুন্দর শহর- প্রধানত, ব্রিটিশ উপনিবেশকারীর স্থান,পোর্টস্মিথ,ভ্রমণকারীদের
স্বপ্নের শহর। খুব উত্তেজিত হয়েছিলাম যখন প্রথমে এই শহরে চাকরী নিয়ে এলাম। তারপর
প্রায়ই কলেজের কাজের শেষে সন্ধ্যায় বেড়াতে আসতাম। ফুরফুরে হাওয়া বইছে আজ,নদীর উপর দিয়ে সাঁতরে আসা স্নিগ্ধ আর আরামপ্রদ। এই আবহাওয়ায় মনে পড়ে
যায় পুরানো দিনের কলকাতার ইডেন-গার্ডেন এর গঙ্গার ধারকে।মফঃস্বলের
মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে এসেছিলাম কলকাতার কলেজে পড়তে। বন্ধুদের সঙ্গে যেতাম ‘ইডেনে’-র ‘হাওয়া’
খেতে। আমিই ছিলাম কেবল একা;অন্য বন্ধুরা ততদিনে সঙ্গিনী জুটিয়ে নিয়েছিলো।অতীন আসতো শ্বেতাকে নিয়ে আর মানসের সঙ্গে থাকতো মনীষা। এই পাঁচজন
প্রায়ই আমরা একসঙ্গে থাকতাম। অন্যরা আড়ালে-আবডালে বলত,”ফাইভ-মাস্কেটিয়ার্স”। অতীন
ঠাট্টা করে বলতো, “ফাইভ না সিক্স মাস্কেটিয়ার্স”। আমি হাঁ
করে তাকিয়ে থাকতাম আর মানস আড়-চোখে দেখাতো দূরে দাঁড়িয়ে থাকা সংযুক্তা সেনকে। আমারও
ভালো লাগতো ওর স্বচ্ছ,স্নিগ্ধ চেহারা আর মরাল-গ্রীবার উপরে একজোড়া দৃপ্ত চোখের উজ্জ্বল দৃষ্টি। সংক্ষেপে
‘এস এস’ অর্থাৎ সংযুক্তা সেন
ক্লাসের সকলের থেকে আলাদা থাকতো,ধবধবে সাদা গায়ের রঙ তার
উপরে নীল রঙের চোখের তারা-যেন একটি ‘রাজ-হাঁস’। অতীন ঠাট্টা করে এস এস না বলে বলতো এসো এসো আর মানস আমাকে পিছন থেকে
আঁকড়ে ধরে গুন-গুনাতো,“এসো এসো আমার ঘরে এসো”। আমি
ওদের মত বেপরোয়া ছিলামনা।মফঃস্বলের মধ্যবিত্ত মানসিকটায়
বেড়ে ওঠা আমি ওদের মত সোচ্চারও ছিলাম না। আমার ভীষণ ভয় করতো,যদি রেগে এস একটা থাপ্পড় লাগায়? আলাপের পরে অবশ্য সংযুক্তা হেসে বলেছিল ওর খুব
খারাপ লাগতো না বরং মজাই লাগত। ওর মতে,এটাই তো মজা করার বয়স,কয়েক বছরের মধ্যেই বাস্তবের টানা-পোড়নে এইসব মজা করার ইচ্ছে শুকিয়ে গিয়ে
মজা-হাজা ডোবার আকার নেবে। আপন মনেই পুরানো দিনের রোমন্থনে মুখে বুঝি এক ঝিলিক হাসি খেলে গিয়েছিল।
-২-
“হেই! হোয়্যার আর ইউ?”, মন্দিরার কনুই এর ধাক্কায় আমার স্মৃতি-রোমন্থন
হোঁচট খেয়ে অতীত থেকে বর্তমানে ফিরে এলো,স্মিত হেসে মন্দিরার দিকে ফিরে তাকালাম,’ইয়েস সুইটি’।
“কি ভাবছিলে”? চলতে চলতে আলতো হেসে প্রশ্ন করলো মন্দিরা।
একটা খালি
বেঞ্চে বসতে বসতে মন্দিরাকেও ইঙ্গিত করলাম।
নদীর ছোট ছোট
ঢেউগুলো তীরে এসে ছলাৎ ছলাৎ আওয়াজ তুলছিল; অদূরে নোঙর করা সাদা বোটগুলো ঢেউয়ের দোলায় দুলছিল
যেন অসংখ্য রাজহাঁস-ছেলেবেলার খেলা পদ্ম-পুকুরে ভাসানো কচু-পাতার ভেলার মত।
ছেলেবেলার সেই স্বপ্নালু দিনগুলোর কথা কি ভোলা যায়?
আর একবার
পুরানো দিনে ফিরে যাবার আগেই মন্দিরা বলে উঠল, “আজ তুমি এত অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছ কেন, সামথিং রুং সুমন?”
সামান্য হেসে
বললাম,“না না কিছু নয়; কিন্তু তুমি যে বলেছিলে স্পোর্টস্মিথ সম্বন্ধে লেকচার দেবে?”
মন্দিরা সজোরে
প্রতিবাদ করলো,“ ওহ ,নো;লেকচার নয়। তোমাকে
লেকচার দেবার দুঃসাহস আমার হতে পারেনা-আফটার অল তুমি আমার ক্লাসের স্টুডেন্ট নও”।
স্মিত হেসে
এবার মন্দিরা শুরু করলো, “আসলে এটি একটি
বন্দর-শহর; ব্রিটিশ উপনিবেশকারীরা ১৬৩০-এর
কাছাকাছি এই ছোট গ্রামে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছিল; আবেনাকি ভাষায় এই নদীটির নাম ছিল,”পিস্কাটাকোয়া” মানে “খরস্রোতা জলধারার শাখা”। নদীর পাড়ের এই
গ্রামটির নাম ছিল “স্ট্র-বেরী ব্যাঙ্কস”, কারণ এর দুইপারে ছিল অসংখ্য ‘স্ট্র-বেরী’-র জঙ্গল। জন মেসন নামক ব্রিটিশ এই
স্পোর্ট-স্মিথ শহরের পত্তন করেন ১৬৫৩সালে। এই জন মেসন
ছিলেন ইংলণ্ডের বিখ্যাত পোর্ট-স্মিথ বন্দরের ক্যাপ্টেন। তাঁরই স্মৃতিতে
পরবর্তীকালে এই স্থানের নামকরণ করা পোর্ট-স্মিথ।
সামান্য থেমে মৃদু হেসে মন্দিরা আবার শুরু করল, “মার্টিন প্রিং এর লেখা থেকে এই অঞ্চল সম্বন্ধে অনেক কিছু জানা যায়। ইয়োরোপিয়ানদের সংগে সংঘর্ষের অনেক আগে এই অঞ্চলে
বসবাস করত উত্তর-পূর্ব আমেরিকার আদিবাসী ‘আবেনাকি’
ও অন্যান্য সম্প্রদায়”।
মন্দিরার কথার
মাঝে আমি লক্ষ্য করলাম ওর কথাগুলি ঐতিহাসিকের
ভাষণের মত মোটেই লাগছিল না,মনে হচ্ছিলো কথাগুলি ওর অন্তরের গভীর থেকে ভেসে আসছিলো।
ঘনায়মান
সন্ধ্যায় আত্ম লীন-ভাবে বলে চলল মন্দিরা, “ ইংরেজ উপনিবেশকারীরা এ অঞ্চল দখল করে বসবাস করা
শুরু করে ১৬৩০সাল নাগাদ। সেই থেকেই এই নদীটির নাম আবেনাকি ভাষার অনুকরণে ‘পেস্কে’ মানে শাখা আর টেগয়ে মানে খরস্রোতা নদী, এই দুটি শব্দ মিলিয়ে হয়ে গেল ‘পিস্কাটাকোয়া’। প্রায় ৫০ বছর পরে এই শহরে
স্থাপিত হ’ল উত্তর আমেরিকার ব্রিটিশ কলোনির রাজধানী।
আশে-পাশের অঞ্চলের বিতাড়িতরা (Exiles) এসে এখানে
আশ্রয় নিতে লাগল”।
মন্দিরাকে
থামতে দেখে আমি দৌড়ে গিয়ে কাছের দোকান থেকে দুটো আইসক্রিম নিয়ে এলাম-ও আইসক্রিমের
খুব ভক্ত।
আইসক্রিম দেখে
ওর লোলুপ চোখ দুটো বাচ্চাদের মত চিক চিক করে উঠলো আর ওর আপেল-রঙের লাল লাল গালে
গভীর টোল পড়লো। হেসে হাত বাড়িয়ে আইসক্রিম নিয়ে বলে উঠলো, “ তুমি ভীষণ চালাক-এভাবেই তুমি আমাকে প্যাম্পার করো”।
আমি বাঁ হাত
দিয়ে আলতো করে জড়িয়ে ধরে ওকে আদর করলাম।
মন্দিরা আমার
গালে একটা হালকা চুমু খেয়ে বলল, “ লাভ ইউ ডিয়ার”।
আইসক্রিমের
আনন্দ নিতে নিতে মন্দিরা বলে চলল,“এই পিস্কাটাকোয়া নদীটা আসলে দুটো ছোট পাহাড়ি নদীর মিলনে হয়েছে; মাত্র ১২ মাইল দৌড়ে গিয়ে পিস্কাটাকোয়া নিজেকে
আটলান্টিক মহাসাগরে সমর্পণ করেছে”,বলেই মন্দিরা নিজেও সমর্পণের ভঙ্গিতে আমার কোলে শুয়ে পড়ে আইসক্রিমের স্বাদ
উপভোগ করতে করতে আদুরে হাসিতে লুটিয়ে পড়লো।
-৩-
আমি উজ্জ্বল
শহরের আলো দেখতে দেখতে,আলতো করে
মন্দিরার রেশমি চুলে হাত বোলাতে বোলাতে তীর-বেগে ধাবমান মোটরবোট গুলোর মৃদু আলো দেখতে দেখতে বললাম,“ওটা কি একটা বড় জাহাজ?”
মন্দিরা
আধ-শোওয়া অবস্থাতেই বলল, “না না ওটা ঘন
সবুজে ঢাকা একটা ছোট দ্বীপ,নাম ‘ব্যাজার্স আইল্যান্ড’। ভাল করে লক্ষ্য করে দেখলাম ঘন সবুজে ঘেরা স্বল্প আলোকিত ব্যাজার্স
আইল্যান্ডকে। মন্দিরার সোনালী রেশমি চুলে হাত চালাতে চালাতে দার্শনিকের মত বলে
উঠলাম, “জানো মন্দিরা, আমার মনে হয়,ভগবানের অনেক দানের মধ্যে আলো নয় অন্ধকারের অবদান অনেক বেশী কেননা অন্ধকারই
নিয়ে আসে নির্জনতা আর নির্জনতা না হলে আমরা সত্যের সন্ধান পাবো কি করে? অন্ধকার আছে,তাই তো আলো কি তা বুঝতে পারি”।
এবার মন্দিরা
এক ঝটকায় উঠে বসে আমার মুখে হাত চাপা দিয়ে বলে উঠলো,“এই,প্লিজ এখন
তোমার ফিলসফি আবার শুরু কোরোনা-এই সুন্দর সন্ধ্যায় অ্যাপ্লাইড ইকনমিক্স এর
প্রফেসরের মুখে আমি ফিলসফি শুনতে রাজি নই।“
আমি হেসে
উত্তর দিলাম, “মানুষ মাত্রই
ফিলসফার,আর তুমি যদি
ফিজিক্সের নামকরা প্রফেসর হয়েও এত ইতিহাস জানতে পারো তাহলে আমি সামান্য ইকনমিক্স
পড়াতে পড়াতে কেন একটু আধটু দর্শন চর্চা করতে পারব না?”
সে কথার জবাব
না দিয়ে গভীর রাতের দরবারী রাগে বলে উঠলো মন্দিরা, “সুমন,তুমি আমার
অতীত সম্বন্ধে কিছুই জাননা”।
“জানতে চাইও না”, ওর মুখে হাত চাপা দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে উত্তর করলাম।
………(ক্রমশ)
দ্বিতীয় পর্ব
পড়ুন আগামী কাল
লেখক পরিচিতি –
শোভনলাল আধারকার-এর স্কুলে থাকতেই শুরু হয়েছিল গল্প আর মহাকাশের উপর প্রবন্ধ লেখা। ওই সময়েই “শুকতারা”তে “অসীমের অন্বেষণে” প্রকাশিত হয়েছিল। সীমাহীন বলেই বুঝি মহাকাশের আকর্ষণ ছিল অসীম। জ্যোতিঃশাস্ত্রের ছোটখাটো বই পড়ে কম দামী বাইনোকুলার চোখে লাগিয়ে চলতে লাগল নক্ষত্রদের সংগে নীরব বার্তালাপ। ইচ্ছা ছিল জ্যোতিঃশাস্ত্র নিয়ে পড়াশুনা করা। কিন্তু “Need to have and Nice to have” এর কলহে সেটা হতে পারেনি। কিন্তু নেশা আর পেশায় দ্বন্দ্ব কখনও হয়নি। তাই এখন এই পরিণত বয়সেও মহাকাশের আর বিজ্ঞানের অনন্ত রহস্য নতুন করে জেনে ও জানিয়ে সহজ সরল ভাষায় পরিবেষণ করে আনন্দ পান।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় আর আই. আই. টি, দিল্লি থেকে পড়াশুনা ও গবেষণা,কিছুদিন অধ্যাপনা,তারপর সরকারী বৈজ্ঞানিক দপ্তরে কার্যকালে পৃথিবীর কয়েকটি দেশেও কাজ করার সৌভাগ্য হয়েছে।
পঞ্চাশটিরও বেশি প্রবন্ধ নামী বৈজ্ঞানিক পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসে (ইন্দোর) আমন্ত্রিত প্রবন্ধ পাঠ করার গৌরবও ভাগ্যে ঘটেছে। বিগত দেড় বছর করোনার প্রকোপে ছাপাখানা বন্ধ থাকার কারণে অনেক ই-ম্যাগাজিনে বিজ্ঞান বিষয়ক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে ও হচ্ছে।
দিল্লি থেকে প্রকাশিত বহুল জনপ্রিয় ই-ম্যাগাজিন, “তাৎক্ষণিক”এর ‘জানা-অজানা’ কলমে এখন পর্যন্ত প্রায় ৩০ টি জনপ্রিয়-বিজ্ঞান বিষয়ক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। সম্প্রতি “দেশ” ওয়েব-সাইটে একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে এবং বিশেষ প্রশংসিত হয়েছে।